২৯শে সেপ্টেম্বর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান রাশিয়ার সোচি ঘুরে এসেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে এক বছরের বেশি সময়ের মাঝে এটা ছিল তার প্রথম বৈঠক। পুতিনের সাথে বৈঠকের পর বিমানে ফেরত আসার সময় এরদোগান তুর্কি সাংবাদিকদের বলেন যে, তুরস্ক রাশিয়ার সাথে আরও প্রতিরক্ষা সমঝোতার দিকে এগুচ্ছে; যার মাঝে রয়েছে ফাইটার বিমান এবং সাবমেরিন। এছাড়াও এরদোগান বলেন যে, তিনি রাশিয়ার সাথে আরও দু’টা পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে ভ্লাদিমির পুতিন মহাকাশে ব্যবহার করার জন্যে রকেট প্ল্যাটফর্ম ডেভেলপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। বর্তমানে তুরস্কের দক্ষিণে ‘আক্কুইয়ু’তে রাশিয়ার ‘রোসাটম’ একটা পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে।
‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইতোমধ্যেই ২০১৯ সালে রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ‘এফ ৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে পুরোপুরিভাবে বাদ দিয়েছে; এবং একইসাথে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের উপর বিভিন্ন ধরনের অবরোধ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এক সপ্তাহ আগেই এরদোগান যখন ঘোষণা দেন যে, তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে আরও ‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র কিনবে, তখন ওয়াশিংটন থেকে বলে দেয়া হয় যে, এর ফলশ্রুতিতে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের আরও অবরোধের মাঝে পড়তে পারে। তবে সোচি থেকে ফেরত আসার সময় এরদোগান আরও নতুন ‘এস ৪০০’ ইউনিট কেনার ব্যাপারে কিছু বলেননি। তিনি শুধু বলেন যে, এই প্রকল্প থেকে ফেরত আসার কোন পথ খোলা নেই।
তুর্কি মিডিয়া ‘এনটিভি’ বলছে যে, এরদোগান বলেন যে, তিনি পুতিনের সাথে বিমানের ইঞ্জিন তৈরি এবং ফাইটার জেট ডেভেলপ করার জন্যে কি ধরনের সহযোগিতা হতে পারে, তা নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়াও জাহাজ এবং সাবমেরিন নির্মাণ নিয়েও তারা কথা বলেছেন বলে বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন যে, তিনি সামনের মাসে ‘জি ২০’ শীর্ষ বৈঠকে এবং গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে কথা বলবেন। তিনি বাইডেনের সাথে তুরস্কের ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে কথা বলবেন, যা তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে ‘এফ ৩৫’ যুদ্ধবিমানের প্রকল্পের জন্যে। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের কাছ থেকে এই অর্থ নিলেও কোন বিমান ডেলিভারি দেয়নি। উল্টো মার্কিনীরা প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বাদ দিয়েছে। এক সপ্তাহ আগেই নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরত আসার সময় এরদোগান বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক সুস্থ্য নয়। তবে সোচি থেকে ফেরত আসার সময় এরদোগান বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুক্ষেত্রে ভালো কিছু পাবার আশা রয়েছে।
সিরিয়ার ইদলিব থেকে লিবিয়া … রাশিয়া এবং তুরস্ক কি বন্ধু, না প্রতিযোগী?
সোচি থেকে ফেরত আসার সময় এরদোগান যেসকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, তার মাঝে ছিল সিরিয়ার ইদলিবের যুদ্ধ। এরদোগান বলেন যে, সিরিয়ার ব্যাপারে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের যেসকল ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে, সেগুলির ব্যাপারে তুরস্ক পুরোপুরিভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন যে, সিরিয়ানদের নিজেদের বাড়িতে নিরাপদে ফেরত পাঠাতে তুরস্ক সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। ইদলিবে ৪ লক্ষ সহ প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ নিজেদের বাড়িতে ফেরত গিয়েছে বলে বলেন তিনি। উত্তর সিরিয়ার ইদলিবে তুরস্ক এবং রাশিয়ার মাঝে একটা সমঝোতা অনুযায়ি কয়েক দফায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং তাদের সহযোগিরা নিয়মিতভাবেই যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইদলিবে যুদ্ধবিরতি নামমাত্র টিকে রয়েছে। এমনই একটা সময়ে এরদোগান পুতিনের সাথে বৈঠক করে এসেছেন।
‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়া এবং তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ককেশাস পর্যন্ত অঞ্চলের সংঘাতে ভিন্ন পক্ষকে সমর্থন করছে। রাশিয়া থেকে তুরস্ক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে; আরও অন্যান্য প্রযুক্তিও কিনতে পারে। তুরস্ক রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে। লক্ষ লক্ষ রুশ পর্যটক তুরস্কে বেড়াতে যায়। অথচ সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে ইদলিবের দক্ষিণে আটকাতে তুরস্ক সৈন্য মোতায়েন করেছে; যেখানে রাশিয়া সরাসরি সিরিয় বাহিনীকে সহায়তা দিচ্ছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিরিয়ার ইদলিবে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকারি বাহিনী রুশ সহায়তা নিয়ে বড় রকমের অভিযান শুরু করে। বিমান হামলায় ৩৪ জন তুর্কি সেনা নিহত হবার পর তুরস্ক ইদলিবে প্রচুর সেনা মোতায়েন করে। এর মাধ্যমে তুরস্ক কোনরকমে ইদলিবের কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। তবে সোচির বৈঠকের আগে আগে রাশিয়া ইদলিবে বিমান হামলা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। একইসাথে সিরিয়রা দাবি করে যে, তুরস্ক ইদলিবে নতুন করে আরও সেনা মোতায়েন করেছে।
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়া খলিফা হাফতারের বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে। হাফতারের বাহিনী যখন ত্রিপোলির দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল, তখনই তুরস্কের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায়। ত্রিপোলি সরকারের পক্ষে তুরস্ক সিরিয়া থেকে মিলিশিয়াদের এনে মোতায়েন করেছিল। অপরদিকে রাশিয়া তার গোপন ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর ভাড়াটে সেনাদের হাফতারের পক্ষে মোতায়েন করে।
২০২০ এর শেষের দিকে ককেশাসের নাগোর্নো কারাবাখে ৪৪ দিনের যুদ্ধের পর আজেরবাইজান আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে বিজয় পায়। আজেরিরা তুরস্ক থেকে সরাসরি সমর্থন পেলেও রাশিয়া সরাসরি আর্মেনিয়ার পক্ষ নেয়নি। তবে রুশ মধ্যস্ততায় আর্মেনিয়ার বাহিনী পুরোপুরিভাবে হেরে যাওয়া থেকে বেঁচে যায়।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া রাশিয়া দখল করে নিলেও তুরস্ক এব্যাপারে রাশিয়াকে সমর্থন করেনি। তুরস্ক ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের অংশ হিসেবেই দেখে। জাতিসংঘে ভাষণ দিতে গিয়েও তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইউক্রেনের পক্ষে কথা বলেন; যা রাশিয়ার বিরক্তির কারণ। তুরস্ক বর্তমানে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে; বিশেষ করে মনুষ্যবিহীন ড্রোন এবং নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করছে তুরস্ক।
রাশিয়া এবং তুরস্কের সম্পর্ক একটা জটিল ব্যালান্সের উপর দাঁড়িয়ে আছে; যেখানে একদিকে উভয় দেশ অনেকগুলি অঞ্চলে প্রতিযোগিতা করছে; অপরদিকে নিজেদের মাঝে সরাসরি সংঘাত এড়াতে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাগত এবং কৌশলগত সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। রাশিয়ার কাছ থেকে সামরিক প্রযুক্তি কিনতে গিয়ে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে ছিটকে যাবার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তুরস্কের। কিন্তু ক্রমবর্ধমান মার্কিন অবরোধের চাপের মাঝেও তুরস্ক রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে চাইছে না। তুরস্কের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা তার উসমানি খিলাফতের ঐতিহাসিক বাস্তবতার উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছে যে, তুরস্ক নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার সাথে আঞ্চলিকভাবে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি হলেও তুরস্ক তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে ছেড়ে আসতে পারছে না। তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান দূরত্বে ভূরাজনৈতিকভাবে রাশিয়া আপাততঃ লাভবান হলেও তুরস্কের সাথে রাশিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সখ্যতা প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘমেয়াদী ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে লুকিয়ে রাখার একটা অবাস্তব প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়।
Saturday, 2 October 2021
রাশিয়া এবং তুরস্ক … বন্ধু, না প্রতিযোগী?
০৩রা অক্টোবর ২০২১
Labels:
Geopolitics,
Russia,
Turkey,
USA
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment