১৯শে নভেম্বর ২০২২
গত ১৭ই নভেম্বর মার্কিন সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জয়েন্ট চীফ অব স্টাফএর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ইউক্রেন এই মুহুর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। আর এই অবস্থাতেই তারা যদি আলোচনার টেবিলে বসে, তাহলে রুশরা হয়তো কোন একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগুতেও পারে। জেনারেল মিলির কথাগুলি ওয়াশিংটনের ইউক্রেন নীতিতে নতুন সুর যোগ করেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
জেনারেল মিলি বলেন যে, রুশরা প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশি সেনা নিয়ে ইউক্রেন হামলা করে বহু হতাহতের শিকার হয়েছে। কিন্তু তারপরেও যে বাহিনী তারা ইউক্রেনে রেখেছে, তা বেশ শক্তিশালী। আর এর সাথে নতুন করে মোবিলাইজ করা সেনারা যুক্ত হচ্ছে। ইউক্রেনিয়রা রুশদের আক্রমণ সফলভাবে ঠেকাতে পেরেছে; এবং এরপর তারা আক্রমণে গিয়ে খারকিভ এবং খেরসনের বেশকিছু এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে। তবে এই পুনরুদ্ধার করা ভূমি রুশদের দখলীকৃত ভূমির খুব বড় কোন অংশ নয়। রুশদেরকে সামরিকভাবে ইউক্রেনের দখলীকৃত ভূমি থেকে উৎখাত করাটা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। কাজেই ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ক্রিমিয়া সহ ইউক্রেনের পুরো ভূমি থেকে রুশদেরকে বিতাড়িত করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার ইউক্রেন ছেড়ে যাবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখন পর্যন্ত রুশ সামরিক বাহিনী যতটা ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছে, তাতে তারা আলোচনার মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগুলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।
‘সিএনএন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এক সপ্তাহ আগেও জেনারেল মিলি বলেছেন যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেলে ইউক্রেনিয়দের তা হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না। অপদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান বলছেন যে, ওয়াশিংটন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখবে। শান্তিচুক্তির জন্যে টেবিলে বসা হবে কিনা, সেটা ইউক্রেনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোন প্রভাব রাখবে না। জেনারেল মিলি এবং জেইক সুলিভানের এহেন ধোঁয়াশা বক্তব্যে ইউক্রেনে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে, তারা কার কথা শুনবে?
প্রায় একই সময়ে ঘটে যাওয়া আরেকটা ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, ওয়াশিংটন প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনের যুদ্ধকে আরও বড় কোন যুদ্ধের দিকে নিতে ইচ্ছুক নয়। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলে যে, ইউক্রেনের আকাশ থেকে একটা ক্ষেপণাস্ত্র এসে ইউক্রেনের প্রতিবেশী ন্যাটো দেশ পোল্যান্ডে আছড়ে পড়েছে এবং সেখানে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ‘সিএনএন’ বলছে যে, এই খবরটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পৌঁছায় যখন তিনি ‘জি-২০’ শীর্ষ বৈঠকের জন্যে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অবস্থান করছিলেন। খবরটা দিতে ভোর রাতে প্রেসিডেন্টকে ডেকে তোলা হয় এবং তিনি তার কর্মকর্তাদের ছাড়াও পোলিশ প্রেসিডেন্ট এবং ইউক্রেনের নেতৃত্বের সাথে কথা বলে তাদেরকে শান্ত থাকার জন্যে উপদেশ দেন।
‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ন্যাটো সদস্য দেশ হিসেবে পোল্যান্ডের উপরে ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ার এই ঘটনা যদি রুশদের হামলা হিসেবে প্রমাণ হয়, তাহলে প্রশ্ন আসবে যে, জোটের ‘আর্টিকেল-৫’ অনুসারে ন্যাটোভুক্ত বাকি দেশগুলি পোল্যান্ডকে সামরিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসবে কিনা। এই আর্টিকেল অনুসারে জোটের একটা দেশের উপরে হামলা হলে বাকিরাও তাদের উপরে হামলা হয়েছে বলে ধরে নেবে। তবে ঘটনার ২৪ ঘন্টার মাঝেই ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান্স স্টলটেনবার্গ সাংবাদিকদের বলেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রটা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, যা রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে ঘায়েল করতে গিয়ে টার্গেট মিস করে পোল্যান্ডে আছড়ে পড়ে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের পক্ষ থেকেও বলা হয় যে, পোল্যান্ডের উপরে রুশ সামরিক হামলার কোন প্রমাণ মেলেনি।
ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া ‘ফোর্সেস নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘বেলিংক্যাট’এর লেখক ব্রিটিশ সাংবাদিক এলিয়ট হিগিন্স বলছেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া গেছে তা হলো, এটা ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, যা এই মুহুর্তে ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়েই ব্যবহার করছে। তবে প্রমাণাদি দেখে মনে হচ্ছে যে, মিডিয়াতে প্রচারিত খবরটা সত্য নয়। অর্থাৎ এই ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়া ছোঁড়েনি। লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর প্রফেসর মাইকেল ক্লার্ক বলেন যে, পোল্যান্ডের ঘটনাটা ঘটার সাথেসাথেই ইউক্রেন ঘোষণা দেয় যে, ক্ষেপণাস্ত্রটা রুশরা ছুঁড়েছে। কিন্তু বাকি সকলেই বলে যে, তদন্ত সম্পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। ইউক্রেনের চারিদিকে ন্যাটোর গোয়েন্দা বিমানগুলি দিনরাত উড়ছে। কাজেই ইউক্রেনের আকাশে কতগুলি ক্ষেপণাস্ত্র উড়ছে, তা ন্যাটোর অজানা থাকার কথা নয়।
পোল্যান্ডের ঘটনাটা দেখিয়ে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র, তথা পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে মোটেই আগ্রহী নয়। পশ্চিমাদের সামরিক সক্ষমতাও প্রশ্নাতীত নয়। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা শিল্পের কাছ থেকে সময়মতো খুচরা যন্ত্রাংশ পাচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্ত্রের অর্ডার বেড়েছে। কিন্তু সরবরাহ ২০২৪এর মাঝেও সমস্যায় থাকবে। অপরদিকে জেইক সুলিভান ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখার কথা বললেও ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় যাবার ব্যাপারে জেনারেল মিলির বক্তব্যকে বাতিল করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি শান্তি আলোচনার ব্যাপারটা একপ্রকার এড়িয়েই গেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন এই মুহুর্তে পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন সামরিক সহায়তার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। অর্থাৎ ইউক্রেনের যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা পশ্চিমা সহায়তার উপরেই নির্ভর করবে। ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে চীনের সাথে একটা সমঝোতায় পোঁছার চেষ্টায় রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘জি-২০’ বৈঠক থেকে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর সাথে বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাংবাদিকদের বলেন যে, ইউক্রেনে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একমত হয়েছে; এবং দুই দেশ এব্যাপারে যোগাযোগ রেখে চলবে। একইসাথে তিনি বলেন যে, তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভানকে আলোচনা এগিয়ে নিতে বেইজিং যেতে বলেছেন। বাইডেনের কথাগুলি যুদ্ধের কারণে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপারে মার্কিন জনগণের মতামতকেই প্রতিফলিত করছে। তদুপরি মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর কংগ্রেসে বিরোধী রিপাবলিকান শিবিরের শক্তিশালী অবস্থান হোয়াইট হাউজকে চাপে রাখবে।
No comments:
Post a Comment