Saturday 4 March 2023

ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প … ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংঘাত কি আসন্ন?

০৪ঠা মার্চ ২০২৩

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার 'সেন্ট্রিফিউজ' পরিদর্শনে দেশটার প্রেসিডেন্ট। ইস্রাইলের পক্ষ থেকে ইরানে হামলার কথা বলাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও বলেন যে, ইস্রাইলের যা করা প্রয়োজন, তাদের তা করা উচিৎ; যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সমর্থন দেবে। কিন্তু ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই হিসেব করে চলছে। কারণ ইরানের উপর যেকোন হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করবে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ দ্বন্দ্বের মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা যুদ্ধ মোটেই কেউই চাইছে না।

বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশ যে, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘আইএইএ’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা জানুয়ারি মাসে ইরানের ‘ফোরদো’ পারমাণবিক স্থাপনায় ইউরেনিয়ামের মাঝে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ বিশুদ্ধ্বতা পেয়েছেন। কয়েক বছর ধরে ইউরেনিয়াম ‘এনরিচমেন্ট’এর মাধ্যমে ইরান এই অবস্থানে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে যতটা বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন, ইরান তার খুব কাছাকাছি পোঁছে গেছে। ইউরেনিয়াম হলো একপ্রকারের খনিজ, যা বিশুদ্ধ বা ‘এনরিচ’ করলে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে ‘এনরিচড’ ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। ‘সেন্ট্রিফিউজ’ নামের এক যন্ত্রের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম থেকে ‘ইউ২৩৫’ অংশগুলি আলাদা করে ফেলার ব্যাপারটাকেই বলা হয় ‘এনরিচমেন্ট’। যে ইউরেনিয়ামের মাঝে ৩ থেকে ৫ শতাংশ ‘ইউ২৩৫’ রয়েছে, সেগুলি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে ৯০ শতাংশের বেশি ‘ইউ২৩৫’ প্রয়োজন।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইরানের ভাষ্য হলো, ‘আইএইএ’র প্রতিবেদনে আসা সংখ্যা মূলতঃ অনিচ্ছাকৃত ওঠানামার কারণেই পাওয়া গেছে। ২০১৫ সালে ইরান পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চুক্তি করে পারমাণবিক প্রকল্প স্থগিত করে; বিনিময়ে ইরানের উপরে নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই তুলে নেয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন সরকার চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় এবং ইরানের উপরে পুনরায় অবরোধ আরোপ করে। এর প্রতিবাদে ইরান আবারও ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করা শুরু করে। প্রায় দুই বছর ধরে প্রকাশ্যেই তারা ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করছে। জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন ইরানের সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে চাইলেও গত এক বছর ধরে তা থেমে রয়েছে।

গত ২০শে ফেব্রুয়ারি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি সাংবাদিকদের বলেন যে, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের ইস্যুগুলি ‘টেকনিক্যাল’ আলাপ এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতে না তুলে মিডিয়ার সামনে তুলে নিয়ে আসার অর্থ হলো ‘আইএইএ’ তাদের পেশাদারিত্ব হারিয়েছে। একইসাথে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার মুখপাত্র বেহরুজ কামালভান্দি সরাসরিই বলেছেন যে, ইরান কখনোই ৬০ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করেনি। পহেলা মার্চ ইরানের বার্তা সংস্থা ‘ইরনা’কে ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেন যে, ‘আইএইএ’র নমুনা এতটাই নগন্য যে, তা খালি চোখে দেখাই সম্ভব নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কি পরিমাণ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করার পর মজুত করা হয়েছে।

তবে ২৬শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন মিডিয়া ‘সিবিএস’এর সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স ‘সিআইএ’র প্রধান উইলিয়াম বার্নস বলেন যে, তাদের বিশ্বাস ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এখনও পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেননি; যা কিনা ২০০৩ সালের পর থেকে ইরান স্থগিত করেছে। তবে এর বাইরে আরও দু’টা যায়গায় তারা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। প্রথমতঃ ইরান যদি ইচ্ছা করে, তাহলে কয়েক সপ্তাহের মাঝেই ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচমেন্ট’ পেরিয়ে যেতে পারবে। আর দ্বিতীয়তঃ তারা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকেও যথেষ্ট অগ্রগামী হয়েছে। কাজেই যদিও ইরান এখনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি, তথাপি অন্যান্য ব্যাপারগুলি পুরো পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জিং করে ফেলেছে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তা কলিন কাহল মার্কিন কংগ্রেসের কমিটির সামনে বলেন যে, ইরানের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতার মাঝে যে দূরত্ব, তা ১২ মাস থেকে কমে গিয়ে ১২ দিনে নেমে এসেছে।

পহেলা মার্চ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, বাইডেন প্রশাসনের নীতি হলো, ইরানকে কোন অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্র পেতে না দেয়া। এই লক্ষ্যে তাদের বিশ্বাস কূটনীতিই সবচাইতে ভালো পদ্ধতি। কারণ এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন; যাতে করে ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র পাবার মতো অবস্থানে যেতে না পারে। তবে তারা অন্য কোন পদ্ধতিই হিসেব থেকে বাদ দেননি। তবে প্রাইস বলেন যে, ২৮শে ফেব্রুয়ারির ‘আইএইএ’র প্রতিবেদনে কি ছিল, সেটা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারবেন না; কারণ সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। তবে তারা ইরানের প্রায় ৮৪ শতাংশ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচমেন্ট’এর ব্যাপারে মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলি দেখেছেন। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপিয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশগুলির সাথে কথা বলেই এগুবে।

তবে ইস্রাইলি ও মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ইরানের হাতে ১০টা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে যথেষ্ট ‘এনরিচড’ ইউরেনিয়াম থাকবে। ইরান যদি রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করে তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার উপর ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সিদ্ধান্ত এগিয়ে আসবে। যদিও রাশিয়া ইরানের কাছে ‘এস-৪০০’ বিক্রি করার কথা প্রকাশ করেনি, তথাপি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এবং ইরান কাছাকাছি চলে এসেছে। এরকম একটা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ইরানে কার্যকর হতে দুই বছরের কম সময় লাগতে পারে। ইরানি পার্লামেন্টের একজন সদস্য বলেছেন যে, মার্চ মাসেই ইরান রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক ‘সুখোই-৩৫’ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে। ইরান ইতোমধ্যেই রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেয়েছে। ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক সপ্তাহ আগেই তেল আভিভের এক নিরাপত্তা আলোচনায় বলেন যে, যত বেশি সময় অপেক্ষা করা হবে, ইরানের উপর হামলার ব্যাপারটা ততটাই কঠিন হয়ে যাবে। ব্রিটিশ সামরিক থিংকট্যাঙ্ক ‘জেনস’এর জেরেমি বিনি বলছেন যে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইস্রাইল আকাশ থেকে আকাশে জ্বালানি সরবরাহ করার বিমান পেতে চলেছে, যা ইরানের অভ্যন্তরে ইস্রাইলের হামলা করার সক্ষমতাকে অনেকটাই এগিয়ে নেবে।

‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ইস্রাইলের পক্ষ থেকে ইরানে হামলার কথা বলাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও ১৯শে ফেব্রুয়ারি বলেন যে, ইস্রাইলের যা করা প্রয়োজন, তাদের তা করা উচিৎ; যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সমর্থন দেবে। কিন্তু ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই হিসেব করে চলছে। কারণ ইরানের উপর যেকোন হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করবে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ দ্বন্দ্বের মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা যুদ্ধ মোটেই কেউই চাইছে না।

2 comments:

  1. ইউএস চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে, ইরানের উপর স্যাংশন দিয়েছে। তবুও ইরানকে চুক্তি মোতাবেক ইউরেনিয়াম এন্রিচ করতে পারবে না / বোমা বানাতে পারবে না।
    এটাই ওয়েস্টার্ন হিপোক্রেসিকে তুলে ধরে। like - Powerই সব কিছু।

    তবে ইস্রায়েল ইউএস মদতে যদি হামলা করে ইরান কি কি ভাবে আটাকাবে/ বদলা নেবে?

    ইস্রায়েল- ইউএস মিত্ররা কি আদোও হামলা করবে? কারন তাদের হাতে সময় খুব কম।

    ReplyDelete
  2. এটাই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার নিয়ম। এর আগে ব্রিটিশরাও কম করেনি। এই নিয়মগুলি তাদেরই বানানো এবং তারা ইচ্ছে করলেই তাদের তৈরি করা নিয়ম ভাঙতে পারে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র বহু দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে; কেউ কিছু বলতে পারেনি। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন অন্য দেশকে এরকম কাজ করার অনুমতি দিয়ে থাকে। যেমন বিভিন্ন সময়ে ভারতকে (মালদ্বীপ, সেইশেল, শ্রীলংকা) দিয়েছে। আবার ইস্রাইলকেও একইভাবে এই অনুমতি দেয়া হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে ইস্রাইল ১৯৬৭ সালে মিশর, জর্দান, ইরাক, সিরিয়ায় সামরিক হামলা করেও তার কোন ক্ষতি হয়নি। আরও বহুবার ইস্রাইল লেবানন, সিরিয়াতে হামলা করেছে; ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে।

    এই সবগুলিই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অংশ। তারা সকলকে এগুলি মেনে নিতে বাধ্য করে। এই মেনে নেয়ার অংশ হিসেবেই ইরান পশ্চিমাদের সাথে আলোচনা করে পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করেছিল ২০১৫ সালে। শুধু তাই নয়, ইরানকে গোপনে এফ-১৪ যুদ্ধবিমানের স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ করার জন্যে বেশ কয়েক বছর আগে ইস্রাইলের আদালতে নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে শুনানি হয়েছে। আবার রাশিয়া এবং চীনের সাথেও স্বার্থের বন্ধুত্ব করতে হয়েছে; যেখানে ইরান রাশিয়া এবং চীনের বাকি সকল নীতির (যেমন উইঘুর) ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে। অর্থাৎ ইরানকে অস্তিত্ব রক্ষায় অনেক যায়গাতেই ছাড় দিতে হয়েছে। ছাড় না দিলে ইরান হয়তো বহু আগেই পারমাণবিক শক্তির মালিক হতে পারতো।

    যাই হোক, যেটা লেখা থেকে পরিষ্কার হবার কথা তা হলো, ইরানের হামলা থামাবার সক্ষমতা থাকুক আর না থাকুক, মধ্যপ্রাচ্যে কেউই আরেকটা যুদ্ধ চাইছে না। আর ইরানের বিরুদ্ধে হামলা করলে ইরান হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করে ইস্রাইলের ভেতর হামলা করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মার্কিন স্থাপনায় হামলা করবে। এগুলি একটা বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। যুক্তরাষ্ট্র এই মুহুর্তে রাশিয়া এবং চীনকে নিয়ে ব্যস্ত। ইরানকে নিয়ে ব্যস্ত হবার ইচ্ছা তার থাকার কথা নয়।

    ReplyDelete