Saturday 26 December 2020

২০২০ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ এবং ২০২১ সালের সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক উত্তাপের স্থানসমূহ

২৬শে ডিসেম্বর ২০২০

রাসায়নিক দ্রব্য ছড়িয়ে রাস্তা থেকে করোনভাইরাস দূরীকরণের চেষ্টা করা হলেও ২০২০ সালে পশ্চিমা পুঁজিবাদের গভীর সমস্যাগুলি আরও নোংড়াভাবে উঠে এসেছে। বছরের সবচাইতে বড় ঘটনা ছিল পশ্চিমা আদর্শের অধোগতি।



করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক ধ্বস এবং আদর্শিক অধোগতি

নিঃসন্দেহে ২০২০ সালের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং ফলাফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী মহামারি। সমাধানহীন অবস্থায় বিচলিত বিশ্ব নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ‘সামাজিক দূরত্ব’ নিশ্চিত করতে ‘লকডাউন’ নামে এক পদ্ধতির আবিষ্কার করে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’এর ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ‘লকডাউন’এর ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি স্থবির হয়ে যায় এবং সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ধ্বস নামে। তেলের বাজার এবং শেয়ার বাজারে ঐতিহাসিক দরপতন ঘটে। ‘লকডাউন’ উঠিয়ে নেয়ার জন্যে পশ্চিমা বিশ্বের স্বাধীনচেতা মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করলে পশ্চিমা আদর্শের ভিত আরও দুর্বল হতে থাকে। কোটি কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারালেও গুটিকয়েক বিলিয়নায়াররা এই সুযোগে তাদের সম্পদ আরও বাড়িয়ে নেয়; যা কিনা সম্পদের অসম বন্টনকে আরও বাজেভাবে উপস্থান করেছে। করোনাভাইরাসের সবচাইতে বড় প্রভাব হলো, তা পশ্চিমা পুঁজিবাদী আদর্শের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলাফল ২০২১ সাল জুড়ে দেখা যাবে।

বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করার আগেই করোনার দ্বিতীয় ডেউ আঘাত হানে ইউরোপে। ২০২১ সালের প্রথম অংশেও বিশ্ব দ্বিতীয় ঢেউকেই মোকাবিলা করবে। এরই মাঝে ভাইরাসের নতুন জাতের আবির্ভাব হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহুর্তে এর গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট করা না গেলেও তা যে অর্থনীতির উপর সবচাইতে বড় আঘাত হানবে, তা নিশ্চিত।

মহামারির কারণে মেডিক্যাল সুরক্ষা সামগ্রী এবং টেস্টিং কিট নিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা; চীন এবং তুরস্ক এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে আখ্যা দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা চালান। চীনারাও এই ভাইরাসের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে হয়েছে বলে দাবি করতে থাকে। দুই দেশের মাঝে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে এই দ্বন্দ্ব আরও অস্থিরতার জন্ম দেয়।

মহামারিতে লাখো মানুষের মৃত্যুর মাঝে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির মাঝে শুরু হয় মুনাফাবৃত্তির প্রতিযোগিতা। ভ্যাকসিন ডেভেলপ করার ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা আরও গতিশীল হয়; বিশেষ করে রাশিয়া এবং চীন ভ্যাকসিন তৈরিতে মনোনিবেশ করার পর থেকে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা এবং আরও কয়েকটা দেশ নিজেদের জনসংখ্যার বহুগুণ ভ্যাকসিন অর্ডার করার ফলে ভ্যাকসিন নিয়ে আসন্ন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া যায়। তদুপরি আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণে ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যমূলক করার প্রচেষ্টা শুরু হওয়ায় এই প্রতিযোগিতা ২০২১ সালে একটা বাজে দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে।

মহামারির মাঝেই ফ্রান্সে ইসলাম বিদ্বেষী ভূমিকা নেয়া এক শিক্ষককে হত্যা করাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মাঝে ফ্রান্স বিরোধী আবেগ দৃশ্যমান হয়। এতে বেশিরভাগ মুসলিম দেশের সরকার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কথা না বললেও তা মুসলিম বিশ্বের অতি সংবেদনশীল জায়গাটাকে দেখিয়ে দেয়। ইউরোপের লিবারাল আদর্শিক অবস্থানের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের জনগণের এই অবস্থান ২০২১ সালের আদর্শিক সংঘাতের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। 

দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন এবং অস্ট্রেলিয় যুদ্ধজাহাজ। ভাইরাসের সংক্রমণে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলি অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সময় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনারা শক্তি প্রদর্শন করে। এতে পূর্ব এশিয়াতে স্বল্প সময়ের জন্যে মার্কিন অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।


দক্ষিণ চীন সাগর

করোনা মহামারির মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও গতিশীল হয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলি অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সময় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনারা শক্তি প্রদর্শন করে। এতে পূর্ব এশিয়াতে স্বল্প সময়ের জন্যে মার্কিন অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হংকংএ চীনা সরকারের কঠোর নীতির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের হস্তক্ষেপের কারণেও থেকে থেকে উত্তেজনা চলে।

বছরের শেষের দিকে ‘আরসেপ’ নাম নিয়ে আবির্ভাব হয় নতুন অর্থনৈতিক জোটের, যেখানে আসিয়ানের সাথে যোগ দেয় চীন, জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে এই জোটের বাইরে রাখা হয়। এই জোট রাজনৈতিক কোন পরিবর্তন না আনলেও যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে রেখেই বিশ্বের সবচাইতে বড় অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

ভারত মহাসাগর

হিমালয়ের পাদদেশে লাদাখ অঞ্চলে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ভারত এবং চীনের মাঝে চলে ব্যাপক উত্তেজনা। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অস্ত্র এবং ভারতের তৈরি করা সীমান্ত অবকাঠামো আকসাই চিন অঞ্চলে চীনা অবস্থানের উপর হুমকি তৈরি করলে বহু দশকে প্রথমবারের মতো চীনারা তাদের স্থল সীমানা নিয়ে ব্যস্ত হতে বাধ্য হয়। এই উত্তেজনার ফলে চীনারা তাদের সীমান্তে নতুন করে অবকাঠামো তৈরি করা শুরু করেছে, যা এখানকার সামরিক ব্যালান্সকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং উত্তেজনাকে ২০২১ সালে টেনে নিয়ে যাবে। হিমালয়ের ইস্যুতে ভারত তার প্রতিবেশী কোন দেশ থেকেই সমর্থন না পাওয়ায় ভারতের জন্যে এমন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যা ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বঙ্গোপসাগরে ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২০’এ অস্ট্রেলিয়ার যোগদানের মাধ্যমে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে ‘কোয়াড’ জোট পূর্ণতা পায়। ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তৈরি করা এই জোট ভারত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়া তথা ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর হাতকে শক্তিশালী করবে। ২০২১ সালে ভারত মহাসাগরে ব্রিটেন তার দৈত্যাকৃতির নতুন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’ মোতায়েন করতে যাচ্ছে, যা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে নতুন অস্থিরতার জন্ম দেবে।

হিমালয়ের উত্তেজনা এবং বঙ্গোপসাগরে ‘কোয়াড’ জোটের অস্ত্রের ঝনঝনানি দক্ষিণ এশিয়াতে তুরস্ককে একটা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার ভিত তৈরি করে দিয়েছে। কাশ্মির ইস্যু এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুকেও তুরস্ক এক্ষেত্রে ব্যবহার করবে। 

জানুয়ারি ২০২০। ত্রিপোলির উপকূলে তুর্কি যুদ্ধজাহাজ। লিবিয়ার যুদ্ধ তুরস্ককে লিবিয়ার উপকূলে একটা স্থায়ী সামরিক উপস্থিতির সুযোগ করে দিয়েছে; যা ফ্রান্স হুমকি হিসেবে দেখেছে।  


ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগর

২০২০ সালে ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগর অঞ্চলে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের উপর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ছিল সবচাইতে বেশি। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার কারণে ফ্রান্স, গ্রীস, মিশর এবং অন্যান্য দেশের সাথে থেকে থেকে বিবাদে জড়িয়েছে তুরস্ক। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্কের হস্তক্ষেপের পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং হাফতার বাহিনী জয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে ত্রিপোলিতে তুরস্কের একটা সামরিক অবস্থান নিশ্চিত হয়; যা ফ্রান্স হুমকিস্বরূপ দেখতে থাকে। এরপর থেকে লিবিয়ার উপকূলে নিয়মিত বিরতিতে গ্রিক এবং ফরাসি যুদ্ধজাহাজের সাথে তুর্কি জাহাজের বিবাদ চলতে থাকে। ২০২১ সালেও এই বিবাদ চলবে। লিবিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতি তৈরি হওয়ায় তিউনিসিয়া এবং আলজেরিয়াকে নিয়ে ফ্রান্স এবং তুরস্কের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

হাফতার বাহিনীর পক্ষে মিশরীয়রা সরাসরি হস্তক্ষপের হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের আলোচনায় যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হয়। উল্টো মিশর নীল নদের উপর ইথিওপিয়ার তৈরি করা বাঁধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। ইথিওপিয়ার সরকার বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসলে মিশর এবং সুদানের সাথে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তবে সেই উত্তেজনাও অন্যদিকে ধাবিত হয় যখন ইথিওপিয়ার সরকার জাতিগত তিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযান শুরু করে। গৃহযুদ্ধের আশংকায় ইথিওপিয়াতে আঞ্চলিক শক্তিগুলির হস্তক্ষেপ ছাড়াও কৌশলগত বাব এল মান্ডেব প্রণালী সংলগ্ন লোহিত সাগর এবং পুরো ‘হর্ন অব অফ্রিকা’ অঞ্চলে অস্থিরতার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বছরের শেষের দিকে সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হলে অত্র অঞ্চলের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। সোমালিয়াতে তুরস্কের সামরিক অবস্থান এক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে; আর একইসাথে সৌদি আরব এবং আমিরাতের জোট তুরস্কের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আরও জোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এভাবে ২০২১ সালে ভারত মহাসাগরে তুরস্কের একটা অবস্থান তৈরি হবার পদ্ধতি তৈরি হয়ে গেলো।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিয়মিত হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের তুর্কি চেষ্টা ইউরোপের সাথে তুরস্কের উত্তেজনা জিইয়ে রাখে। এর মাঝেই বিশাল এক বিস্ফোরণে লেবাননের বৈরুত বন্দরের উল্লেখযোগ্য অংশ ধ্বংস হয়ে গেলে বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ফ্রান্স, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়। তুরস্ক এবং গ্রীসের পাল্টাপাল্টি সামরিক মহড়ায় উত্তপ্ত থাকে সমুদ্র। ইস্তাম্বুলের হায়া সোফিয়াতে নামাজ পড়া শুরু হলেও ইউরোপের সাথে তুর্কিদের একটা চাপা উত্তেজনা শুরু হয়। 

আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের পর আজেরিদের উল্লাস। আজেরিদের পক্ষে তুর্কিদের সমর্থন ককেশাসে তুরস্কের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। 


ইউরেশিয়া

ককেশাসে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে শুরু হয় যুদ্ধ। তুর্কি সহায়তায় এবং রুশ নিরপেক্ষতায় আজেরিরা বড় একটা জয় ঘরে তুলে নেয়। এই যুদ্ধ ককেশাসে তুর্কি অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে এবং মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের নতুন করে অবস্থান তৈরির ভিত তৈরি করেছে। এই যুদ্ধ ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, যা ২০২১ সালের সম্ভাব্য সংঘাতগুলিকে প্রভাবিত করবে। অপরদিকে মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানে রাজনৈতিক পরিবর্তন চীনের উইঘুর সীমান্তে নতুন এক ভূরাজনৈতিক খেলার জন্ম দিতে যাচ্ছে। বেলারুশে ব্যাপক অস্থিরতা চললেও সেখানে রাজনৈতিক পরিবর্তন সংগঠিত হয়নি। আর ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের সখ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডনবাসে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রাশিয়া এবং তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে হাইড্রোকার্বন পাইপলাইনের জন্যে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আর যদিও রাশিয়া থেকে তুরস্ক ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র বছর শেষে তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তথাপি তুরস্ক এবং রাশিয়ার সম্পর্ক খুব শক্ত ভিতের উপর নয়। ভূকৌশলগত কারণে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাগুলি রাশিয়ার স্বার্থের পরিপন্থী। লিবিয়া এবং সিরিয়াতে রাশিয়া এবং তুরস্ক বিপরীত পক্ষে রয়েছে। একারণেই ২০২১ সালে সিরিয়ায় ইদলিবের যুদ্ধ নতুন করে শুরু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে লিবিয়া এবং আজেরবাইজানে তুরস্কের সমর্থন যুদ্ধের মোড় ঘোরার কারণে তা তুরস্ককে সিরিয়াতে অভিযান শুরু করতে আত্মবিশ্বাসী করবে।

পশ্চিম আফ্রিকা

পশ্চিম আফ্রিকায় দেশ মালিতে সামরিক অভ্যুত্থান গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দেশটাতে ফ্রান্সের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। একইসাথে তা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। আলজেরিয়া তার সংবিধান পরিবর্তন করে নিজ সীমানার বাইরে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে; যা সাহারা অঞ্চলে আলজেরিয়াকে নতুন শক্তি হিসেবে অবির্ভূত করছে। তুরস্কও পশ্চিম আফ্রিকাতে তার রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্যে কূটনৈতিক কর্মকান্ড বাড়িয়েছে।

পশ্চিম আফ্রিকার ফরাসি ভাষাভাষী দেশগুলিতে রাশিয়াও তার প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষ করে সেসব দেশের গৃহযুদ্ধে সমরাস্ত্র বিক্রয় এবং ভাড়াটে সেনা মোতায়েন করে ফ্রান্সের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে রাশিয়া। অত্র অঞ্চলে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে ব্যাপক তথ্যযুদ্ধও চলমান। শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সোশাল মিডিয়ার ব্যবহার নতুন এক প্রতিযোগিতার দ্বারকে জনসন্মুখে আনলো। 

রাস্তায় শেতাঙ্গ পুলিশের হাতে একজন কৃষ্ণাঙ্গের বিচার বহির্ভূত হত্যার পর থেকে পুরো যুক্তরাষ্ট্র কেঁপে ওঠে। মহামারির ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেই রাস্তায় লাখো মানুষের সমাবেশ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়। সারা বিশ্ব টেলিভিশনে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জাতিগত কলহকে প্রত্যক্ষ করে; যা ছিল ঐতিহাসিক।



আটলান্টিকের ওপাড়ে

নির্বাচনের বছরে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই ছিল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ নিয়ে হোয়াইট হাউজের সাথে লিবারালদের বছরব্যাপী দ্বন্দ্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। এর উপর রাস্তায় শেতাঙ্গ পুলিশের হাতে একজন কৃষ্ণাঙ্গের বিচার বহির্ভূত হত্যার পর থেকে পুরো যুক্তরাষ্ট্র কেঁপে ওঠে। মহামারির ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেই রাস্তায় লাখো মানুষের সমাবেশ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়। সারা বিশ্ব টেলিভিশনে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জাতিগত কলহকে প্রত্যক্ষ করে; যা ছিল ঐতিহাসিক।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কলহের সর্বশেষ রূপ ছিল হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনে জিতলেও একটা বিভক্ত রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেবার কঠিন দায়িত্ব পান তিনি। একইসাথে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির আবির্ভাবে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠেছে, তখন বাইডেন প্রশাসনের জন্যে ২০২১ সাল যে বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে, তা বলাই বাহুল্য। 

মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল আরব দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। মার্কিন দুর্বলতার কারণে ইস্রাইল তার নিরাপত্তার জন্যে এখন আরব দেশগুলি এবং তুরস্কের উপর নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। এতে মুসলিম দেশগুলির সরকারগুলিকে জনগণের অসন্তোষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।


মধ্যপ্রাচ্য

মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল আরব দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন এর সাফল্য দাবি করলেও তা প্রকৃতপক্ষে নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতার ফলাফল। মার্কিন দুর্বলতার কারণে ইস্রাইল তার নিরাপত্তার জন্যে এখন আরব দেশগুলি এবং তুরস্কের উপর নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। এতে মুসলিম দেশগুলির সরকারগুলিকে জনগণের অসন্তোষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ২০২১ সালেও এই প্রবাহ চলবে।

বছরটা শুরু হয়েছিল ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ইরানের প্রভাবশালী সামরিক অফিসার কাশেম সুলাইমানিকে মার্কিন ড্রোন হামলায় হত্যার মাধ্যমে। আর বছর শেষ হয়েছে ইরানের অভ্যন্তরে দেশটার পারমাণবিক প্রকল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মোহসেন ফাখরিজাদেহএর হত্যার মাধ্যমে; যা কিনা ইস্রাইলের কাজ ছিল বলেই সকলে ধারণা করেন। এছাড়াও সাইবার হামলায় ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সেন্টিফিউজের স্থাপনা ধ্বংস হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নির্বাচন চালিয়ে নেবার প্রচেষ্টা, মহামারির ভয়াবহতা গোপনের চেষ্টা, অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় রাস্তায় বিক্ষোভ, ভুলবশতঃ ইউক্রেনের বেসামরিক বিমান ভূপাতিত করে অস্বীকার করা এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পাল্টে ক্ষতিপূরণ প্রদান, ইত্যাদি ঘটনা ২০২০ সালে ইরানকে আরও দুর্বল করেছে। ইরান তার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেবার লক্ষ্যেই ফাখরিজাদেহ হত্যার প্রতিশোধ নেয়া থেকে এখনও বিরত থেকেছে। তারা হয়তো আশা করছে যে, নতুন মার্কিন প্রশাসন ইরানের উপর অবরোধ তুলে নিতে সচেষ্টা হবে। তবে বাইডেন প্রশাসনকে ট্রাম্প প্রশাসনের রেখে যাওয়া বাস্তবতাগুলি নিয়েই কাজ করতে হবে।

বাইডেন প্রশাসনের নীতি পরিবর্তনকে মাথায় রেখে ইতোমধ্যেই তুরস্ক এবং সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ শুরু করেছে। এতে সবচাইতে বড় হুমকিতে পড়বে ইরান। সিরিয়ার ইদলিবে বছরের শুরুতে তুর্কি সমর্থিত বাহিনীর সাথে রুশ এবং ইরান সমর্থিত বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তবে উপসংহারে না পৌঁছানো এই সংঘাত আবারও শুরু হবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। ইরান বাইডেন প্রশাসনের মাঝে অবরোধ উঠিয়ে নেয়ায় আশার আলো দেখলেও ইরাক এবং সিরিয়াতে ইরানের অবস্থানকে তুর্কি এবং সৌদি গ্রুপের প্রভাব বিস্তার থেকে রক্ষা করার জন্যে ইরানের পক্ষে রাশিয়া ছাড়া আর কেউই থাকবে না। বিশেষ করে ইস্রাইলের সাথে আরব দেশগুলির সখ্যতা তৈরি হওয়ায় ২০২১ সালে ইরানের জন্যে আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখা কঠিন হবে।

No comments:

Post a Comment