২৯শে অক্টোবর ২০২১
মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘এনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০ লক্ষ সেনার পৃথিবীর সবচাইতে বড় সামরিক বাহিনী থাকলেও চীনের যে ব্যাপারটা নিয়ে এখন মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা চিন্তিত, তা হলো চীনের ডেভেলপ করা অস্ত্রসমূহ, যা কিনা মার্কিন সামরিক প্রতিরক্ষ্যা ব্যুহকে ভেদ করতে পারে। পেন্টাগনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনারা এই গ্রীষ্মে দু’টা হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। তবে চীনারা এখন পর্যন্ত একটা পরীক্ষার কথা স্বীকার করেছে; তাও আবার তারা বলছে যে, সেটা ছিল চীনাদের বেসামরিক মহাকাশ গবেষণার অংশ। মার্কিনীরা ভীত যে, এই অস্ত্র সামনের দিনগুলিতে হয়তো পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করতে সক্ষম হবে। শব্দের গতির চাইতে কমপক্ষে ৫ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন এই অস্ত্র বর্তমানের মার্কিন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সক্ষম হতে পারে। গত ২৭শে অক্টোবর বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’এর সাথে এক সাক্ষাতে সর্বোচ্চ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মার্ক মিলি বলেন যে, চীনারা হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। তিনি বলেন যে, এই পরীক্ষা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশে ‘স্পুতনিক’ স্যাটেলাইট প্রেরণের মতো অত গুরুত্ববহ না হলেও এর খুব কাছাকাছি; তাই মার্কিনীরা এর উপর কড়া নজর রাখছে। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘স্পুতনিক’ স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণের পর মার্কিনীরা প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ‘এনবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন কর্মকর্তাদের কথায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে, মার্কিনীরা চীনাদের এই অগ্রগামিতার ব্যাপারে প্রস্তুত ছিল না। মার্কিনীরা নিজেরাও হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপ করছে। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘রেথিয়ন’এর প্রধান নির্বাহী বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক অস্ত্রের দিক থেকে চীনের থেকে কয়েক বছর পিছিয়ে আছে।
ওয়াশিংটন এবং বেইজিং থেকে হাইপারসনিক অস্ত্রের ব্যাপারে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রথম রাষ্ট্র, যারা হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে। তারা এখনও সেগুলি ডেভেলপ করছে, এমনকি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে চাইছে। একইসাথে তারা ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদের পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’ উন্নততর করছে। পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’ হলো ভুমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য, সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য এবং আকাশ থেকে ছোঁড়া তিন প্রকারের পারমাণবিক অস্ত্রের ডিটারেন্ট। ওয়াং ওয়েনবিন বলেন যে, চীনের সাধারণ মহাকাশ গবেষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বারংবার নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা এটা করেছে ‘চীনা হুমকি’র চিন্তাটাকে সামনে নিয়ে আসার জন্যেই। ২৭শে অক্টোবর পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কারবি সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার বাজেটের ভেতরেই বাস্তবসম্মতভাবে নিজেদের হাইপারসনিক অস্ত্রের সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে এবং এই সক্ষমতা ডেভেলপ করার পথে তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
১৯শে অক্টোবর ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলেছিল যে, গত অগাস্টে চীন হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এতে বলা হয় যে, ক্ষেপণাস্ত্রটা প্রথমে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে, এরপর সেটা গ্লাইড করে ভূমির দিকে নেমে আসে। ব্যাপারটা এমন কিছু উন্নততর সক্ষমতাকে দেখায়, যা মার্কিন কর্মকর্তাদেরকে অবাক করেছে। ‘আর্মস কনট্রোল এসোসিয়েশন'এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড্যারিল কিম্বাল ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, এই অস্ত্র যেহেতু খুবই দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং এটাকে আগে থেকে খুঁজে পাওয়াও যেহেতু কঠিন হতে পারে, তাই এগুলি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যে পূর্বাভাষের সময় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়কে কমিয়ে দেবে। তবে যেহেতু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই অস্ত্র মহাকাশের কক্ষপথ ঘুরে এসেছে, তাই এটা আরও একটা নতুন উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডীন চেং বলছেন যে, এই প্রতিবেদন যদি সঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ন করতে হবে যে, মহাকাশে প্রেরিত যেকোন চীনা স্যাটেলাইটই গোপনে পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করছে কিনা। এই গ্রীষ্মে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে যে, চীনারা তাদের পশ্চিমের মরু অঞ্চলে এক’শরও বেশি আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার বা ‘সাইলো’ তৈরি করা শুরু করেছে। ডীন চেং বলছেন যে, চীনারা সাম্প্রতিক সময়ে গত চার বা পাঁচ দশকের তুলনায় নিজেদের আন্তমহাদেশীয় কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এক বছরের কম সময়েই চীনারা কমপক্ষে আড়াই’শ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ড্যারিল কিম্বাল মনে করছেন যে, বেশি দুশ্চিন্তার ব্যাপার হতে পারে যদি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে গিয়ে পূর্ব এশিয়াতে লাগামহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কারণ সেখানে চীন এবং জাপানের মাঝে সামরিক উত্তেজনা রয়েছে; কোরিয় উপদ্বীপেও রয়েছে; আবার চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝেও উত্তেজনা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়াও হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপ করছে বলে খবর আসছে। কেউ কেউ উত্তর কোরিয়ার এই প্রযুক্তির উৎসের সাথে চীনের সম্পর্ক খুঁজলেও খুব সম্ভবতঃ এই প্রযুক্তি কোরিয়রা নিজেরাই ডেভেলপ করেছে।
তবে কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, চীনের হাইপারসনিক অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টকে আরও বড় পরিসরে দেখতে হবে। ‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে সাক্ষাতে ‘ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্র্যাসি’র সিনিয়র ডিরেক্টর ব্র্যাডলি বাউম্যান বলছেন যে, প্রথমতঃ এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা হলেও এটা একেবারে নতুন কিছু নয়। এবং দ্বিতীয়তঃ যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হামলার সক্ষমতা চীনের বর্তমানেই রয়েছে। তবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মহাকাশে প্রেরিত রকেটে বহণ করা স্পেস শাটলের মতো, যা গ্লাইড করে ভূমিতে নেমে আসতে পারবে। বেশিরভাগ মার্কিন রাডার যখন উত্তর মেরুর উপর নজর রাখছে, তখন চীনারা দক্ষিণ মেরুতে রকেট পাঠিয়ে সেখান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র গ্লাইড করতে পারবে; এতে তা রাডারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে বাউম্যান মনে করছেন যে, চীনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় না নেমে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ নিজেদের পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’কে আরও উন্নত করা; মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র খোঁজার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা; এবং ‘বুস্ট ফেইজ’এ বা উৎক্ষেপণের সময় ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেয়ার প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা। তিনি মনে করছেন যে, সবচাইতে বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, চীনাদের সাথে কোন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তি না থাকায় তারা লাগামহীনভাবেই নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে; যা মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদেরকে বিচলিত করছে। তবে বাউম্যান বলছেন যে, প্রতিদ্বন্দ্বীরা যতক্ষণ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রকে চাপের মাঝে না ফেলে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে আলোচনায় বসতে চায় না। কাজেই এক্ষেত্রে নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতাকে উন্নত করার মাধ্যমেই মস্কো এবং বেইজিংএর অস্ত্র প্রকল্পগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিনীদের মাঝে অনেকেই বুঝতে পারছেন যে, মার্কিন কর্মকর্তারা চীনাদের হুমকিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করছে। বিদায়ী মার্কিন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল জন হাইটেন সাংবাদিকদের বলেন যে, গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র নয়বার হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে; অপরপক্ষে চীনারা একই সময়ে শতশত হাইপারসনিক পরীক্ষা চালিয়েছে। মার্কিন সংস্থা ‘ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টস’এর ক্যামেরন ট্রেসি এক লেখায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র ডেভেলপ করলেও সেগুলি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। নিজেদের স্বার্থেই একে অপরকে কেউ ধ্বংস করতে চায়না বলেই চার দশকের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত এবং মার্কিনীরা একে অপরকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়নি। এই একই চিন্তা এখনও বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল মিলি নিজেই তার কথায় বলেছেন যে, মার্কিনীরা চীনাদের প্রত্যুত্তরে নিজেদের সামরিক অবস্থানকে পরিবর্তন করবে। এর অর্থ হলো প্রতিরক্ষায় ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক টাইলার রোগোওয়ে এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা যেভাবে চীনের হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে চিৎকার করছেন, তা থেকে পরিষ্কার যে, তারা আসলে চীনের ব্যাপারে একটা ভীতির জন্ম দিতে চাইছেন। এর মূল উদ্দেশ্য আসলে মার্কিন হাইপারসনিক অস্ত্রের প্রকল্পের জন্যে বাজেট জোগাড় করা। ট্রেসি বলছেন যে, তথাকথিত ‘সন্ত্রাস’এর হুমকি কমে যাওয়ায় মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলি এখন নতুন বাজেট চাইছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলির স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টার ব্যাপারে ক্যামেরন ট্রেসি এবং টাইলার রোগোওয়ের কথাগুলি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘রেথিয়ন’এর প্রধানের কথাতেও প্রতিফলিত হয়েছে, যিনি মার্কিন হাইপারসনিক প্রকল্পকে চীনাদের থেকে কয়েক বছর পিছিয়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। চীনারা বলছে যে, মার্কিনীদের উচিৎ অন্য রাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা ডেভেলপ করার ব্যাপারে সহনশীল আচরণ করতে। প্রকৃতপক্ষে চীন এবং রাশিয়ার হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপের কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। ২০০১ সালের পর থেকে মার্কিনীরাই আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মার্কিনীরা বলছে যে, উত্তর কোরিয়ার মতো কোন ‘অবাধ্য রাষ্ট্র’ যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে হবে। এর ফলশ্রুতিতে রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তি অর্থহীন হয়ে যায় এবং রাশিয়া নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়ে যায়। একারণেই রাশিয়া হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপ করায় মনোযোগী হয়। চীনারা জানে যে, মার্কিনীদের পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’কে চীনারা প্রতিহত করতে না পারলেও চীনা ‘ট্রায়াড’কে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিহত করতে পারবে; একারণেই চীনারাও সেই একই পথে এগুচ্ছে। হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই লাগামহীন প্রতিযোগিতা ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থারই একটা প্রমাণ মাত্র।
No comments:
Post a Comment