Saturday 26 February 2022

রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ… পশ্চিমা নেতৃত্বের বিশ্ব ব্যবস্থা ধ্বসে পড়েছে

২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২২

যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন রাশিয়াকে অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিলেও পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেন সরকারকে রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী প্রেরণ না করে আন্তর্জাতিক আইনকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয়নি; যা বন্ধু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাশিয়া নিশ্চয়ই ভুল করেছে; কিন্তু তার পিছনে সবচাইতে বড় ইন্ধন যুগিয়েছে আফগানিস্তান পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। রাশিয়াকে চীনের সমর্থন বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে; অর্থাৎ ধ্বসে পড়েছে পশ্চিমা নেতৃত্বের বিশ্বব্যবস্থা।

 
প্রায় দু’লক্ষ রুশ সেনা যখন ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে, তখন অনেকগুলি প্রশ্ন আলোচনায় আসছে। ইউক্রেনের যুদ্ধে পশ্চিমাদের জড়াবার সম্ভাবনা কতটুকু? ইউক্রেনে রাশিয়ার পরিকল্পনাটা আসলে কি? এই যুদ্ধে চীনের স্বার্থই বা কতটুকু? বিশ্বব্যাপী এই যুদ্ধের প্রভাবই বা কতটুকু হতে পারে? পশ্চিমারা যখন বলছে যে, নিরাপত্তার ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যাটাই সঠিক, তখন রাশিয়া এবং চীন ভিন্ন কথা বলছে। ২৪শে ফেব্রুয়ারি চীনা মুখপাত্র বলেন যে, মিডিয়াতে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’এর কথা বলা হচ্ছে। অথচ যখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান এবং ইরাকে ঢোকার জন্যে কারুর কাছ থেকে অনুমতি নেয়নি, তখন কেন এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়নি? তখন আন্তর্জাতিক আইন বা জাতিসংঘের অনুমতি কেন নেয়া হয়নি? চীনাদের এই কথাগুলি বুঝিয়ে দেয় যে, পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ আইনের শাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘সিবিএস নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, গত তিন দশকে কেউ ইউরোপে সংঘাতের কথা চিন্তা করেনি; যা এখন পরিবর্তিত হয়ে গেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন বলেছেন যে, ইউক্রেনকে কেউ সহায়তা দিতে আসলে মারাত্মক পরিণতি হবে, তখন এটা জেনে রাখা ভালো যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, তারা ইউক্রেনকে রক্ষায় সৈন্য মোতায়েন করবে না। পশ্চিমারা রাশিয়ার উপর যে অবরোধ দিতে চলেছে, তা ইরানের উপর দেয়া অবরোধের চাইতে কিছুটা কম; যদিও তা যেকোন ‘গ্রেট পাওয়ার’এর উপর দেয়া সর্বোচ্চ অবরোধ। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসকল অর্থনৈতিক অবরোধের কথা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সেগুলি বাস্তবায়ন ইউরোপের জন্যে খুবই কষ্টের হবে। জ্বালানি এবং কৃষিজ পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি আরও প্রকট হবে এবং এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপ আগামী এক বছরে তার জিডিপির কমপক্ষে ১ শতাংশ হারাতে পারে। অপরদিকে চীন রাশিয়ার উপর অবরোধের সমালোচনা করলেও তারা সেই অবরোধ এড়াতে চেষ্টা নাও করতে পারে।

মার্কিন কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘গ্যালাপ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, পুতিন হয়তোবা মনে করেছিলেন যে, হামলার ভয় দেখিয়ে তিনি পশ্চিমাদের কাছ থেকে তার দাবিগুলি আদায় করে নেবেন। বিশেষ করে জার্মানির ভিন্নমতকে তিনি হয়তো তার দাবি আদায়ের স্তম্ভ হিসেবে নিয়েছিলেন; সেটা হয়নি। ন্যাটোকে পূর্বদিকে আর বর্ধিত করা হবে না, সেটা লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়ার যে দাবি পুতিন করেছিলেন, সেটা যে যুক্তরাষ্ট্র মানবে না, সেটা পুতিন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন। এখন হামলা করে পুতিন কিছুই পেলেন না। ন্যাটোর পূর্বদিকের সীমানা সীমিত করার দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। ফ্রীডম্যান ইউক্রেন সমস্যায় চীনের স্বার্থকে তুলে ধরে বলেন যে, রাশিয়া এবং চীন একে অপরকে সামরিকভাবে কোন সহায়তা দিতে না পারলেও রাশিয়ার উপর অবরোধের মাঝে চীন হয়তো রাশিয়াকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু চীনের সাম্প্রতিক রিয়েল এস্টেট সেক্টরের সমস্যার পর তারা রাশিয়াকে কতটা আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছাকাছি দু’টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে বার্তা দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র দু’টা শক্তিকে একত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ‘রবার্ট স্ট্রাউস হুপে চেয়ার’ রবার্ট ডি ক্যাপলান ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, ইউক্রেন নিয়ে যুদ্ধ হলেও মূল ইস্যু হলো পশ্চিমাদের একাত্মতা; যেখানে জার্মানি হলো ইউরোপের মাঝে প্রধান সমস্যা। ইউক্রেনে ভীষণভাবে আটকে গেলেও ন্যাটোর মাঝে যেকোন ধরনের ভাঙ্গন ধরাতে পারাটা পুতিনের জন্যে বিজয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর পশ্চিমাদের কোন অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ছিল না। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলস্বরূপ রাশিয়া এবং চীন পশ্চিমাদের কাছে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এছাড়াও ইউক্রেনের মতোই পূর্ব এশিয়ায় রয়েছে তাইওয়ান ইস্যু। যদি কখনও এটা বোঝা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে পারবে না বা বাঁচাবে না, তাহলে জাপান থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সকল মার্কিন বন্ধু দেশ চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তিনি মনে করছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে ভেতর থেকে ভেঙ্গে গিয়েছিল, রাশিয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই হতে পারে। তথাপি এর অনেকটাই নির্ভর করছে পশ্চিমা দেশগুলি, রাশিয়া এবং চীন কিভাবে তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। স্বল্প মেয়াদে অনেক কিছুই নির্ভর করবে ন্যাটো কতদিন তার এই মুহুর্তের একাত্মতাকে ধরে রাখতে পারবে, সেটার উপর। ক্যাপলান মনে করছেন যে, সামনের দিনগুলিতে বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ইউরেশিয়াকে নিয়ে প্রতিযোগিতা আরও গভীর হবে। এর অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা এবং চীনা স্বার্থের দ্বন্দ্ব হতে পারে। ইরান এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে থাকতে পারে; কারণ ইরান একইসাথে যেমন মধ্য এশিয়ায় ঢোকার পথ, তেমনি তা ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত।

সামরিক হামলার ভয় দেখিয়ে দাবি আদায়ের রুশ প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে ইউক্রেনে সীমিত পরিসরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা ছাড়া পুতিনের কাছে আর কোন উপায়ই ছিল না। তবে ইউরোপের অনৈক্য লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। জার্মানি যেখানে রাশিয়াকে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে চায়, ফ্রান্স সেখানে চাইছে ইউরোপের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে। উল্টোদিকে ব্রিটেন চাইছে রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্বকে জিইয়ে রাখতে। পোল্যান্ড যেখানে রাশিয়াকে হুমকি মনে করে, সেখানে বুলগেরিয়া থেকে হাঙ্গেরি পর্যন্ত বলকানের দেশগুলি অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক নয়। ন্যাটো সদস্য তুরস্কও ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন রাশিয়াকে অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিলেও পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেন সরকারকে রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী প্রেরণ না করে আন্তর্জাতিক আইনকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয়নি; যা বন্ধু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাশিয়া নিশ্চয়ই ভুল করেছে; কিন্তু তার পিছনে সবচাইতে বড় ইন্ধন যুগিয়েছে আফগানিস্তান পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। রাশিয়াকে চীনের সমর্থন বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে; অর্থাৎ ধ্বসে পড়েছে পশ্চিমা নেতৃত্বের বিশ্বব্যবস্থা।

7 comments:

  1. এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছাকাছি দু’টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে বার্তা দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র দু’টা শক্তিকে একত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। - এই বার্তা কি আপনি একাই খুঁজে পেয়েছেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দুঃখিত, আমি মনে করেছিলাম জর্জ ফ্রীডম্যানের কথাগুলি আপনিও শুনেছেন। উনার কথাগুলি বাংলায় ছিল না অবশ্য।

      https://news.gallup.com/podcast/390227/george-friedman-ukraine-russia-wanted-crisis.aspx

      Delete
  2. অর্থনৈতিক সিস্টেম ভেঙে পড়লে কি রাজনৈতিক সিস্টেম ধসে পড়বে?

    রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি ডলার ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইতি ঘটাবে? ফলে কি পশ্চিমা লিবরাল ডেমোক্রেটিক সিস্টেমের ধংসে সাহায্য করবে?

    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এখানে দেখতে হবে যে, কোনটা আগে - রাজনৈতিক ব্যবস্থা, নাকি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

      ব্রিটেন সারা দুনিয়াতে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগে সে দুনিয়াতে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেবার পরেই সে তার পুঁজিবাদী আদর্শকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের কাছ থেকে দুনিয়ার নেতৃত্ব নেবার চেষ্টা করতে থাকার সময় প্রথমেই রাজনৈতিক নেতৃত্বখানা নিয়েছিল।

      যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির কাছে যখন সকলেই নতি স্বীকার করছিল, তখনই যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালের ব্রেটন উডস কনফারেন্সের মাধ্যমে দুনিয়ার মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সমঝোতা থেকে বের হয়ে যায়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ডলারের মূল্য নির্ধারিত হতো স্বর্ণের সাথে সমন্বয় করে। কিন্তু ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র গায়ের জোর দেখিয়ে চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় এবং ঘোষণা দেয় যে, মার্কিন ডলারের মূল্য এখন থেকে আর স্বর্ণের উপর নির্ভরশীল থাকবে না। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র নিজের ইচ্ছেমতো ডলার ছাপাবে; এখানে কারুর বাধা দেয়ার শক্তি নেই। মোটকথা যুক্তরাষ্ট্র গায়ের জোরে বিশ্বব্যাপী ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং ইচ্ছামতো ডলার ছাপাবার কর্মকান্ডকে জায়েজ করিয়ে নিয়েছিল পেশীর জোরে; বা রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে।

      কাজেই এখানে পরিষ্কার যে, ডলারকে সারা বিশ্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তির কারণেই। আর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তি কমতে শুরু করলে একসময় ডলারের দাপটও কমতে শুরু করবে।

      আর এই মুহুর্তে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমেই পশ্চিমা পুঁজিবাদ বা মার্কিন ডলারের পতন হবে কিনা, সেটা নিশ্চিতভাবে কেউই বলতে পারবেন না। তবে এটা বলা যায় যে, রাশিয়া এবং চীন মার্কিন ডলার এবং মার্কিন নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সিস্টেমের একটা বিকল্প বের করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তথাপি এটা বলা যাবে না যে, রাশিয়ার কারণে মার্কিন ডলারের পতন ঘটবে। কারণ চীন মার্কিন ডলারে সবচাইতে বেশি বিনিয়োগ করেছে। মার্কিন ডলারের পতন ঘটলে চীনারাই সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই চীনারাই মার্কিন ডলারকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে।

      Delete
    2. লিবারাল বিশ্বব্যবস্থা ঊনিশ শতক থেকেই ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। এর পিছনে মূল কারণ ছিল পুঁজিবাদের খারাপ দিকগুলির ব্যাপকভাবে সামনে চলে আসা, এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার আবির্ভাব। পুঁজিবাদকে বাঁচিয়ে রাখতেই লিবারাল চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল। লিবারালরা ক্রীতদাস প্রথা বিলীন, অস্ত্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, সমাজের দরিদ্রদের জন্যে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি, কর্পোরেটদের উপর কর বৃদ্ধি, মাবনবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, যৌন স্বাধীনতা, ইত্যাদি চিন্তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বহু মানুষ সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত না হয়ে লিবারাল ক্যাপিটালিস্ট হয়ে গিয়েছিল। এতে সমাজতন্ত্র ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা না পেয়ে দরিদ্র এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।

      লিবারাল বিশ্বব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচাইতে বেশি শক্তিশালী হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যুদ্ধ করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবু ঘরাইব প্রিজন, গুয়ান্তানামো বে প্রিজনে মারাত্মক মানবাধিকার লংঘন, আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়াতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ, ইউরোপে মুসলিম শরণার্থীদের ঢুকতে বাধা দেয়া, চীনের সাথে বাণিজ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মুক্ত বাণিজ্য চিন্তাকে নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনকে এড়িয়ে গিয়ে চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতকে বন্ধু হিসেবে পাশে চেয়েছে। অর্থাৎ লিবারাল বিশ্বব্যবস্থা এখন নামমাত্র টিকে আছে।

      Delete
    3. তাহলে এটা বলা যাবে কি যদি এই যুদ্ধের মাধ্যমে ডলার ব্যবস্থার পতন হয়,তাহলে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা লিবরাল ব্যবস্থার পতন হবে? নাকি চিন এক্ষেত্রে লিবরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সহজে পতন হতে দেবে না। যেহেতু ওদের স্বার্থ জড়িত৷
      ধন্যবাদ।

      Delete
    4. পশ্চিমা লিবারাল আদর্শের বিশ্বব্যবস্থা সমস্যায় পড়েছে অনেক আগ থেকেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে, চীনের কারণেই এটা হয়েছে। চীন এই সমস্যার একটা অংশ। পশ্চিমারাই চীনকে তৈরি করেছে তাদের নিজেদের সুবিধার্থে; যাতে চীনের বিশাল জনশক্তিকে শিল্পপণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু আইফোনের প্রযুক্তি যে তৈরি করতে পারবে, সে যে ক্ষেপণাস্ত্রের গাইড্যান্স সিস্টেমও তৈরি করতে পারবে, সেটা পশ্চিমারা ভুলে গেছে। এটাই হলো তাদের আদর্শিক স্খলন। তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অনেক প্রযুক্তিই চীনকে সরবরাহ করে দিয়েছে। এরপর পশ্চিমারা নিজেরাই অর্থের বিনিময়ে গোপনে চীনের কাছে অনেক প্রযুক্তি বিক্রি করে দিয়েছে; যা ব্যবহার করে চীনারা এখন ঈজিস ডেস্ট্রয়ার এবং স্টেলথ ফাইটার বিমান তৈরি করে ফেলেছে। এই অস্ত্রগুলি সমুদ্রে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছে। সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ হলো ক্যাপিটালিস্ট রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল স্তম্ভ।

      এর উপর পশ্চিমাদের নিজস্ব আদর্শিক অধঃপতন তো রয়েছেই; যেগুলি ব্যক্তির ইস্যু নয়, বরং আদর্শের ইস্যু। বস্তুবাদিতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, বিষন্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, নিজেকে রাষ্ট্রের উপর প্রাধান্য দেয়া, ইত্যাদি সমস্যায় পশ্চিমা দেশগুলি এখন জর্জরিত। এই সমস্যাগুলি ডলারের চাইতে অনেক বড় সমস্যা। ডলারকে রক্ষা করার অনেক পদ্ধতিই হয়তো বের করা যেতে পারে; কিন্তু এই সমস্যাগুলির কোন সমাধানই পশ্চিমারা বের করতে সক্ষম হয়নি। তাদের অধঃপতন এগুলির কারণেই হবে; ডলারের কারণে নয়। এগুলির কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল; ডলারের কারণে নয়। একটা দুর্বল যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে সবল রাখার জন্যে যথেষ্ট নয়। যারা ডলার ছাপাবে, তারাই যদি সমস্যায় পতিত হয়, তাহলে ডলার নিয়ে এতো মাথাব্যাথা করে কি লাভ? চীন তো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আদর্শিক স্খলন থামাতে পারবে না।

      Delete