Wednesday 22 March 2023

মার্কিন ব্যাংক দেউলিয়া… পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ?

২২শে মার্চ ২০২৩

'সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক' বা 'এসভিবি'র বাইরে ডিপোজিট তুলে ফেলার জন্যে মানুষের লাইন। তথা পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থা চলছে ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ বা জোড়াতালি দিয়ে। সকল বিশ্লেষকেরাই বলছেন যে, মার্কিন অর্থনীতি ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার উপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যাচ্ছে। কারণ সরকারি বন্ড বা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখাও এখন অনিরাপদ ঠেকছে।


‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’এর দেউলিয়া হওয়াটা ছিল ২০০৮ সালের পর থেকে সবচাইতে বড় ব্যাংক দেউলিয়ার ঘটনা। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক দেউলিয়ার ঘটনা। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাংকটার দেউলিয়ার হবার ঘটনাগুলির বর্ণনা দিয়ে বলা হয় যে, শেয়ার বাজারে ব্যাংকটার শেয়ারের মূল্য এক সপ্তাহে ৮০ শতাংশ পড়ে যায়; যার ৬০ শতাংশই পড়ে ১০ই মার্চ, বা মাত্র একদিনে! তবে সমস্যা হলো, ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ বা ‘এসভিবি’ যা করছিল, তা ব্যাংকিং সেক্টরের বহু ব্যাংকই করছিল; আর তা হলো, মানুষের কাছ থেকে ডিপোজিট হিসেবে অর্থ জোগাড় করে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা। এই বিনিয়োগের মাঝে ছিল মার্কিন সরকারের ঋণপত্র না বন্ড এবং বিভিন্ন প্রকারের ঋণ। ব্যাংকটা বিপদে পড়ে যায় যখন মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ বা ‘ফেড’ ব্যাপকহারে সুদের হার বাড়াতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ‘এসভিবি’ ক্ষতির মুখে পড়তে থাকে এবং এই খবরগুলি যখন ছড়াতে থাকে, তখন ব্যাংকের বিপুলসংখ্যক গ্রাহক একসাথে তাদের ডিপোজিট তুলতে থাকেন। এরপরই মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘এসভিবি’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। মাত্র ৩৬ ঘন্টার মাঝে ‘এসভিবি’ দেউলিয়া হয়ে যায়।

‘এসভিবি’র দেউলিয়া হবার মূল কারণ কি?

সম্পদের হিসেবে ‘এসভিবি’ ছিল মার্কিন ব্যাংকিং সেক্টরের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে চালু হওয়া ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ মূলতঃ মার্কিন প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলিকে সহায়তা দেয়ার জন্যে স্থাপিত হয়েছিল। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানিগুলির প্রায় অর্ধেকই ‘এসভিবি’র করা বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল ছিল। ‘এসভিবি’র অনেক বিনিয়োগই ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোম্পানিতে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক ধ্বসের পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ‘ডড-ফ্র্যাঙ্ক এক্ট’ নামের আইনে স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলিকে আরও কঠোর আইন মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। তবে ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান সরকারের সময়ে এর কঠোরতা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়। তবে মার্কিন কংগ্রেসে এই আইন পাস করতে গিয়ে আইনপ্রণেতাদের মাঝে যথেষ্ট দ্বন্দ্ব হয়। এর মাধ্যমে বড় ব্যাংকগুলির নিয়ম কঠোর থাকলেও অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাংকগুলি, যেগুলির সম্পদের পরিমাণ আড়াই’শ বিলিয়ন ডলারের কম, সেগুলির ক্ষেত্রে নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে ছোট আকারের ব্যাংক চালু করতে অনুপ্রেরণা দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

২০২০ সালে করোনা লকডাউনের মাঝে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির ডিপোজিট বেড়ে যায়। ‘এসভিবি’র ডিপোজিট দুই বছরে তিনগুণ হয়ে ১’শ ৮৯ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়। এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদী সরকারি ঋণপত্র বা বন্ডে। এই বিনিয়োগগুলিকে সবসময়ই নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করা হয়। সরকারি বন্ডে ১’শ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করার পর ২০২২ সালের মার্চ থেকে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ সুদের হার বাড়াতে থাকে। এর ফলে সরকারি বন্ডের মূল্য ক্রয়মূল্যের চাইতে কমে যেতে থাকে। ‘এসভিবি’র কাছে থাকা সরকারি বন্ডের মূল্য ১৭ বিলিয়ন ডলার কমে যায়। ‘এসভিবি’র মতো সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা অন্যান্য ব্যাংকগুলিও ব্যাপক হারে ক্ষতির সন্মুখীন হতে থাকে। গত ৮ই মার্চ একটা প্রতিবেদনে ‘এসভিবি’ উল্লেখ করে যে, তারা সরকারি বন্ড বিক্রি করতে গিয়ে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছে। এই খবরে ‘এসভিবি’র শেয়ারের মূল্য পড়ে যেতে থাকে। একইসাথে বিপুল সংখ্যক বড় আকারের বিনিয়োগকারী ‘এসভিবি’ থেকে তাদের ডিপোজিট তুলে নিতে থাকে। ১০ই মার্চ ‘এসভিবি’র শেয়ারমূল্যে ধ্বস নামে এবং একদিনে ৪২ বিলিয়ন ডলারের ডিপোজিট তুলে ফেলে গ্রাহকরা। সেদিনই সরকার ‘এসভিবি’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

তবে এর বাইরেও কিছু বড় কারণ রয়েছে; বিশেষ করে বড় পরিসরের কারণগুলিকে বাদ দেয়া যাবে না। নিউইয়র্কের ‘ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর রিচার্ড স্কুয়ির ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, প্রথম বড় কারণ হলো, গত কয়েক বছরের মাঝে, বিশেষ করে করোনাভাইরাসের লকডাউনের সময় মার্কিন ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ ব্যাপকহারে ডলার ছাপিয়েছে। এই ডলার ছাপাবার উদ্দেশ্য ছিল করোনার খারাপ অবস্থা থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে উদ্ধার করা এবং সরকারের বাজেটের ঘাটতি পূরণ করা। এর ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, তেমনি মুদ্রাস্ফীতি রোধে ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ সুদের হার বাড়াতে শুরু করে; যার ফলে সরকারি বন্ডের মূল্য পড়ে যায়। বাজারে প্রচুর ডলারের ছড়াছড়ির এই পরিস্থিতিতে কিছু ব্যাংক বেশ ভালো অবস্থানে চলে যায়; আর কিছু বেশ খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে। দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকগুলি বিশেষ কিছু সেক্টরের উপর নির্ভরশীল ছিল, যেখানে সরকারি বন্ডের মূল্য পড়ে যাবার প্রভাবটা ছিল অনেক বেশি। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন যে, মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিরাপদ; তিনি ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তার সরকার বলছে যে, করদাতাদের অর্থে দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকগুলিকে তারা বাঁচাবে না। কিন্তু মাল্টিমিলিয়ন ডলারের কর্পোরেট ডিপোজিটগুলিকে রক্ষা করে সরকার প্রকারান্তরে করদাতাদের অর্থ ব্যয় করে এই কোম্পানিগুলিকে বাঁচাচ্ছে।


ব্যাংক দেউলিয়া হলে মার্কিন সরকার কি সেটাকে বাঁচাবে?

প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সদস্য গ্যারি কোহন ‘সিএনএন’কে ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, একটা ব্যাংক মানুষের কাছ থেকে ডিপোজিট আকারে যত অর্থ যোগাড় করে, তার বেশিরভাগটাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে এবং খুব স্বল্প পরিমাণ অর্থই নিজের কাছে রেখে দেয়। সাধারণতঃ একটা ব্যাংকের মোট ডিপোজিটের খুব কম অংশই একদিনে ব্যাংক থেকে বের হয়। কিন্তু যখন একটা ব্যাংক সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সকলেই একসাথে সেই ব্যাংক থেকে তাদের ডিপোজিট তুলে ফেলতে চায়। কিন্তু একটা ব্যাংক কখনোই এতটা ডিপোজিট ফেরত দেবার অবস্থায় থাকে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকে রাখা ডিপোজিটের আড়াই লক্ষ ডলার পর্যন্ত ইন্সুরেন্সের আওতায় থাকে। অর্থাৎ একজন ডিপোজিটর ব্যাংকে যত অর্থই রাখুন না কেন, আড়াই লক্ষ ডলার তিনি নিশ্চিতভাবে ফেরত পাবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফেডেরাল ডিপোজিটরি ইন্সুরেন্স কর্পোরেশন’ বা ‘এফডিআইসি’ নামের সংস্থা এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করে। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘এসভিবি’র মোট ১’শ ৫১ বিলিয়ন ডলারের ডিপোজিট ছিল, যা কিনা ‘এফডিআইসি’র ইন্সুরেন্সের বাইরে ছিল। অর্থাৎ এগুলি ছিল আড়াই লক্ষ ডলারের চাইতে বড় ডিপোজিট।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রাক্তন কর্মকর্তা নিকি হেলি বলছেন যে, মার্কিন করদাতারা একটা দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকের দায় নেবে না। অর্থাৎ ‘এসভিবি’কে বাঁচাবার দায়িত্ব সরকারের নেয়া উচিৎ নয়। তবে গ্যারি কোহন বলছেন যে, ব্যাংকিং ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারকেরা সকলেই জনগণকে ব্যাংকে অর্থ রাখার জন্যে আগ্রহী রাখতে চায়। কারণ ব্যাংকের মাধ্যমেই মার্কিন অর্থনীতিতে ডলার আবর্তিত হয়। তবে দেউলিয়া হওয়া ‘এসভিবি’র বেশিরভাগ ডিপোজিটই ইন্সুরেন্সের আওতায় পড়েনি। যারা এই ডিপোজিট রেখেছিল, এর একটা বড় অংশ ছিল বিভিন্ন কোম্পানির কর্মচারীদের বেতনের অর্থ। খেটে খাওয়া মানুষের বেতনের অর্থ এখানে রয়েছে বলেই এক্ষেত্রে সরকারের কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে একটা ব্যাংক যাতে সহজে দেউলিয়া না হয়, সেই লক্ষ্যে ব্যাংকের পুঁজি কত হতে হবে, তা নিয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মাঝে যথেষ্ট বিরোধ রয়েছে।

গ্যারি কোহন বলছেন যে, ২০১৮ সালে ব্যাংকিং আইন পরিবর্তন করার সময়ে অনেকেই বলেছেন যে, ব্যাংকের পুঁজি অনেক বেশি বা নিয়মনীতি খুব বেশি কঠোর হওয়া উচিৎ নয়। তারা চাইছেন আরও বেশি সংখ্যক ছোট ছোট ব্যাংক গড়ে উঠুক। বেশি কঠোর নীতি থাকলে ব্যাংকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। আর ‘এসভিবি’ ব্যাংকের যথেষ্ট পুঁজি ছিল; এর পরেও তারা দেউলিয়া হয়েছে। এর সাথে ২০১৮ সালের আইন পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক নেই। তবে জো বাইডেন প্রশাসনের কেউ কেউ দাবি করছেন যে, ২০১৮ সালে ‘ডড-ফ্র্যাঙ্ক এক্ট’এর আইনগুলিকে পরিবর্তন করার জন্যেই এমনটা ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন যে, তিনি কংগ্রেসকে আনুরোধ করেছেন যাতে করে ব্যাংকিংএর আইনগুলিকে আরও কঠোর করে ফেলা হয়; এর ফলশ্রুতিতে ব্যাংক দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা অনেক কমে আসবে।

‘এসভিবি’ এমন কিছু করেনি, যা কিনা মার্কিন ব্যাংকগুলি করছিলো না। অর্থাৎ ‘এসভিবি’র মতো আরও অনেক ব্যাংক রয়েছে, যারা একই সমস্যায় পতিত। ‘এসভিবি’র পতনের মাত্র দুই দিনের মাথায়, ১২ই মার্চ, ‘সিগনেচার ব্যাংক’ নামের আরেকটা ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। এই ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম দেউলিয়া হবার ঘটনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিন্তায় পড়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেউলিয়া হওয়া দু’টা ব্যাংকের সকল ডিপোজিটই ইন্সুরেন্সের অধীনে আসবে; অর্থাৎ যাদের একাউন্টে আড়াই লক্ষ ডলারের বেশি অর্থ ছিল, তারাও ইন্সুরেন্সের আওতায় পড়বে। তবে ১৩ই মার্চ মার্কিন সরকারের রাজস্ব সচিব জ্যানেট ইয়েলেন সরাসরিই বলেন যে, সরকার এই ব্যাংকগুলিকে বাঁচাবে না। তবে জ্যানেট ইয়েলেন যাই বলুন না কেন, বাইডেন প্রশাসন যখন আড়াই লক্ষ ডলারের সীমা অতিক্রম করে দেউলিয়া ব্যাংকের ডিপোজিট ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তখন অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে, সরকার প্রকৃতপক্ষে সাধারণ করদাতাদের অর্থ ব্যয় করে এই ব্যাংকগুলি বা ব্যাংকের গ্রাহকদেরকে বাঁচাচ্ছে। এই গ্রাহকগুলির মাঝে সিলিকন ভ্যালির বিভিন্ন কোম্পানি ছিল, যারা মাল্টিমিলিয়ন ডলার ডিপোজিট রেখেছিল এই ব্যাংকগুলিতে। অর্থাৎ সরকার প্রকারান্তরে করদাতাদের অর্থ ব্যয় করে এই কোম্পানিগুলিকে বাঁচাচ্ছে।

কেউ কেউ বলছেন যে, প্রযুক্তি সেক্টরের ব্যাংক হবার কারণেই বাইডেন প্রশাসন ‘এসভিবি’কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। ‘বিএনই ইন্টেলিনিউজ’এর সম্পাদক বেন আরিস ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের সাথে প্রযুক্তি যুদ্ধে মনোনিবেশ করছে, তখন হোয়াইট হাউজ চাইছে না যে, মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি আর্থিক সমস্যায় পড়ে যাক। একারণেই সরকার এই সেক্টরের ডিপোজিট যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রেখেছে এবং ইন্সুরেন্সের সীমা ছাড়িয়ে ডিপোজিটগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

২০শে মার্চ বিশ্বের বৃহৎ ব্যাংকগুলির একটা, সুইজারল্যান্ডের ‘ক্রেডিট সুইস’ ব্যাংককে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে জোরপূর্বক কিনে নেয় ‘ইউবিএস’ ব্যাংক। সুইজারল্যান্ডের সরকার বলছে যে, একটা অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়ানোর এটাই ছিল একমাত্র পথ। সকলেই এখন যা কিছু বলছেন, তার সাথে বলছেন যে, ‘তার বিশ্বাস’ এটা বা ওটা হবে। এর অর্থ হলো পুরো ব্যবস্থাটাই বিশ্বাসের সমস্যা পড়েছে। বিশ্বাস যেমন অর্জন করা সম্ভব, তেমনি খুব স্বল্প সময়ের মাঝে হারানোও সম্ভব।


মার্কিন এবং ইউরোপের ব্যাংকিং সেক্টরের উপর প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক দেউলিয়া হবার প্রভাব সারা দুনিয়াতেই পড়েছে। অনেকেই এতে বিচলিত হয়েছেন; আর একারণেই রাজনীতিবিদেরা মানুষকে আস্বস্ত করতে চাইছেন। ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মেয়ার পার্লামেন্টে বলেন যে, ফ্রান্স ২০০৮ সালের আর্থিক দুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ইউরোপের ব্যাংক এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়েছে; বিশেষ করে ফরাসি ব্যাংকগুলির এখন যেধরনের রক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তা যথেষ্ট শক্তিশালী। তিনি শক্তভাবে বলেন যে, ফরাসি ব্যাংকের এপ্রকারের কোন ঝুঁকি নেই। কিন্তু রাজনীতিবিদদের কথায় সকলে আস্বস্ত নয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টক এক্সচেঞ্জের ‘বাডের ব্যাংক’এর পুঁজি বাজার বিশ্লেষণ প্রধান রবার্ট হালভার ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, ২০০৮ সালের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলিকে আবারও হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে; যাতে করে একটা ছোট্ট মাছি বড় হতে হতে হাতি না হয়ে যায়। সেবার ‘লিহমান ব্রাদার্স’এর দেউলিয়া হওয়াটা প্রায় পুরো আর্থিক বাজারকেই ধ্বসিয়ে দিয়েছিল। একারণেই বাজারে যথেষ্ট ভয় বিদ্যমান রয়েছে।

রাজনীতিবিদেরা যাই বলুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক দেউলিয়া হবার ঘটনা যে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে, তা এখন পরিষ্কার। ২০শে মার্চ বিশ্বের বৃহৎ ব্যাংকগুলির একটা, সুইজারল্যান্ডের ‘ক্রেডিট সুইস’ ব্যাংককে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে জোরপূর্বক কিনে নেয় ‘ইউবিএস’ ব্যাংক। ‘ইউবিএস’ হলো সুইজারল্যান্ডের সবচাইতে বড় ব্যাংক; আর ‘ক্রেডিট সুইস’ হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক। এই ঘটনায় আর্থিক বাজারের বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে গেলেও সরকার এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলি বলছে যে, মূল উদ্দেশ্য হলো ডিপোজিটগুলিকে রক্ষা করা এবং পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখা। সুইজারল্যান্ডের সরকার বলছে যে, একটা অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়ানোর এটাই ছিল একমাত্র পথ। সুইজারল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী ক্যারিন কেলার সাটার সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, শুধু সুইজারল্যান্ড নয়, বিশ্বব্যাপী আর্থিক সমস্যা এড়ানোর জন্যেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কাজে ১’শ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। আর এই একত্রীরণের ফলে ‘ইউবিএস’এর ক্ষতি বেশি হলে সরকার ৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণের নিশ্চয়তা দেবে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০০৮ সালে দেউলিয়া হওয়া মার্কিন ব্যাংক ‘লিহমান ব্রাদার্স’এর তুলনায় ‘ক্রেডিট সুইস’এর আকার দ্বিগুণ। শুধু তাই নয়, সুইজারল্যান্ডের এই ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ব্যবসা অনেক বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক ‘জে সাফরা সারাসিন’এর প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্সটেন ইউনিস ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, সকলেই এখন যা কিছু বলছেন, তার সাথে বলছেন যে, ‘তার বিশ্বাস’ এটা বা ওটা হবে। এর অর্থ হলো পুরো ব্যবস্থাটাই বিশ্বাসের সমস্যা পড়েছে। বিশ্বাস যেমন অর্জন করা সম্ভব, তেমনি খুব স্বল্প সময়ের মাঝে হারানোও সম্ভব। সরকারের হস্তক্ষেপে আর্থিক বাজারে স্বস্তি ফিরবে বলে তিনি আশা করছেন এবং তারও বিশ্বাস মানুষের আস্থা ফিরে আসবে এবং সমস্যা বহুদূর পর্যন্ত গড়াবে না। কিন্তু এটা কখনোই শতভাগ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে, এটা হবেই।

মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ ব্যাপকহারে ডলার ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করেছে; আবার মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়াতে মনোনিবেশ করেছে; যা কিনা ব্যাংকিং সেক্টরকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা এখন পরিষ্কার যে, মার্কিন, তথা পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থা চলছে ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ বা জোড়াতালি দিয়ে। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার উপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যাচ্ছে। কারণ সরকারি বন্ড বা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখাও এখন অনিরাপদ ঠেকছে। সাধারণ জনগণের এই ভীতি ছোট্ট একটা সমস্যাকে পুরো আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বসে রূপ দিতে পারে।


মার্কিন সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কি করবে?

বেন আরিস বলছেন যে, মুদ্রাস্ফীতি কমাতে গিয়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সুদের হার বাড়াতে থাকলো, তখন তারা চিন্তা করেনি যে, এর প্রভাব ব্যাংকিং সেক্টরের উপর কিভাবে পড়বে। ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ এখন দোটানায় পড়েছে যে, তারা কি সুদের হার কমিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরকে বাঁচাবে, নাকি মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়াতেই থাকবে? এই পরিস্থিতিটা তাদের জন্যে সত্যিই মারাত্মক। কারণ ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্জয় মুদ্রাস্ফীতির চাইতে আরও মারাত্মক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। একইসাথে সুদের হার বাড়াতে থাকলে বাজারে একটা আলোচনা তৈরি হয় যে, সুদের হার বুঝি বাড়তেই থাকবে। সেই হিসেবে বাকি সকলকিছুও পরিবর্তিত হতে থাকে। শেষপর্যন্ত দেখা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতিও খুব একটা কমে না।

অর্থনীতিবিদ নুরিয়েল রুবিনি ‘ব্লুমবার্গ’কে বলছেন যে, ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’এর সামনে সুদের হার বাড়ানো ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এখন বিপুল পরিমাণ ঋণ; ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহ ঋণ, কর্পোরেট ঋণ, ব্যাংকের ঋণ, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ, সরকারি ঋণ। একারণেই যদি পরিস্থিতি কঠিন হয়, তবে সেটা অনেক বেশি কঠিনই হবে; এবং সেটা হবে দীর্ঘমেয়াদী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বাড়ার সাথেসাথে সরকারি বন্ডের মূল্য প্রায় ২০ শতাংশ পড়ে গেছে। এর ফলে শুধুমাত্র মার্কিন ব্যাংকগুলিকেই ৬’শ ২০ বিলিয়ন ডলারের লোকসান গুণতে হবে। এই ব্যাংকগুলির পুঁজি প্রায় ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার, বা ২২’শ বিলিয়ন ডলার। কাজেই এই লোকসান তাদের পুঁজির প্রায় ২৮ শতাংশকে নিঃশেষ করে ফেলবে; যা এখনও বাস্তবে রূপ নেয়নি। অনেক ছোট ব্যাংকের পুঁজির প্রায় অর্ধেকই ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। এছাড়াও পুরো অর্থ ব্যবস্থায় ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের দীর্ঘমেয়াদী বন্ড রয়েছে; যেগুলি ডলারের সাথে সম্পর্কিত। ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’এর সুদের হার বাড়ানোর কারণে এই সবগুলিই মূল্য পড়ে যাবার ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থাৎ এর ফলস্বরূপ শুধুমাত্র মার্কিন অর্থনীতিতেই ৩ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান গুণতে হবে। এগুলির অনেক লোকসানই এখনও বাস্তবে রূপ নেয়নি। এতকাল মানুষ মনে করতো যে, সরকারি বন্ড একটা নিরাপদ বিনিয়োগ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সকলেই বুঝতে পারছে যে, সরকারি বন্ড নিরাপদ নয়। কারণ যদিও এটার মূল্য ফেরত না পাবার সম্ভাবনা নেই, তথাপি বাজারে এর মূল্য বেশ দ্রুতই কমে যেতে পারে; যা থেকে বাঁচা যাচ্ছে না। গত এক বছরের মাঝে ১০ বছর মেয়াদী বন্ডের মূল্যে ২০ শতাংশ পড়ে গেছে। কাজেই যারা রিটায়ার করার পর তাদের পেনশনের অর্থ বন্ডে বিনিয়োগ করেছে, তাদেরকে এখন ভিন্ন পথ দেখতে হবে।

এটা এখন পরিষ্কার যে, মার্কিন, তথা পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থা চলছে ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ বা জোড়াতালি দিয়ে। সকল বিশ্লেষকেরাই বলছেন যে, মার্কিন অর্থনীতি ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। যেকারণেই এই সেক্টরের ব্যাপারে সকলেই সংবেদনশীল। কিন্তু এই সেক্টরের নীতি নিয়ে মার্কিন রাজনীতিবিদদের মাঝে মেরুকরণ চলছে; যা আরও বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণের একটা অংশ। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার উপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যাচ্ছে। কারণ সরকারি বন্ড বা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখাও এখন অনিরাপদ ঠেকছে। সাধারণ জনগণের এই ভীতি ছোট্ট একটা সমস্যাকে পুরো আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বসে রূপ দিতে পারে। রিচার্ড স্কুয়ির বেশ পরিষ্কারভাবেই বলেছেন যে, করোনাভাইরাসের সময় ব্যাপকভাবে ডলার ছাপানোটাই শেষ পর্যন্ত ব্যাপক মূদ্রাস্ফীতির জন্ম দিয়েছে। আর মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে আর কোন পদ্ধতি না পেয়ে সুদের হার বাড়াতে মনোনিবেশ করেছে; যা কিনা ব্যাংকিং সেক্টরকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বেন আরিস বলছেন যে, ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয় মুদ্রাস্ফীতির চাইতে আরও মারাত্মক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। অপরদিকে নুরিয়েল রুবিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ছোট একটা ব্যাংক দেউলিয়া হলে একইরকম আরও বেশকিছু ব্যাংক দেউলিয়া হতে শুরু করবে; যা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে ধ্বসিয়ে ফেলবে এবং অর্থনীতিকে মন্দার মাঝে পতিত করবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মাঝে এই মন্দা পুরো অর্থনীতিকে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলবে। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, একটা শক্ত ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচা আর সম্ভব নয়।

8 comments:

  1. ব্যাংকিং সিস্টেম কি লিবরাল ক্যাপিটালিজম এর পরিচয় বহন করে?
    ডলার এর গোল্ড এর পেজ্ঞড নয়, তাই বলে কি এরকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে? নাকি সুদ নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা,এই রকম অস্থিতিশীলতার কারন?
    এইভাবে যদি সিস্টেমটা ধসে যায়, তবে কি রাজনৈতিক মডেল( world order) পুরো ভেঙে পড়বে?
    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্যাংকিং ব্যবস্থাটা মডার্ন ক্যাপিটালিজমের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ ব্যাংকের মাধ্যমেই পুঁজিপতিরা সর্বোচ্চ পরিমাণে পুঁজি যোগাড় করতে পারে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকিংএর মাধ্যমেই পুঁজিকে ম্যাজিকের মতো ১০ গুণ করে ফেলা যায়। ১০০ ডলার ডিপোজিটের বিপরীতে ১,০০০ ডলার পর্যন্ত ঋণ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থ হলো ঐ ১০০ ডলার, যা কিনা ডিপোজিট হিসেবে ব্যাংকে একবার জমা পড়েছে। বাকিগুলি প্রকৃতপক্ষে অন্তসারশূন্য। এরকম একটা ব্যবস্থাকে চলমান রাখাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক; যেকোন সময়ে তা ধ্বসে পড়তে পারে। একারণেই ব্যাংকিং পড়াবার সময় বলা হয় যে, ব্যাংকিং হলো রিস্ক ম্যানেজমেন্ট।

      একটা বিপজ্জনক ব্যবস্থা কোন একটা সময় যে পড়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। একারণেই নিয়মিতভাবে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে থাকে। সবসময় সেগুলি বড় খবর হয় না; কারণ বেশিরভাগ ব্যাংক হলো অপেক্ষাকৃত ছোট; যেগুলিতে মিডিয়া আগ্রহী নয়। মিডিয়ার আগ্রহ সেইগুলিতে, যেগুলি পুরো বাজারে প্রভাব ফেলবে।

      অপরদিকে ডলার হলো কাগজের মুদ্রা বা ফিয়াট কারেন্সি; যার পিছনে প্রকৃতপক্ষে কোন ধরণের ব্যাকআপ নেই। অর্থাৎ কোন প্রকৃত সম্পদকে স্তম্ভ ধরে ডলার ছাপানো হয়নি। এরপরে বাজারে প্রকৃত সম্পদের চাইতে যখন ডলার বেশি হয়ে যায়, তখনি মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। একটা বড় সমস্যা হলো, ডলার হলো একটা দেশের জাতীয় মুদ্রা। সেকারণে সেই মুদ্রাকে নিয়ে তার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সে যা যা করবে, সেটাই সারা দুনিয়াতে প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝে কর্পোরেট এবং জনগণকে করোনা প্রনোদনা দিতে গিয়ে এই কান্ডটাই হয়েছে। তারা ইচ্ছেমতো ডলার ছাপিয়ে মানুষের কাছে বিলি করেছে। এটারই ফলাফল এখন মুদ্রাস্ফীতি। আর এই মুদ্রাস্ফীতি কমাতে গিয়েই ফেডেরাল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে এবং পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বিপদে ফেলেছে।

      আর আপনি সুদভিত্তি ব্যবস্থার যে সমস্যার কথা বলেছে, সেটা ক্যাপিটালিস্টরাও জানে। তারা নিজেরাই বলে যে, সুদ এবং মানবাধিকার হলো একে অপরের পরিপন্থী।

      বিশ্বব্যবস্থা এখন আসলে প্রায় নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র টিকে রয়েছে বলেই এখনও মানুষ ডলারকে দামী ভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মারাত্মক কিছু শুরু হলে ডলারের মূল্য ফ্রি-ফলএ চলে যাবে।

      Delete
  2. চিন / রাশিয়া কি ইউ এন থেকে লিভ নিতে পারে? এটা কি আমেরিকার লেড লিবরাল বিশ্বব্যবস্থার সমাপ্তির ঘোষণা দিবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. রাশিয়া জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদটা পেয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুবাদে। আর কমিউনিস্ট চীন তাদের স্থায়ী সদস্যপদটা পেয়েছে জাতীয়তাবাদী চীন (যা এখন তাইওয়ান)এর সুবাদে। উভয় দেশই এই সদস্যপদকে অত্যন্ত সন্মানের মনে করে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রস্তাবকে তারা ভেটো দেবার ক্ষমতা রাখে ভেবে সেটা তাদেরকে কূটনৈতিক শক্তি যোগায়; যদিও যুক্তরাষ্ট্র কখনোই সেটার তোয়াক্কা করে না।

      যদি কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন, যারা কিনা পশ্চিমা পুঁজিবাদকে সরিয়ে দিয়ে সমাজতন্ত্রকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, তারাই যদি জাতিসংঘের সদস্য হয় এবং পশ্চিমাদের সাথে সেই ফোরামে যুক্তিতর্কে অংশ নেয়, তাহলে রাশিয়াকে নিয়ে কথা বলা তো নিরর্থক। আর ১৯৭১ সালে কমিউনিস্টকে চীনকে যখন জাতিসংঘে চীনাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলো, তখনও মাও সে তুং এবং চৌ এনলাই উভয়েই বেঁচে ছিলেন। তারা তো আজকের পুঁজিবাদী চীনের প্রবক্তা ছিলেন না। তারাই যদি চীনকে জাতিসংঘে নিতে পারেন, তাহলে শি জিনপিংএর চীন তো জাতিসংঘ ছাড়াই প্রশ্নই আসে না।

      রাশিয়া এবং চীন দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি; কোন রাষ্ট্রের সংবিধান লিখে দেয়নি; কোন রাষ্ট্রের সরকার নির্বাচনে তারা অংশ নেয় না বা প্রভাব খাটাতে পারে না। এমতাবস্থায় জাতিসংঘ এই দুই দেশের জন্যেই কথা বলার সর্বোচ্চ প্ল্যাটফর্ম। যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন এই প্ল্যাটফর্ম ছাড়াই দুনিয়াকে যেভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম, রাশিয়া বা চীনের পক্ষে তার কিছুই সম্ভব নয়। মোটকথা রাজনৈতিকভাবে এই দুই দেশই বিশ্বে তেমন কোন বড় শক্তি নয়। যা রাশিয়া এবং চীন এখন করতে পারছে, তার বেশিরভাগটাই পশ্চিমা আদর্শের দৈন্যতার কারণে।

      Delete
  3. 'সুদ নির্ভর নয়' এরকম ব্যাংক গুলি কি আদৌ কি সুদ বাদ চলতে পারে? নাকি তাদের কার্যকলাপ পুরোটাই যেকোনো ককনভেনশনাল ব্যাংকের মত?

    পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থাকে 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক ' বলে সংস্থাটি টিকিয়ে রাখে? কেমনভাবে সাহায্য করে?

    বর্ত্মানে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি ডিজিটাল কারেন্সি আনতে চাইছে? এটা কতটা ফিয়াট কারেন্সি থেকে আলাদা হবে? এই ব্যাপার যদি বলেন তবে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।

    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্যাংকিং হলো অর্থলগ্নী ব্যবসা। অর্থ খাটিয়ে লাভ না করতে পারলে কেউ ব্যাংকিং ব্যবসা করবে না। ব্যাংকিংএর কনসেপ্টটাই হলো সুদের উপরে ভিত্তি করে। আপনি ডিপোজিটের উপরে সুদ দেবেন; আর এর চাইতে বেশি সুদ আদায় করবেন ঋণ দিয়ে - এই দুইএর মাঝে ব্যবধানই আপনার লাভ। ব্যাংকিং ব্যবসায় লাভ হলো ইন্টারেস্ট ডিফারেনশিয়াল; অর্থাৎ সুদের দুই হারের মাঝে ব্যবধান।

      কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ হলো কারেন্সি ছাপানো। অর্থাৎ একটা রাষ্ট্রে কত মুদ্রা থাকবে, সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে। পশ্চিমা দেশগুলিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো বেসরকারি। অর্থাৎ কথায় হলেও সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ এর উপরে নেই। তবে বাস্তবিকপক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে যায় না। আর বাকি বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। পশ্চিমারা ঐ দেশগুলির উপরে চাপ সৃষ্টি করে যাতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারিকরণ করা হয়। এতে করে পশ্চিমারা তাদের মনোনীত লোকগুলিকে দিয়ে সেই দেশগুলির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আইএমএফএর ঋণের শর্তগুলির মাঝে একটা থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারিকরণ; যদি তারা মুখে কখনও এই কথাটা স্বীকার করে না।

      কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকুক আর না থাকুক বেশিরভাগ দেশই আন্তর্জাতিক মুদ্রা (মার্কিন ডলার)-র উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। সেকারণে আইএমএফএর মতো সংস্থাগুলি তাদের ঋণের সাথে এটাও শর্ত দেয় যে, সেই দেশের মুদ্রাকে অবাধে কেনাবেচা করতে দিতে হবে। এতে করে সেই দেশের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। যেমনটা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে। মোটকথা বেশিরভাগ দেশই আর্থিক বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। পশ্চিমারা সবদিক থেকেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। একারণেই কেউ কেউ বিকল্প কারেন্সি ব্যবস্থার দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

      তবে এই বিকল্প ক্রিপ্টো কারেন্সির কনসেপ্ট কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে পুরোপুরিভাবে সাংঘর্ষিক। এই কারেন্সির অর্থ হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়াই আপনি মুদ্রা বানাতে পারবেন। এই কারেন্সির জন্মই হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাইপাস করার জন্যে।

      Delete
  4. প্রায় অনেক দেশেই নিজেদের কারেন্সি ব্যাবহার করতে চাইছে নিজেদের মধ্যে বানিজ্যে, এতে করে ডলারের ব্যবহার ও প্রভাব কমবে ফলে আই এম এফ এর মত সংস্থা গুলি ধসে পরবে। ফলে আমেরিকার অর্থনীতির অবস্থা করুন হয়ে যাবে। যেটা অবশ্যম্ভাবী?

    ReplyDelete
    Replies
    1. জ্বি। অনেকেই নিজেদের মাঝে বাণিজ্যে তৃতীয় পক্ষের মুদ্রা (ডলার) ব্যবহার না করে নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা এখনও সফলভাবে করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হলো বিশ্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এখনও পশ্চিমাদের হাতে। এই ব্যবস্থার মাঝে রয়েছে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ। আন্তদেশীয় ক্লিয়ারিংএর কাজ করতে হলে প্রতিটা ব্যাংককে পশ্চিমাদের বেঁধে দেয়া কিছু নিয়ম পালন করতে হবে। সেই নিয়ম পালন করলে ডলার ব্যাতীত অন্য মুদ্রা দিয়ে বাণিজ্য করা খুবই কঠিন।

      এছাড়াও আরেকটা ব্যাপার হলো বাণিজ্যের জন্যে পশ্চিমাদের উপরে নির্ভরশীলতা। পুরো বিশ্বের বাণিজ্যের কনসেপ্ট পশ্চিমাদের কাছ থেকে এসেছে। এর মূলে রয়েছে "কম্পিটিটিভ এডভান্টেজ" থিউরি। এর মাধ্যমে একটা দেশ শুধুমাত্র যে পণ্যগুলি কম মূল্যে এবং বেশি ভালোভাবে তৈরি করতে পারবে, সেগুলিই উৎপাদন করবে। বাকি সকল কিছু সে তৈরি করতে পারলেও তৈরি করবে না; বরং আমদানি করবে। সারা বিশ্বের সকল দেশ এই থিউরি অনুসরণ করছে। একারণেই একটা দেশ নিজের দেশে খাদ্য উৎপাদন না বাড়িয়ে বা নিজের দেশের মাটির নিজের সম্পদ না উঠিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে। এই থিউরি থেকে চীন বা রাশিয়াও বাইরে নয়। কারণ তারা পশ্চিমা আদর্শের কোন বিকল্প দেয়নি। এই থিউরি বলবত থাকার কারণে বিশ্ব বাণিজ্য অটোমেটিক্যালি পশ্চিমাদের হাতে থাকবে। আর বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীলতা থাকার কারণেই প্রতিটা দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আইনের উপরে নির্ভরশীল থাকবে; যা আবার ডলারের উপরে নির্ভরশীল। আর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের ওঠানামা হবে, তখন অনেক দেশই দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আইএমএফএর দ্বারস্থ হবে। এটাই আজকের এই বিশ্ব ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার বিকল্প না এনে হাল্কা পাতলা পরিবর্তনের কথা বলে সময় নষ্ট করা অর্থহীন।

      Delete