Tuesday 22 December 2020

‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’... নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার শুরু?

২২শে ডিসেম্বর ২০২০

‘ফেইস রেকগনিশন’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে চীনে ‘সোশাল রেটিং’ বা ‘সোশাল ক্রেডিট’এর যে ব্যবহার শুরু হয়েছে, তা চীনাদেরকে ‘এআই’ ডেভেলপমেন্টে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠির দৈনন্দিন জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ডে প্রযুক্তির ব্যবহার একটা নৈতিক প্রশ্নের অবতারণা করেছে, যা বিশ্বকে বিভাজিত করছে।


মার্কিন বিমান বাহিনী বলছে যে, গত ১৫ই ডিসেম্বর তারা প্রথমবারের মতো একটা সামরিক বিমানের কোপাইলট হিসেবে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এআই’, অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করেছে। বিমান বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ডিজিটাল যুগে তাদের জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে একটা বড় ধাপ এগিয়েছে। মার্কিনীরা মনে করছে যে, ‘এআই’এর ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির সাথে এগিয়ে থাকার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিমান বাহিনীর ‘এয়ার কমব্যাট কমান্ড ইউ ২ ফেডেরাল ল্যাবরেটরি’র গবেষকেরা ‘আরটাম’ নামের এই এলগোরিদম ডেভেলপ করে। মার্কিন বিমান বাহিনীর বরাত দিয়ে ‘সিএনএন’ বলছে যে, একটা মহড়ার মাঝে বিমান বাহিনীর ‘ইউ ২’ কৌশলগত গোয়েন্দা বিমানে এই পরীক্ষা সফলভাবে চালনা করা হয়, যেখানে ‘এআই’ একজন মানুষের জন্যে বরাদ্দকৃত কাজগুলি সম্পাদন করে। বিমান চালনার কর্মকান্ডের মাঝে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সেন্সরগুলি পরিচালনা এবং ট্যাকটিক্যাল ন্যাভিগেশন বা দিকনির্দেশনার কাজগুলি ‘আরটাম’ সম্পাদন করে। অপরপক্ষে বিমানের মূল পাইলট খেয়াল রাখছিলেন যে কোন শত্রু বিমান এসে পড়ে কিনা। বিমান বাহিনীর ক্রয় পরিদপ্তরের সহকারি সচিব উইল রোপার এক বার্তায় বলেন যে, ‘এআই’এর সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে ব্যর্থতা মানেই হলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হার স্বীকার করে নেয়া।

‘এআই’এর সাথে পশ্চিমা স্বাধীনচেতাদের দ্বন্দ্ব

‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর বহু খাত প্রতিদিনই খুলছে, যা মাত্র কিছুদিন আগেই ছিলই না। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে ‘এআই’এর ব্যবহার ব্যাপক বেড়ে গেছে। সিয়াটলের সফটওয়্যার কোম্পানি ‘রিয়েল নেটওয়ার্কস’ একটা ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা বিভিন্ন বাণিজ্যিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে মাস্ক পড়ার বাধ্যবাধকতা মনে করিয়ে দেবে। ‘মাস্ক চেক’ নামের ‘এআই’ ভিত্তিক এই ব্যবস্থা প্রথমে একটা ট্যাবলেটের ক্যামেরা ব্যবহার করে নিশ্চিত করে যে, এর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মানুষটা মাস্ক পড়েছে কিনা অথবা সঠিকভাবে সেটা মুখের উপর লাগিয়েছে কিনা; যেমন, মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকলেও নাক বের হয়ে আছে কিনা। এরপর দরকার অনুযায়ী এই ব্যবস্থাটা সতর্কবার্তা দেবে এবং সঠিকভাবে মাস্ক পড়ার নিয়ম দেখিয়ে দেবে। ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘রিয়েল নেটওয়ার্কস’এর চিফ টেকনলজি অফিসার রেজা রাসুল বলছেন যে, এই ‘এআই’ প্রকৃতপক্ষে মানুষের চেহারা বিশ্লেষণ করে পরিচয় খুঁজে না বা কোনকিছু রেকর্ড করে না। তবে এর ব্যবহারকারী চাইলে ব্যক্তির ছবি তুলে তা আরও কিছু সেবা দিতে সক্ষম। যেমন মানুষের বয়স এবং লিঙ্গ বোঝার মাধ্যমে তা তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম, যার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা সম্ভব যে, কো ধরণের মানুষের মাঝে মাস্ক পড়ার প্রচলন কেমন। তবে ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এখানেই আসল আলোচনার বিষয়টা চলে আসছে। এই ব্যবস্থায় যত বেশি তথ্য রেকর্ড করার ব্যবস্থা করা হবে, ততটাই তা একটা পুলিশ রাষ্ট্রের কথা মনে করিয়ে দেবে। এছাড়াও ‘মাস্ক চেক’ ব্যবস্থার মাঝে না থাকলেও কেউ কেউ ইতোমধ্যেই চিন্তা করছেন যে, এর মাঝে একটা অপশন থাকতে পারে, যার মাধ্যমে মুখে মাস্ক না থাকলে ‘এআই’ ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় দরজা আটকে দিয়ে প্রতিষ্ঠানে ঢোকার পথে বাধা প্রদান করবে। সেকুলার আদর্শের পশ্চিমা স্বাধীনচেতা সমাজে অনেকেই চান না যে, সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান তাদেরকে বাধ্য করুক মাস্ক পড়তে। চীনে 'ফেইস রেকগনিশন' প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই মানুষের ব্যক্তিগত কর্মকান্ডের উপর নজরদারি করার কথা আলোচনায় এসেছে। আপাততঃ পশ্চিমা সেকুলার আদর্শের সাথে খুব সামান্য ব্যবধান রেখে চলছে ‘এআই’। তবে পশ্চিমা সমাজের অধঃগামিতা অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে, যা ‘এআই’এর ক্ষেত্রকে আরও বাড়াচ্ছে। নিরাপত্তার কথা বলে পশ্চিমা বিশ্বেও অনেকেই চীনাদের মতো না হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘ফেইস রেকগনিশন’ প্রোগ্রামের ব্যবহার করতে ইচ্ছাপোষণ করছেন।
ডিসেম্বর ২০২০। মনুষ্যবিহীন ‘এআই’ চালিত ড্রোন ‘ভ্যালকাইরি’র সাথে ফর্ম্যাশন ফ্লাইটে মার্কিন বিমান বাহিনীর মনুষ্য চালিত ‘এফ৩৫’ এবং ‘এফ২২’ যুদ্ধবিমান। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর সবচাইতে জটিল কাজগুলি হচ্ছে প্রতিরক্ষা শিল্পে। ‘এআই’ বর্তমানে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে একটা নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে।



‘এআই’এর আসল ক্ষেত্র হলো প্রতিরক্ষা

‘জাপান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক সেক্টর প্রতি বছর ‘এআই’এর পিছনে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। তবে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর সবচাইতে জটিল কাজগুলি হচ্ছে প্রতিরক্ষা শিল্পে। ‘বিজনেস ওয়্যার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডিফেন্স প্ল্যাটফর্ম’ বা ‘এআইডিপি’ নামের একটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এন্ডি খাজা ‘বিজনেস ভিউ’ ম্যাগাজিনের ২০২০ সালের সেরা উদ্যোক্তা হয়েছেন। ‘এআইডিপি’র কর্মকান্ডের পরিধি হলো প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ। কোম্পানিটা তাদের কাজকে কেন্দ্রীভূত করেছে ‘ইসাবেলা’ নামের একটা ‘এআই’ ডেভেলপ করার পিছনে। কোম্পানির ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, ‘ইসাবেলা’ ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থেকে ওপেন সোর্স তথ্য পড়ছে এবং জমিয়ে রাখছে। এর মাধ্যমে প্রোগ্রামটা বিভিন্ন ভাষার তথ্য থেকে শিখবে। এই প্রোগ্রামটার তথ্য সংরক্ষণের কোন সীমা নেই। অন্যান্য প্রযুক্তি এবং যন্ত্র ‘ইসাবেলা’র সাথে যুক্ত হয়ে এর প্রসেসিং ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারবে। ২০২৫ সালে ‘ইসাবেলা’কে তারা সবার সন্মুখে উন্মোচন করবে বলে বলছেন এন্ডি খাজা।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার ‘এআই’এর পিছনে ব্যাপক বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর ২০১১ সালে যেখানে ‘এআই’, ‘বিগ ডাটা’ এবং ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’এর পিছনে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল, তা ২০১৬ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের একটা মেমোর মাধ্যমে ‘প্রজেক্ট ম্যাভেন’ নামের একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট ‘গুগল’এর ডেভেলপ করা ‘এলগোরিদমিক ওয়ারফেয়ার’ নামে পরিচিত এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ড্রোনগুলির পাঠানো ভিডিও চিত্র থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বস্তুর পরিচয় বের করার ব্যবস্থা করা হয়। এতে কোন মানুষের সরাসরি সংযুক্তি ছাড়াই মাঠ পর্যায়ের ইন্টেলিজেন্স পাচ্ছে সামরিক বাহিনী। মার্কিন বিমান বাহিনী গত ৯ই ডিসেম্বর সফলভাবে মনুষ্যবিহীন স্টেলথ ড্রোন ‘এক্সকিউ ৫৮এ ভ্যালকাইরি’র ‘এআই’ চালিত ফ্লাইটের পরীক্ষা চালিয়েছে। পরীক্ষায় মানুষ চালিত ‘এফ২২’ এবং ‘এফ৩৫’ যুদ্ধবিমানের সাথে সমন্বয় করে ‘ভ্যালকাইরি’ ড্রোনটা ফর্ম্যাশন ফ্লাইট চালনা করে। মার্কিন নৌবাহিনীও ‘এআই’এর ব্যবহারে বেশ এগিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী সাবমেরিনের পিছু নেবার জন্যে ‘সী হান্টার’ নামের একটা মনুষ্যবিহীন যুদ্ধজাহাজ তারা তৈরি করে ২০১৬ সালে। ৪০ মিটার লম্বা এবং মাত্র ১’শ ৪৫ টন ওজনের এই জাহাজ টানা ৭০ দিন সমুদ্রে টহল দিতে পারে এবং একবার জ্বালানি নিয়ে প্রায় ১০ হাজার নটিক্যাল মাইল চলতে সক্ষম। মানুষ না থাকার ফলে জাহাজটা সমুদ্রে দিনের পর দিন টহল দেবার ধকল খুব সহজেই সামলে নেবে। জাহাজ পরিচালনার কাজগুলি ‘এআই’ করবে। তবে একজন মানুষ খেয়াল রাখবে এবং শুধু সিদ্ধান্ত দেবার ব্যাপারটা দেখবে। নেভাল ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক এইচ আই সাটন গত সেপ্টেম্বরে ‘ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় চীনা সোশাল মিডিয়া ‘উইয়েবো’তে পোস্ট করা একটা ছবির বরাত দিয়ে বলেন যে, মার্কিন ‘সী হান্টার’ প্রকল্পের কপি হিসেবে চীনারাও একটা মনুষ্যবিহীন যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছে।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় বলা হয় যে, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বর্তমানে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে একটা নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে। আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার জন্যে মার্কিন স্পেশাল অপারেশনস কমান্ডএর কমান্ডার জেনারেল রিচার্ড ক্লার্ক সেনাদের মাঝে ডাটা সাইন্টিস্ট, কোডার এবং মিড লেভেল ম্যানেজার ডেভেলপ করার কথা বলেন। তিনি বলেন যে, ‘এআই’তে বিনিয়োগ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথই খোলা নেই। তবে কেউ কেউ বলছেন যে, ‘এআই’ ডেভেলপ করতে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে। গত বছর ‘ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট’এর এক আলোচনায় মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল ব্রায়ান লুজি বলেন যে, নিজেদের ক্রয় পরিদপ্তরের জটিলতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তুলনায় ‘এআই’ ডেভেলপ করার ব্যাপারে পিছিয়ে আছে।

‘বস্টন কলেজ’এর প্রফেসর থমাস ড্যাভেনপোর্ট ‘মার্কেট ওয়াচ’এর এক লেখায় বলছেন যে, চীন যখন নিজেদের ‘এআই’ কৌশলকে বাস্তবায়নে নেমেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলের ব্যাপারেই এখনও নিশ্চিত নয়। চীনারা সাম্প্রতিক সময়ে ‘এআই’এর পিছনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশা করছে। প্রতিরক্ষা এবং ইন্টেলিজেন্সসহ জনগণের উপর সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও চীনারা ‘এআই’ ব্যবহারে পিছপা হচ্ছে না। ‘ফেইস রেকগনিশন’ ব্যবহার করে রাস্তায় নিয়ম ভঙ্গকারীকে পাকরাও করা এবং মানুষের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাকে ‘সোশাল ক্রেডিট’ বা ‘সোশাল রেটিং’ করার ব্যাপারে চীনারা বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। অপরদিকে ‘এআই’এর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর ছাড়া বাকি গবেষণাগুলি হচ্ছে মূলতঃ বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টরে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট সেক্টর গবেষনার পিছনে ৫৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যার অনেকটাই গিয়েছে ‘এআই’ খাতে। তবে এই গবেষণার একটা বড় অংশ গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে; বিশেষতঃ চীনে। ব্যক্তির কর্মকান্ডের সাথে মিল রেখে বিজ্ঞাপন দেয়া, সার্চ ইঞ্জিনের ফলাফল উন্নত করা, মানুষের চেহারা খুঁজে বের করা এবং তাদের লেবেলিং করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্মার্ট পণ্য উৎপাদনের পিছনে এই গবেষণা গিয়েছে। তদুপরি ড্যাভেনপোর্ট মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ‘এআই’ প্রযুক্তিতে চীনের থেকে এগিয়ে আছে; তবে চীনারা সরকারিভাবে যেভাবে উঠেপরে লেগেছে, তাতে ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি উল্টে যেতে পারে। 


মার্কিন নৌবাহিনীর ডেভেলপ করা ‘এআই’ চালিত মনুষ্যবিহীন জাহাজ ‘সী হান্টার’কে কপি করেছে চীনারা। ‘এআই’ এখন এমন এক প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে চলেছে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা এগিয়ে থাকার মাঝেই নিজেদের অস্তিত্বকে দেখতে পাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিযোগিতায় নৈতিকতা হতে চলেছে দ্বিতীয় সাড়ির চিন্তা।



‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় ‘এআই’এর ভবিষ্যৎ কি?

মার্কিন সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার জয়েন্ট চিফস অব স্টাফএর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মাইলি কিছুদিন আগেই ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এ কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, বেসামরিক সমাজিক ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ছাড়াও সামরিক ক্ষেত্রে ‘এআই’এর ব্যবহার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মাঝে যেসকল সামরিক দ্বন্দ্ব হবার সম্ভাবনা থাকবে, তাতে ‘এআই’ এবং রোবোটিক্সএর অনেক বড় ভূমিকা থাকবে; এমনকি বেশিরভাগ সামরিক বাহিনীতেই হয়তো রোবোটের ব্যাপক ব্যবহার থাকবে। ২০২০এর শুরুতে পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনারা ‘এআই’কে ভবিষ্যতের সামরিক এবং শিল্প শক্তির অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছে। জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে বেইজিং ‘এআই’এর উপর বিশ্বব্যাপী কৌশলগত বিনিয়োগ করছে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত পাঁচ বছরে চীন ‘এআই’ ব্যবহার করে মনুষ্যবিহীন জাহাজ তৈরি করেছে, যা ব্যবহার করে দক্ষিণ চীন সাগর তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে চীনারা নিজেদের ভৌগোলিক দাবিগুলিকে সমুন্নত রাখতে চাইছে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর জন্যে মনুষ্যবিহীন ট্যাঙ্কও তারা ডেভেলপ করেছে।

সকলেই বুঝতে পারছেন যে, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বিশ্ব আরও অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে। গত ১৮ই ডিসেম্বর চীনের শিংহুয়া ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত এক ফোরামে চীনের প্রাক্তন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফু ইয়িং বলেন যে, ‘এআই’এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের একত্রে বসে কিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম তৈরি করতে হবে, যা কিনা ‘এআই’ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হবে। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে চীনা প্রতিনিধি হিসেবে ফু ইয়িং এবং মার্কিং প্রতিনিধি হিসেবে থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর প্রেসিডেন্ট জন এলেন ‘এআই’এর সামরিক ব্যবহারের ব্যাপারে তিন দফা আলোচনা করেছেন। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কোন টার্গেটগুলি ‘এআই’ অস্ত্রের বাইরে থাকা উচিৎ, আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে এগুলির ব্যবহারের পরিসীমা, মানুষের দেখাশুনা, ইত্যাদি। উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে, ‘এআই’এর ডেভেলপমেন্টের গতি আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বগুলিকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেবে; আর এর মাধ্যমে সাধারণ বেসামরিক জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়েই ‘এআই’কে আরও নতুন ধরনের অস্ত্র হিসেবে ডেভেলপ করছে এবং একে অপরের এই প্রচেষ্টার উপর কড়া নজর রাখছে। ঠান্ডা যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতার মতো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা অসম্ভব নয়। বেশিরভাগ ‘এআই’ অস্ত্র এখনও ডেভেলপমেন্টের শুরুর দিকে রয়েছে। সামরিক বাহিনীর মাঝে ছড়িয়ে দেবার আগেই দুই দেশের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হওয়া উচিৎ বলে তারা মন্তব্য করেন। জন এলেন বলছেন যে, নিরাপত্তার ব্যাপারটা যদি চিন্তার শীর্ষে চলে যায়, তাহলে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকার লক্ষ্য ভবিষ্যতে বিপদ এড়ানোর পথকে বাধাগ্রস্ত করবে।
 

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক ভাষণে বলেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ হবে ড্রোনের মাঝে। এক রাষ্ট্রের ড্রোন যখন অপর রাষ্ট্রের ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করে ফেলবে, তখন যুদ্ধ বন্ধ করে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না। মানুষের দুর্বলতাগুলিকে অতিক্রম করে ‘এআই’ চালিত রোবোটের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার যে ভবিষ্যৎবাণী প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলি উচ্চারণ করছে, তাতে হত্যা করার সিদ্ধান্ত কি কোন যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে চলবে নৈতিক এবং আদর্শিক দ্বন্দ্ব।
 

হত্যা করার সিদ্ধান্ত কি যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিৎ?

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন যে, যে রাষ্ট্র ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে, সে রাষ্ট্র দুনিয়া শাসন করবে। ‘এআই’এর ডেভেলপমেন্টের কারণে বিপুল সুযোগ এবং হুমকির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যা কিনা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ হবে ড্রোনের মাঝে। এক রাষ্ট্রের ড্রোন যখন অপর রাষ্ট্রের ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করে ফেলবে, তখন যুদ্ধ বন্ধ করে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না। পুতিন তার কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করেন ডিসেম্বরের শুরুতে ‘এআই জার্নি’ নামের এক অনলাইন কনফারেন্সে। তিনি বলেন যে, ‘এআই’ কোন ফ্যাশন নয় অথবা শুধুমাত্র গর্ব করার জন্যে তৈরির বিষয় নয়, যে তা সময়ের সাথে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে, যখন বড় রাষ্ট্র বা কর্পোরেট শক্তি প্রযুক্তির উন্নয়নের সময় ঘুমিয়ে ছিল; পরবর্তীতে রাতারাতি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেছে। তিনি সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ‘এআই’এর কারণে যেসব জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তা মানুষ আগে কখনোই দেখেনি। পুতিনের কথাগুলি ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার কথা যেমন মনে করিয়ে দেয়, তেমনি নতুন কিছু জটিলতার কথা সামনে আনে, যা এই প্রতিযোগিতা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। যেমন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে কিনা, যা মানুষের মৌলিক কোন চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক?

‘এআই’কে বলা হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাসে তৃতীয় বিপ্লব; এর আগের দু’টা ছিল গানপাউডার বা বারুদ এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি। অনেকেই বলছেন যে, ‘এআই’এর ব্যবহারে খুব শিগগিরই যুদ্ধক্ষেত্রে রোবোট সেনা দেখা যাবে। কিন্তু একটা যন্ত্রকে কতটুকু পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর একেক জন একেকভাবে দিচ্ছেন। মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবসায় অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা পামার লাকি ’ওয়েব সামিট’এর এক আলোচনায় প্রশ্ন করছেন যে, মানুষের জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত কি একটা যন্ত্রের কাছে ছেড়ে দেয়া উচিৎ? একটা যন্ত্রকে তো কোর্ট মার্শাল করা সম্ভব নয়। যন্ত্রকে যুদ্ধাপরাধের কারণে কারাগারে প্রেরণও সম্ভব নয়। লাকি মনে করছেন যে, ‘এআই’ ব্যবহারের মাধ্যমে ডাটা এনালিসিসের যে কাজগুলি একজন মানুষের পক্ষে করা কঠিন, তা করে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু কোন মানুষকে হতাহত করার সিদ্ধান্ত মানুষের হাতেই থাকা উচিৎ। তিনি এও মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও যাতে সেপথেই হাঁটে, তা নিশ্চিত করার জন্যে তাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করা দরকার। তবে পামার লাকির এই চিন্তাগুলি বাস্তবায়ন যে অতটা সহজ নয়, তা এখন নিশ্চিত।

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘পলসন ইন্সটিটিউট’এর প্রযুক্তি বিষয়ক উইং ‘মার্কোপোলো’র ফেলো ম্যাট শীহান ‘বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি একসময় বড় কাজগুলি ধরার জন্যে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্যে কাজ করেছে; এবং একইসাথে বড় বাজার হিসেবে চীনে কাজ করতে গিয়ে চীনা নেতৃত্বের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেছে। এভাবে কোম্পানিগুলি যখন বিপুল সম্পদের মালিক এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হয়ে যায়, তখন তারা নিজস্ব একটা সিভিল সোসাইটি তৈরি করে ফেলে। এই সোসাইটির চাপের মুখে অনেক সময়েই এই কোম্পানিগুলি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। মার্কিনীদের সাথে চীনাদের ‘গ্রেট পাওয়ার’ দ্বন্দ্বে নিজেদের ব্যবসা ধরে রাখতে এরা হিমসিম খাচ্ছে। ‘গুগল’ যদিও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত ‘প্রজেক্ট ম্যাভেন’ ডেভেলপ করেছিল, তথাপি ২০১৮ সালে ‘গুগল’এর ৩ হাজার কর্মী এর বিরুদ্ধে পিটিশন স্বাক্ষর করার পর কোম্পানি নৈতিকতার কথা বলে প্রকল্প থেকে বের হয়ে যায়। একই বছর ‘গুগল’ মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাউড কম্পিউটিং প্রকল্প ‘ জয়েন্ট এন্টারপ্রাইজ ডিফেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ বা ‘জেডাই’ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ‘গুগল’এর কর্মীরা প্রতিবাদ করার পর তারা ঘোষণা দেয় যে, এই প্রকল্প তাদের কর্পোরেট আদর্শের সাথে যায় না।

প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ই একসময় পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল। এখন ‘এআই’এর ক্ষেত্রেও এই প্রতিযোগিতাই সকল পক্ষকে গতিশীল করছে। বৈশ্বিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যখন কিছু কোডিং প্রোগ্রামের মাঝে চলে যাচ্ছে, তখন মাল্টিবিলিয়ন ডলারের সামরিক শক্তি দ্বিতীয় সাড়ির শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে। মানুষের দুর্বলতাগুলিকে অতিক্রম করে ‘এআই’ চালিত রোবোটের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার যে ভবিষ্যৎবাণী প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলি উচ্চারণ করছে, তাতে হত্যা করার সিদ্ধান্ত কি কোন যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে চলবে নৈতিক এবং আদর্শিক দ্বন্দ্ব। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিযোগিতায় আদর্শিক অবস্থান কতটা শক্তভাবে ধরে রাখা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। একারণেই কেউ কেউ চাইছেন, প্রতিযোগিতা ঠান্ডা যুদ্ধে রূপ নেবার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের আলোচনার মাধ্যমে ‘এআই’এর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করা। তবে সেখানেও কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তথা পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক দুর্বলতার সুযোগ না নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি, বিশেষতঃ চীন এবং রাশিয়া, আলোচনার প্রতি কতটা আগ্রহী হবে? নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় নৈতিকতা যখন দ্বিতীয় সাড়ির চিন্তায় রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন মানবজাতি এমন এক মহাবিপদের মাঝে পড়তে যাচ্ছে, যা থেকে বের হবার কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান বর্তমান বিশ্বের সেকুলার রাজনৈতিক চিন্তার মাঝে নেই।

No comments:

Post a Comment