Saturday 18 March 2023

সৌদি-ইরান সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চীনের জন্যে কতবড় সাফল্য?

১৮ই মার্চ ২০২৩

যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের বিরাগভাজন হচ্ছে। একইসাথে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে; যা চীনকে সুযোগ করে দিয়েছে। তবে এখনও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইন্টেলিজেন্স এবং অস্ত্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল।

গত ১১ই মার্চ চারদিনের গোপন আলোচনার পর বেইজিংএ ইরান এবং সৌদি আরবের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয়া হয়। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে শিয়া ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদন্ডের প্রতিবাদে তেহরানে সৌদি দূতাবাসে আগুন দেয়ার পর থেকে দুই দেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এখন বলা হচ্ছে যে, উভয় দেশই দুই মাসের মাঝে অপর দেশে দূতাবাস খুলবে। ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের আলী সামখানি বেইজিংএ সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সমঝোতা গোটা মুসলিম বিশ্বের সাথে ইরানের সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টার একটা অংশ। উভয় দেশই তাদের জাতীয় স্বার্থে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়েছে। একইসাথে এই সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যে বাইরের শক্তিদের প্রভাবকে ব্যালান্স করবে বলে বলেন তিনি। একইসাথে তিনি বলেন যে, এই সমঝোতার ফলে ইস্রাইল নাখোশ হবে।

‘আল জাজিরা’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এই সমঝোতা সরাসরি প্রতিফলিত হবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে; যেখানে সৌদি আরব এবং ইরান উভয়েই জড়িত। একইসাথে লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইরাক ও সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতেও এই সমঝোতার প্রভাব পড়তে পারে। তবে দুই দেশের মাঝে সমঝোতায় কেউ অবাক হয়নি; কারণ অনেক আগ থেকেই দুই দেশের মাঝে আলোচনা চলছিল। বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে ইরাকের মধ্যস্ততায় আলোচনার সুবাদে উভয় দেশের কর্মকর্তারা বাগদাদে পাঁচবার মিলিত হয়েছেন। একইসাথে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ওমানেও বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছেন। তবে কেউই আশা করেননি যে, এই সমঝোতাটা হবে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপস্থিতি ছাড়াই।

‘আল জাজিরা’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে ‘আব্রাহাম একর্ড’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে, তখন ইরানের সাথে সৌদিদের সম্পর্কোন্নয়ন ইস্রাইলের কাছে শ্রুতিমধুর হবার কথা নয়; কারণ এর মাধ্যমে ইরানকে একঘরে করার ইস্রাইলি চেষ্টায় ভাটা পড়বে। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জন কার্বি সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতাকে স্বাগত জানাচ্ছে; বিশেষ করে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ বন্ধে এবং আঞ্চলিক উত্তজনা নিরসণে এই সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে। তবে তিনি বলেন যে, এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রকারের হাত ছিল না।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘গালফ রিসার্চ সেন্টার’এর চেয়ারম্যান আব্দুলআজিজ সাগের ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, এই সমঝোতার মূলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে; যার মাঝে উভয় দেশের সার্ভভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সৌদিরা চাইছে যাতে ইরান সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। এছাড়াও জ্বালানি ও নৌ নিরাপত্তা এবং ইয়েমেন, লেবানন এবং সিরিয়াতে ইরানের ভূমিকার ব্যাপারে সৌদিরা নিশ্চিত হতে চাইছে। আর চীনের সকল জ্বালানির প্রায় ৩৬ শতাংশ যখন উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসে, তখন এই সমঝোতায় চীনের স্বার্থ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।

সৌদি আরবের ইন্টেলিজেন্সের প্রাক্তন প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে বলছেন যে, চীন যে এখানে মধ্যস্ততা করতে পারে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কোন দেশেরই সৌদি আরব এবং ইরান উভয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। এছাড়াও তিনি বলেন যে, যেহেতু সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলা হয়নি, তাই এই সমঝোতা ইস্রাইলের উপরে কতটা প্রভাব রাখতে পারে, তা বলা যাবে না। আর ইস্রাইল যদি ইরানের উপর হামলা করতেই চায়, তাহলে তারা ছুতো খুঁজবে না। ২০০৫ সাল থেকেই ইরানের উপরে ইস্রাইলের হামলার কথা বলা হলেও সেটা আজ অবধি ঘটেনি।

‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে কথা বলতে গিয়ে জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কারপো’র জ্যেষ্ঠ গবেষক সেবাস্টিয়ান সন্স বলছেন যে, তার মনে হয় না যে, এটা কৌশলগত কোন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এটা মূলতঃ দুই দেশের স্বল্পমেয়াদী স্বার্থকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছে। সোদিরা বরাবরই তেলের বাজারে উচ্চমূল্য দেখতে চায়। সেই হিসেবেই তারা রাশিয়া এবং ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছে। একইসাথে চীন সৌদি আরব এবং ইরানের মাঝে চলমান আলোচনার যে বাস্তবতা ছিল, সেটার সুযোগ নিয়েছে। এখন এই সমঝোতার সফলতা যে সকলেই দাবি করতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার ‘জি-জিরো মিডিয়া’তে বলছেন যে, এতকাল যাবত চীনারা নিজেদের উঠানের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কোন রাজনৈতিক আলোচনায় মধ্যস্ততা করার চেষ্টা করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি এবং ইরানের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়। তবে এখানে চীনের জড়িত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই মুহুর্তে ওয়াশিংটনের সাথে বেইজিংএর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে।

আব্দুলআজিজ সাগের বলছেন যে, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে ফেলে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিতে মোতায়েনকৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে ফেলে। এছাড়াও ২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনার উপর হামলার পর সৌদিরা সেই হামলায় ইরানের জড়িত থাকার প্রমাণ দিলেও যুক্তরাষ্ট্র কোন পদক্ষেপই নেয়নি; যেগুলি সৌদিদের কাছে ভুল বার্তা দিয়েছে। এর ফলে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য বন্ধু কিনা। একারণে সৌদিরা আঞ্চলিক নিরাপত্তার দিক থেকে অপশন বৃদ্ধি করতে চাইছে। যার ফলস্বরূপ, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি রাশিয়ার সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকা ছাড়াও চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখেছে।

ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, ইন্দোপ্যাসিফিকে ‘কোয়াড’ এবং ‘অকাস’এর মাধ্যমে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সামরিক সহায়তা দিয়ে নিরাপত্তার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ থাকছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে জো বাইডেন প্রশাসন ভুল অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের বিরাগভাজন হচ্ছে। একইসাথে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে; যা চীনকে সুযোগ করে দিয়েছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে চীনারা শান্তি প্রস্তাব দেয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। সামনের দিনগুলিতে মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংএর কূটনৈতিক কর্মকান্ড আরও বাড়বে। তবে এখনও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইন্টেলিজেন্স এবং অস্ত্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল।

No comments:

Post a Comment