Sunday 20 February 2022

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাকেই তুলে ধরে

২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি যে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যখন বলছে যে, তাদের শক্তির মূল উৎস হলো তাদের মিত্র এবং সহযোগীরা, তখন সেটা প্রমাণ করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক নীতি আঞ্চলিক বাস্তবতাকে পরিবর্তন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই।

 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গত ১১ই ফেব্রুয়ারি তাদের বহুল প্রতীক্ষিত নতুন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের নীতিপত্র প্রকাশ করে। নীতিপত্র প্রকাশের দিনক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। কারণ সপ্তাহান্তের ছুটি শুরুর ঠিক আগে শুক্রবার বিকেলে এই নীতিপত্র প্রকাশ করার ঘন্টাখানেক পর মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন ইউক্রেন নিয়ে। তিনি চীনকে হুশিয়ার করে বলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করলে চীন যদি রাশিয়াকে সমর্থন দেয়, তাহলে তাদেরকে এর মূল্য দিতে হবে। নীতিপত্রে চীনকে পরিবর্তনের চেষ্টা না করে অত্র অঞ্চলের বাস্তবতাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে নিয়ে আসার কথা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং সহযোগীদের, বিশেষ করে ইইউ, আসিয়ান, ন্যাটো, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং কোয়াড জোটের সাথে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ বলছে যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি নয়; তবে সেখানে চীনের আগ্রাসী নীতিকে একটা সমস্যা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটা এখন পরিষ্কার যে, চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’ আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় মার্কিন থিংকট্যাংক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার প্রেবল বলছেন যে, ইউরোপে ইউক্রেনকে ঘিরে যখন এতবড় একটা বিরোধ চলছে, ঠিক সেই সময়ে তারা নীতিপত্রটা প্রকাশ করলো; যা খুবই অদ্ভূত। এরকম একটা সময়ে বোঝা কষ্টকর হচ্ছে যে, বাইডেন প্রশাসন কি ভেবে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ না করে দুনিয়ার একটা অংশ নিয়ে নীতিপত্র প্রকাশ করলো। পুরো নীতিপত্রে চীনের নাম এসেছে খুবই কম; মূলতঃ চীন কোন কোন আন্তর্জাতিক আইন ভেঙ্গেছে, সেগুলিই শুধু বলা হয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলে চীন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা একেবারেই উল্লেখ করা হয়নি। এটা পড়লে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের ব্যাপারটা একটা ‘ব্ল্যাক হোল’এর মতো মনে হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। অর্থাৎ ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের কোন অস্তিত্বই যেন নেই! নীতিপত্রে ইন্দোপ্যাসিফিক যুক্তরাষ্ট্রের কতবড় বাণিজ্য সহযোগী সেটা বলা হয়েছে; অথচ এর মাঝে চীনের সাথে বাণিজ্যই যে সবচাইতে বেশি, সেটা উল্লিখিত হয়নি। তিনি বলছেন যে, আর মাধ্যমে এই নীতিপত্রের দৃষ্টিভঙ্গিখানা বোঝা যায়। ট্রাম্প প্রশাসন যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা বলেছিল যে, যতক্ষণ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলে চীনের দাবিগুলিকে মেনে নেবে না। কিন্তু এখন বাইডেন প্রশাসনের নীতিখানা কি? তারা কি ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের গুরুত্বকে এড়িয়ে যেতে চাইছে?

‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর ফেলো জ্যাক কুপার বলছেন যে, হয়তো বাইডেন প্রশাসন সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাইছে যে, তাদের এশিয়া নীতিই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নীতি। কিন্তু এই নীতিপত্রে গত দশ বছরে যা বলা হয়েছে, এর বাইরে নতুন কোনকিছুই আসেনি; বরং প্রশ্ন হলো, এই নীতির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র কি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার তিন স্তম্ভের প্রথম স্তম্ভ হলো নিরাপত্তা। নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ‘সমন্বিত ডিটারেন্স’ বলে যা বলা হয়েছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে নতুন কিছু নয়। বরং ‘সমন্বিত’ বলে সেখানে সামরিক নিরাপত্তার ব্যাপারটার গুরুত্ব কমিয়ে ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থনীতির অংশ হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইন্দোপ্যাসিফিকে নতুন কোন বাণিজ্য চুক্তির জন্ম দিতে পারেনি। যেগুলি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেগুলি একটাও কার্যকর হয়নি। আর তৃতীয় স্তম্ভ আদর্শ অত্র অঞ্চলে যে কাজ করছে না, তা নিশ্চিত। বাইডেনের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠকে ইন্দোপ্যাসিফিকের ১০টা দেশের মাঝ থেকে মাত্র ৩টা দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। চীনকে মার্কিন সরকার যখন একুশ শতকের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ বলছে, তখন নীতিপত্রে আরও শক্তিশালী কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই থাকা উচিৎ ছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিক স্তম্ভের ক্ষেত্রে নীতি সবচাইতে দুর্বল। চীন যখন আঞ্চলিক দেশগুলির সাথে বাণিজ্যের দিক থেকে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে চাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র যেন বাউন্ডারির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কুপার বলছেন যে, এশিয়ায় অনেকেই বলছেন যে, ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থানে থাকা উচিৎ যাতে তা চীনের জন্যে একটা শিক্ষা হিসেবে আসে। কিন্তু তারা কেউই আবার চাইছে না যে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে এশিয়া থেকে দূরে থাকুক। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার কোন অঞ্চলকেই অধিক গুরুত্ব দিতে পারছে না।

চীনা মিডিয়া ‘সিজিটিএন’এর এক লেখায় মস্কোভিত্তিক মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এন্ড্রু করিবকো বলছেন যে, নতুন এই নীতি আসলে কিছু ইচ্ছার প্রতিফলন মাত্র। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে এর কতগুলি বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মূলতঃ এই নীতিপত্রের প্রতিরক্ষার দিকটাই হয়তো বেশি প্রাধান্য পাবে। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, নীতিপত্রে অনেক কিছুই বলা হচ্ছে; তবে এগুলি বাস্তবায়নে অত্র অঞ্চলের দেশগুলির কি ধরনের সুবিধা হবে, সেটা দেখানোটা বেশি জরুরি।

ক্রিস্টোফার প্রেবল বলছেন যে, এই নীতিপত্রে যেসব কথা বলা হয়েছে সেগুলি বাস্তবে রূপ দিতে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মার্কিনীদের যে মূল্য দিতে হবে এবং কষ্ট সহ্য করতে হবে, সেব্যাপারে মার্কিন জনগণ একমত নয়। ‘সমন্বিত ডিটারেন্স’এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কি চীনা ছাত্রদের বাধা দিতে পারবে? যুক্তরাষ্ট্র কি অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে চীনা আর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে ভর্তুকি দিতে পারবে? নীতিপত্রে যতকিছু করা হবে বলে বলা হয়েছে, মার্কিন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই কাজগুলি করার জন্যে অর্থায়ন কিভাবে যোগাড় করা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন তিনি। বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি যে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যখন বলছে যে, তাদের শক্তির মূল উৎস হলো তাদের মিত্র এবং সহযোগীরা, তখন সেটা প্রমাণ করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। প্রেবল, কুপার বা করিবকোর কথায় এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক নীতি আঞ্চলিক বাস্তবতাকে পরিবর্তন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই।

No comments:

Post a Comment