Wednesday 23 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ… তুরস্ক আসলে কার পক্ষে?

২৩শে মার্চ ২০২২

২৮শে ফেব্রুয়ারি তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্ক ১৯৩৬ সালের মনট্রিউ কনভেনশন মেনে চলছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন কাভুসোগলুকে মনট্রিউ কনভেনশনকে সমুন্নত রাখার জন্যে এবং এর সপক্ষে বক্তব্য দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কনভেনশন মেনে রুশ যুদ্ধজাহাজের জন্যে বসফরাস বন্ধ করে দেয়া ছাড়াও ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় মধ্যস্ততা করার আগে তুরস্ক মার্কিন সমর্থন এবং উপদেশ নিয়েছে; যদিওবা মাত্র কয়েক মাস আগেই রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ ক্রয়ের ‘অপরাধে’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর অবরোধ দিয়েছে।

২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করার দিনই ইউক্রেন তুরস্ককে বসফরাস এবং দার্দানেলিস প্রণালি রুশ জাহাজের জন্যে বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান জানায়। এর চারদিন পর ২৮শে ফেব্রুয়ারি তুরস্ক বসফরাস এবং দার্দানেলিস প্রণালিকে সকল রাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু সাংবাদিকদের বলেন যে, তুরস্ক ১৯৩৬ সালের মনট্রিউ কনভেনশন মেনে চলছে। সেই অনুযায়ী তুরস্ক যখন কোন যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিচ্ছে, তখন তার অধিকার রয়েছে যুদ্ধে অংশ নেয়া পক্ষগুলির যুদ্ধজাহাজকে বসফরাস এবং দার্দানেলিস প্রণালি পার হতে বাধা দেয়ার। যদি কোন যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণ সাগরে নিজের ঘাঁটিতে ফেরত যায়, তবে সেক্ষেত্রে তুরস্ক কোন বাধা দেবে না। কাভুসোগলু বলেন যে, এর আগে রুশ সরকার তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল যে, তুরস্ক মনট্রিউ কনভেনশন মেনে চলবে কিনা। তুরস্কের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল যে, তুরস্ক সেই কনভেনশন কঠোরভাবে মেনে চলবে। ‘নেভাল নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুর্কি সরকার কনভেনশনের ‘আর্টিকেল ১৯’ অনুযায়ী যুদ্ধরত পক্ষগুলিকে যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে নিষেধ করেছে। তবে সকল দেশের যুদ্ধজাহাজ যাওয়া বন্ধ করার জন্যে তারা খুব সম্ভবতঃ ‘আর্টিকেল ২১’এর সরণাপন্ন হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে যে, তুরস্ক যদি যুদ্ধের হুমকির মাঝে পড়ে, তাহলে তারা বসফরাস বন্ধ করে দিতে পারে। তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের পরপরই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন কাভুসোগলুর সাথে ফোনালাপ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, ব্লিংকেন কাভুসোগলুকে মনট্রিউ কনভেনশনকে সমুন্নত রাখার জন্যে এবং এর সপক্ষে বক্তব্য দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ইউক্রেনকে সহায়তা দানের জন্যেও ব্লিংকেন তুরস্ককে ধন্যবাদ দেন। ইউক্রেনে রুশ সামরিক হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই তুরস্কের গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। যুদ্ধের আগে তুরস্কের সাথে যাদের দ্বন্দ্ব চলছিল, তাদের অনেকেই তুরস্ক সফর করেছেন; যা দেখিয়ে দেয় যে, যুদ্ধ অত্র অঞ্চলের বাস্তবতাকে কতটা পরিবর্তন করেছে।

৪ঠা মার্চ মার্কিন উপপররাষ্ট্র সচিব ওয়েন্ডি শেরমান তুরস্ক সফর করে তুর্কি প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনএর সাথে বৈঠক করেন। ‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বৈঠকে উভয় পক্ষ যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার জন্যে যৌথ প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করতে একমত হয়। কালিন বলেন যে, তুরস্ক যুদ্ধরত দুই দেশের মাঝে মধ্যস্ততা করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়াও দু’পক্ষ সিরিয়া, লিবিয়া এবং আফগানিস্তানের শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনা করে; এবং ইস্রাইলের সাথে তুরস্কের ও তুরস্কের সাথে আর্মেনিয়ার সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারেও আশা ব্যক্ত করা হয়।

 
৪ঠা মার্চ মার্কিন উপপররাষ্ট্র সচিব ওয়েন্ডি শেরমান তুরস্ক সফর করে তুর্কি প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনএর সাথে বৈঠক করেন। এটা পরিষ্কার যে মাত্র কিছুদিন আগেও যখন উসমানি খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর তুর্কিদের আবেগের বাস্তবতাকে পুঁজি করে এরদোগান তুরস্ককে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধের বাস্তবতাকে পুঁজি করে তিনি তার অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে লুকাবার চেষ্টা করে ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রাইল, জার্মানি, ন্যাটো এবং গ্রিস সেই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ব্যবহার করেই তুরুস্কের সাথে আলোচনা করছে।


ইউক্রেন ও রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় মধ্যস্ততা করার প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাবার পর ১০ই মার্চ তুরস্কের আনতালিয়াতে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রথম বৈঠকের পর তুরস্কের গুরুত্ব যেন আরও একধাপ বেড়ে যায়! ১১ই মার্চ ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টলটেনবার্গ তুরস্ক সফর করে আসেন। ন্যাটোর এক সংবাদ বার্তায় বলা হচ্ছে যে, স্টলটেনবার্গ সফরকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে সাক্ষাৎ করে ন্যাটোর মাঝে তুরস্কের বিশেষ ভূমিকার প্রশংসা করেন। একইসাথে তিনি ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় তুরস্কের মধ্যস্ততাকে এবং ইউক্রেনকে তুরস্কের সহায়তা দেয়াকে স্বাগত জানান।

স্টলটেনবার্গের তুরস্ক সফরের দুই দিনের মাথায় ১৩ই মার্চ আঙ্কারা যান গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস। তুর্কি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর ইকনমিকস এন্ড ফরেন পলিসি স্টাডিজ’এর প্রেসিডেন্ট সিনান উলগেন ‘এএফপি’কে বলছেন যে, উভয় দেশের জন্যেই এই মুহুর্তে নিজেদের মাঝে নতুন করে কোন দ্বন্দ্ব একেবারেই অনভিপ্রেত। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর ফেলো আসলি আয়দিনতাসবাস বলছেন যে, উভয় দেশের নেতৃত্বই বুঝতে পারছে যে, তাদের আশেপাশের বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস আগেও ইউরোপিয় নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ এরকম ছিল না।

যদি মিতসোতাকিসের আঙ্কারা সফর নতুন কিছু ঠেকে, তাহলে আরও অবাক হবার কথা এর পরদিন ১৪ই মার্চ জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের তুরস্ক সফরের খবরে। এক যৌথ সংবাদ সন্মেলনে শোলজ বলেন যে, দুই দেশ ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ্বের ব্যাপারে একমত এবং উভয় দেশই ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। তিনি বসফরাস প্রণালি সকল যুদ্ধজাহাজের জন্যে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে তুরস্ককে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তবে একইসাথে তিনি তুরস্কের সাথে দ্বন্দ্বের দিকগুলি, যেমন, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং জার্মান নাগরিকদের বিরুদ্ধে তুরস্কের বিভিন্ন পদক্ষেপের ব্যাপারেও কথা বলেন। অপরদিকে এরদোগান মনে করিয়ে দেন যে, রাশিয়ার সাথে তুরস্কের বর্তমানে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে, যা তারা ৫০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

 
৯ই মার্চ তুরস্ক সফরে আসেন ইস্রাইলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান সংবাদ সন্মেলনে এই সফরকে ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্র বলে আখ্যা দেন। তিনি বিশেষ করে দুই দেশের মাঝে জ্বালানির ব্যাপারে সমঝোতার উপর গুরুত্ব দেন।


ইউক্রেন এবং রাশিয়ার প্রথম আলোচনার আগের দিন ৯ই মার্চ তুরস্ক সফরে আসেন ইস্রাইলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান সংবাদ সন্মেলনে এই সফরকে ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্র বলে আখ্যা দেন। তিনি বিশেষ করে দুই দেশের মাঝে জ্বালানির ব্যাপারে সমঝোতার উপর গুরুত্ব দেন। সেই লক্ষ্যে সামনের দিনগুলিতে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ইস্রাইল সফর করবেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনে দুই দেশের গুরুত্ব দেয়ার উপর জোর দেন। এছাড়াও তিনি দুই দেশের মাঝে মতভেদের বিষয়গুলিকে পারস্পরিক সন্মান ও খোলা মনের মাধ্যমে সুরাহা করার আশা ব্যক্ত করেন।

‘আল মনিটর’ বলছে যে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এহেন নীতি পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্তগুলির পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক দুর্দশা, যা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এছাড়াও ২০২৩ সালে রয়েছে তুরস্কের নির্বাচন, যেখানে ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’ যথেষ্ট শক্তিশালী বিরোধী গ্রুপের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক ইউক্রেন যুদ্ধে এমন একটা অবস্থানে আছে, যা কৌশলগতভাবে সমর্থন করা গেলেও নৈতিক দিক থেকে অসমর্থনযোগ্য। লেখায় আরও বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে চাইছে, যাতে প্রথমতঃ তুরস্কের গ্যাস সরবরাহ যেন ব্যাহত না হয়, এবং দ্বিতীয়তঃ সিরিয়াকে স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে যেন রাশিয়াকে পাশে পাওয়া যায়। আবার ইউক্রেনকেও তুরস্ক সমর্থন দিয়ে গেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোন সরবরাহ করেছে, যেগুলি রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু সাফল্যও পেয়েছে। এই কথাগুলিতে এটা পরিষ্কার যে, তুরস্ক কোন নীতি নয়, বরং স্বার্থকে বুঝে বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একারণেই ১৯৩৬ সালের মনট্রিউ কনভেনশন মেনে রুশ যুদ্ধজাহাজের জন্যে বসফরাস বন্ধ করে দেয়া ছাড়াও ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় মধ্যস্ততা করার আগে মার্কিন সমর্থন এবং উপদেশ নিয়েছে; যদিওবা মাত্র কয়েক মাস আগেই রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ ক্রয়ের ‘অপরাধে’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর অবরোধ দিয়েছে। এটা পরিষ্কার যে মাত্র কিছুদিন আগেও যখন উসমানি খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর তুর্কিদের আবেগের বাস্তবতাকে পুঁজি করে এরদোগান তুরস্ককে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধের বাস্তবতাকে পুঁজি করে তিনি তার অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে লুকাবার চেষ্টা করে ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রাইল, জার্মানি, ন্যাটো এবং গ্রিস সেই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ব্যবহার করেই তুরুস্কের সাথে আলোচনা করছে।

No comments:

Post a Comment