Saturday 25 February 2023

ইউক্রেন যুদ্ধ… চীন আসলে কোন পক্ষে?

২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩

মস্কোতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে চীনা শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইয়ি। সামনের দিনগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে একটা দ্বন্দ্ব হতে চলেছে সেব্যাপারে চীন নিশ্চিত। এমতাবস্থায় চীন রাশিয়ার মতো একটা বন্ধুকে পাশে চাইছে। তাই নিরপেক্ষ থাকার কথা বলেও চীনারা কিছুটা রাশিয়ার দিকেই ঝুঁকে রয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে চীন ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কাজ করতে ইচ্ছুক। ২৪শে ফেব্রুয়ারি চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নীতিপত্রে যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের অবস্থানকে তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয় যে, এই যুদ্ধ কারুর জন্যেই সুবিধা বয়ে নিয়ে আসছে না। কাজেই সকলেরই উচিৎ স্বাভাবিক চিন্তা প্রয়োগ করা, যাতে করে এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলে। ‘আল জাজিরা’র এই বিশ্লেষণে চীনা প্রস্তাবের বিশেষ দিকগুলিকে তুলে ধরা হয়; যার মাঝে ছিল মানবিক করিডোরের মাধ্যমে বেসামরিক নাগরিকদের সরানোর ব্যবস্থা করা, সারা দুনিয়াতে খাদ্যশষ্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে শস্য রপ্তানি পুনরায় চালু করা। তবে এর মাঝে চীনারা বহুকাল ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের যে অবস্থানকে তুলে ধরেছে, সেগুলিকেই নিয়ে আসা হয়; যেমন, যেকোন দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং ভৌগোলিক সীমানার নিশ্চয়তা দেয়া। একইসাথে প্রস্তাবে পারমাণবিক কেন্দ্রগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। তবে একইসাথে সেখানে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা’ পরিহার করতে বলা হয়; যার মাধ্যমে চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকেই বোঝায়।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে চীনের এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তবে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, এখানে শুধুমাত্র ইউক্রেনের সীমারেখাই লঙ্ঘন করা হয়েছে। ইউক্রেনের ভূমি ছেড়ে যেতে রুশদের রাজি করাতে তিনি চীনাদের সচেষ্ট দেখতে চান। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সিনিয়র উপদেষ্টা মিখাইলো পদোলিয়াক এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ইউক্রেনের সীমানা থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার না করেই যদি কোন যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়, তাহলে সেটা শান্তি হবে না; হবে যুদ্ধকে একটা অবস্থানে থামিয়ে রাখা।

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’ বলছে যে, চীনা নীতিপত্রের অধিকাংশ অংশেই পশ্চিমাদের টার্গেট করা হয়েছে এবং পশ্চিমাদের সামরিক জোটের পরিধি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান ‘সিএনএন’কে বলেন যে, চীনা প্রস্তাবে যখন বলা হয়েছে সকল দেশের সার্বভৌমত্বকে মেনে চলা উচিৎ, তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেয়া উচিৎ ছিল যে। কারণ ইউক্রেন, ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই রাশিয়ার উপরে হামলা করেনি; হামলা করেছেন পুতিন। অপরদিকে বেইজিংএ ইইউএর প্রতিনিধি সাংবাদিকদের বলেন যে, চীনের এই প্রস্তাব কোন শান্তি প্রস্তাব নয়। তবে ইইউ এই প্রস্তাবকে খুঁটিয়ে দেখছে।

‘সিএনএন’ বলছে যে, এর আগের সপ্তাহেই মিউনিখে নিরাপত্তা আলোচনাতে চীনা শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইয়ি এই নীতিপত্রের ব্যাপারে কথা বলেন। একই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ওয়াং মস্কো সফর করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে দেখা করেন। পুতিন তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেন এবং দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে দুই দেশের সহযোগিতার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। তবে ওয়াং তার বক্তব্যে বলেন যে, দুই দেশ বিভিন্ন সময়ে সমস্যার মাঝ দিয়ে যায়; যেখানে সম্পর্কোন্নয়নে নতুন সুযোগের সৃষ্টি হয়। তিনি উভয় দেশের পরিবর্তনগুলিকে স্বেচ্ছায় তুলে ধরে সেগুলির ব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা নেয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকার কথা বলেন। অস্ট্রেলিয়ার ‘নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি’র আলেক্সান্ডার করোলেভ ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, ওয়াং তার ইউরোপ সফরে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং হাঙ্গেরি গিয়েছে; যে দেশগুলি ইউক্রেনকে সহায়তা করার ব্যাপারে কিছুটা হলেও দোদুল্যমান ছিল। চীনারা হয়তো দেখতে চাইছে যে, ইউরোপের কিছু অংশকে তারা তাদের পক্ষে আনতে পারে কিনা।
 
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের সাথে চীনা শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইয়ি। ওয়াং তার ইউরোপ সফরে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং হাঙ্গেরি গিয়েছে; যে দেশগুলি ইউক্রেনকে সহায়তা করার ব্যাপারে কিছুটা হলেও দোদুল্যমান ছিল। চীনারা হয়তো দেখতে চাইছে যে, ইউরোপের কিছু অংশকে তারা তাদের পক্ষে আনতে পারে কিনা।

 যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইয়েল ‘ল স্কুল’এর ‘পল সাই চায়না সেন্টার’এর ফেলো নিকোলাস বেকেলিন ‘আল-জাজিরা’কে বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চীন বড় ধরণের সমস্যায় পড়েছে; তার অর্থনীতি বিপদে রয়েছে, ইউরোপের সাথে তার সম্পর্ক টানাপোড়েনে পড়েছে। একইসাথে সামনের দিনগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে একটা দ্বন্দ্ব হতে চলেছে সেব্যাপারে চীন নিশ্চিত। এমতাবস্থায় চীন রাশিয়ার মতো একটা বন্ধুকে পাশে চাইছে। তাই নিরপেক্ষ থাকার কথা বলেও চীনারা কিছুটা রাশিয়ার দিকেই ঝুঁকে রয়েছে।

সাংহাইএর ‘ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিট’র ঝাং শিন ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, যদিও পশ্চিমারা বলছে যে, চীনারা রাশিয়াকে অস্ত্র দিতে চাইছে, তথাপি সেটা যে চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধ, সেব্যাপারে চীনারা অবগত রয়েছে; কারণ চীনের বেশিরভাগ বাণিজ্যই পশ্চিমাদের সাথে। একইসাথে তা অনেক দেশকেই যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছে নিয়ে যাবে। যেটা বরং সম্ভাব্য তা হলো, চীনারা রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য চালিয়ে যাবে; যা রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের বিরুদ্ধাচরণ। ‘জার্মান মার্শাল ফান্ড’এর সিনিয়র ফেলো এন্ড্রু স্মল ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, চীনারা হয়তো ঘুরপথে রাশিয়াকে সহায়তা দিতে পারে; যাতে করে তারা বলতে পারে যে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না। যেমন উত্তর কোরিয়ার মাধ্যমে এমন সকল প্রযুক্তি তারা রাশিয়াকে সরবরাহ করতে পারে, যেগুলি সামরিক এবং বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। তবে যুদ্ধ যেভাবে চলছে, তাতে একটা সময় চীনাদেরকে ঠিক করতেই হবে যে, তারা রাশিয়াকে সহায়তা দিতে আরও কতদূর যাবে।

‘বিবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এক বছর ধরেই পশ্চিমারা চাইছিল চীনারা যেন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে সহায়তা দেয়। এখন চীনের প্রস্তাব আসার পর সেটা পশ্চিমাদের মনঃপুত হয়নি। পশ্চিমারা হয়তো চীনাদের প্রস্তাবে খুশি হয়নি; তবে পশ্চিমাদের রাজি করানোটা হয়তো বেইজিংএর লক্ষ্য ছিল না। বেইজিং এই নীতিপত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার কথা উল্লেখ করে উন্নয়নশীল বিশ্বকেই বুঝিয়েছে; যেখানে চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিকল্প হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে চাইছে। উন্নয়নশীল বিশ্ব যখন ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে উৎকণ্ঠার সাথে চেয়ে রয়েছে, তখন চীনারা মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার একটা বিকল্প দেখাবার চেষ্টা করছে। আলেক্সান্ডার করোলেভ বলছেন যে, চীনারা আরও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, পশ্চিমাদের সাথে দ্বন্দ্বে রাশিয়া একা নয়; একইভাবে চীনের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের সময়েও চীনারা একা থাকবে না। চীনারা ইচ্ছে করলে আরও আগেই এই প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারতো; ঠিক যুদ্ধের বর্ষপূর্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতো না।

No comments:

Post a Comment