Friday 11 November 2022

রুশ সেনাদের খেরসন শহর ছেড়ে যাবার কৌশলগত গুরুত্ব

১২ই নভেম্বর ২০২২
 
১১ই নভেম্বর ২০২২। খেরসনের সিটি সেন্টারে ইউক্রেনিয়রা পতাকা উত্তোলন করছে। খেরসনে ইউক্রেনের বিজয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা কোয়ালিশনকে টিকিয়ে রাখবে এবং মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা নিয়ন্ত্রণ নেবার আগেই ইউক্রেনের জন্যে আরও অস্ত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

ইউক্রেন যুদ্ধে আরও একটা বড় ঘটনা ঘটলো রুশ সেনাদের খেরসন শহর ছেড়ে যাবার সাথেসাথে। বেলজিয়ামের আকৃতির ইউক্রেনের দক্ষিণের খেরসন প্রদেশ দখল করে নেবার পরে মস্কো গত সেপ্টেম্বরের শেষে ইউক্রেনের আরও তিনটা প্রদশসহ রাশিয়ার মূল ভূখন্ডের অংশ বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খেরসন শহরের উত্তর-পূর্ব থেকে ইউক্রেনিয় আক্রমণে দেশটার সবচাইতে বড় এবং চওড়া নীপার নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত খেরসন শহরে রুশ সেনাদের অবস্থান হুমকির মাঝে পড়ে যায়। একারণে গত ৯ই নভেম্বর রুশ কর্মকর্তারা খেরসন শহর ছেড়ে যাবার জন্যে রুশ ইউনিটিগুলিকে নির্দেশ দেয়। অনেকেই ধারণা করছিলেন যে, খেরসন শহর ছেড়ে না আসলে কয়েক হাজার রুশ সেনা নদীর ওপাড়ে আটকা পড়তে পারতো। এর মাধ্যমে রুশরা নীপার নদীর পশ্চিম তীরে তাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানটা হারালো। ১১ই নভেম্বর রুশ সেনারা শহর পুরোপুরি ছেড়ে যাবার আগেই ইউক্রেনের কর্মকর্তারা খেরসনে প্রবেশ করে সিটি হলের উপরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। তবে রুশদের মাঝে অনেকের জন্যেই খেরসন ছেড়ে আসাটা ছিল কষ্টকর এবং অপমানজনক। রুশ সাংবাদিক ইউরি কোতিওনোক এক টেলিগ্রাম পোস্টে প্রশ্ন করেন যে, রুশরা কেন সেখানে সকল কিছু ধ্বংস করে এবং জ্বালিয়ে দিয়ে আসলো না?

নীপার নদীর উপরে নোভা কাখভকা বাঁধও ইউক্রেনিয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই বাঁধ ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে সেচের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর সবচাইতে বড় গুরুত্ব হলো এখান থেকে খালের মাধ্যমে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পানি পৌঁছায়। ২০১৪ সালে রুশদের দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপে বড় কোন পানির উৎস নেই। ইউক্রেনিয়রা ক্রিমিয়াতে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। সেজন্যে যুদ্ধের শুরুতেই রুশদের একটা লক্ষ্য ছিল ক্রিমিয়াতে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। এখন ইউক্রেনিয়রা আবারও ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। ইউক্রেনিয় বিশ্লেষক আলেক্সেয় কুশ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, খেরসন শহর নীপার নদীর নদীপথ এবং এর উপরে শিপইয়ার্ডগুলির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও রুশরা এখনও নীপার নদী থেকে কৃষ্ণ সাগরের প্রবেশস্থলে ‘কিনবার্ন স্পিট’এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জেনারেল এবং মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর মিক রায়ান টুইটারে এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, রুশদের খেরসন ছেড়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, রুশরা আত্মসমর্পণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের ইউনিটগুলিকে পুনর্গঠন করছে। রুশরা দুর্বল হলেও তাদের দখলীকৃত অঞ্চলগুলিকে তারা ছেড়ে দেয়ার চিন্তায় নেই। খেরসন থেকে সরিয়ে নেয়া সেনাদেরকে কোথায় মোতায়েন করা হয়েছে, সেটা দেখে বোঝা যাবে যে, রুশ সেনাদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং রুশ জেনারেল সুরভকিন ২০২৩ সালের শুরুতে কিসের উপরে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত কম এলাকা রক্ষা করতে হবে বলে সুরভকিনের পক্ষে তারা সেনাদের সংগঠিত করা কিছুটা সহজ হবে। আর রুশদের অবস্থান শক্ত করার অর্থ হলো যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হওয়া।

 
রুশদের খেরসন ছেড়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, রুশরা আত্মসমর্পণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের ইউনিটগুলিকে পুনর্গঠন করছে। রুশরা দুর্বল হলেও তাদের দখলীকৃত অঞ্চলগুলিকে তারা ছেড়ে দেয়ার চিন্তায় নেই। অপেক্ষাকৃত কম এলাকা রক্ষা করতে হবে বলে সুরভকিনের পক্ষে তারা সেনাদের সংগঠিত করা কিছুটা সহজ হবে। আর রুশদের অবস্থান শক্ত করার অর্থ হলো যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হওয়া।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, খেরসন শহরে রুশরা বিলবোর্ড লাগিয়েছিল, যেখানে রুশ কর্মকর্তাদের বার্তা দিয়েছে যে, ‘রাশিয়া এখানে থাকবে চিরকালের জন্য’। কিন্তু ১০ই নভেম্বর যখন হাজার হাজার রুশ সেনা খেরসন ছেড়ে যাচ্ছিলো, তখন ইউক্রেনিয়রা রুশদের বার্তাগুলিকে কটাক্ষ করছে। যদিও ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলছেন যে, খেরসন রাশিয়ার অংশ ছিল এবং এতে কোন পরিবর্তন হবে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এর মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধে বড় রকমের পরিবর্তন আসলো এবং রুশ ভূরাজনৈতিক সন্মান আবারও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার’ বা ‘আইএসডব্লিউ’ এক বিশ্লেষণে বলছে যে, আসন্ন শীতকাল অপেক্ষাকৃত খারাপভাবে সজ্জিত রুশ সেনাদের জন্যে বেশি কঠিন হবে। অপরদিকে ইউক্রেনিয়রা হয়তো শীতকালেও তাদের আক্রমণ চালিয়ে যেতে পারে। শীতকালে মাটি শক্ত হয়ে যাবার ফলে শরৎকালের কর্দমাক্ত সময়ের তুলনায় ভূমির উপর দিয়ে চলাচল আরও সহজ হবে। ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো রব লী টুইটারে এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, রুশ সেনারা মনোবলের দিকে থেকে ইউক্রেনিয়দের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। একারণে শীতকালের খারাপ আবহাওয়াকেও ইউক্রেনিয়রা সুযোগ হিসেবে নিয়ে তাদের পুনর্দখল করা অঞ্চলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চাইতে পারে।

জার্মানির ‘ব্রিমেন ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর নিকোলায় মিত্রোখিন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, খেরসন হারাবার পরে ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলে রুশদের আক্রমণ করার সক্ষমতা খুবই কমে গেলো। এখন রুশদের হাতে রয়েছে অর্ধ্বচন্দ্রাকৃতির একটা ভূখন্ড। ইউক্রেনিয় সেনারা পরবর্তীতে খেরসন প্রদেশের পূর্বদিকে আজভ সাগরের তীরবর্তী মেলিটোপোল, বেরদিয়ানস্ক এবং মারিউপোলের দিকে আক্রমণ চালালে রুশরা বর্তমানে তাদের হাতে থাকা খেরসন প্রদেশের অঞ্চলগুলিকেও ছেড়ে দিয়ে ক্রিমিয়াতে অবস্থান নিতে বাধ্য হবে। একইসাথে রুশরা যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনের দক্ষিণের ওডেসা বন্দর এবং মলদোভার বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্রান্সনিস্ত্রিয়া অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে নেবার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, তা এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্ট্রাল এশিয়া ডিউ ডিলিজেন্স’এর প্রধান আলিশার ইলখামমভ বলছেন যে, ইউক্রেনে রুশদের সামরিক বিপর্যয়ে রাশিয়ার সন্মান যেমন আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, তেমনি তা মধ্য এশিয়াতে ভূরাজনৈতিক শূণ্যতা তৈরি করেছে। এই শূণ্যতার জায়গাটা নিতে যাচ্ছে চীন এবং তুরস্ক।

জেনারেল মিক রায়ান বলছেন যে, খেরসন ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিতে রুশদেরকে ইউক্রেনের উপরে কৌশলগত হামলা করে যেতে হবে, যাতে করে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে থাকে। এক্ষেত্রে ইরানের কাছ থেকে আমদানি করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কাজে আসতে পারে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক লেখায় ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর ফেলো ম্যাক্স বুট বলছেন যে, খেরসনে ইউক্রেনের বিজয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা কোয়ালিশনকে টিকিয়ে রাখবে এবং মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা নিয়ন্ত্রণ নেবার আগেই ইউক্রেনের জন্যে আরও অস্ত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। রুশ বিশ্লেষক পাভেল লুজিন ‘দ্যা ইনসাইডার’এর এক লেখায় বলছেন যে, রাশিয়ার সামনে এখন কোন কষ্টহীন পথ নেই। যদি ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তাহলে হয়তো বাকি দুনিয়া থেকে আরও বেশি দূরে সরে যেতে হতে পারে। আর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলে বড় কোন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।

No comments:

Post a Comment