Tuesday 15 December 2020

তুরস্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের গভীর বিশ্বাসগত পার্থক্যকেই তুলে ধরে

১৫ই ডিসেম্বর ২০২০


২০১৯এর জুলাই। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের তিন বছরপূর্তিতে রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘এস ৪০০’এর তুরস্কে অবতরণ। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, তুরস্ক এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে ভবিষ্যতের অভ্যুত্থান ঠেকাতে। কিন্তু এই ব্যবস্থা ন্যাটোর অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের বিমানও টার্গেট করতে সক্ষম; যা তুরস্কের অন্য কোন ক্ষেপণাস্ত্র পারে না।


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজ ছাড়ার প্রায় শেষ মুহুর্তে এসে গত ১৪ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞার মাঝে পড়েছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা ক্রয় দপ্তর ‘প্রেসিডেন্সি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ এবং এর প্রধান ইসমাঈল দেমির সহ মোট চারজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এর ফলে তুরস্কের এই দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তি ক্রয়ের লাইসেন্স পাবে না। একইসাথে উল্লিখিত চারজন কর্মকর্তার যেসকল সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তা আটকে দেয়া ছাড়াও তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছিল, তার সর্বাগ্রে রয়েছে তুরস্কের রুশ ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এক বিবৃতিতে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহুবার সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুরস্ককে জানিয়েছে যে, ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের ফলে মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি এবং জনবল হুমকির মাঝে পড়বে। একইসাথে তা রুশ প্রতিরক্ষা সেক্টরকে অর্থায়ন করবে এবং তুরস্কের সামরিক বাহিনী এবং সামরিক শিল্পে রাশিয়ার ঢোকার ব্যবস্থা করবে। তিনি বলেন যে, এরপরও তুরস্ক এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় এবং পরীক্ষা করা থেকে বিরত থাকেনি। অথচ ‘এস ৪০০’এর বিকল্প হিসেবে ন্যাটোর নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল, যা তুরস্কের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারতো। তিনি তুরস্ককে যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে কাজ করায় ব্রতী হবার আহ্বান জানান। অপরপক্ষে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন যে, তুরস্কের ‘এস ৪০০’ কেনার ব্যাপারটার যৌক্তিকতা রয়েছে। একইসাথে বিবৃতিতে বলা হয় যে, তুরস্ক তার সুবিধামত যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের জবাব দেবে। বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বানও জানানো হয়। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সময়ে পররাষ্ট্রনীতির যে সিদ্ধান্তগুলি আসছে, সেগুলিকে কাঁধে নিয়েই পরবর্তী জো বাইডেন প্রশাসনকে কাজ শুরু করতে হবে।

‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ‘এফ ৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে বের করে দেয়। তবে এর পরবর্তীতে আর কোন বড় পদক্ষেপ নেয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকে। গত অক্টোবর মাস থেকে তুরস্ক ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা শুরু করে। মার্কিন কংগ্রেস থেকে এব্যাপারে আহ্বান করা হয় যে, ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস এডভারসারিজ থ্রু স্যাংসন্স এক্ট’ বা সিএএটিএসএ’ বা ‘কাটসা’ আইনের অধীনে তুরস্কের উপরে অবরোধ আরোপ করা হোক। এই আইনের অধীনে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কাজের জন্যে যেকোন রাষ্ট্রকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়। যদিও বাইডেনের নির্বাচন জয়ী দল বলে এসেছে যে, তারাও তুরস্কের ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের বিরোধী, তথাপি এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের সম্পর্কের মাঝে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা দেয়ালকে আরও উঁচু করলো।

 
২০১৩ সাল। ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপে গ্রিস রুশ নির্মিত ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা করছে। গ্রিস এবং বলকানের অন্যান্য দেশগুলি রুশ সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করলেও ন্যাটো তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। মূলতঃ তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যালান্স করে রাখার জন্যেই গ্রিস ‘এস ৩০০’ ক্রয় করেছে, এবং ন্যাটো তা সহ্য করেছে।


তুরস্ক বরাবরই বলে আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ‘প্যাট্রিয়ট’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানাবার ফলেই তুরস্ক রুশ ‘এস ৪০০’ ক্রয়ে বাধ্য হয়েছে। তুরস্ক আরও বলে আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলির মাঝেই দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে; গ্রিস রুশ নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করলেও তাকে কোন অবরোধের মাঝে পড়তে হয়নি। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গ্রিক সাইপ্রাস ১৯৯৭ সালে রাশিয়া থেকে দূরপাল্লার ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করে। পরে তুরস্কের প্রতিবাদের জেরে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটাকে গ্রিসের ক্রিট দ্বীপে মোতায়েন করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এই ব্যবস্থাকে গ্রিকরা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে বলে বলছে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’। ২০১৫ সালে গ্রিস রুশ সহায়তায় এই ব্যবস্থাটার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করে এবং নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় করে। এছাড়াও গ্রিকরা রাশিয়া থেকে ‘টর এম১’ এবং ‘অসা একেএম’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করেছে। গত নভেম্বর মাসে তুরস্ক বলে যে, গ্রিস তার রুশ নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ক্রিট দ্বীপে ন্যাটোর মহড়ার মাঝে পরীক্ষা করেছে।

এর আগে গত ১৬ই অক্টোবর তুরস্ক ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ব্যাপারটা নিশ্চিত করে বলেন যে, তুরস্ক এই পরীক্ষা চালিয়ে যাবে এবং এই পরীক্ষার জন্যে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি চাইবে না। অক্টোবরের ‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পিছনে ক্রিট দ্বীপে ফ্রান্স এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুদ্ধবিমান মোতায়েনকে কারণ হিসেবে দেখায় তুরস্ক। তুরস্কের সেই পরীক্ষার প্রায় দু’মাস পর যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। অক্টোবরে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র জনাথন হফম্যান বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের সম্ভাব্য এই পরীক্ষার খবর এসেছে। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে প্রতিরক্ষা দপ্তর এর কড়া প্রতিবাদ জানাবে।

 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময় ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমান দ্বারা পার্লামেন্ট ভবন এবং প্রেসিডেন্টের বিমান আক্রান্ত হলেও তুর্কি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেই বিমানগুলিকে টার্গেট করতে পারেনি। এই ব্যবস্থাটা ন্যাটোর তৈরি করা; যার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হয় যে ন্যাটোর একটা সামরিক সরঞ্জাম অপরটার উপর হামলা করবে না। এরদোগান হয়তো ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের মাধ্যমে আরেকটা অভ্যুত্থানই প্রতিরোধ করতে চাইছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গ্রিস কেন ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে রাশিয়ার কাছ থেকে? ‘সিএসআইএস’ অবশ্য এব্যাপারে কোন বিশ্লেষণ দেয়নি।

গ্রিস ছাড়াও পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ব্যাপকভাবে রুশ অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। চেক রিপাবলিক, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং স্লোভাকিয়া এখনও রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। গ্রিস এবং তুরস্কের রুশ সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির উত্তর পাওয়া যাবে অত্র অঞ্চলের ইতিহাসের দিকে। পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই একসময় ইস্তাম্বুলের উসমানি খিলাফতের অধীনে ছিল। রাশিয়া, অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ চার শতক ধরে যুদ্ধ করে উসমানিদের কাছ থেকে বলকান অঞ্চল ছিনিয়ে নেয় এবং সেখানে অনেকগুলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা থাকলেও সকলেই ইসলামের ঝান্ডাবাহী উসমানি খিলাফতের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। বলকানে তৈরি করা রাষ্ট্রগুলির মাঝে রয়েছে গ্রিস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, মন্টিনেগ্রো, কসোভো। এই দেশগুলির বেশিরভাগ জনগণ বিশ্বাসগত দিক থেকে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী হবার কারণে রাশিয়ার চার্চের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। একারণেই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি বলকানে তাদের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সাবধানে এগিয়েছে; অনেক ক্ষেত্রে ছাড়ও দিয়েছে। রুশ অস্ত্র ব্যবহারে ছাড় দেয়াটাও এই দেশগুলিকে ন্যাটোর অংশ করে নেবার নীতির অংশ ছিল।

সাইপ্রাস নিয়ে ১৯৭০এর দশক থেকেই গ্রিস এবং তুরস্কের দ্বন্দ্ব চলছে। গ্রিস এবং তুরস্ক উভয়েই ন্যাটোর তৈরি সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে; যার একটা অপরটাকে টার্গেট করতে পারবে না। মূলতঃ ন্যাটোর তৈরি তুর্কি বিমানগুলিকে টার্গেট করার জন্যেই গ্রিস ‘এস ৩০০’ কিনেছে রাশিয়ার কাছ থেকে। অর্থাৎ রুশ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি গ্রিসের জন্যে তুরস্কের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ। আর একারণেই ন্যাটো গ্রিসের সাথে রাশিয়ার বহু বছরের সামরিক সম্পর্ককে সহ্য করে চলছে। গ্রিসের সামরিক বাহিনীতে রুশ নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ন্যাটো হুমকি মনে না করলেও তুর্কি বাহিনীতে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে ন্যাটো হুমকি হিসেবে দেখছে। এই দ্বিমুখী নীতি মূলতঃ কয়েক শতক ধরে চলে আসা চিন্তারই ফলাফল; যার মাঝ দিয়ে ইস্তাম্বুলকে রুশ এবং পশ্চিমারা কেউই বন্ধু হিসেবে নেয়নি। রুশ ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের জন্যে তুরস্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা দেখিয়ে দেয় যে, আঙ্কারার সেকুলার নেতৃত্বের মাঝেও পশ্চিমারা উসমানি খিলাফতের ছায়াই দেখতে পাচ্ছে। তুরস্ক হয়তো নিজস্ব সামরিক শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির উপর তার নির্ভরশীলতা বহুলাংশেই কমিয়ে ফেলতে পারবে; কিন্তু তুর্কিদের মুসলিম পরিচয়ের ব্যাপারে পশ্চিমাদের কয়েক’শ বছরের অস্বস্তি যে মুছে ফেলতে পারবে না, তা নিশ্চিত।

No comments:

Post a Comment