Tuesday 26 June 2018

আর্জেন্টিনা কি পারবে?

২৬শে জুন ২০১৮
আর্জেন্টিনা কি পারবে? কি পারবে? বাংলাদেশের মানুষকে এই প্রশ্ন করলে তাদের বেশিরভাগের চিন্তায় থাকবে – আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে কি না। যারা এধরনের চিন্তা করছেন, তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে আর্জেন্টিনা একটা দেশের নাম; ফুটবল টিমের নাম নয়।


কি পারবে আর্জেন্টিনা?


আর্জেন্টিনা কি পারবে? কি পারবে? বাংলাদেশের মানুষকে এই প্রশ্ন করলে তাদের বেশিরভাগের চিন্তায় থাকবে – আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে কি না। যারা এধরনের চিন্তা করছেন, তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে আর্জেন্টিনা একটা দেশের নাম; ফুটবল টিমের নাম নয়। আর্জেন্টিনার ভূমি রয়েছে প্রায় ২৮ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ-এর মতো, যা বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১৯ গুণ বড়। তবে জনসংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লাখের মতো, যা বাংলাদেশের প্রায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। এর অর্থনীতি আকার প্রায় ৬২৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্বিগুণেরও বেশি। ১৪,০০০ ডলারের মাথাপিছু আয় থাকার পরেও দেশের অর্থনীতি এতটা খারাপ অবস্থায় রয়েছে যে, তাদের সামরিক বাহিনী টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে গিয়েছে। ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্রের শিকার, এবং ৬ দশমিক ২ শতাংশ সবচাইতে খারাপ দারিদ্রের মাঝে রয়েছে। ২০১০ সালে ৫৩০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি থেকে ২০১৬-তে মাত্র ৫৪৬ বিলিয়নে পৌঁছায়। এর মাঝে দুই বছর অর্থনৈতি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক।

তাহলে আর্জেন্টিনার এই ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি নিয়ে কি পারার কথা হচ্ছে? আর্জেন্টিনার উপকূলের অদূরে রয়েছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, যা আর্জেন্টিনার নয়; ব্রিটেনের। ব্যাপারটা বোঝানোর জন্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভারতের অধীনে, তাহলে সেটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে কেমন লাগতে পারে? ঠিক তেমনটাই আবেগ রয়েছে আর্জেন্টিনার। কিন্তু আর্জেন্টিনা কি পারবে ব্রিটেনের কাছ থেকে এই দ্বীপকে বাগিয়ে নিতে?
  
 
অক্টোবর ২০১৬। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আয়ার্সে উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ পতাকা পোড়াচ্ছে। ব্রিটিশরা ফকল্যান্ডে সামরিক মহড়া দেবে - এই ঘোষণার প্রতিবাদ এটি। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা ঠিকই ফকল্যন্ড দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে তারা ধরে রাখতে পারবে না, তা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল।


ফুটবল বিশ্বকাপ নয়, ফকল্যান্ড নিজের দখলে নিতে পারবে আর্জেন্টিনা?

১৯৮২ সাল। আর্জেন্টিনা তার উপকূলে ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নিয়েছে। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশিক রাজত্বের বেশিরভাগটাই ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হারিয়েছে। তবুও ব্রিটিশ ইজ্জত বলে কথা। ব্রিটিশরা স্বল্প সময়ের মাঝে তাদের যতটুকু সামরিক সক্ষমতা রয়েছে, ততটাই কাজে লাগিয়ে দ্বীপগুলি পুনর্দখল করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু প্রায় ১৪ হাজার কিঃমিঃ দূরে পুরো আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আসা ব্রিটিশদের সক্ষমতা ছিল সীমিত। তাই তারা তাদের সকল ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগে উদ্যোগী হয়। এর মাঝে একটা ছিল ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটিশদের জন্যে একটা বন্ধু খোঁজা, যে কিনা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সহায়তা দিয়ে ব্রিটিশদের সক্ষমতায় ফাঁকফোকড়গুলিকে বন্ধ করতে পারবে। আরেকটি উদ্যোগ ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে নিজের পক্ষে কাজ করানো।

বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা মূলতঃ মার্কিনীদের তৈরি। তারা ব্রিটিশদের ব্যবস্থাগুলিকে নিজেদের মতো করে তৈরি করিয়ে নিয়েছে। দুর্বল দেশগুলি অস্ত্রের জন্যে অন্যের উপরে নির্ভরশীল থাকবে– এটা অবশ্য ব্রিটিশ সময়ের চিন্তা হলেও মার্কিনীরা এটা অব্যহত রেখেছে। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় আর্জেন্টিনার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ছিল ফ্রান্সের তৈরি ‘এক্সোসেট’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিমান থেকে লঞ্চ করা ভার্সনেরই আর্জেন্টিনা সবচাইতে বড় ব্যবহার করেছিল। আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনীর ছোঁড়া দু’টি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে দু’টি ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস হয়। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ রাষ্ট্রের কিছু লোক চাইছিলো আর্জেন্টিনা পর্যন্ত এই এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের চালান বন্ধ করে দিতে। এই চালানগুলি আসতো বিমানে। চার্লস হিউসডন নামের এক ব্রিটিশ এয়ার ফ্রেইটের ব্যবসা করতেন, যিনি ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ এটর্নি জেনারেল মাইকেল হাভার্স-এর বন্ধু। হিউসডন এয়ার ফ্রেইটের আদি-নক্ষত্র জানতেন। তিনি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের চালান বন্ধ করার একটা পরিকল্পনা এটর্নি জেনারেলকে বলার পরে সেটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার পর্যন্ত যায়।
 
 
আর্জেন্টিনার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ছিল ফ্রান্সে নির্মিত 'এক্সোসেট' ক্ষেপণস্ত্র। ফ্রান্সের সরবরাহকৃত 'সুপার এটেনডার্ড' বিমান থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়। মাত্র ৫টা ক্ষেপণাস্ত্র ব্রিটিশদের মাঝে যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল, দুই ডজন কি করতে পারতো, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ফ্রান্স ৫টার বাইরে একটাও সরবরাহ করেনি। এমনকি ৫টার মাঝে প্রথমে কাজ করেছে মাত্র ২টা; বাকি ৩টা কাজ করাতে অনেক কষ্ট করতে (সময় ক্ষেপণ) হয়েছে ফরাসিদের। 


ফ্রান্স কি ব্রিটেনের পক্ষে ছিল, নাকি আর্জেন্টিনার?

পরিকল্পনাটা ছিল এরকম। নিজেদের অনুগত একটা কোম্পানি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র শিপমেন্ট করার জন্যে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করবে। এটা এমন একটা সময় যখন নিজেদের “নিরপেক্ষ” দেখাতে ফরাসিরা নিজেদের বিমানে আর্জেন্টিনায় এই ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাবে না। লোডমাস্টারের যোগসাজসে বিমানটার কোর্স পরিবর্তন করে ট্রানজিটে বার্মুদা বা অন্য কোন স্থানে নামানো হবে। থ্যাচার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া মিতেরাঁর কাছে এক গোপন চিঠি লিখে দক্ষিণ আমেরিকায় এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের চালান দেরি করানোর অনুরোধ করেন। ফ্রান্স যাতে পেরুর কাছে এই অস্ত্র বিক্রি না করে, সেটার অনুরোধ করেন থ্যাচার। কারণ পেরু থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র নিশ্চিতভাবেই আর্জেন্টিনায় যাবে। যুদ্ধের আগে ফ্রান্স আর্জেন্টিনার কাছে ৫টি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছিল, যা কেউ তেমন গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। যখন ১৯৮২-এর মে মাসে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আর্জেন্টিনা ২টি ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস করে ফেলে, তখন সকলে নড়েচড়ে বসে। ফ্রান্স ঘোষণা দেয় যে তারা আর্জেন্টিনার কাছে কোন অস্ত্র বিক্রি করবে না। একইসাথে ফ্রান্স ব্রিটেনের কাছে তথ্য দেয় যে তারা আর্জেন্টিনার কাছে কি কি ধরনের অস্ত্র বিক্রি করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ফরাসি সামরিক স্থাপনাগুলিকেও ফ্রান্স ব্রিটেনের ব্যবহার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়। তবে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় কিছু লোকজন মনেপ্রাণে ব্রিটেনের বিপক্ষে ছিলেন।

ফরাসি সরকারের অজানা ছিল না যে একটা ফরাসি সরকারি কোম্পানির (৫১ শতাংশ শেয়ার) একটা টেকনিক্যাল দল আর্জেন্টিনাকে সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের পুরো সময় আর্জেন্টিনাতে অবস্থান করে। দলটি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু সমস্যা দূর করে অস্ত্রটিকে বিমান থেকে লঞ্চ করার জন্যে কর্মক্ষম করে তোলে। ফরাসি সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য এগুলি জানতো না বলে দাবি করে। তবে মাত্র ৫টি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আর্জেন্টিনা যে কিছু করতে পারবে না, তা ব্রিটিশরা জানতো। তাই তাদের মূল ফোকাস ছিল কিভাবে আর্জেন্টিনাকে নতুন করে এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র পাওয়া থেকে দূরে রাখা যায়। ফরাসিরা যে দুই পক্ষকে খুশি রাখছে, সেটা ব্রিটিশরা জানতো; তারপরেও ফরাসিদের সাথে তাদের নতুন করে কোন শত্রুতা হয়নি। ফরাসিরা থ্যাচারের সাথে দরকষাকষিতে এগিয়ে ছিল। তারা আর্জেন্টিনার কাছে নতুন করে আর এক্সোসেট বিক্রি করেনি। আবার পুরোনো এক্সোসেটগুলিকে কর্মক্ষম করার মাধ্যমে তারা আর্জেন্টিনারও পক্ষেও থাকার ভান করেছে। তারা আর্জেন্টিনাকে এমন কোন সহায়তা দেয়া থেকে বিরত থাকে, যা কিনা যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে ফেলতে পারতো। আরও দুই ডজন এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র হয়তো রয়াল নেভির বারোটা বাজাতে পারতো। কিন্তু সেটা মিতেরাঁ-থ্যাচারের দরকষাকষিতেই ব্যবহৃত হয়েছিল কেবল।
 
  
ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর 'নিমরড' গোয়েন্দা বিমান। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় এরকম একটা বিমান আর্জেন্টিনার প্রতিবেশী দেশ চিলির প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ স্যান ফেলিক্সে মোতায়েন করা হয়। চিলির সহায়তায় ব্রিটিশরা আগে থেকেই আর্জেন্টিনার বিমান হামলার ওয়ার্নিং পেয়ে যেতো। চিলির এই সহায়তা ছাড়া ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ জেতা কঠিন হয়ে যেতো। 


দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রিটেনের শক্ত ঘাঁটি – চিলি

পুরো যুদ্ধের সময় চিলি ছিল ব্রিটেনের খুব কাছে বন্ধু। তবে সন্মুখে চিলি ল্যাটিন আমেরিকার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার কথা বলে ব্রিটেন-আর্জেন্টিনার যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকে। যুদ্ধের শুরুতেই সিডনি এডওয়ার্ডস নামের ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের এক অফিসারকে গোপনে চিলিতে প্রেরণ করা হয়। তিনি চিলির বিমান বাহিনীর প্রধান জেনারেল ফার্নান্দো মাত্থেই-এর সাথে সাক্ষাৎ করে সহায়তা চান। চিলির প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের কাছাকাছি স্যান ফেলিক্স দ্বীপে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের একটা ‘নিমরড’ গোয়েন্দা বিমান মোতায়েন করা হয়। সিডনি এডওয়ার্ডস-এর গোয়েন্দা রিপোর্টগুলি ছিল অত্যন্ত গোপনীয় এবং খুব কম লোকই জানতো এর ব্যাপারে। এই রিপোর্টগুলি পরিচিত ছিল “সিডগ্রামস” নামে। এই বার্তাগুলিতে আর্জেন্টিনার দক্ষিণের উশুয়াইয়া, রিও গালেগোস, রিও গ্রান্দে এবং কমোডোরো রিভাদাভিয়া বিমান ঘাঁটিগুলিতে আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনীর কর্মকান্ড রিপোর্ট করা হতো। বিশেষতঃ এই ঘাঁটিগুলি থেকে যুদ্ধবিমান উড়লেই সেই ওয়ার্নিং চলে যেতো ফকল্যান্ডস-এর অদূরে অবস্থান নেয়া রয়াল নেভির কাছে। রয়াল নেভির বিমান প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিল হাতে গোনা ২৮টি সী হ্যারিয়ার বিমানের হাতে। বিপক্ষে ছিল আর্জেন্টিনার বিমান এবং নৌবাহিনীর মোটামুটি ১১৫টির মতো ফাইটার বিমান। সংখ্যায় অল্প হওয়ায় রয়াল নেভির পক্ষে সম্ভব ছিল না যে সারাক্ষণ এই বিমানগুলি আকাশে টহল দেবে। কারণ আকাশে উড়লে সেগুলি নামার পরে মেইনটান্সের কারণে কয়েকটা বিমান রেডি থাকবে না। ঐ সময়ে আর্জেন্টিনার বিমান হামলা হলে সবগুলি বিমান ইন্টারসেপ্ট করার লক্ষ্যে উড়তে পারবে না। অর্থাৎ তাদের ফ্লিটকে রক্ষা করা সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। তাই ব্রিটিশরা পরিকল্পনা করে কি করে আগেভাগে আর্জেন্টিনার বিমান হামলার খবর পাওয়া যায়। তখন সে অনুযায়ী হ্যারিয়ার বিমান জাহাজ থেকে ওড়ানো যাবে। আর্জেন্টিনার উপকূল থেকে ফকল্যান্ডের দূরত্ব কমপক্ষে ৩৫০ কিঃমিঃ। অর্থাৎ একটা ফাইটার বিমানের ফকল্যান্ডের কাছাকাছি ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে হামলা করতে কমপক্ষে ২০ মিনিট সময় লাগবে। আগেভাগে জানতে পারলে এটা বিমান প্রতিরক্ষাকে প্রস্তুত করার জন্যে মোটামুটি যথেষ্ট। চিলি ব্রিটিশদেরকে এই সহায়তাটাই করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস (এসএএস) কমান্ডোদের অবতরণ করিয়ে আর্জেন্টিনার দক্ষিণের রিও গ্রান্দে বিমান ঘাঁটিতে অবস্থিত এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র বহণকারীসুপার এটেনডার্ড ফাইটার বিমান ধ্বংস করার জন্যে অত্যন্ত সাহসী একটা মিশন পরিকল্পনা করে ব্রিটিশরা। মিশনটির আগে তথ্য সংগ্রহ করার একটা অপারেশন চালানো হয়, যা সফল হয়নি। কমান্ডোরাসীমান্ত অতিক্রম করে চিলিতে ঢুকে যায় এবং তখন চিলি সরকার তা আলাদা কিছু নয় বলে ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। চিলির নৌবাহিনীর জন্যে ব্রিটিশ নৌবাহিনী থেকে কেনা রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার ‘টাইডপুল’ চিলি সরকার – কিছুদিন পরে ডেলিভারি দিলেও চলবে, এই হিসেবে – ব্রিটিশদের আরও কিছুদিন ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। জাহাজটি ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্যবহার করে ব্রিটিশ রয়াল নেভি।


 

কৌশলগত ম্যাজেলান প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর্জেন্টিনার সাথে চিলির রয়েছে দ্বন্দ্ব। ব্রিটেন চিলির পক্ষে থাকায় চিলি এই দ্বন্দ্বে শক্তি পায়। ম্যাজেলান প্রণালী থেকে পূর্বেই রয়েছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, যা ব্রিটিশদের হাতে রয়েছে। ম্যাজেলানের আরও দক্ষিণের ড্রেইক প্যাসেজ দিয়েও জাহাজ যেতে পারে। তবে সেখানে আবহাওয়া আরও খারাপ থাকে।


ফকল্যান্ড আর্জেন্টিনার হাতে গেলে কি হতো?

চিলি এবং ফ্রান্সের সাথে ফকল্যন্ড যুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনের সম্পর্ক কিছু আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসে। প্রথমতঃ দক্ষিণ আমেরিকাতে ব্রিটিশ প্রভাব ধরে রাখতে চিলি ব্রিটেনকে সহায়তা করছে। চিলি ১৮৭৯-৮৩ সালে সংঘটিত ‘ওয়ার অব দ্যা প্যাসিফিক’এ পেরু এবং বলিভিয়ার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে চিলি তার ব্রিটেনে নির্মিত অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলি ব্যবহার করে পেরুর পুরো নৌবাহিনীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। উভয় দেশ একত্রে চিলির কাছে সামরিক পরাজয় বরণ করে এবং এর ফলশ্রুতিতে চিলি বলিভিয়া এবং পেরুর কাছ থেকে আতাকামা মরুভূমির বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয়। ঐ অঞ্চল ছিল বলিভিয়ার জন্যে সমুদ্রে পৌঁছানোর একমাত্র উপায়। একইসাথে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খণিজ সম্পদ ছিল, যা পুরোটাই চিলির হস্তগত হয়। বলিভিয়া এবং পেরুর পক্ষ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেসময় থেকেই পেরুকে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র তার বলয়ে নিয়ে আসতে থাকে। পেরুকে অস্ত্রসস্ত্র সরবরাহ করে ব্রিটিশদের বন্ধু চিলির বিরুদ্ধে ব্যালান্স তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র।
 

বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপথগুলির মাঝে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণের সমুদ্রপথের বাণিজ্যিক গুরুত্ব তেমন একটা নেই। কিন্তু এর কারণ কিন্তু মধ্য আমেরিকার পানামা খাল, যা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। ইউরোপিয়রা সর্বদাই আটলান্টিক হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের যাবার জন্যে পানামা খালের একটা বিকল্প রাখতে চাইবে।


চিলির সাথে ইউরোপের যোগাযোগ ছিল দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণের ম্যাজেলান প্রণালী এবং এরও দক্ষিণের ড্রেইক প্যাসেজ হয়ে, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল মুলতঃ চিলি এবং কিছুটা আর্জেন্টিনার হাতে। আর ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ হলো সেই সমুদ্রপথের পূর্ব প্রান্তে। অন্যদিকে পেরুর সাথে ইউরোপের যোগাযোগ বর্তমানে পানামা খাল-এর মাধ্যমে, যা ১৯১৪ সালের আগ পর্যন্ত ছিল না। ১৮৭৯-৮৩-এর যুদ্ধে পেরুর জন্যে অস্ত্র পানামা যোজকের ভূমি পার হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে এসে জাহাজে উঠতো। পানামা খাল তৈরি হবার আগ পর্যন্ত পেরুকে অনেক ক্ষেত্রেই চিলির নিয়ন্ত্রণে থাকা ম্যাজেলান প্রণালি ব্যবহার করতে হতো। ইউরোপ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে সরাসরি যোগাযোগের পথ হলো পানামা খাল হয়ে, যা যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ম্যাজেলান প্রণালি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে না। বরং সেখানে চিলির সহায়তায় ফকল্যান্ড থেকে ব্রিটিশরা ম্যাজেলানকে নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড নিজেদের দখলে রাখতে পারলে ব্রিটশরাও প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছাতে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত পানামা খালের উপরে নির্ভরশীল হয়ে যেতো। আর পানামা খালে কোন ধরনের সমস্যা হলে সকল জাহাজকে ম্যাজেলান প্রণালি হয়ে যাতায়াত করতে হবে। সেই ঘটনা ঘটার আগে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই ম্যাজেলানের গুরুত্ব থাকবে না; এটাই স্বাভাবিক।

ম্যাজেলান প্রণালির সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর্জেন্টিনার সাথে চিলির বিবাদ রয়েছে। আর্জেন্টিনা যদি ফকল্যান্ড দখলে রাখতে পারতো, তাহলে চিলিও পরবর্তীতে টার্গেট হতো আর্জেন্টিনার; যার সুবাদে ম্যাজেলান প্রণালির নিয়ন্ত্রণ চিলির কাছ থেকে আর্জেন্টিনার কাছে চলে যেতো। আবার ফকল্যান্ড আর্জেন্টিনার হওয়া মানে মানচিত্রের পরিবর্তন, যা কিনা বলিভিয়া এবং পেরুকে ১৮৭৯-৮৩-এর প্যাসিফিক যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিতো এবং চিলিকে চাপের মুখে ফেলতো। প্যাসিফিকের যুদ্ধে আর্জেন্টিনাও গোপনে বলিভিয়া এবং পেরুর সাথে কথা বলেছিলো। তবে চিলি ব্যাপক সামরিক সাফল্য পাওয়ায় আর্জেন্টিনা পিছু হটে যায়। ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টিনার পক্ষে গেলে আতাকামা নিয়ে বিবাদে আর্জেন্টিনা নিশ্চিতভাবেই পেরু এবং বলিভিয়ার পক্ষ নিতো। আবার এসব সংঘাত চলার সময় আর্জেন্টিনাকে অনেক শক্তিশালী এবং আগ্রাসী হতে দেখে এই এলাকার সবচাইতে বড় দেশ ব্রাজিলও বসে থাকতো না। ব্রিটেন কোনভাবেই এভাবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা সমুদ্রপথকে ছেড়ে দিতো না।
  
নভেম্বর ২০১৫। কৌশলগত ম্যাজেলান প্রণালী অতিক্রম করছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'জর্জ ওয়াশিংটন। ফকল্যান্ড এবং চিলির মাধ্যমে এই প্রণালীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ব্রিটেন। আর ফ্রান্স আর্জেন্টিনাকে 'কোনরকম' সহায়তার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ফকল্যান্ড ব্রিটেনের হাতে থাকলে ফ্রান্স এর বিরোধিতা করবে না। 

 

অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রশান্ত মহাসাগরে বেশকিছু উপনিবেশ রয়েছে। ফরাসীরাও ফকল্যন্ড ব্রিটিশদের হাতে থাকায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে যে পানামা খাল ছাড়াও ফ্রান্স থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছার আরেকটা পথ ইউরোপীয়দের হাতেই রইলো। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু ম্যাজেলান প্রণালিকে ভুলে যায়নি। মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলি তেমন কোন কারণ ছাড়াই এই প্রণালি দিয়ে আটলান্টিক এবং প্যাসিফিকের মাঝে যাতায়াত করে; যদিও পানামা খাল দিয়ে যাওয়াটা তাদের জন্যে হাজার গুণ সহজ হতো। ২০১৭-এর ডিসেম্বরেও মার্কিন উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ওয়াসপ’ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্যাসিফিকে যেতে পানামা খাল ব্যবহার না করে ম্যাজেলান প্রণালি ব্যবহার করে। ২০১৫-এর অক্টোবর-নভেম্বরে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ (CVN 73) তার পুরো ব্যাটলগ্রুপ-সহ ম্যাজেলান প্রণালি পার হয়। ২০০৪ সালে আরেক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রোনাল্ড রেগ্যান’ (CVN 76) এই প্রণালি পার হয়। ২০১৪-এর অগাস্টে উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘আমেরিকা’ (LHA 6) ম্যাজেলান প্রণালি পারি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র একা নয়, ২০১৩ সালের অক্টোবরে চীনা নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধজাহাজের একটা গ্রুপ ম্যাজেলান প্রণালি পারি দেয়। ম্যাজেলানের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বোঝাটা খুব কঠিন নয়।



১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফূটবল। আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড। ম্যারাডোনার 'হ্যান্ড অব গড' গোল। আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডের সাথে জিতেছিল ফুটবলে; কিন্তু ফকল্যান্ড যুদ্ধে নয়! আর্জেন্টিনা বাকি বিশ্বের কাছে একটা ফুটবল দল। ভূরাজনীতিতে আর্জেন্টিনার অংশগ্রহণ ততটুকুই, যতটুকু সুপারপাওয়ার তাকে করতে দেবে। ফুটবলের কাপ আর্জেন্টিনার হাতে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু ভূরাজনীতির কাপ দেয়া যাবে না! আর্জেন্টিনা আসলে কি পারবে, এই প্রশ্নটা একটা ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন। আর্জেন্টিনাকে দিয়ে সেটাই পারানো হবে, যেটা সুপারপাওয়ার চায়। বিশ্বের আমজনতার কাছে তাই আর্জেন্টিনা একটা ফুটবল দলই থাকবে। একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র ভূরাজনীতি বুঝবে – এটাই স্বাভাবিক। ফুটবল খেলা নয়, বরং ভূরাজনীতির খেলায় কাকে কি ধরনের চরিত্র দেয়া হয়েছে, সেটা বোঝাটা ভূরাজনীতি বোঝার অংশ।


আর্জেন্টিনা পশ্চিমা আদর্শিক শক্তিগুলির হাতে বন্দী। যে তাকে অস্ত্র সরবরাহ করবে, সে-ও তাকে এমনভাবে সরবরাহ করবে, যেন সে যুদ্ধে জিততে না পারে। যে সুপারপাওয়ার তাকে সহায়তা করবে, সে তাকে ততটাই সহায়তা করবে, যতটা করলে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ শক্তির কাছ থেকে যথেষ্ট দরকষাকষির সুযোগ পাওয়া যায়। আর্জেন্টিনাকে কেউ জেতাবে না; ব্যবহার করবে। ভূরাজনীতিতে আর্জেন্টিনার অংশগ্রহণ ততটুকুই, যতটুকু সুপারপাওয়ার তাকে করতে দেবে। ফুটবলের কাপ আর্জেন্টিনার হাতে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু ভূরাজনীতির কাপ দেয়া যাবে না! আর্জেন্টিনা আসলে কি পারবে, এই প্রশ্নটা একটা ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন। আর্জেন্টিনাকে দিয়ে সেটাই পারানো হবে, যেটা সুপারপাওয়ার চায়। বিশ্বের আমজনতার কাছে তাই আর্জেন্টিনা একটা ফুটবল দলই থাকবে। একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র ভূরাজনীতি বুঝবে – এটাই স্বাভাবিক। ফুটবল খেলা নয়, বরং ভূরাজনীতির খেলায় কাকে কি ধরনের চরিত্র দেয়া হয়েছে, সেটা বোঝাটা ভূরাজনীতি বোঝার অংশ।

1 comment: