Tuesday 29 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ… রুশ কৌশলে বড় পরিবর্তন?

২৯শে মার্চ ২০২২

কিয়েভের বাইরে বুচায় রুশ সামরিক গাড়ির ধ্বংসস্তূপ। রাশিয়া এখন বাধ্য হচ্ছে একটা করে টার্গেট নিয়ে এগুতে। বর্তমানে দক্ষিণের মারিউপোল শহর এখন তাদের ফোকাস; এরপর তারা খুব সম্ভবতঃ খারকিভের দিকে মনোযোগ দেবে। এরপর তারা হয়তো নীপার নদী বরাপর উত্তর দিকে ধাবিত হয়ে খারকিভের সাথে মিলিত হতে চেষ্টা করবে, যাতে করে ডনবাসে ইউক্রেনের সকল বাহিনীকে ঘিরে ফেলা যায়। যদি রুশরা খারসন শহর ধরে রাখতে পারে, তাহলে তারা হয়তো একটা যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে পারে, যার মাঝে ডনবাস থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত যোগাযোগের নিয়ন্ত্রণ রুশদের হাতে থাকবে।

একমাস যুদ্ধের পর গত ২৫শে মার্চ রুশ নেতৃত্ব বলছে যে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তাদের সামরিক মিশনের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। ঘোষণায় বলা হচ্ছে যে, রুশরা এখন পূর্বের ডনবাস অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করবে। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর রাফায়েল লস ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইউক্রেনের সেনারা রুশ সাপ্লাই লাইনগুলিকে চাপের মাঝে রেখেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা রুশ বাহিনীকে ঘিরে ফেলার অবস্থায়ও নিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় রুশরা হয়তো তাদের সামরিক অপারেশনকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করছে; যাতে করে তাদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। তবে তারা যদি ডনবাসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তারা অবশ্যই কিয়েভের উপর নতুন করে ফোকাস দেবে। কৌশল পরিবর্তনের ঘোষণা হয়তো স্বল্প মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্যে সন্মান বাঁচাবার চেষ্টা হতে পারে। তবে তিনি গত দু’বছরে ইউক্রেন নিয়ে যেধরনের মন্তব্য করেছেন, তাতে এটা নিশ্চিত যে, ইউক্রেন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। পুতিন বলেছেন যে, ইউক্রেনিয়ানদের পরিচয় রুশ পরিচয় থেকে আলাদা নয়। এমতাবস্থায় পুতিন নিশ্চিতভাবে দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনের উপর চাপ অব্যাহত রাখবেন।

‘ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন’এর প্রফেসর এগলায়া স্নেতকভ বলছেন যে, গত একমাসের যুদ্ধে মনে হচ্ছে যে, রুশরা প্রায় তিন বা চারটা ভিন্ন স্ট্র্যাটেজি বা বড় পরিসরে কৌশল নিয়ে এগিয়েছে। এই কৌশলগুলি হয়তো এখন সফল হচ্ছে না বলেই পূর্ব ইউক্রেনের সাথে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করাটা এখন তাদের জন্যে মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যোগাযোগের লজিস্টিক্যাল দিকটা হয়তো রুশদের জন্যে ব্যবস্থাপনা করা অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ হতে পারে। এই মুহুর্তে রুশ জনগণও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্লাদিমির পুতিনের উপর দোষারোপ না করে পশ্চিমাদের উপর দোষারোপ করছে। কাজেই জনমত হয়তো এখনও পুতিনের সাথেই রয়েছে, যদিও রুশ শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে একটা বোধ এসেছে যে, প্রাথমিকভাবে যে লক্ষ্য নিয়ে তারা এগিয়েছে, সেটা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে হয়তো জনগণ প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু সেটা যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান নয়। আর এই মুহুর্তে পুতিনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার মতো কেউ রয়েছে বলেও মনে হয় না; যদিও পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে সময় লাগে না।

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল ডেভিড পেট্রেয়াস কানাডার টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিবিসি’কে বলছেন যে, রাশিয়ার সামরিক অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল রাজধানী কিয়েভ দখল করা, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং একটা রুশ সমর্থিত সরকারকে তার স্থলাভিষিক্ত করা। তবে এখন পর্যন্ত রুশরা কিয়েভের বাইরে অবস্থান করছে, খারকিভকেও ঘিরে ফেলতে পারেনি, যদিও তারা দক্ষিণে কিছু সফলতা পেয়েছে; যেমন মারুউপোলকে ঘিরে ফেলেছে, ডনবাসের নিয়ন্ত্রণের কাজেও তারা বেশকিছু এগিয়েছে। দক্ষিণের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেবার পর তারা হয়তো সৈন্য সরিয়ে উত্তর এবং পূর্বের এলাকাগুলিতে মোতায়েন করতে পারে। কমপক্ষে ৭ জন জেনারেল পদের সেনা কর্মকর্তার নিহত হবার খবর পাওয়া যায়; তাদের ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার সেনাও হয়তো নিহত হয়েছে। রাশিয়ার নিজস্ব অর্থনীতিও মারাত্মক সমস্যায় পতিত। এমতাবস্থায় তারা ইউক্রেনের সাথে কোন একটা সমঝোতার মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ করতে চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা হয়তো বলতে পারে যে, ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সাথে ডনবাস অঞ্চলের সরাসরি স্থলপথ নিশ্চিত হয়ে গেলেই অপারেশনের লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যাবে। তারা হয়তো ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর ওডেসা দখলের চেষ্টাটাও বাদ দিতে পারে।

 

ডাচ অনলাইন সামরিক ম্যাগাজিন ‘ওরিক্স’এর স্টাইন মিতজার এবং তার দল ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে হিসেব করেছেন যে, যুদ্ধে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমপক্ষে কত হতে পারে। রুশরা এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২ হাজার সামরিক গাড়ি হারিয়েছে; যার মাঝে প্রায় ১ হাজার ধ্বংস হলেও প্রায় ৭’শ ৩৫টা ইউক্রেনিয়ানরা দখল করেছে। এই গাড়ির মাঝে ৩’শ ১৫টা ছিল ট্যাংক; যেগুলির মাঝে ১’শ ৪০টা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; আর বাকি ১’শ ৭৫টা ইউক্রেনিয়ানরা দখল করেছে, অথবা রুশরা ফেলে চলে গেছে। এছাড়াও রুশরা কমপক্ষে ৬’শ ১৫টা অন্যান্য সাঁজোয়া যান; ৬১টা ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি; ৬৩টা ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; ৬৪টা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; ১’শ ৪৪টা আর্টিলারি ও রকেট; ১৭টা যুদ্ধবিমান; ৩৫টা হেলিকপ্টার; ১৬টা মনুষ্যবিহীন ড্রোন; ৩টা যুদ্ধজাহাজ; আরও ৭’শ ৬টা সামরিক গাড়ি; ইত্যাদি আরও অনেক কিছু হারিয়েছে। অপরদিকে ইউক্রেন হারিয়েছে কমপক্ষে ৫’শ ৭৪টা গাড়ি; যার মাঝে রয়েছে ৭৯টা ট্যাংক; ১’শ ৪৯টা অন্যান্য সাঁজোয়া যান; ৫১টা ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; ৪৭টা আর্টিলারি ও রকেট; ২১টা বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র; ১২টা যুদ্ধবিমান; ১টা হেলিকপ্টার; ৯টা মনুষ্যবিহীন ড্রোন; ১৩টা যুদ্ধজাহাজ; ২’শ ১৮টা অন্যান্য সামরিক গাড়ি; ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র সিনিয়র ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, রাশিয়া এখন বাধ্য হচ্ছে একটা করে টার্গেট নিয়ে এগুতে। বর্তমানে দক্ষিণের মারিউপোল শহর এখন তাদের ফোকাস; এরপর তারা খুব সম্ভবতঃ খারকিভের দিকে মনোযোগ দেবে। এরপর তারা হয়তো নীপার নদী বরাপর উত্তর দিকে ধাবিত হয়ে খারকিভের সাথে মিলিত হতে চেষ্টা করবে, যাতে করে ডনবাসে ইউক্রেনের সকল বাহিনীকে ঘিরে ফেলা যায়। যদি রুশরা খারসন শহর ধরে রাখতে পারে, তাহলে তারা হয়তো একটা যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে পারে, যার মাঝে ডনবাস থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত যোগাযোগের নিয়ন্ত্রণ রুশদের হাতে থাকবে। তবে নীপার নদী বরাবর কোন অপারেশনই সহজ হবে না; ইউক্রেনিয়ানরা এটাকে প্রবলভাবে প্রতিহত করতে চাইবে। আপাততঃ তারা অন্যদিকে গুরুত্ব দিলেও ভবিষ্যতে তারা রাজধানী কিয়েভের দিকে মনোযোগ দেবে। যারা এই মুহুর্তে যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষপাতি, তারা হয়তো কিয়েভের নেতৃত্বকে দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার কাছে কিছু সুবিধা ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক থাকবে। অপরদিকে ইউক্রেনের নেতৃত্ব মনে করবে যে, রুশদের আপাততঃ লক্ষ্য ছোট করে আনার অর্থ হলো নিজেদের বৃহত্তর উচ্চাকাংক্ষাগুলিকে ভবিষ্যতের জন্যে জিইয়ে রাখা। তবে প্রশ্ন হলো যে, পশ্চিমারা এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে কতটা একমত হতে পারবে।

No comments:

Post a Comment