Thursday 3 November 2022

সেভাস্তোপোলের রুশ নৌঘাঁটিতে ইউক্রেনিয় হামলার কৌশলগত গুরুত্ব

০৩রা নভেম্বর ২০২২
 
ইউক্রেনের সুইসাইড ড্রোন বোটগুলি শেষ পর্যন্ত ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়েছে। এরকমই একটা ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, রুশ 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার থেকে বোটের দিকে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। একটা যুদ্ধজাহাজ কতগুলি সুইসাইড বোট ঠেকাতে পারবে, সেই সংখ্যাটা নির্দিষ্ট। আর সবগুলি বোটের মোট খরচও সর্বদাই যুদ্ধজাহাজের খরচের চাইতে অনেক কম হবে। সকলেই এখন ইউক্রেনের যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।

গত ২৯শে অক্টোবর ইউক্রেনিয়রা রুশ কৃষ্ণ সাগরীয় নৌবহরের হেডকোয়ার্টার্স সেভাস্তোপোলে বড়সড় হামলা করে।হামলার মূল টার্গেট ছিল রুশ নৌবহরের যুদ্ধজাহাজগুলি। আর হামলা করা হয় ইউক্রেনের নৌবাহিনীর নিজস্ব ‘ম্যারিন ড্রোন’ বা মনুষ্যবিহীন সুইসাইড বোটের মাধ্যমে। একইসাথে আকাশ থেকেও মনুষ্যবিহীন বিমান ড্রোনের মাধ্যমে হামলা করা হয়। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন যে, রুশ কৃষ্ণ সাগরীয় নৌবহরের ফ্ল্যাগশিপ ফ্রিগেট ‘এডমিরাল মাকারভ’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরদিকে রুশরা বলছে যে, শুধু একটা মাইনসুইপার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনিয়দের প্রকাশ করা একটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, রুশ ‘এমআই-৮’ হেলিকপ্টার থেকে ড্রোন বোটকে লক্ষ্য করে মেশিন গানের গুলি ছোঁড়া হচ্ছে; যা বোটের আশেপাশে পানিতে আছড়ে পড়ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই ড্রোনটা হয়তো তার টার্গেটে পৌঁছাবার আগেই ধ্বংস হয়েছিল। হামলার কিছু সময় পরেই রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলে যে, যে জাহাজগুলির উপর ইউক্রেনিয়রা হামলা করেছে, সেগুলি ইউক্রেনের শষ্য রপ্তানির জাহাজগুলিকে রক্ষা করছিল। সেই হিসেবে রাশিয়া ইউক্রেনের শষ্য রপ্তানির চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়।

হামলার বর্ণনা

আপাততঃ পাওয়া প্রমাণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রুশরা ইউক্রেনের ড্রোনগুলির মাঝে বেশ কতগুলির বিরুদ্ধে সফলতা পেয়েছিল। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, এই হামলা চালায় ইউক্রেনের ‘৭৩তম ম্যারিন স্পেশাল ফোর্সেস সেন্টার’; যাদেরকে সহায়তা দিয়েছে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেনিয়রা কমপক্ষে ৭টা ম্যারিন ড্রোন এবং ৯টা বিমান ড্রোন ব্যবহার করেছিল। একটা ড্রোন সম্ভবতঃ ইউক্রেনের শষ্য রপ্তানির করিডোর ব্যবহার করেছে। সেখানে ইউক্রেনিয় বা পশ্চিমা একটা বাণিজ্য জাহাজ থেকে এই ড্রোন পানিতে ভাসানো হয়েছে। তারা আরও বলছে যে, সবগুলি বিমান ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে; আর ম্যারিন ড্রোনগুলির মাঝে ৪টা সমুদ্রে, আর ৩টা ভূমিতে ধ্বংস করা হয়েছে। বিবৃতিতে মাইনসুইপার জাহাজ ‘আইভান গোলুবেতস’এর স্বল্প ক্ষতি হবার কথা স্বীকার করা হয়। ‘নেভাল নিউজ’এর এক লেখায় তুর্কি নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, প্রমাণাদি দেখে ব্যাপারটা ভিন্ন মনে হয়। কারণ রুশ ‘এডমিরাল গ্রিগোরোভিচ-ক্লাস’এর একটা ফ্রিগেটের খুবই কাছ থেকে ড্রোন ফুটেজ দেখা যায়; যেখানে ফ্রিগেটটা নিজেকে রক্ষা করতে কিছুই করছে না বলে আপাতদৃষ্টে মনে হয়।

ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য এবং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক এইচ আই সাটন মনে করছেন যে, এর আগে রুশ নৌবাহিনীর ক্রুজার ‘মস্কভা’ ডুবে যাবার মতো সেভাস্তোপোলে ইউক্রেনের হামলাও নৌ ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচিত হবে। অনেক নৌবাহিনীই হয়তো এধরণের ড্রোন বোটের কথা ভেবেছে। কিন্তু ইউক্রেনই প্রথম এটা করে দেখিয়েছে। এতকাল যাবত ড্রোনের ক্যামেরা থেকে পাওয়া ফুটেজে টার্গেটকে আকাশ থেকে নিচে দেখা গিয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো টার্গেটের পাশ থেকে ড্রোন ফুটেজ দেখা গেলো।

ড্রোন বোট হামলার ইতিহাস

তবে রিমোট কন্ট্রোল ড্রোন বোটের ব্যবহার এর আগে হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯১৭ সালে জার্মানরা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের উপরে রিমোট কন্ট্রোল বোট দিয়ে হামলা করেছিল; যদিও তা সফলতা পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ইতালি, জাপান, ব্রিটেন এবং জার্মানি মূলতঃ মনুষ্যচালিত বোটের মাধ্যমে শত্রু জাহাজের উপরে হামলা করে। জার্মানরা টার্গেটে আঘাত করার আগে শেষ দুই মাইল মনুষ্যচালিত কমান্ড বোট থেকে ড্রোন বোট নিয়ন্ত্রণ করতো। ড্রোন বোটগুলিতেও পাইলট থাকতো; যারা শেষ মুহুর্তে বোট থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তো। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭ এবং ২০২২ সালে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা বিস্ফোরক বহণ করা বোট দিয়ে সৌদি এবং আমিরাতি যুদ্ধজাহাজের উপরে হামলা করে।

তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, ২০০০ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘কোল’এর উপর ইয়েমেনের আদেন বন্দরে হামলা হবার পর পশ্চিমা নৌবাহিনীগুলি নিজেদের বন্দর ও জাহাজগুলির নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। কারণ এহেন হামলা এমন সময়ে করা হয়, যখন একটা যুদ্ধজাহাজ সবচাইতে দুর্বল অবস্থানে থাকে। বন্দরে থাকা অবস্থায় জাহাজগুলি নিজেদের অস্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে না। ২০০০ সালের এই ঘটনাকে পুঁজি করে নিজেদের নৌবাহিনী তৈরি করেছে ইরান। মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলি বড় জাহাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে তৈরি হলেও বহু সংখ্যক ছোট বোটের সমন্বিত হামলা মোকাবিলা করার জন্যে তৈরি করা হয়নি।

 
সেভাস্তোপোল বন্দরের স্যাটেলাইট ছবি। সেভাস্তোপোল সামরিক ঘাঁটির মুখটা বেশ সরু এবং সেখানে যেকোন জাহাজ ঢোকার মুখে চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়াও বন্দরের বাইরে রয়েছে নৌবাহিনীর প্যাট্রোল। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বন্দরের বাইরে এবং ভিতরে রুশ প্যাট্রোল ম্যারিন ড্রোনগুলিকে বাধা দিয়েছিল। তথাপি দু’টা ম্যারিন ড্রোন বন্দরের ভেতরে কোনভাবে ঢুকে পড়ে। রাশিয়া যেখানে ৯ মাস ধরে যুদ্ধরত, তখন সেভাস্তোপোল বন্দরে ঢোকার মুখে একটা ড্রোন বোটকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বা বোটগুলিকে রুশরা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হবে; এটা মেনে নেয়া যায় না।

কিভাবে এবং কি দিয়ে এই হামলা সম্ভব হলো?

সেভাস্তোপোল সামরিক ঘাঁটির মুখটা বেশ সরু এবং সেখানে যেকোন জাহাজ ঢোকার মুখে চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়াও বন্দরের বাইরে রয়েছে নৌবাহিনীর প্যাট্রোল। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বন্দরের বাইরে এবং ভিতরে রুশ প্যাট্রোল ম্যারিন ড্রোনগুলিকে বাধা দিয়েছিল। তথাপি দু’টা ম্যারিন ড্রোন বন্দরের ভেতরে কোনভাবে ঢুকে পড়ে। তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, রাশিয়া যেখানে ৯ মাস ধরে যুদ্ধরত, তখন সেভাস্তোপোল বন্দরে ঢোকার মুখে একটা ড্রোন বোটকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বা বোটগুলিকে রুশরা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হবে; এটা মেনে নেয়া যায় না। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে, রুশ হেলিকপ্টারগুলি বোটগুলির উপরে মেশিনগান দিয়ে গুলি করছে। কিন্তু এধরণের ছোট এবং দ্রুতগামী টার্গেট ধ্বংস করতে হয়তো নিখুঁত নিশানার ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।

ইউক্রেনিয়দের এহেন ম্যারিন ড্রোনের কথা জানা যায় গত সেপ্টেম্বরে; যখন একটা ড্রোন বোট ক্রিমিয়া উপদ্বীপের ওমেগা উপসাগর উপকূলে ভেসে আসে। এইচ আই সাটন এই বোটের একটা বিশ্লেষণ করেছেন। এর ইঞ্জিন খুব সম্ভবতঃ পানিতে খেলাধূলার জন্যে ব্যবহৃত জেটস্কির ওয়াটারজেট ইঞ্জিন। খুব সম্ভতঃ কানাডিয় কোম্পানি ‘সীডু’এর তৈরি জেটস্কির ইঞ্জিন এতে লাগানো হয়েছে। বোটের সামনে দু’টা সোভিয়েত ডিজাইনের ফিউজ (ইউপি-৫৮১) ব্যবহার করা হয়েছে। এই ফিউজগুলি দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে, এর ওয়ারহেড ছিল হয়তো ‘এফএবি-৫০০’ বোমা। একটা ঘুর্নায়মান ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ক্যামেরার মাধ্যমে টার্গেটের ছবি তুলতে পারে বোটটা। এই ক্যামেরা দিয়ে তোলা ভিডিওই ইউক্রেনিয়রা প্রকাশ করেছে। বোটের ন্যাভিগেশন আসছে এর উপরে বসানো স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট এন্টেনা থেকে।

‘দ্যা ড্রাইভ’ ম্যাগাজিনের প্রতিরক্ষা সেকশন ‘ওয়ারজোন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এই বোটগুলি ইউক্রেনের উপকূল থেকে ছাড়ার অর্থ হলো যথেষ্ট পরিমাণে জ্বালানি বহণ করতে হবে; যা কিনা বহণকৃত বিস্ফোরকের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। এগুলিকে ডিজাইন করা হয়েছে দূরপাল্লার টার্গেটে আঘাত হানার জন্যে; যা থাকবে সরাসরি দৃষ্টির পাল্লার বাইরে। তবে সেই দূরত্বেও সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এর অর্থ হলো, বিশ্বের যেকোন বন্দর এখন এধরণের হামলার আওতায় পড়তে পারে। এরকম দূরত্ব থেকে বোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারার অর্থ হলো, অস্থায়ী টার্গেটেও হামলা করা সম্ভব হবে; প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও এড়াতে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে; ঐ মুহুর্তে কোন সুযোগ হাজির হলে সেটাও কাজে লাগানো যাবে। কারণ বোটটাকে শেষ পর্যন্ত কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এবং দরকার হলে এর দিক পরিবর্তন করতে পারছে। এই ব্যাপারটা নৌযুদ্ধের ক্ষেত্রে অনেক বড় নতুনত্ব। এতকাল সুইসাইড ড্রোন বোট অপারেট করেছে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে যে, এই চিন্তাটা যখন আরও উন্নততর কোন শক্তি লুফে নেবে, তখন এগুলির সক্ষমতা কেমন হতে পারে।

গত সেপ্টেম্বরে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে ভেসে আসা ড্রোন বোটটা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা উপকূল থেকে প্রায় ২’শ ৮০ কিঃমিঃ দূরে ছিল। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয় যে, ড্রোনগুলি এসেছে ইউক্রেনের ওচাকভ এলাকা থেকে; যা কিনা সেভাস্তোপোল থেকে প্রায় ২’শ ৪০ কিঃমিঃ দূরে। ‘ডিফেন্স আপডেট’এর এক লেখায় ইস্রাইলি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক তামির এশেল বলছেন যে, এর অর্থ হলো, এই লম্বা দূরত্ব এই বোটগুলি অতিক্রম করেছে রুশদের দৃষ্টি এড়িয়ে। আর সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেনিয় ড্রোন ক্রিমিয়ার উপকূলে আবিষ্কার হবার পরে রুশরা তাদের জাহাজগুলিকে খোলা সমুদ্রে প্যাট্রোল থেকে সরিয়ে সেভাস্তোপোল বন্দরের ভিতরে জমা করে; যে সুযোগ ইউক্রেনিয়রা কাজে লাগায় বন্দরের ভিতরে হামলা করে। একসাথে ম্যারিন এবং বিমান ড্রোন ব্যবহার করার ফলে ঐ মুহুর্তে ইউক্রেনিয়রা সর্বশেষ ইন্টেলিজেন্স পায় এবং সেগুলিকে সঠিকভাবে সমন্বয় করতে সক্ষম হয়। একইসাথে ইউক্রেনিয়রা ঘাঁটির মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে রুশদের হতভম্ব করে ফেলে।

সেপ্টেম্বর মাসে ক্রিমিয়ার উপকূলে ভেসে আসা ইউক্রেনিয় ড্রোন বোট। একটা ড্রোন বোট তৈরিতে হয়তো বেশ কয়েক হাজার ডলার খরচ হবে। তবে তা লক্ষ ডলারের কাতারে যাবে না। এর তুলনায় অনেক আধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য মিলিয়ন ডলারও হয়ে থাকে। একটা জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র খুব অল্প সংখ্যক রাষ্ট্রই তৈরি করতে পারে; কিন্তু এরকম একটা সুইসাইড বোট অনেকেই তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।

তেইফুন ওজবেরক রুশ কৃষ্ণ সাগরীয় নৌবহরের সমালোচনা করে বলছেন যে, তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে না। এর আগে তারা ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্রের হাতে ক্রুজার ‘মস্কভা’ এবং একটা গুরুত্বপূর্ণ টাগবোট হারিয়েছে। এছাড়াও তুর্কিদের নির্মিত ড্রোনের হামলায় তাদের বিভিন্ন প্যাট্রোল বোট ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধজাহাজ ‘মস্কভা’ আক্রান্ত হবার আগে রুশ ইন্টেলিজেন্স যদি সঠিক তথ্য দিতে পারতো যে, ইউক্রেনের জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলি উপকূলে অপারেশনাল রয়েছে, তাহলে জাহাজটাকে ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে রাখা যেতো। আর ইউক্রেনের হাতে মার্কিন ‘হারপুন’ জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে জেনেও রুশরা তাদের টাগবোট স্নেইক আইল্যান্ডের কাছে পাঠিয়েছিল। ‘মস্কভা’ হারাবার পর রুশরা উপকূলীয় অঞ্চলে আকাশের নিয়ন্ত্রণ হারায়। এরপরেও তারা হাল্কা বিমান প্রতিরক্ষা সজ্জিত প্যাট্রোল বোটগুলিকে উপকূলের কাছে পাঠায়; যেখানে সেগুলিকে ইউক্রেনের ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোনগুলি ধ্বংস করে। ‘মস্কভা’ হারাবার সময় বহু দেশের মতো রুশদেরও একই বাস্তবতা ছিল – তাদের নৌবাহিনী কয়েক দশক ধরে কোন যুদ্ধ করেনি। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রথম ঘটনার পরে তো তাদের শিক্ষা নেবার কথা; যা তারা নেয়নি। সেপ্টেম্বর মাসে সেভাস্তোপোলের কাছে যখন একটা ইউক্রেনিয় ড্রোন পাওয়া যায়, তখন রুশদের বোঝা উচিৎ ছিল যে, ইউক্রেনিয়রা সেভাস্তোপোলে রুশ নৌবহরের উপরে হামলার পরিকল্পনা করছে। পাঁচ সপ্তাহের আগাম সতর্কতা পাবার পরেও তারা সেভাস্তোপোলের নিরাপত্তা যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের উপর সেভাস্তোপোল হামলার সম্ভাব্য ফলফল


এইচ আই সাটন মনে করছেন যে, আক্রমণে রুশ নৌবাহিনীর কোন জাহাজ সম্ভবতঃ ডুবে যায়নি। তথাপি এর কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এতে রুশদের দৃষ্টি অন্য দিকে সড়ে যাবে এবং ঘাঁটি হিসেবে সেভাস্তোপোলকে হুমকির মাঝে রাখবে। রুশ নৌবাহিনীর ইউনিটগুলি ভবিষ্যতে কোথায় কিভাবে মোতায়েন করা হবে, তা এই ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবে।

তেইফুন ওজবেরকএর মতে, ইউক্রেনিয়রা এর আগে যেসব হামলা করেছে, সেগুলির কৌশলগত প্রভাব ছিল যথেষ্ট। সেই হামলাগুলি রুশ সামরিক বাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। বিশেষ করে রুশ নৌবাহিনীর ক্রুজার ‘মস্কভা’ ডুবে যাওয়া এবং ক্রিমিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কার্চ সেতুর উপরে হামলা রুশ সামরিক বাহিনীর সন্মানহানি করেছে। এখন ফ্রিগেট ‘এডমিরাল মাকারভ’এর উপরে হামলা সেই আঙ্গিকে ইউক্রেনের সাফল্য এবং রুশদের সন্মনহানি; যেখানে খুব ভালো ইন্টেলিজেন্স এবং নেটওয়ার্ক ভিত্তিক যুদ্ধক্ষমতার ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে রুশদের এই ব্যর্থতাগুলি দেখিয়ে দেয় যে, একেবারে সাধারণ সামরিক বিষয়গুলি, যেমন বন্দরের নিরাপত্তা দেয়া, নজর রাখতে পারা, এবং শত্রুর শক্তি বিচার করতে পারার মতো সক্ষমতার ক্ষেত্রে রুশরা যথেষ্ট পারঙ্গম নয়।
 
'এডমিরাল গ্রিগোরোভিচ-ক্লাস'এর ফ্রিগেট 'এডমিরাল মাকারভ', যা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনের ড্রোন বোটগুলি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এহেন হামলা এমন সময়ে করা হয়, যখন একটা যুদ্ধজাহাজ সবচাইতে দুর্বল অবস্থানে থাকে। বন্দরে থাকা অবস্থায় জাহাজগুলি নিজেদের অস্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে না।

নৌ-যুদ্ধকৌশলের উপরে দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কেমন হতে পারে?

‘দ্যা ওয়ারজোন’এর এক লেখায় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক টাইলার রোগোওয়ে বলছেন যে, এধরণের একটা ড্রোন বোট তৈরিতে হয়তো বেশ কয়েক হাজার ডলার খরচ হবে। তবে তা লক্ষ ডলারের কাতারে যাবে না। এর তুলনায় অনেক আধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য মিলিয়ন ডলারও হয়ে থাকে। খরচ কম রাখার একটা পদ্ধতি হলো বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায় এমন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা। একইসাথে স্যাটেলাইট যোগাযোগের মতো বিভিন্ন প্রযুক্তি এখন কম খরচে যে কেউই পেতে পারে; যা এরকম দূরপাল্লার হামলাকে সম্ভব করছে। একটা জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র খুব অল্প সংখ্যক রাষ্ট্রই তৈরি করতে পারে; কিন্তু এরকম একটা সুইসাইড বোট অনেকেই তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। আর কোন বন্দরের প্রতিরক্ষাই নিশ্ছিদ্র নয়। সকল নিরাপত্তাই নেয়া হয় অতীতে যা ঘটেছে সেটার উপর নির্ভর করে; ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে সেটা চিন্তা করে নয়।

রোগোওয়ে বলছেন যে, এরকম সুইসাইড ড্রোন যদি কোন বাণিজ্যিক জাহাজে করে দূরবর্তী এলাকায় নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে এরকম হামলা পৃথিবীর যেকোন অঞ্চলেই করা সম্ভব হতে পারে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে প্রচুর বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল রয়েছে, সেখানে বহু জাহাজের প্রপেলারের শব্দের মাঝে এরকম একটা ছোট ড্রোন বোটের শব্দ খুঁজেই পাওয়া যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্য রুটগুলির মাঝ দিয়ে যাবার সময় মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলিকে বেশ ধীরগতিতে যেতে হয়। এরকম সময়ে বহু দিক থেকে বিপুল সংখ্যক ম্যারিন ড্রোনের হামলা ঠেকানো বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে যেতে পারে। আর এর সাথে যদি বিমান ড্রোন যুক্ত হয় তাহলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সামরিক ঘাঁটিগুলি এরকম হামলার হুমকিতে থাকবে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা করার মাধ্যমেও সামরিক সাপ্লাই চেইনে বিশৃংখলা তৈরি করা সম্ভব।

এইচ আই সাটন বলছেন যে, যদিও অনেকেই এধরনের ড্রোনের ব্যাপারে চিন্তা করেছে, তথাপি অনেকগুলি ম্যারিন ড্রোন একত্রে একটা টার্গেটের উপরে হামলা করার ঘটনা এবারই প্রথম। আর ড্রোন বোটগুলি অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী হওয়ায় অনেকেই এগুলি তৈরির চেষ্টা চালাবে। এরকম একটা ড্রোন খুব বড় হুমকি না হলেও অনেকগুলি একত্রে প্রভাব তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে এই ড্রোনগুলিকে কিভাবে প্রতিহত করা হবে, সেটা চিন্তা করে অনেক সিদ্ধান্তই পরিবর্তিত হবে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ বা সামুদ্রিক মাইন অপসারণে বর্তমানে ব্যবহৃত ম্যারিন ড্রোনগুলি তাদের অবস্থান ধরে রাখবে অবশ্যই। তবে এর সাথে নতুন অস্ত্র হিসেবে এই সুইসাইড ম্যারিন ড্রোনও যুক্ত হবে। প্রকৃতপক্ষে, অনেক ধরণের ম্যারিন ড্রোনের মাঝে এরকম আক্রমণকারী ড্রোনকেই সকলে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।

অপরদিকে তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, একসাথে আকাশ এবং সমুদ্র থেকে অনেকগুলি ড্রোনের হামলা দেখিয়ে দেয় যে, স্বল্প খরচের এই অস্ত্রগুলি শতশত মিলিয়ন ডলারের যুদ্ধজাহাজগুলির জন্যে কতবড় হুমকি হতে পারে। ভবিষ্যতে বড় যুদ্ধজাহাজগুলিতে যদি এরকম হামলা ঠেকাবার জন্যে যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা না হয়, তাহলে সেগুলির নিরাপত্তা দেয়া কঠিন হবে। টাইলার রোগোওয়ে বলছেন যে, একটা যুদ্ধজাহাজ কতগুলি সুইসাইড বোট ঠেকাতে পারবে, সেই সংখ্যাটা নির্দিষ্ট। আর সবগুলি বোটের মোট খরচও সর্বদাই যুদ্ধজাহাজের খরচের চাইতে অনেক কম হবে। সকলেই এখন ইউক্রেনের যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, ইরান এবং উত্তর কোরিয়াও এখান থেকে শিখছে; যারা ভবিষ্যতে কোন সুযোগে এরকম সুইসাইড ড্রোন বোট দিয়ে সমুদ্র ছেয়ে ফেলতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু পশ্চিমা দেশগুলিরও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে অত্যন্ত দ্রুত এরকম ড্রোন তৈরি করার। কাজেই অতি শিগগিরই এরকম সুইসাইড ড্রোন বোট ডেভেলপ করার প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে; যেখানে বড় বা ছোট সকল দেশই অংশ নেবে।



সূত্রঃ
‘Ukraine's New Drone Boats That Will Change Naval Warfare, Explained’ by H.I. Sutton, 31 October 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=C_tvZufo4hE)
‘Analysis: Ukraine strikes with Kamikaze USVs – Russian bases are not safe anymore’ by Tayfun Ozberk in Naval News, 30 October 2022
‘Ukraine’s New Weapon To Strike Russian Navy In Sevastopol’ by H.I. Sutton in Naval News, 21 September 2022
‘Coordinated Drone Attack Targets the Russian Black Sea Fleet at Sevastopol’ by Tamir Eshel, in Defense Update, 30 October 2022 (https://defense-update.com/20221030_coordinated-drone-attack-targets-the-russian-black-sea-fleet-at-sevastopol.html)
‘Ukraine’s Unprecedented Mass Drone Boat Attack Was A Wakeup Call’ by Tyler Rogoway, in The Warzone, 01 November 2022 (https://www.thedrive.com/the-war-zone/ukraines-unprecedented-mass-drone-boat-attack-was-a-wakeup-call)
‘Ukraine Unleashes Mass Kamikaze Drone Boat Attack On Russia’s Black Sea Fleet Headquarters’ in The Warzone, 29 October 2022 (https://www.thedrive.com/the-war-zone/ukraine-unleashes-mass-kamikaze-drone-boat-attack-on-russias-black-sea-fleet-headquarters)
‘Russia says it has recovered, analyzed drones used to attack its fleet in Crimea’ by Reuters in Al-Arabiya News, 30 October 2022

No comments:

Post a Comment