Saturday 11 March 2023

যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রযুক্তির দ্বন্দ্ব আরও উত্তপ্ত হচ্ছে

১১ই মার্চ ২০২৩

চীনের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় অগ্রগামিতা তার সম্পদ বা অস্ত্র নয়; বরং তা হলো বিশ্বব্যাপী তার বন্ধু। পশ্চিমা আদর্শের নেতৃত্বের কারণে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিনীদের বন্ধুর অভাব নেই; সেটা যতটাই স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক না কেন। চীন এক্ষেত্রে দুনিয়াকে বিকল্প কোন আদর্শ অফার করতে পারেনি; যা কিনা চীনের বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে পারতো।

গত ৮ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে নেদারল্যান্ডসের সরকার সবচাইতে উন্নত মাইক্রোচিপ প্রযুক্তির রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। দেশটার বাণিজ্যমন্ত্রী লিসি স্রাইনমাখার ডাচ পার্লামেন্টের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠিতে বলেন যে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই প্রযুক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। তবে তিনি সেখানে চীনের নাম উল্লেখ করেননি। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘এএসএমএল’ অন্তর্ভুক্ত হবে; যারা সেমিকন্ডার তৈরিতে পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রের ডিজাইনার ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। কোম্পানি বলছে যে, তাদের ‘ডীপ আলট্রা ভায়োলেট’ বা ‘ডিইউভি’ নামের প্রযুক্তির ‘লিথোগ্রাফি’ যন্ত্র রপ্তানি করতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। ‘লিথোগ্রাফি’ যন্ত্রের মাধ্যমে সিলিকনের উপর লেজার ব্যবহার করে সার্কিট ছাপানো হয়; যার ফলে সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোচিপ তৈরি হয়।

সেমিকন্ডাক্টর হলো এমন জিনিস, যা ছাড়া মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সর্বশেষ প্রযুক্তির সামরিক যন্ত্রপাতি তৈরি করা অসম্ভব। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেন যে, ডাচদের লক্ষ্য হলো চীনকে উন্নত হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তিনি বলেন যে, চীনারা আশা করবে নেদারল্যান্ডস ‘অন্যান্য দেশকে’ অনুসরণ করে রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে না। এখানে চীনারা ‘অন্যান্য দেশ’ বলতে যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝিয়েছে। চীন সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি কুক্ষিগত করে রাখার অভিযোগ করে। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত জানুয়ারি মাসে মার্কিনীরা ডাচ এবং জাপানিদের সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছায় বলে জানা যায়; যার মাধ্যমে চীনে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সর্বশেষ প্রযুক্তি রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। তবে সর্বশেষ প্রযুক্তি না পেলেও চীন অপেক্ষাকৃত পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেতে পারবে। শুধু তাই নয়, সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের লোকেরা বলছেন যে, চীনারা ‘এএসএমএল’এর আগের প্রযুক্তিগুলি ক্রয় করতে পারবে। একমাত্র চীনই পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, জাপান এবং কিছু ইইউ দেশ উন্নততর ‘১০ ন্যানোমিটারের নিচের’ প্রযুক্তিতে চলে যাচ্ছে। ‘এএসএমএল’এর প্রযুক্তি ‘৩ ন্যানোমিটারের নিচের’। তবে চীনারা সর্বশেষ প্রযুক্তি না পেলে সেটা তাদের সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির জন্যে ভালো খবর নয় এবং ভবিষ্যতে তা চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে ব্যাহত করতে পারে। নতুন মার্কিন আইন নিশ্চিত করতে চাইছে যে, চীন যেন ‘১৪ ন্যানোমিটারের নিচের’ প্রযুক্তি বা ‘১২৮ লেয়ার ৩ডি এনএএনডি’এর চাইতে উন্নততর প্রযুক্তি না পায়।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ডাচ সরকার ২০১৯ সাল থেকেই চীনে ‘এএসএমএল’এর ‘এক্সট্রিম আলট্রা ভায়োলেট’ বা ‘ইইউভি’ প্রযুক্তির যন্ত্র রপ্তানি করার উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে মার্কিন সরকার চীনে প্রযুক্তি রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এই নিয়ন্ত্রণের ফলে পৃথিবীর যেকোন দেশে মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা সেমিকন্ডাক্টর চীনে রপ্তানি করতে গেলে সরকারের অনুমতি লাগবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত তাদের বন্ধু দেশগুলিকেও খুশি করতে পারেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী এক সপ্তাহ আগেই বলেছেন যে, সেমিকন্ডাক্টরের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ফলে তা একদিকে যেমন ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করবে, তেমনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে। এছাড়াও তা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগুরুত্বপূর্ণ করবে। দক্ষিণ কোরিয় কোম্পানি ‘স্যামসাং’ পৃথিবীর সবচাইতে বড় সেমিকন্ডাক্টর তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ বলছে যে, চীনা কোম্পানিগুলি এখন অতি দ্রুত সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্র যোগাড় করতে মরিয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন আইনগুলি বাস্তবায়নে কিছুটা ঘোলাটে পরিস্থিতি থাকবে, ততক্ষণ তারা এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। ‘এএসএমএল’এর যথেষ্ট ব্যবসায়িক স্বার্থ এখানে জড়িত। কোম্পানিটার ৩৪ শতাংশ আয় আসে সর্বশেষ ‘ডিইউভি’ প্রযুক্তি বিক্রি করে; আর ৪৬ শতাংশ আয় আসে এর আগের ‘ইইউভি’ প্রযুক্তি থেকে। উভয় প্রযুক্তিই এখন চীনে যাচ্ছে না।

‘এশিয়া টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনারা সোলার প্যানেলের যন্ত্রপাতি রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। সারা দুনিয়ার সবচাইতে বড় ১০টা সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারকই চীনা। সোলার প্যানেল তৈরির সকল কাজের মাঝে ৮০ শতাংশই চীনাদের নিয়ন্ত্রণে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় জেনিফার লী বলছেন যে, চীনাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল মার্কিনীদের সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপের একটা প্রত্যুত্তর। মার্কিন কংগ্রেসে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্যে আইন পাস করে জীবাশ্ম জ্বালানির উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে বলা হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে যে, সোলার এবং বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এখন সমস্যা হলো, চীনারা শুধু সোলারই নয়, বায়ুশক্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী; যার ফলে মার্কিন নীতি বাস্তবায়ন এখন চীনের সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হবে। এছাড়াও কিছুদিন আগেই চীনারা বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ব্যাটারির প্রযুক্তি যাতে মার্কিনীদের কাছে চলে না যায়, সেব্যাপারে কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এগুলি প্রমাণ করে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মার্কিন সরকার চীনকে নিয়ন্ত্রণে যে বহু ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা বিভিন্ন সেক্টরকে প্রভাবিত করবে।

‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো ডেক্সটার রবার্টস ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে ডাচদের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা বড় বিজয়; আর চীনের জন্যে খারাপ সংবাদ। তবে এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হলো। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর ডিরেক্টর গ্রেগোরি এলেন ‘দ্যা টাইম’এর এক লেখায় বলছে যে, গোয়েন্দা বেলুন বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর যে প্রতিযোগিতাকে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ‘প্রযুক্তি যুদ্ধ’র অংশ বলা হচ্ছে, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে একা নয়। চীনের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় অগ্রগামিতা তার সম্পদ বা অস্ত্র নয়; বরং তা হলো বিশ্বব্যাপী তার বন্ধু। যে ব্যাপারটা এলেন বলেননি তা হলো, পশ্চিমা আদর্শের নেতৃত্বের কারণে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিনীদের বন্ধুর অভাব নেই; সেটা যতটাই স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক না কেন। চীন এক্ষেত্রে দুনিয়াকে বিকল্প কোন আদর্শ অফার করতে পারেনি; যা কিনা চীনের বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে পারতো।

No comments:

Post a Comment