Friday 25 December 2020

সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করবে কে?

২৫শে ডিসেম্বর ২০২০

সোমালিয়ার উপকূলে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘মাকিন আইল্যান্ড’। কেউ কেউ মনে করছেন যে, মার্কিনীরা চলে যাবার পরে আল শাবাবের আক্রমণ আবারও বেড়ে যেতে পারে। তবে যে ব্যাপারটা আলোচনায় আসেনি তা হলো, সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান কে নিতে পারে।


সোমালিয়ার উপকূলে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলি ব্যস্ত রয়েছে। উভচর এসল্ট শিপ ‘মাকিন আইল্যান্ড’ এবং সী বেইজ শিপ ‘হার্শেল উডি উইলিয়ামস’ সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার কাজ করছে। এর আগে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারির ১৫ তারিখের মাঝে সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার নির্দেশ দেন। মার্কিন সামরিক বাহিনীর বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, সোমালিয়াতে ৭’শ মার্কিন সেনা রয়েছে, যাদের কিছু অংশ মার্কিনীরা পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলিতে, মূলতঃ জিবুতি এবং কেনিয়াতে সরিয়ে নিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে একইভাবে সৈন্য সরিয়ে নেবার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বরাবরই এসব সামরিক মিশনগুলিকে ব্যয়সাধ্য এবং অকার্যকর বলে আখ্যা দিয়েছেন। গত নভেম্বরেই ট্রাম্প প্রতিরক্ষা সচিবের পদ থেকে মার্ক এসপারকে অব্যাহতি দেন। এসপার চাইছিলেন যে, সোমালিয়াতে মার্কিন সেনারা থাকুক। পেন্টাগনের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনাদের অন্য দেশে সরিয়ে নেয়া মানে এ নয় যে, মার্কিন নীতির পরিবর্তন হয়েছে। এতে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গী গ্রুপগুলির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখবে এবং একইসাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান সমুন্নত রাখবে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, মার্কিন এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত খারাপ সময়ে এসেছে; যখন দুই মাসের মাঝে সোমালিয়াতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে চলেছে; আর প্রতিবেশী ইথিওপিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একইসাথে বহু বছর ধরে পার্শ্ববর্তী জিবুতি, কেনিয়া এবং সেইশেল দ্বীপ থেকে মার্কিন বিমান হামলার পরেও আল শাবাব জঙ্গী গোষ্ঠিকে দমন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেদনে আশংকা করা হচ্ছে যে, এখন মার্কিনীরা চলে যাবার পরে আল শাবাবের আক্রমণ আবারও বেড়ে যেতে পারে। তবে প্রতিবেদনে যে ব্যাপারটা আলোচনায় আসেনি তা হলো, সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান কে নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সোমালিয়ার রাজনৈতিক এলিটরা মার্কিন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সোমালিয়ার পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক সিনেট কমিটির সদস্য আইয়ুব ইসমাঈল ইউসুফ ‘রয়টার্স’কে পাঠানো এক বার্তায় বলেন যে, আল শাবাবের সাথে যুদ্ধের এমন এক সময়ে সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার দুখঃজনক। সোমালিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি অনেক বড় অবদান রেখেছে এবং সোমালি সেনাদের ট্রেনিংএর পিছনে অনেক বড় সহায়তা দিয়েছে। তিনি তার এক টুইটার বার্তায় নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ট্যাগ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযোগ পেশ করেন। তবে এহেন মতামত কি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারছে যে, সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
১৮ই ডিসেম্বর সেন্ট্রাল সোমালিয়ার মুদুগ অঞ্চলের গালকায়ো শহরের একটা স্টেডিয়ামে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়। ১৪ বছর ধরে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় যুদ্ধ করার পরেও সোমালিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং তার আশেপাশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিজেদের জীবনের ব্যাপারে নিশ্চিত নন। মার্কিন সেনারা সোমালিয়া থেকে সরে গেলে এই পরিস্থিতি আর কতটা পরিবর্তন হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন কি?


সোমালিয়ার যুদ্ধের অবস্থা


সোমালিয়াতে আফ্রিকান ইউনিয়নের ব্যানারে কয়েকটা দেশের ২১ হাজার ৫’শ ২৪ জন সেনা মোতায়েন রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন মিশন ইন সোমালিয়া’ বা ‘আমিসম’ নামের এই মিশনে আফ্রিকার ১০টা দেশের ২২ হাজারেরও বেশি সেনা এবং পুলিশ মোতায়েন থাকলেও সবচাইতে বেশি সেনা এসেছে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে। ‘আমিসম’এর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, সোমালিয়াতে প্রতিবেশী উগান্ডার রয়েছে সবচাইতে বেশি ৬ হাজার ২’শ ২৩ জন সেনা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৪’শ ৩২ জন সদস্য এসেছে বুরুন্ডি থেকে। ইথিওপিয়ার রয়েছে ৪ হাজার ৩’শ ৯৫ জন সেনা। এই মিহুর্তে একটা ব্যাটালিয়ন উঠিয়ে নেবার পর এই মিশনে কেনিয়ার সেনা রয়েছে ৩ হাজার ৬’শ ৬৪ জন। সিয়েরা লিওন থেকে ৮’শ ৫০ জন সেনা এসে কেনিয়ার উঠিয়ে নেয়া ব্যাটালিয়নের স্থান নিয়েছে। এছাড়াও জিবুতির রয়েছে ৯’শ ৬০ জন সেনা। এই সেনাদের বাইরেও সোমালিয়ার যুদ্ধে কেনিয়া নিয়োজিত করেছে তাদের সেনাবাহিনীর ৫০তম এয়ার ক্যাভালরি ব্যাটালিয়ন; যাতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ‘এমডি ৫০০’, ‘এমডি ৫৩০এফ’ এবং ‘এএইচ ১এফ কোবরা’ এটাক হেলিকপ্টার। ‘আফ্রিকা ইইউ পার্টনারশিপ’ প্রকল্পের ওয়েবসাইট বলছে যে, ‘আমিসম’কে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। ২০১৯ সালে ইইউএর বাৎসরিক সহায়তার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ২’শ ৫৩ মিলিয়ন ডলারে। এতকিছুর পরেও সোমালিয়ার প্রতিবেশী এই দেশগুলির সেনারা নিয়মিতভাবে আল শাবাবের বড় আকারের হামলার শিকার হয়েছে। এসব হামলায় মোট কতজন সেনা মৃত্যুবরণ করেছে তার বিশ্বাসযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। তবে এই সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার ৪’শ থেকে ১ হাজার ৮’শ বলে ২০১৯এর এক গবেষণায় প্রকাশ করে ‘দ্যা গ্লোবাল অবজারভেটরি’। এত বিপুল সংখ্যক আফ্রিকান সেনা মোতায়েন এবং হতাহতের পরেও মাত্র কয়েক’শ মার্কিন সেনা উঠিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা কেউ কেউ মানতে পারছেন না। সোমালিয়ার পুরো নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের প্রশিক্ষণে তৈরি করা হয়েছে সোমালিয়ার স্পেশাল ফোর্স ‘দানাব ব্রিগেড’। ১১’শ সেনার এই ‘দানাব ব্রিগেড’ই সোমালিয়ার সেনাবাহিনীর মাঝে সবচাইতে ভালো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ‘দানাব’এর প্রাক্তন কমান্ডার কর্নেল আহমেদ আব্দুল্লাহি শেখ ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, যদি মার্কিন সেনারা পুরোপুরি চলে যায়, তাহলে আল শাবাবএর বিরুদ্ধে অপারেশন বেশ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন যে, প্রায় তিন বছর ‘দানাব’এ থাকাকালীন তার অধীনে শতাধিক সেনা মৃত্যুবরণ করেছে; মার্কিন সেনা মারা গিয়েছিল মাত্র দুইজন। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য রয়েছে যে ২০২৭ সালের মাঝে ‘দানাব’এর সদস্যসংখ্যাকে ৩ হাজারে উন্নীত করা। মার্কিনীরা সোমালিয়াতে না থাকলে সেটা বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন কর্নেল শেখ।

প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাল্টি বিলিয়ন ডলার খরচের পরেও সোমালিয়াতে এত বছরে কেন শান্তি ফিরে এলো না। গত ১৮ই ডিসেম্বর সেন্ট্রাল সোমালিয়ার মুদুগ অঞ্চলের গালকায়ো শহরের একটা স্টেডিয়ামে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়। হামলার টার্গেট ছিল গত সেপ্টেম্বর থেকে আসীন হওয়া সোমালিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহামেদ হুসেইন রোবলে। প্রধানমন্ত্রী বেঁচে গেলেও তার নিরাপত্তা বাহিনীর ৪ জন এবং সেনাবাহিনীর ২১তম ডিভিশনের কমান্ডার নিহত হন বলে বলছে সোমালি পুলিশ। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্টেডিয়ামে নির্বাচনী বক্তব্য দিতে যাচ্ছিলেন। আল শাবাব এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে বলছে বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’। ১৪ বছর ধরে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় যুদ্ধ করার পরেও সোমালিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং তার আশেপাশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। মার্কিন সেনারা সোমালিয়া থেকে সরে গেলে এই পরিস্থিতি আর কতটা পরিবর্তন হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন কি?

 
সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা

ভূকৌশলগতভাবে সোমালিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। তাই কোন শক্তিই সোমালিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চাইছে না। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাব এল মান্ডেব প্রণালী এবং আদেন উপসাগরের পাশে অবস্থিত হওয়ায় ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে সমুদ্র যোগাযোগের পথের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে সোমালিয়া এবং এর পার্শ্ববর্তী জিবুতি ও এরিত্রিয়া। এছাড়াও সোমালিয়া থেকে প্রকৃতপক্ষে আলাদাই রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সোমালিল্যান্ড। বাব এল মান্ডেব প্রণালীর উত্তর পাড়ে রয়েছে ইয়েমেন। প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ জিবুতিতে ফরাসিরা একটা সামরিক ঘাঁটি রেখেছিল বহু আগে থেকেই। ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১এর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রও ২০০২ সালে জিবুতিতে ফরাসি সামরিক ঘাঁটির পাশে আরেকটা ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। এই ঘাঁটি থেকে মার্কিনীরা ইয়েমেন এবং সোমালিয়াতে বিমান হামলা চালনা করে। সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুতা প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে জিবুতিতে জাপান একটা সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে ২০১১ সালে। এরপর ২০১৬ সালে চীনারাও জিবুতিতে একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে।

২০১৪ সালে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সাথে মনসুর হাদি সরকারের যুদ্ধ শুরু হলে অত্র অঞ্চলের হিসেব পাল্টে যায়। ২০১৫ সালে এরিত্রিয়ার আসাব বন্দর এলাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা শুরু করে। এছাড়াও আদেন উপসাগরে সকোত্রা দ্বীপেও আমিরাতিরা ইন্টেলিজেন্স স্থাপনা বসিয়েছে বলে কেউ কেউ দাবি করছে। এরপর ২০১৭ সালে আমিরাতিরা সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশ সোমালিল্যান্ডে বারবেরা সমুদ্রবন্দর উন্নয়নের জন্যে চুক্তি করে। এতে সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আমিরাতের সম্পর্কের অবনতি হয়। আমিরাত সোমালিয়ার উত্তরের আরেকটা স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ পুন্টল্যান্ডের বোসাসোতে সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে চেয়েছিল। মোগাদিশুর কেন্দ্রীয় সরকার সেটার ব্যাপারেও বাধা প্রদান করেছিল। আমিরাত পুন্টল্যান্ডের ম্যারিটাইম পুলিশ ফোর্স নামের একটা মিলিশিয়াকেও অর্থায়ন করে থাকে, যা পুন্টল্যান্ডের নেতৃত্বকে নিরাপত্তা দেয়। আমিরাতের এই প্রচেষ্টাগুলিকে সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার সোমালিয়াকে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা হিসেবেই দেখেছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে সোমালি সরকার আমিরাতের একটা বিমান থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার অর্থ জব্দ করে। সোমালিয়া অভিযোগ করে যে, এই অর্থ সোমালিয়ার বিচ্ছন্নতাকামী প্রদেশগুলিকে ঘুষ হিসেবে দেবার চেষ্টা চলছিল। অপরদিকে আমিরাত পাল্টা অভিযোগ করে যে, সোমালি সরকার কাতারের অর্থ দ্বারা পুষ্ট।

সোমালিয়ার গুরুত্ব পুরোপুরি পাল্টে যায় তুরস্কের আবির্ভাবের মাধ্যমে। ২০১০ সালের মে মাসে সোমালিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে তুরস্কের সাথে সোমালিয়ার একটা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ২০১১ সালে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান প্রথমবারের মতো মোগাদিশু ভ্রমণ করেন। সেসময় ‘বিবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলু বলেন যে, সোমালিদের সাথে বন্ধন বৃদ্ধি করতে এবং সেখানকার চলমান দুর্ভিক্ষে মানবিক সহায়তা দিতে তুরস্কের শীর্ষ নেতৃত্ব সোমালিয়া গিয়েছিল। সোমালিয়াতে কেউ যেতে পারে না, এমন চিন্তাটাও তারা ভাঙতে চেয়েছেন। ২০১২ সালে সোমালিয়ার প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠা হয় এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন হাসান শেখ মোহামুদ। এসময় থেকেই তুরস্কের সাথে সোমালিয়ার সম্পর্কের উন্নয়ন হতে থাকে। ২০১৩ সালে তুর্কি কোম্পানি ‘ফাভোরি’ মোগাদিশু এয়ারপোর্টের উন্নয়নের কাজ পায় এবং একইসাথে টারকিশ এয়ারলাইন্স প্রথম বিমান সংস্থা হিসেবে মোগাদিশুতে ফ্লাইট অপারেট শুরু করে। একই বছর সোমালি পার্লামেন্ট তুর্কি কোম্পানি ‘আল বায়রাক’কে ২০ বছরের জন্যে মোগাদিশু সমুদ্রবন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়। ২০১৪ সালে তুরস্কের ট্রেনিং একাডেমিতে সোমালি সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্যে দুই দেশের মাঝে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মোগাদিশুতে ৪’শ হেক্টর বা ৪ বর্গ কিঃমিঃ জমির ওপর তুরস্কের বিশাল সামরিক ঘাঁটি ‘তুর্কসোম’ উদ্ভোধন করা হয়। এই ঘাঁটিতে একসাথে দেড় হাজার সোমালি সেনা এবং অফিসারের প্রশিক্ষণ দেবার জন্যে ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১২ সপ্তাহ ট্রেনিং দেবার মাধ্যমে প্রতি বছর সোমালি সেনাবাহিনীর তিনটা ব্যাটালিয়ন তৈরি করতে চাচ্ছে তুরস্ক। একসাথে ২’শ তুর্কি সামরিক সদস্য এখানে কাজ করছে। এটা তুরস্কের বাইরে সেদেশের সবচাইতে বড় সামরিক ঘাঁটি। সর্বশেষ ২০২০এর জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঘোষণা দেন যে, সোমালিয়া তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

এই অঞ্চলের আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র মিশরও প্রভাব বিস্তারের খেলা থেকে পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। ৬ই ডিসেম্বর মিশরের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেরিফ ইসার নেতৃত্বে একটা উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক দল সোমালিয়া সফর করে আসে। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, এই দলটা সোমালিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহামেদ আব্দিরিজাকএর সাথে দেখা করে আঞ্চলিক ইস্যুগুলি নিয়ে আলোচনা করে এবং পুরো ‘হর্ন অব আফ্রিকা’র উপর এই ইস্যুগুলির প্রভাব কি হতে পারে, তা নিয়ে কথা বলে। ‘ইজিপশিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন এফেয়ার্স’এর সদস্য রোখা হাসান বলছেন যে, মিশর সোমালিয়ার সাথে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে সোমালিয়াতে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি দেখে মিশরও বাধ্য হচ্ছে সোমালিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে। গত মার্চে আরব লীগের বৈঠকে মিশর নীল নদের উপর ইথিওপিয়ার বাঁধ দেয়ার ব্যাপারে আরব দেশগুলির ঐকমত্য চাইলে সোমালিয়া মিশরকে সমর্থন দেয়নি। আর মে মাসে আমিরাতের মতো মিশরও সোমালিয়ার ফেডারেল রাজ্য পুন্টল্যান্ডের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলছিল; যা দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। ‘এরাব সেন্টার ফর পলিটিক্যাল স্টাডিজ’এর উপ প্রধান মুখতার ঘোবাশি বলছেন যে, হতে পারে যে সোমালিয়াতে মিশরের কূটনীতিকেরা মোগাদিশুতে মিশরের একটা সামরিক ঘাঁটির ব্যাপারে কথা বলেছেন। তবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর ওমর মাহমুদ মনে করছেন না যে, সোমালিয়ার সাথে মিশরের সম্পর্কের বড় কোন পরিবর্তন হয়েছে।

 

সোমালিয়ার সাথে প্রতিবেশীদের সম্পর্ক

সোমালিয়ার দক্ষিণে কেনিয়ার সাথে মোগাদিশু সরকারের রেষারেষি চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই; যদিও সোমালিয়ার অভ্যন্তরে কেনিয়ার কয়েক হাজার সেনা রয়েছে। গত ১৫ই ডিসেম্বর সোমালিয়ার সরকার টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে কেনিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। কেনিয়া থেকে সোমালিয়ার সকল কূটনীতিকদের দেশে ফিরে আসতে বলা হয়েছে; আর একইসাথে সোমালিয়াতে কেনিয়ার সকল কূটনীতিককেও এক সপ্তাহের মাঝে দেশত্যাগ করতে বলা হয়েছে। সোমালিয়ার তথ্যমন্ত্রী ওসমান দুবে রাষ্ট্রীয় ‘এসএনটিভি’তে বলেন যে, কেনিয়া সোমালিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে এবং তারা সোমালি সরকারের বারংবার অনুরোধকে এড়িয়ে গেছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, যদিও ঠিক কোন বিষয়গুলি নিয়ে সোমালিয়া বিরক্ত হয়েছে সেটা দুবে বলেননি, তথাপি একটা ধারণা করা যায় যে, এটা সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী সোমালিল্যান্ডের জন্যেই হয়েছে; কারণ ওই মুহুর্তে সোমালিল্যান্ডের নেতা মুসা বিহি আব্দি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি সফর করছিলেন। পরদিন ১৬ই ডিসেম্বর কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনইয়াট্টা বলেন যে, তার দেশ সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসাতে আগামী মার্চের মধ্যেই একটা কনসুলেট খুলবে। এছাড়াও কেনিয়ার সরকারি বিমান সার্ভিস নাইরোবি এবং হারগেইসার মাঝে ফ্লাইট শুরু করবে। সোমালি সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণার পর কেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইরাস ওগুনা বলেন যে, এই কূটনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে সরকার একটা কমিটি গঠন করেছে। তিনি বলেন যে, কেনিয়ার সরকার ২ লক্ষ সোমালি শরণার্থীকে কেনিয়ার অভ্যন্তরে থাকতে দিয়ে দয়ার উদাহরণ দেখিয়েছে। তবে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও আগ থেকেই খারাপ হচ্ছিল। ৩০শে নভেম্বর সোমালিয়া কেনিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিঃষ্কার করে এবং নিজের রাষ্ট্রদূতকে কেনিয়া থেকে ডেকে পাঠায়। সোমালিয়ার অভিযোগ ছিল যে, কেনিয়া তার সীমান্তে অবস্থিত সোমালি প্রদেশ জুবাল্যান্ডের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। জুবাল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আহমেদ মাদোবে জুবাল্যান্ডের উপর মোগাদিশুর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার অভিযোগ করে আসছেন। কেনিয়ার অভ্যন্তরে আল শাবাবের হামলা বন্ধে কেনিয়া জুবাল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাদোবের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। জুবাল্যান্ডের একজন মন্ত্রীকে মোগাদিশু সরকার বিভিন্ন অপরাধের কারণে গ্রেপ্তার করতে চাইছে; কিন্তু কেনিয়া সরকার তাকে আশ্রয় দিয়েছে। এছাড়াও দুই দেশের সমুদ্রসীমা নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সোমালিয়া ভারত মহাসাগরের উপকূলে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে সচেষ্ট হওয়ায় তা কেনিয়ার সাথে সম্পর্ককে টানাপোড়েনের মাঝে ফেলেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ওমর মাহমুদ বলছেন যে, জুবাল্যান্ডের অনেক রাজনীতিবিদই মোগাদিশুতে ফেরার আগে নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে নাইরোবিকে ব্যবহার করেছেন। সোমালিয়া কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে কেনিয়ার নীতির পরিবর্তন ঘটাতে চাইছে। তবে তিনি বলছেন যে, সোমালিয়াতে কেনিয়ার সেনাদের অবস্থানের ব্যাপারটা এখনও অনিশ্চিত। যদি কেনিয়ার সেনা প্রত্যাহারের কথা ওঠে, তবে সেটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।

সোমালিয়ার পশ্চিমে রয়েছে ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়াতে তিগ্রে অঞ্চলের বিদ্রোহীদের সাথে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ; যা দীর্ঘায়িত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় সোমালিয়াতে ইথিওপিয় সেনাদের অবস্থান শংকার মাঝে পড়তে পারে। ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর ডিরেক্টর ভানডা ফেলবাব ব্রাউন এক লেখায় বলছেন যে, সোমালিয়ার সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বহু বছর ট্রেনিং দেবার পরেও গোত্রভিত্তিক বাহিনীই রয়ে গেছে; আল শাবাবের বিরুদ্ধে যাদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা যথেষ্টই কম। একারণে সোমালিয়ার নিরাপত্তার জন্যে ইথিওপিয়ার সেনাদের গুরুত্ব অনেক। যদিও ২০১৬ সালের পর থেকে ‘আমিসম’এর সেনারা কোন বড় আক্রমণে না গিয়ে গ্যারিসনে বসে সময় কাটিয়েছে, তথাপি এই সেনাদের উপস্থিতি সোমালিয়ার মিলিশিয়াদেরকে শক্তি যোগায়। তিগ্রে অঞ্চলে ইথিওপিয় সরকারের অভিযান শুরুর পর থেকে সোমালিয়াতে অবস্থানরত ইথিওপিয় সেনাদের মাঝে তিগ্রেদের নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। ফেলবাব ব্রাউন বলছেন যে, তিগ্রে অঞ্চলের সংঘাত আরও গভীর হলে এবং ইথিওপিয়া সরকার তিগ্রেদের দমন করতে যদি সোমালিয়া থেকে সেনা হ্রাস করতে উদ্যত হয়, তবে ‘আমিসম’এর নিরাপত্তা সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। তদুপরি, ইথিওপিয়া সেনা সরিয়ে নিতে চাইলে জিবুতি, উগান্ডা এবং বুরুন্ডির মতো দেশগুলিও তাদের সেনা সরিয়ে নিতে চাইতে পারে। ২০২১ সালে ‘আমিসম’এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা নবায়ন করা হবে কিনা, তা নির্ভর করছে ইথিওপিয়ার অংশ নেবার উপর। তবে কেনিয়ার ভূমিকার মতো ইথিওপিয়ার ভূমিকা মোগাদিশু সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী নয়। সোমালিয়ার স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যগুলির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ইথিওপিয় সেনারা সরাসরি সহায়তা করেছে। এমনকি জুবাল্যান্ডের নির্বাচনের সময় কেনিয়ার সেনাদের সাথে প্রায় সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছিল ইথিওপিয় সেনারা। এর মূল কারণ ইথিওপিয়াও সোমালিয়ার মতো ফেডারেল রাষ্ট্র এবং সোমালিয়াতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ইথিওপিয়ার জন্যে খারাপ উদাহরণ।

 
সোমালি সেনারা ‘ক্যাম্প তুর্কসোম’এ ট্রেনিং নিচ্ছে। তুর্কিরা সোমালিয়ার মাঝে একটা সামরিক সংস্কৃতি তৈরি করতে চাচ্ছে; যার মাধ্যমে কৌশলগত ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে তারা একটা সত্যিকারের বন্ধু পাবে।


সোমালিয়ায় বাড়ছে তুরস্কের প্রভাব

সোমালিয়ার বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ সোমালিয়াতে তুর্কি রাষ্ট্রদূতের কাছে এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, তারা জানতে পেয়েছেন যে তুরস্ক সোমালিয়ার স্পেশাল পুলিশ ফোর্স ‘হারমাআদ’এর জন্যে ১ হাজার ‘জি৩’ এসল্ট রাইফেল এবং দেড় লক্ষ বুলেট সরবরাহ করছে। চিঠিতে তারা বলেন যে, সোমালিয়ার নির্বাচনের আগে সংবেদনশীল সময়ে এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আসাতে তারা চিন্তিত। সোমালিয়ার ‘ওয়াদাজির’ পার্টির চেয়ারম্যান আব্দিরাহমান আব্দিশাকুর ওয়ারসামি ‘রয়টার্স’এর কাছে এই চিঠির সত্যতা স্বীকার করেন। চিঠিতে তারা আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট মোহামেদ আব্দুল্লাহি মোহামেদ ইতোমধ্যেই ভীতি প্রদর্শন এবং আঞ্চলিক নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে ‘হারমাআদ’কে ব্যবহার করেছেন; কাজেই নিঃসন্দেহে সেই একই ‘হারমাআদ’ এবং তুর্কি অস্ত্র আসন্ন নির্বাচনকে হাইজ্যাক করতে ব্যবহৃত হবে। তারা এই অস্ত্রের চালান নির্বাচনের পর দেয়ার জন্যে তুরস্ককে অনুরোধ জানান। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহি মোহামেদের সরকারের সাথে তুরস্কের বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক চলছে। তুরস্কের অর্থায়নে সোমালিয়াতে হাসপাতাল, স্কুল এবং অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও সোমালি ছাত্রদের তুরস্কে পড়াশোনার জন্যে স্কলারশিপের ব্যবস্থাও করেছে তুরস্ক। কিন্তু তুর্কিদের সাথে সোমালিদের এই সখ্যতা আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে পড়ে গেছে; যেখানে একপক্ষে রয়েছে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত, আর অপরপক্ষে রয়েছে তুরস্ক ও কাতার।

তুরস্কের সরকারি বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে সামরিক ঘাঁটি ‘তুর্কসোম’এর সরেজমিন বর্ণনা দেয়া হয়। সেখানে সোমালি সেনাদেরকে তুর্কি ভাষা পড়তে, লিখতে এবং বলতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থী সেনারা তুরস্কের মিলিটারি একাডেমিতে যে সামরিক সঙ্গীত গাওয়া হয়, সেই সঙ্গীত গায়। এমনকি সেনাদের খাবার পরিবেশন করেন তুর্কি বাবুর্চি, যিনি তুর্কি খাবারই পরিবেশন করেন সোমালি সেনাদের জন্যে। সেনারা প্রশিক্ষণের জন্যে যে অস্ত্র ব্যবহার করছে, তা হলো তুর্কি সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত ‘এমপিটি ৭৬’ রাইফেল। সোমালি প্রশিক্ষণার্থী সেনা হাসান আব্দুল্লাহ আহমেদ বলেন যে, ৫’শ বছর আগে অটোমান সাম্রাজ্যের মতোই তুর্কি ভাইরা সোমালিদের জন্যে দরজা খুয়ে দিয়েছে। সারা দুনিয়া যখন সোমালিদের সামনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন তুর্কি ভাইরাই সোমালিদের হিসেব ছাড়া সহায়তা দিয়েছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তুরস্ক প্রায় আড়াই হাজার সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় তুর্কি বিশ্লেষক ক্যান কাসাপোগলু বলছেন যে, তুরস্ক ‘তুর্কসোম’ ঘাঁটির মাধ্যমে ১০ হাজার সেনাকে ট্রেনিং দিতে চাচ্ছে, যারা তৈরি করবে তুর্কি ভাষাভাষী সোমালি সেনাবাহিনী। স্পেশাল ফোর্সের ট্রেনিংএর জন্যে এই সেনাদেরকে তুরস্কেও পাঠানো হচ্ছে। তুর্কিরা সোমালিয়ার মাঝে একটা সামরিক সংস্কৃতি তৈরি করতে চাচ্ছে; যার মাধ্যমে কৌশলগত ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে তারা একটা সত্যিকারের বন্ধু পাবে।

সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান কে নেবে?

যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছে না। জিবুতি এবং কেনিয়াতে মার্কিন ঘাঁটিগুলি থেকে যাবে। তবে সোমালিয়াতে মার্কিন অবস্থানকে কে প্রতিস্থাপন করবে, সেটা নিয়েই হবে আলোচনা। তুরস্ক সোমালিয়াতে সেই অবস্থানটা নেবার চেষ্টাতেই সেখানে সামরিক ঘাঁটি ছাড়াও বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছে। ক্যান কাসাপোগলু বলছেন যে, তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে তার সামরিক ঘাঁটি তৈরি করছে; যেমন লিবিয়া। সোমালিয়া যেহেতু বাব এল মান্ডেব প্রণালী এবং আদেন উপসাগর দিয়ে যাওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের উপর অবস্থিত, তাই সেখানে তুরস্ক তার অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু লিবিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে যে, এর ফলে তুরস্ককে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করতে হবে। আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে যে, তাদের নীতির মাধ্যমে তারা সোমালিয়ার ফেডেরাল রাজ্যগুলিকে, বিশেষ করে উত্তরের সোমালিল্যান্ড এবং পুন্টল্যান্ডকে সোমালিয়া থেকে আলাদা করে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। অপরদিকে সোমালিয়ার নিরাপত্তায় কয়েক হাজার সেনা মোতায়েনের পরেও কেনিয়া মোগাদিশু সরকারের বন্ধু হতে পারেনি। সোমালিয়ার সাথে কেনিয়ার সীমান্তে একটা বাফার বাজ্য তৈরি করার চেষ্টায় কেনিয়া সরকার জুবাল্যান্ড রাজ্যের সাথে আলাদাভাবে সখ্যতা তৈরি করেছে। হাইড্রোকার্বনে পূর্ণ সমুদ্রসীমা নিয়েও বিরোধ রয়েছে তাদের মাঝে। একইসাথে আমিরাতের নীতি অনুসরণ করে সোমালিল্যান্ডকেও আলিঙ্গন করেছে কেনিয়া। এক্ষেত্রে সোমালিয়ার বন্ধু থেকেছে ইথিওপিয়া; যারা নিজেদের ফেডেরাল অবস্থার কথা চিন্তা করে সোমালিয়ার ফেডারেশন টিকিয়ে রাখতে সরাসরি সহায়তা দিয়েছে। একারণেই ইথিওপিয়ার তিগ্রে অঞ্চলের গৃহযুদ্ধ সোমালিয়ার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ১৪ বছর মার্কিন এবং ইউরোপিয় সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা সত্ত্বেও সোমালিয়ার যুদ্ধ শেষ হয়নি। বরং বিস্তর অঞ্চল এখনও আল শাবাবএর দখলে; এখনও সোমালিয়ার নেতৃবৃন্দ নিরাপদে ঘোরাফিরা করতে অক্ষম। এমতাবস্থায় তুরস্ক মোগাদিশু সরকারের পিছনে বিনিয়োগ করছে। তুরস্কের জাতীয় আকাংক্ষা তুরস্ককে অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন অব আফ্রিকা’তে টেনে এনেছে। সোমালিয়াতে শক্তিশালী অবস্থান মানেই ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরে স্থায়ী উপস্থিতির একটা সুযোগ। আল শাবাব, আমিরাত এবং কেনিয়ার সাথে সোমালিয়ার দ্বন্দ্বকে তুরস্ক সুযোগ হিসেবেই নিয়েছে; যদিও এই সুযোগ কাজে লাগানো বেশ কঠিন কাজ।

No comments:

Post a Comment