Saturday 19 December 2020

আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সোশাল মিডিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়েছে ফ্রান্স ও রাশিয়া

২০শে ডিসেম্বর ২০২০ 

 ফেইসবুকের এই ব্যবস্থা গ্রহণে রুশ অপারেশন বেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, তবে একইসাথে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে দুর্বল হওয়া ফ্রান্সের অনৈতিক অবস্থানও জনসন্মুখে এসে গেল। এতে শুধু ফ্রান্সই ইমেজ সংকটে পড়েনি, গণতন্ত্রের ঝান্ডাবাহী পশ্চিমা লিবারাল চিন্তার দেশগুলি আফ্রিকার প্রাক্তন উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনভাবে চলতে দেবার বেলায় কতটা লিবারাল, তা আরও একবার প্রকাশ পেল।

গত ১৫ই ডিসেম্বর সোশাল মিডিয়া কোম্পানি ফেইসবুক ঘোষণা দেয় যে, তারা বেশকিছু একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে, যেগুলির রুশ এবং ফরাসি সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রয়েছে। অভিযোগে বলা হয় যে, এসব একাউন্ট থেকে ভুয়া আইডির মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, প্রথমবারের মতো ফেইসবুক কোন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ থাকা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো। ফেইসবুক রুশ যে গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, তারা ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে জড়িত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। ফেইসবুক বলছে যে, মোট ২’শ ৭৪টা একাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে; সাথে এদের দ্বারা চালিত বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেইজ ছাড়াও ‘ইন্সটাগ্রাম’ একাউন্টও রয়েছে। ‘ইন্সটাগ্রাম’ হলো একটা ছবি শেয়ারিং ওয়েবসাইট, যা ফেইসবুক ২০১২ সালে ১ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। এক সংবাদ সন্মেলনে ফেইসবুকের কর্মকর্তারা বলেন যে, এই অপারেশনগুলি সবচাইতে বেশি টার্গেট করেছে পশ্চিম আফ্রিকার মালি এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিককে। এছাড়াও বুরকিনা ফাসো, নিজের, আলজেরিয়া, আইভোরি কোস্ট এবং শাদ কমবেশি আক্রান্ত হয়েছে। নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ গ্রুপ ‘গ্রাফিকা’ বলছে যে, ফেইসবুকের এহেন ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো তৃতীয় কোন রাষ্ট্রে দু’টা প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার চিত্র ফুটে উঠলো। আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রভাব বিস্তারের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুধু ফেইসবুকই নয়, টুইটার, ইউটিউব এবং বিভিন্ন আর্টিকেলের মাঝেও দেখা যাচ্ছে। ‘গ্রাফিকা’র চিফ ইনোভেশন অফিসার ক্যামিল ফ্রাঁসোয়া বলছেন যে, যখন গণতান্ত্রিক সরকারগুলি মিথ্যা বানোয়াট খবর প্রচারে মনোনিবেশ করে, তখন তাদের জন্যে নিজেদের দেশে অন্য কারুর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে নিন্দা করাটা কঠিন হয়ে যায়।

বন্ধ করা ফরাসি একাউন্টগুলির মাঝে রয়েছে ৮৪টা ফেইসবুক একাউন্ট, ১৪টা ‘ইন্সটাগ্রাম’ একাউন্ট এবং কতগুলি ফেইসবুক গ্রুপ ও পেইজ। এদের প্রায় হাজার পাঁচেক ফলোয়ার ছিল। ফরাসিরা আফ্রিকান মানুষের ভুয়া বেশ ধরে ফরাসি এবং আরবি ভাষায় আফ্রিকায় ফ্রান্সের নীতি, সেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আফ্রিকার নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা, ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও আফ্রিকায় প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলিতে ফরাসি সামরিক বাহিনীর কর্মকান্ডের পক্ষে পোস্ট দিচ্ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির জনগণকে টার্গেট করা একটা ফেইসবুক পোস্টে বলা হয় যে, ‘মালির জন্যে রুশ সাম্রাজ্যবাদীরা হলো গ্যাংগ্রিনের মতো! জারিস্ট ব্রেইনওয়াশ থেকে সাবধান থাকুন!’ ফেইসবুক বলছে যে, যদিও এই একাউন্টগুলি নিজেদের পরিচয় এবং সমন্বয় গোপন করতে চাইছিল, তথাপি তাদের তদন্তে পাওয়া গেছে যে, এই ব্যক্তিদের সাথে ফরাসি সামরিক বাহিনীর যোগসাজস রয়েছে। ফেইসবুকের ব্যবস্থা নেবার পরদিন ফরাসি সরকার এই ঘটনায় তাদের নিজেদের জড়িত থাকার ব্যাপারে কোনকিছু না বলে শুধু বলে যে, আফ্রিকায় মিথ্যা বানোয়াট খবর মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, ফরাসি সরকার এই প্রতিবেদন খতিয়ে দেখছে। এই মুহুর্তে তারা কাউকে দায়ি করতে পারছেন না; বরং তারা বলছেন যে, যেহেতু অনেকগুলি পক্ষ এখানে জড়িত, তাই কাউকে নির্দিষ্ট করা কঠিন। তাদের পার্টনারদের সাথে ফ্রান্স আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

অপরপক্ষে রুশদের মূল লক্ষ্য ছিল সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ২৭শে ডিসেম্বরের আসন্ন নির্বাচন। একটা রুশ পোস্টে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফস্টিন আরশাঞ্জ তুয়াদেরার পক্ষ নিয়ে বলা হয় যে, শান্তির পক্ষে প্রেসিডেন্ট তুয়াদেরা যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তার কারণে পরবর্তী প্রজন্ম ভালো জীবন পাবে। রুশ নেটওয়ার্কগুলি রাশিয়ার ডেভেলপ করা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের পক্ষেও পোস্ট দেয়। বন্ধ করা রুশ একাউন্টগুলির প্রায় ৬০ লক্ষ ফলোয়ার ছিল। রুশরা লিবিয়ার রাজনৈতিক আলোচনাকে টার্গেট করে অপারেশন চালাচ্ছিল। লিবিয়ার এই ফেইসবুক পেইজগুলিতে ১৩ লক্ষ ফলোয়ার ছিল। এছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার গিনি উপকূলের দেশ ইকুয়েটোরিয়াল গিনিতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চলছে বলেও তথ্য ছড়ায় রুশরা। রুশরা অবশ্য সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে অন্য কোন দেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করার ব্যাপারটা সরাসরিই অস্বীকার করেছে। রুশ এবং ফরাসি নেটওয়ার্কগুলি একে অপরের পোস্টে কমেন্ট করছিল এবং একে অপরের ফ্রেন্ড লিস্টে ঢোকার চেষ্টা করছিল। তারা একে অপরকে ভুয়া একাউন্ট বলে অভিযোগ করছিল। ফেইসবুক বলছে যে, ২০১৭ সাল থেকে ফেইসবুক ১’শ নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থা নিয়েছে, যার মাঝে মাত্র একটাতে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করছিল। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যখন রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে মিথায় বানোয়াট তথ্য দিয়ে সোশাল মিডিয়া ভরিয়ে দেয়, তখন সাধারণ জনগণ এর শিকারে পরিণত হয়।

ফরাসি পত্রিকা ‘লে ওপিনিওন’এর এক লেখায় ফরাসি সাংবাদিক জঁ ডমিনিক মারশে ফরাসি সামরিক বাহিনীর এই ‘সমন্বিত ভুয়া কর্মকান্ড’র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, এধরণের কর্মকান্ড এতদিন রাশিয়ার কাছ থেকে আসতো; এখন ফরাসি সেনাবাহিনী এহেন কর্মকান্ডে জড়িয়েছে। ফরাসি পত্রিকায় সেদেশের সরকারের আফ্রিকা নীতি নিয়ে সমালোচনা করা হলেও এগুলি মূলতঃ ফ্রান্সের দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় নীতিরই ফলাফল। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে নিয়মিত সামরিক হস্তক্ষেপ করায় এমনিতেই ফরাসিরা ইমেজ সংকটে রয়েছে। তদুপরি ফ্রান্সের সামরিক হস্তক্ষেপের পর থেকে পশ্চিম আফ্রিকার মালি এবং আশেপাশের নিজের, বুরকিনা ফাসো, আইভোরি কোস্টে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার কারণে আফ্রিকায় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক নীতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আফ্রিকায় ফ্রান্সের এই দুর্বল অবস্থানের সুযোগ নিয়ে অন্যান্য প্রভাবশালী রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করতে চাইছে; ফেইসবুকে এই দ্বন্দ্ব সেই ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় সোশাল মিডিয়ার গুরুত্ব যে বাড়ছে, তা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির সুনির্দিষ্ট অপারেশনই বলে দিচ্ছে। ফেইসবুকের এই ব্যবস্থা গ্রহণে রুশ অপারেশন বেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, তবে একইসাথে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে দুর্বল হওয়া ফ্রান্সের অনৈতিক অবস্থানও জনসন্মুখে এসে গেল। এতে শুধু ফ্রান্সই ইমেজ সংকটে পড়েনি, গণতন্ত্রের ঝান্ডাবাহী পশ্চিমা লিবারাল চিন্তার দেশগুলি আফ্রিকার প্রাক্তন উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনভাবে চলতে দেবার বেলায় কতটা লিবারাল, তা আরও একবার প্রকাশ পেল।

No comments:

Post a Comment