Thursday, 6 July 2017

যুদ্ধজাহাজের সংজ্ঞা কি? (পর্ব ১ - মাঝ সমুদ্রের সেনাবাহিনী)

০৬ জুলাই ২০১৭


মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ (MV Bunga Mas Lima)‘বুঙ্গা মাস লিমা’। জাহাজটি ছিল একটি ‘বেসামরিক’ কনটেইনারবাহী জাহাজ। ২০১১ সালে জাহাজটি থেকে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা হেলিকপ্টার ও দ্রুতগামী ছোট বোটের মাধ্যমে জলদস্যু-আক্রান্ত জাহাজে উঠে সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। যা নিয়ে আলোচনা হয়নি তা হলো, এরকম একটি জাহাজের সক্ষমতা রয়েছে শত্রুর নিয়ন্ত্রিত একটি জাহাজের দখল নেয়ার 'যুদ্ধকৌশল' বাস্তবায়ন করার। কাজেই এটি একটি সক্ষম যুদ্ধ জাহাজই বটে!

সোমালিয়ার উপকূলে... 


২২শে জানুয়ারী ২০১১। সোমালিয়ার উপকূলে মালয়েশিয়ার একটি কেমিক্যালবাহী জাহাজ ‘বুঙ্গা লরেল’ সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জাহাজটির নিরাপত্তা দিচ্ছিল কাছাকাছি থাকা মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ (MV Bunga Mas Lima)‘বুঙ্গা মাস লিমা’। আসলে ‘বুঙ্গা মাস লিমা’ জাহাজাটি ছিল একটি ‘বেসামরিক’ কনটেইনারবাহী জাহাজ, যা কিনা ‘অপারেশন ফজর’ নামের মিশনে সোমালিয়ার উপকূলে টহল দিচ্ছিল। জাহাজটি মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহণ করছিল। এই সামরিক সদস্যদেরকে হেলিকপ্টার ও দ্রুতগামী ছোট বোটের মাধ্যমে জলদস্যু-আক্রান্ত জাহাজে ওঠার ব্যবস্থা করা হয়, এবং তারা জাহাজে উঠে জলদস্যুদের পরাজিত করে জাহাজ এবং ২৩ জন ক্রুকে উদ্ধার করে। ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ার সরকার জাহাজটিতে কিছু পরিবর্তন করে মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর কাজের জন্যে প্রস্তুত করে। ৯,০০০ টনের এবং ১৩৩ মিটার লম্বা এই জাহাজটির উপরে বড় দু’টি ক্রেন ছিল, যার একটি সরিয়ে দিয়ে সেখানে হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং স্পটসহ একটি হেলিকপ্টার হ্যাঙ্গার তৈরি করা হয়, ডেকের উপর কয়েকটি ছোট বোট পরিবহণ করার ব্যবস্থা করা হয়, এবং স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের বহণ করার ব্যবস্থা করা হয়। ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিন বছর জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলে অপারেট করে। ২০১১ সালেই মিশরে আরব বসন্তের সময় সেদেশে থাকা মিশরীয় ছাত্রদেরকে এই জাহাজটি উদ্ধার করে। ২০১৪ সালে জাহাজটিকে মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্যের উপকূলে তেলের রিগগুলিকে রক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। সমুদ্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রক্ষা করার এই চিন্তাটি আরও জাহাজ কনভার্ট করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই জাহাজগুলিকে বলা হচ্ছে ‘Mobile Sea Base’। ‘টুন আজিজান’ নামের একটি কার্গো জাহাজকে পরিবর্তন করে ৯৯ জন মানুষের লম্বা সময়ের জন্যে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এই জাহাজটিও বুঙ্গা মাস লিমা জাহাজটির মতো নিরাপত্তা-বিষয়ক অপারেশন চালাতে সক্ষম হবে।

বেসামরিক জাহাজকে কিছু পরিবর্তন করে সামরিক কাজে ব্যবহার করার চিন্তাটা নতুন কিছু নয়। তবে যে ব্যাপারটা নিয়ে তেমন কথা হচ্ছে না তা হলো এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে সেনা মোতায়েন করে জাহাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া। এই কাজটিকে এতোটাই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে আলোচনা করা হচ্ছে যে, জাহাজ থেকে জাহাজে সেনা পাঠানোর চিন্তাটা কোথা থেকে এলো, সেটাই এখন আলোচনাতে নেই! অথচ এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কারণ এই আলোচনাতে আসা উচিত কোন কোন কাজ করলে একটা জাহাজকে যুদ্ধজাহাজ বলা হবে। এই আলোচনার শুরুতে যুদ্ধজাহাজের ইতিহাসের দিকে তাকালে আলোচনায় সুবিধা হতে পারে।

  
রোমানরা ছিল স্থলশক্তি; অন্যদিকে কার্থেজরা ছিল নৌশক্তি। কার্থেজদের শক্তিশালী নৌবহরকে মোকাবিলা করার জন্যে রোমানরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল বিপক্ষের জাহাজে অবতরণ (Boarding) করায়। রোমানরা প্রচুর সৈন্য বহণ করতো তাদের জাহাজে, যাতে তারা শত্রু জাহাজে উঠে পড়ে সেই জাহাজ দখল (Seizure) করে নিতে পারে।

রোমানদের সমুদ্রের সেনাবাহিনী… 

রোম আর কার্থেজের মাঝে প্রথম পুনিক যুদ্ধ হয় খ্রীষ্টপূর্ব ২৬৪ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ২৪১ পর্যন্ত। এই যুদ্ধে নৌ-সংঘাতের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। রোমানরা তখন পর্যন্ত ছিল স্থলশক্তি; অন্যদিকে কার্থেজরা ছিল নৌশক্তি। এর প্রধান কারণ ছিল – রোমানরা যেখানে তাদের স্থলসীমানা রক্ষা করতেই বেশি ব্যস্ত ছিল, কার্থেজরা ব্যস্ত ছিল তাদের নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কার্থেজরা ছিল ভূমধ্যসাগরের প্রধান ব্যবসায়ী; তাই নৌশক্তি তৈরি করাটা তাদের জন্যে স্বাভাবিক ছিল। কার্থেজদের শক্তিশালী নৌবহরকে মোকাবিলা করার জন্যে রোমানরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল বিপক্ষের জাহাজে অবতরণ (Boarding) করায়। রোমানরা প্রচুর সৈন্য বহণ করতো তাদের জাহাজে, যাতে তারা শত্রু জাহাজে উঠে পড়ে সেই জাহাজ দখল (Seizure) করে নিতে পারে। দখল করতে না পারলে সেই জাহাজটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে অচল করার চেষ্টা করতো তারা। আর যেহেতু রোমানরা স্থলযুদ্ধে ভালো ছিল, তাই তাদের সেনারা শত্রু জাহাজে উঠে দিয়ে জাহাজের উপরে একটা ছোটখাটো স্থলযুদ্ধই করে ফেলতেন। অর্থাৎ সমুদ্রে যুদ্ধ হলেও যুদ্ধের ধরণটা এসেছিল স্থলযুদ্ধ থেকে। এধরনের নৌযুদ্ধের চল ছিল বহুকাল। পালতোলা জাহাজে কামান বসানোর পরেও শত্রু জাহাজ দখল করা চলতো। পরবর্তীতে অর্থনৈতিক অবরোধ দেবার চিন্তা থেকে জাহাজ দখলের চিন্তাটা আরও শক্ত ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঠিক এই যুদ্ধের ধরণটাই বর্তমানকালে চলছে প্রতিনিয়ত, যদিও খুব কম লোকই এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেছে।

  
পারস্য উপসাগরে মহড়া দিচ্ছে মার্কিন কোস্ট গার্ডের সদস্যরা। ১৯৯০ সাল থেকে ইরাকের উপর অর্থনৈতিক অবরোধের ক্ষেত্রেও Visit, Board, Search & Seizure (VBSS) অপারেশন  অনুসরণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে শত্রুদেশের সাধারণ জনগণকে না খাইয়ে মারার যুদ্ধকৌশলখানা বহু প্রাচীন। অথচ ২১ শতকে এসে অর্থনৈতিক অবরোধ দিতে ব্যবহৃত ছোট বোটগুলিকে যুদ্ধজাহাজের ক্যাটাগরিতেই ফেলা হচ্ছে না।


২১ শতকে শত্রুজাহাজ দখল… 

Visit, Board, Search & Seizure (VBSS) অপারেশনগুলি এখন খুব সাধারণ একটি ব্যাপার। একটি জাহাজ থেকে সৈন্যরা (প্রধানতঃ স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা) অন্য একটি জাহাজের কাছাকাছি যাচ্ছে, উঠে চড়ে বসছে, খোঁজাখুঁজি করছে, বা পুরো জাহাজই দখল করে নিচ্ছে। উপরে মালয়েশিয়ার যে দু’টি জাহাজের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, সেগুলির বেশিরভাগ ক্রু কিন্তু বেসামরিক। অর্থাৎ একটি “বেসামরিক” জাহাজেরও সক্ষমতা থাকতে পারে সৈন্য মোতায়েন করে একটি শত্রু জাহাজ দখল করে নেয়া। আবার গভীর সমুদ্রে VBSS মিশনগুলি চলবে উপরে যেভাবে মালয়েশিয়ার মিশনের কথা বলা হয়েছে সেভাবেই; তবে উপকূলের কাছাকাছি বা নদী-বদ্বীপ অঞ্চলে বড় জাহাজের স্থানে থাকবে ছোট বোট। ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে মার্কিনীরা প্রচুর ছোট ছোট বোট তৈরি করেছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গন বন্দরকে চালু রাখতে এবং বিদ্রোহীদের ধ্বংস করতে। মার্কিন কোস্ট গার্ড অংশ নিয়েছিল ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সাল থেকে ইরাকের উপর অর্থনৈতিক অবরোধের ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে শত্রুদেশের সাধারণ জনগণকে না খাইয়ে মারার যুদ্ধকৌশলখানা বহু প্রাচীন। অথচ ২১ শতকে এসে অর্থনৈতিক অবরোধ দিতে ব্যবহৃত এই ছোট বোটগুলিকে যুদ্ধজাহাজের ক্যাটাগরিতেই ফেলা হচ্ছে না। আবার সোমালিয়ার উপকূলে মালয়েশিয়ার ব্যবহৃত জাহাজকেও অনেকেই যুদ্ধজাহাজ বলবেন না; বলবেন অক্সিলারি জাহাজ; যদিও সেই জাহাজের সক্ষমতা আছে বিপক্ষের আরেকটি জাহাজ দখল করে নেবার। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে শত্রুর একটি কার্গো জাহাজ দখল করা, আর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ দখল করাটা এক নয়। কাজেই কোন জাহাজ কতো বড় জাহাজ দখল করতে পারবে, সেটা এখানকার আলোচনার বিষয়বস্তুই নয়।


সমুদ্রে সেনাবাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে বিপক্ষের নৌজাহাজ দখল করে নেয়াটা হাজারো বছরের পুরোনো যুদ্ধকৌশল। বড় যুদ্ধের মাঝে এধরনের কর্মকান্ডকে যুদ্ধের অংশ হিসেবে ধরা হলেও বড় যুদ্ধ ছাড়া এগুলিকে সকলে এতোটাই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়েছে যে জাহাজ দখল করাকে যুদ্ধের কর্মকান্ড বলাটা অনেকের কাছেই পাগলের প্রলাপ ঠেকবে। অথচ হাজারো বছরের ইতিহাসে এটা ছিল যুদ্ধের কারণ, এবং যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুদ্ধাস্ত্র ঘোষিত না হয়েও বহু জাহাজ যুদ্ধাস্ত্ররূপে কাজ করছে আজ; কারণ তাদের কর্মকান্ডগুলিকে এখন মানুষ আর যুদ্ধ বলে মনে করার ক্ষমতা হারিয়েছে। একটি চলমান যুদ্ধকে মেনে নেয়া এবং এর বিরুদ্ধাচরণ না করার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ এটি। যুদ্ধের সংজ্ঞাই তো পাল্টে ফেলা হয়েছে। যে চায় সর্বদা যুদ্ধ করবে, কিন্তু কেউ তাকে কিছু বলবে না, সে সর্বদাই চাইবে যুদ্ধের সংজ্ঞা যেন মানুষ তার কাছ থেকেই নেয়। তাতে মানুষ প্রতিনিয়ত যুদ্ধের মাঝে থেকেই মনে করবে শান্তির সময় পার করছে। পরিশেষে বলা যায় যে, যুদ্ধের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে বলেই যুদ্ধাস্ত্র এবং যুদ্ধজাহাজের সংজ্ঞা মানুষের কাছে আজ এতো কঠিন ঠেকছে। ১০ হাজার টনের এজিস রাডার ও ভার্টিক্যাল লঞ্চ মিসাইল সজ্জিত না হলে নাকি যুদ্ধজাহাজই হয় না! এরকম জাহাজ বানাবার সক্ষমতা তো শুধু অল্প কয়েকটি “ধনী” দেশের রয়েছে। তাহলে বাকিরা কি যুদ্ধজাহাজই রাখতে পারবে না? যুদ্ধ করার সক্ষমতা এবং “অধিকার” কি শুধু ঐ ধনী দেশগুলিরই? বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞা পরিত্যাগেই মাঝেই রয়েছে যুদ্ধজাহাজের আসল সংজ্ঞা। মাঝ সমুদ্রে সেনা পাঠিয়ে শত্রুজাহাজ দখল করে নেবার যুদ্ধকৌশল বাস্তবায়নকারী জাহাজ হলো একধরনের যুদ্ধজাহাজ। সমুদ্রপথে টহল দিয়ে শত্রুদেশের জনগণের উপরে অর্থনৈতিক অবরোধের যুদ্ধকৌশল বাস্তবায়নকারী জাহাজগুলিও যুদ্ধজাহাজ।      

No comments:

Post a Comment