Tuesday 10 January 2023

ইউক্রেনের জন্যে পশ্চিমা ট্যাংক … কত বড় ঘটনা এটা?

১০ই জানুয়ারি ২০২৩
 
ফরাসি সেনাবাহিনীর 'এএমএক্স-১০আরসি' 'হাল্কা ট্যাংক'। ইউক্রেনকে ফ্রান্সের ‘হাল্কা ট্যাংক’ এবং ব্রিটেনের সম্ভাব্য ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়ার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং জার্মানির উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের ইউক্রেনকে ট্যাংক দেয়ার পক্ষে সমর্থন জার্মানিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলবে; কারণ এতে জার্মানি রাশিয়াকে তার নিরাপত্তার প্রতি প্রধানতম হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিতে বাধ্য হবে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ গত ৪ঠা জানুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির সাথে ঘন্টাখানেক ফোনালাপের পর ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বলা হয় যে, ফ্রান্স ইউক্রেনকে ‘হাল্কা ট্যাংক’ দিতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি একই দিনে এক টুইটার বার্তায় ‘হাল্কা ট্যাংক’ দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান। পরদিন ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, ফ্রান্স ইউক্রেনকে ‘এএমএক্স-১০আরসি’ নামের সাঁজোয়া যান দিচ্ছে; যা ফরাসিরা ‘হাল্কা ট্যাংক’ নামে আখ্যা দিয়ে থাকে। ফ্রান্সের এই ঘোষণার পর থেকে একদিকে যেমন ট্যাংকের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, তেমনি পশ্চিমা আর কোন কোন দেশ ফ্রান্সের উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে, তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা কল্পনা।

ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ফ্রান্সের ‘লে মন্ড’ পত্রিকা বলছে যে, ‘এএমএক্স-১০আরসি’ সাঁজোয়া যানগুলি ১০৫মিঃমিঃ কামান দ্বারা সজ্জিত। এর বর্ম পদাতিক বাহিনীর হাল্কা অস্ত্রের আঘাত সহ্য করতে পারে। তবে ট্যাংকের ‘ট্র্যাক’এর পরিবর্তে এর রয়েছে ৬টা রাবারের চাকা। ১৯৮১ সাল থেকে সার্ভিসে আসা ২’শ ৪৫টা গাড়ি বর্তমানে ফরাসি সেনাবাহিনীতে ‘জাগুয়ার’ নামের আরেকটা সাঁজোয়া গাড়ি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তবে গত চার দশকে এই গাড়িগুলিকে আরও উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এম-১ আব্রামস’ এবং জার্মানির ‘লেপার্ড-২’ ট্যাংক চাওয়া হচ্ছে। ফ্রান্স এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে ‘সীজার’ স্বয়ংচালিত আর্টিলারি, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘ক্রোটেইল’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে। একইসাথে ফ্রান্স নিজ দেশে ২ হাজার ইউক্রেনিয় সেনাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

‘বিজনেস ইনসাইডার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ফরাসি ‘এএমএক্স-১০আরসি’ সাঁজোয়া গাড়িগুলি ট্যাংকের মতো অতটা শক্তিশালী বর্ম দ্বারা সজ্জিত নয়। আর এর কামানও অন্যান্য ট্যাংকের ১২০মিঃমিঃ বা ১২৫মিঃমিঃ কামানের চাইতে অপেক্ষাকৃত স্বল্প ক্ষমতার। ১৬ টন ওজনের এই ‘হাল্কা ট্যাংক’ ভালো রাস্তায় প্রায় ৬০ কিঃমিঃ গতিতে চলতে সক্ষম। অপরদিকে মার্কিন ‘আব্রামস’ ট্যাংকগুলি প্রায় ৭০ টন ওজনের এবং সেগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে সচল রাখার জন্যে বেশ জটিল সাপ্লাই চেইনের প্রয়োজন হয়। ‘এএমএক্স-১০আরসি’ গাড়িগুলি বিপক্ষের ট্যাংক ধ্বংস করার জন্যে তৈরি হয়নি। বরং শত্রুর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে দ্রুত সড়ে পড়ার জন্যে ডিজাইন করা হয়েছে। তবে অন্যান্য সাঁজোয়া যানের সাথে ‘এএমএক্স-১০আরসি’র পার্থক্য হলো, যেখানে অন্যান্য গাড়িগুলি ৩০ মিঃমিঃ বা ৪০ মিঃমিঃ কামান বহণ করে, ‘এএমএক্স-১০আরসি’ বহণ করে ১০৫ মিঃমিঃ কামান। এই কামান শত্রুর ট্যাংক এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যান ধ্বংস করতে সক্ষম; আর এই কামানের জন্যেই ফরাসিরা হয়তো এগুলিকে ‘হাল্কা ট্যাংক’ বলছে।

১৯৭০এর দশকের প্রযুক্তির এই ‘হাল্কা ট্যাংক’গুলি ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে ফ্রান্স এবং ইউক্রেন উভয়েই এই গাড়িগুলিকে যে ‘হাল্কা ট্যাংক’ বলছে, তা বেশ গুরুত্ববহ। পশ্চিমা দেশগুলি এখনও ‘আব্রামস’এর মতো ট্যাংক ইউক্রেনকে দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এর ফলে ইউক্রেনকে সোভিয়েত ডিজাইনের ট্যাংকের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে; যার বেশগুলি আবার যুদ্ধের মাঝে রুশদের হাত থেকে দখল করা। ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সাঁজোয়া যান দিতে রাজি হয়েছে। ফ্রান্সের ঘোষণার পরপরই ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘এম-২ ব্র্যাডলি’ এবং জার্মানি ‘মারডার’ সাঁজোয়া যান দেয়ার ঘোষণা দেয়। এই গাড়িগুলিতে চাকার স্থলে রয়েছে ‘ট্র্যাক’। এগুলি ফরাসি গাড়িগুলি থেকে আরও ভারি হলেও এগুলির কামান তত শক্তিশালী নয়। তবে এগুলি ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে সক্ষম।

 
জার্মান সেনাবাহিনীর 'লেপার্ড-২' ট্যাংক। ইউরোপের ইতিহাস বলে যে, জার্মানি এবং রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি সামরিক অবস্থান ইউরোপকে ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে ফেলেছে। জার্মানির উপরে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের এহেন চাপ সৃষ্টি ইইউএর অস্তিত্বকে যেমন প্রশ্নের মাঝে ফেলতে পারে, তেমনি ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তাকেও অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দিতে পারে।

এদিকে পশ্চিমা সূত্রের বরাত দিয়ে গত ৯ই জানুয়ারি ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’ বলে যে, ব্রিটেন কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইউক্রেনকে নিজেদের সেনাবাহিনীর ১০টার মতো ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়ার কথা চিন্তা করছে। ১৯৯৪ সালে সার্ভিসে আসা এই ট্যাংকগুলি প্রায় ৬২ টন ওজনের এবং এর রয়েছে শক্তিশালী ১২০ মিঃমিঃ কামান। তবে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও এব্যাপারে চুপ রয়েছে। এই ট্যাংকগুলি যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না। তবে তা ট্যাংকের ব্যাপারে পশ্চিমা সিদ্ধান্তহীনতাকে পরিবর্তন করতে সহায়তা দেবে। এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য হলো অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত দেশ, বিশেষ করে জার্মানিকে তার ‘লেপার্ড’ ট্যাংকগুলি এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তার ‘আব্রামস’ ট্যাংকগুলি দিতে প্রভাবিত করা। জার্মানি ছাড়াও পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং স্পেন জার্মান ‘লেপার্ড’ ট্যাংক ব্যবহার করে। পোল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ড ইউক্রেনকে এই ট্যাংক দিতে ইচ্ছুক হলেও এগুলিকে পুনরায় রপ্তানি করতে গেলে জার্মানির অনুমতি প্রয়োজন। জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে ৯ই জানুয়ারি বলা হয় যে, ইউক্রেনকে জার্মানি ট্যাংক দেয়ার কথা চিন্তা করছে না। গত বছর ব্রিটিশ সরকার পোল্যান্ডকে ১৪টা ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়; যাতে করে পোল্যান্ড ইউক্রেনকে তাদের বহরে থাকা সোভিয়েত ডিজাইনের ‘টি-৭২’ ট্যাংকগুলি দিয়ে দিতে পারে। তবে প্রাক্তন ব্রিটিশ ট্যাংক কমান্ডার কর্নেল হেমিশ ডে ব্রেটন গর্ডনের মতে, ‘চ্যালেঞ্জার’, ‘লেপার্ড’ বা ‘আব্রামস’এর মতো ট্যাংকগুলি সোভিয়েত ডিজাইনের ট্যাংক থেকে অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সুরক্ষিত, নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুতগামী। এগুলি ইউক্রেনকে দেয়ার অর্থ হলো, রুশদের কাছে বার্তা দেয়া যে, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে যেকোনকিছুই দিতে প্রস্তুত।

ইউক্রেনকে ফ্রান্সের ‘হাল্কা ট্যাংক’ এবং ব্রিটেনের সম্ভাব্য ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়ার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং জার্মানির উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই জার্মানি রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাত এড়াতে ইউক্রেনকে বড় কোন সহায়তা দেয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করার ব্যাপারেও জার্মানি সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল। ফ্রান্সও নীতিগতভাবে জার্মানির কাছাকাছিই থেকেছে। তবে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের ইউক্রেনকে ট্যাংক দেয়ার পক্ষে সমর্থন জার্মানিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলবে; কারণ এতে জার্মানি রাশিয়াকে তার নিরাপত্তার প্রতি প্রধানতম হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিতে বাধ্য হবে। ইউরোপের ইতিহাস বলে যে, জার্মানি এবং রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি সামরিক অবস্থান ইউরোপকে ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে ফেলেছে। জার্মানির উপরে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের এহেন চাপ সৃষ্টি ইইউএর অস্তিত্বকে যেমন প্রশ্নের মাঝে ফেলতে পারে, তেমনি ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তাকেও অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দিতে পারে।

No comments:

Post a Comment