Friday 18 December 2020

হ্যাকিং যুদ্ধ... প্রকাশ পাচ্ছে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার চেহারা

১৮ই ডিসেম্বর ২০২০
পাল্টাপাল্টি সাইবার হামলার এই নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় আইনের শাসন একটা কল্পনার বিষয়বস্তু। বিশাল সামরিক বাহিনী এবং সর্বোচ্চ সামরিক বাজেটও ডিজিটাল সম্পদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেবার জন্যে যথেষ্ট নয়।

গত ১৩ই ডিসেম্বর ‘রয়টার্স’ খবর দেয় যে, মার্কিন সরকারের বেশ কয়েকটা দপ্তর একটা বড় ধরনের সাইবার হ্যাকিংএর শিকার হয়েছে, যার মাঝে রয়েছে মার্কিন রাজস্ব দপ্তর, বাণিজ্য দপ্তরের অধীন ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন এন্ড ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশন’ এবং ‘ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’। এছাড়াও সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ‘ফায়ার আই’ও আক্রান্ত হয়েছে বলে বলা হয়। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, এই হ্যাকিংএর পিছনে রুশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসভিআর’এর হাত রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। ‘এপিটি২৯’ বা ‘কোজি বেয়ার’ নামের একটা হ্যাকার গ্রুপ কাজটা করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ন্যাটো, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ব্রিটিশ ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’, হোম অফিস, আঞ্চলিক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ডেভেলপার কোম্পানি ‘এসট্রাজেনেকা’, এমনকি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘জিসিএইচকিউ’ এই সফটওয়্যারের ব্যবহারকারী। প্রাথমিক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ‘সোলার উইন্ডস’এর ব্যবস্থাপনায় চালিত ‘ওরাইয়ন’ নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রায় ১৮ হাজার কম্পিউটার এই হ্যাকিংএর শিকার হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক এই দপ্তরগুলিতে কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে কেউ সুনির্দিষ্ট কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। ‘সোলার উইন্ডস’ হলো একটা সফটওয়্যার ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান, যারা মূলতঃ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা, আইটি সিস্টেম এবং অবকাঠামো নিয়ে কাজ করে থাকে। ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া এই ব্যবসার হেডকোয়ার্টার্স টেক্সাসের অস্টিনে এবং এর জনবল তিন হাজারের বেশি। ২০১৯ সালে কোম্পানিটা ৯’শ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করে। ‘মাইক্রোসফট সিকিউরিটি রেসপন্স সেন্টার’ বলছে যে, সফটওয়্যারের আপডেট করার সময়ই সন্তর্পণে হ্যাকাররা ব্যবহারকারীদের কম্পিউটারে ‘ম্যালওয়্যার’ ঢুকিয়ে দেয়। এরপর এই সুযোগে তারা খুব সম্ভবতঃ ব্যবহারকারীদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়। আপাতঃ ধারণায় বলা হচ্ছে যে, এই সাইবার হামলা খুব সম্ভবতঃ গত মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে মাসের পর মাস ধরে চলেছে। বলা হচ্ছে যে, এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচাইতে মারাত্মক সাইবার হামলার মাঝে একটা।

মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সামরিক ম্যাগাজিন ‘সিফোরআইএসআরনেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন সরকারি দপ্তরগুলিতে হ্যাকিংএর এই ঘটনার ফলে এটা পরিষ্কার হচ্ছে যে, বেসামরিক সরবরাহকারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সেবার উপর নির্ভরশীল থাকার ফলে প্রতিরক্ষা দপ্তর মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। সরকারি নির্দেশে বিভিন্ন দপ্তরগুলি যখন ‘সোলার উইন্ডস’এর ‘ওরাইয়ন’ সফটওয়্যার ব্যবহার থেকে সড়ে আসছে, তখন সামরিক বাহিনীতে এই সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। মার্কিন সেনা, নৌ, বিমান, ম্যারিন এবং স্পেস, সবগুলি বাহিনীই এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এছাড়াও পেন্টাগন এবং গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ বা ‘এনএসএ’ও এই সফটওয়্যারের ব্যবহারকারী। কি পরিমাণ তথ্য চুরি হয়েছে, অথবা তথ্যের গোপনীয়তা কি পর্যায়ে ছিল, তা এখনই নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।

হ্যাকাররা কি পেলো?

বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, সবচাইতে চিন্তার বিষয় হলো, সরকারি ইমেইল এবং তথ্য হ্যাকাররা অনেক লম্বা সময়ের জন্যে নাগালের মাঝে পেয়েছিল। ‘কার্নেগি ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর সাইবার পলিসি ইনিশিয়েটিভএর ফেলো জন বেইটম্যান মনে করছেন যে, বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী সংস্থাগুলিকে যখন সবচাইতে শক্তিশালী হ্যাকাররা আক্রমণ করছে, তখন যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় পেলে আক্রমণকারীরাই জয়ী হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তার সক্ষমতার পরিসীমাটা প্রকাশ পাচ্ছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ‘সাইবার স্টেটক্রাফট ইনিশিয়েটিভ’এর ডিরেক্টর ট্রে হার বলছেন যে, চুরি করা তথ্য হ্যাকারদের কাছে স্বর্ণখনির মতো হবে। মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতিগত দিকগুলি উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

‘বিজনেস ইনসাইডার’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনএসএ’এর প্রাক্তন হ্যাকার ডেভিড কেনেডি বলছেন যে, হ্যাকাররা এতটা কষ্ট করে মার্কিন নেটওয়ার্কের ভেতর এতটা সময় কাটিয়েছে; যার অর্থ হলো, তারা নিশ্চয়ই দামি কিছু পেয়েছে। তিনি বলেন যে, অন্য রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স সাধারণতঃ এরকম হ্যাকিংই চায়, কারণ এর মাধ্যমে তারা এমন শক্ত ইন্টেলিজেন্স পায়, যা সাধারণতঃ সহজে পাওয়া যায় না এবং সেই রাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতি সম্পর্কেও তারা জানতে পারে।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত সাইবার নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর টেকনলজি এন্ড সিকিউরিটি’র প্রধান ফিলিপ রেইনার মনে করছেন যে, তৃতীয় পক্ষের লেখা কোডের উপর মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এবং সরকারি দপ্তরগুলির ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা তাদেরকে সর্বদাই বিপদের মাঝে রাখবে। তিনি বলছেন যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের আসলে তৃতীয় পক্ষের তৈরি পণ্য এবং সেবার উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায়ই নেই। যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তারা এটা জানে এবং এটাকে তারা ব্যবহার করছে। এই অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হতে থাকবে বলে তিনি মনে করছেন। সাইবার নিরাপত্তা রেটিং এজেন্সি ‘বিটসাইট টেকনলজিস’এর ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যাকব ওলকট বলছেন যে, পুরো সামরিক বাহিনীতে বহু কর্মকান্ডকে এখন ‘সেবা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে; মনে করা হচ্ছে যে, এই ‘সেবা’গুলি তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে ক্রয় করা সম্ভব। মার্কিন সিনেটর এঙ্গাস কিং বলছেন যে, তিনি চিন্তা করতেই ভয় পাচ্ছেন যে, কতগুলি কোম্পানি মার্কিন সরকারকে বিভিন্ন পণ্য এবং সার্ভিস বিক্রি করছে। বর্তমানে শুধুমাত্র পেন্টাগনের সাথেই ব্যবসা করছে ৩ লক্ষ কোম্পানি!

যুক্তরাষ্ট্র এখন কি করবে?

নিরাপত্তা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক লেখায় মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ডিফেন্স প্রায়রিটিজ’এর ফেলো বনি ক্রিস্টিয়ান মত দিচ্ছেন যে, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রধানতম কাজগুলির একটা হওয়া উচিৎ সাইবার নিরাপত্তা। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন সরকারের অডিট রিপোর্টগুলি বলছে যে, নিরীক্ষণকারীরা খুব সাধারণ সরঞ্জামাদি ও কৌশল ব্যবহার করেই মার্কিন সামরিক বাহিনীর পরীক্ষাধীন থাকা অস্ত্রগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিল। তিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদকে অন্য দেশের উপর আক্রমণাত্মকভাবে ব্যবহার করে প্রতিশোধমূলক হামলা ডেকে না এনে বাইডেনের উচিৎ হবে নিজেদের সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালী করা।

তবে ১৭ই ডিসেম্বর মার্কিন হবু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বক্তব্যের মাধ্যমে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবার মুহুর্ত থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর কোন ধরনের হামলা হলে চুপচাপ বসে থাকবেন না। তিনি আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তিনি সরকারের সকল ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার বাধ্যতামূলক করবেন এবং বেসরকারি সরবরাহকারীদের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করা ছাড়াও সাইবার নিরাপত্তায় অবকাঠামো এবং জনবলের পিছনে বিনিয়োগ করবেন। তিনি আরও বলেন যে, তার সরকার এমন ব্যবস্থা নেবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পক্ষে এহেন কর্মকান্ড অনেক কঠিন হয়ে যায়। এই কাজগুলি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধু দেশগুলির সহায়তা নেবে। মার্কিন ডেমোক্র্যাট সিনেটর মিট রমনি ‘সিএনএন’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উচিৎ শক্ত কিছু বলা। তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন যে, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, একটা রুশ বোমারু বিমান যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ এবং দেশের রাজধানীর উপর দিয়ে উড়ে গেল; অথচ ট্রাম্প এসময় কিছুই করলেন না। রমনির কথাগুলি বুঝিয়ে দেয় যে, সাইবার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা ছাড়াও বাইডেনের সরকারের উপর এই সাইবার যুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবার জন্যে চাপ থাকবে।

পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় নিরাপত্তা এখন নতুন সংজ্ঞা নিচ্ছে। কম্পিউটার এবং সাইবার স্পেস এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র, যার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা। প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষয়ক্ষতি করতে এখন অপরের রাজধানী শহরের উপর বোমা ফেলতে হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, হামলা যে হয়েছে, সেটা বুঝে উঠতেই লেগে যাচ্ছে মাসের পর মাস। তদুপরি কে এটা করেছে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যেমন কঠিন, তেমনি হামলাকারীরা চুরি করা তথ্য কোথায় কিভাবে ব্যবহার করবে, সেটাও অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে। নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শক্তভাবে ব্যবস্থা নেবার কথা বললেও মার্কিন সরকার যখন বেসরকারি সেবা প্রদানকারীদের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে, তখন সরকারের সাথে কাজ করা লাখ লাখ মার্কিন কোম্পানির সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটা ততটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এহেন সাইবার সংঘাতের সম্ভাবনা দিনে দিনে বাড়তে থাকবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। হামলার পিছনে সন্দেহভাজন রুশ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে নিয়ে কথা হলেও মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের হ্যাকিং অপারেশন আলোচনায় আসছে কমই। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস করার পিছনে মার্কিন সাইবার ইন্টেলিজেন্সের হাত ছিল বলে খবরে এসেছে। পাল্টাপাল্টি সাইবার হামলার এই নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় আইনের শাসন একটা কল্পনার বিষয়বস্তু। বিশাল সামরিক বাহিনী এবং সর্বোচ্চ সামরিক বাজেটও ডিজিটাল সম্পদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেবার জন্যে যথেষ্ট নয়।

No comments:

Post a Comment