Wednesday 4 July 2018

ভেনিজুয়েলা-কলম্বিয়া-ইকুয়েডরের পতাকা একইরকম কেন?

ঊনিশ শতকে গ্র্যান কলম্বিয়া তৈরি হয় স্পেন থেকে আলাদা হয়ে। এরপরে গ্র্যান কলম্বিয়া ভেঙ্গে তৈরি হয় ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডর। দেশগুলির পতাকায় মিল এতটাই যে, এদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। 


 ০৫ জুলাই ২০১৮
 
দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি একসময় ছিল স্প্যানিস এবং পর্তুগীজ উপনিবেশ। পঞ্চদশ শতকের শেষে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অভিযানের পর থেকে ঐ এলাকার মানুষগুলিকে প্রায় নির্মূল করে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা সেখানে বসতি গড়ে। জনসংখ্যার পুরোটাই প্রকৃতপক্ষে ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত। এদের ভাষা এবং সংস্কৃতি একই। তবুও অনেকগুলি দেশে বিভক্ত এই মহাদেশ। অনেকগুলি পতাকা; জাতীয় সঙ্গীত; জাতীয় প্রতীক। এই বিভক্তির কারণ খুঁজতে যেতে হবে অষ্টম শতাব্দীতে, যখন ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি আলাদা হবার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
  
স্প্যানিস সামরিক অফিসার ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা ব্রিটিশদের সহায়তায় স্পেনের কাছ থেকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিকে আলাদা করার ব্যবস্থা করেন। তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে সবচাইতে বেশি লাভবান হয়েছে তৎকালীন সুপারপাওয়ার ব্রিটেন। স্প্যানিসরা ফ্রাঞ্চিসকোকে ব্রিটিশ গুপ্তচর সন্দেহ করতো।


ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা – যিনি দক্ষিণ আমেরিকাকে স্পেন থেকে আলাদা করেন

১৭৫০ সালে ভেনিজুয়েলাতে জন্ম নেয়া স্প্যানিস সামরিক অফিসার ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা বহু দেশের বহু যুদ্ধে অংশ নেন। মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্প্যানিসরা সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের কিছু উপনিবেশ বাগিয়ে নিতে চায়। ১৭৮১ থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে স্প্যানিস বাহিনীর অধীনে যুদ্ধে করেন ফ্রাঞ্চিসকো। ১৭৮১ সালে ফ্রাঞ্চিসকোকে ব্রিটিশ উপনিবেশ জামাইকাতে গোয়েন্দাগিরি করতে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি তার কর্মসম্পাদনের মাঝে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ফিলিপ অলউডের সাথে এক চুক্তিও করে ফেলেন। চুক্তি মোতাবেক ব্রিটিশদেরকে তিনি স্পেনের সাথে বাণিজ্যের আড়ালে স্পেনে যাবার একটা চ্যানেল খুলে দেন। স্প্যানিসরা পরবর্তীতে ফ্রাঞ্চিসকোকে গুপ্তচর আখ্যা দেয় এবং অবিশ্বাস করতে থাকে। ফ্রাঞ্চিসকো স্পেন এবং ফ্রান্সের এক যৌথ অপারেশনে অংশ নেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশদের সবচাইতে শক্ত ঘাঁটি জামাইকাকে দখল করা। পুরো দলের মাঝে ফ্রাঞ্চিসকোরই ব্রিটিশদের সম্পর্কে সবচাইতে ভালো ধারণা ছিল, কারণ তাকে ব্রিটিশদের উপরে গোয়ান্দাগিরিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এই অভিযান চলার মাঝেই কিভাবে যেন ব্রিটশরা আগেভাগে পরিকল্পনা জেনে ফেলে এবং আগেই আক্রমণ করে বসে; ভেস্তে যায় অভিযান। জামাইকা ব্রিটিশদের হাতেই থাকে। আভিযান ব্যর্থ হবার পর ফ্রাঞ্চিসকোর বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আবারও গভীর হয়। ফ্রাঞ্চিসকো ১৭৮৩ সালের জুলাই মাসে স্প্যানিস কিউবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান, এবং পরের বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি জর্জ ওয়াশিংটন, হেনরি নক্স, থমাস পেইন, আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন, স্যামুয়েল এডামস এবং থমাস জেফারসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।

ফ্রাঞ্চিসকো কি ব্রিটিশ গুপ্তচর ছিলেন?

১৭৮৫ সালে ফ্রাঞ্চিসকো লন্ডনে আসেন। সেখান থেকে মার্কিন দূতাবাসের এক সামরিক কূটনীতিবিদ কর্নেল উইলিয়াম স্টিফেন স্মিথের সাথে তিনি প্রুশিয়া যান সামরিক মহড়া দেখতে। পুরো ইউরোপ ঘুরে তিনি অনেকের সাথে বন্ধুত্ব করেন।স্প্যানিয়ার্ডরা সবসময়েই তার উপরে নজর রাখছিল। তারা ফ্রাঞ্চিসকোকে গ্রপ্তার করার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু শক্তিশালী বন্ধুরা ফ্রাঞ্চিসকোকে রক্ষা করে। ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা অনেকদিন থেকেই দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশের একটা বড় অংশের দায়িত্বে থাকা ‘ক্যাপ্টেন্সি জেনারেল অব ভেনেজুয়েলা’র কর্তৃত্ব নিতে এক পরিকল্পনা করেন। এই ক্যাপ্টেন্সির অধীনে বর্তমান ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, পানামা, ইকুয়েডর এবং পেরুর বিরাট অঞ্চল ছিল। তিনি ১৭৯০ সালে প্রথম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদের সাথে দক্ষিণ আমেরিকায় আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাটা আলোচনা করেন। তখন ব্রিটিশদের সাথে স্প্যানিয়ার্ডদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। তবে দু’দেশের সম্পর্কে বসন্ত এসে গেলে এই প্রকল্পে ব্রিটিশরা আগ্রহ হারায়।

১৭৯১ থেকে ১৭৯৭ পর্যন্ত সময় ফ্রাঞ্চিসকো ফ্রান্সে কাটান এবং সেখানকার ফরাসী বিপ্লবে সরাসরি অংশ নেন। তিনি ফরাসি বিপ্লবের বিপক্ষে রাজতন্ত্রকামীদের সাথে থাকেন। একাধিকবার বিপ্লবীদের হাতে গ্রেপ্তার হবার পরেও তাকে নিয়ে কি করা হবে, সেটা ঠিক করতে না পেরে তাকে বারংবার ছেড়ে দেয়া হয়। ছাড়া পাবার পরেও তিনি তার কর্মকান্ড অব্যহত রাখেন এবং ১৭৯৬-৯৭ সালের মাঝে দু’দু’বার রাজতন্ত্রপন্থীদের পক্ষে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। অবশেষে সকল চেষ্টা ভেস্তে গেলে ১৭৯৮ সালে গোপনে ব্রিটেনে পালিয়ে যান, যেখানে সবসময়ই তার নিরাপদ আশ্রয় আপেক্ষা করছিল। ব্রিটেন সবসময়েই ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে রাজতন্ত্রীদের সহায়তা দিয়েছিল। আর ১৭৯৯ সাল থেকে ফরাসী বিপ্লব থেকে উত্থিত ন্যাপোলিয়ন আবির্ভূত হন ব্রিটেনের বিশাল শত্রু হিসেবে।

ল্যাটিন আমেরিকায় ফ্রাঞ্চিসকোর প্রথম অভিযান - যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা


তার দক্ষিণ আমেরিকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৮০১ সালে ব্রিটিশদের সহায়তা চান ফ্রাঞ্চিসকো। স্পেন তখন ব্রিটেনের শত্রু দেশ, কেননা ১৭৯৬ থেকে ফ্রান্সের সাথে স্পেন হাত মিলিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট দ্যা ইয়াংগার ১৮০৫ সালে রিয়ার এডমিরাল হোম রিগস পপহ্যামকে দায়িত্ব দেন ফ্রাঞ্চিসকোর পরিকল্পনাটি খতিয়ে দেখার জন্যে। পপহ্যাম ব্রিটিশ নেতৃত্বকে বোঝান যে, দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিস উপনিবেশকে স্পেন থেকে আলাদা করতে গেলে ভেনিজুয়েলা নয়, বরং বর্তমান আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সের ফলাফল বয়ে আনার সম্ভাবনা বেশি। সেখানে ব্রিটিশ হামলা হলে স্প্যানিস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উস্কে দেয়া যাবে অপেক্ষাকৃত সহজে।

ফ্রাঞ্চিসকো এতে মনোক্ষুন্ন হলেন। তিনি তার পরিকল্পনা পাল্টে ১৮০৫-এর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সরণাপন্ন হলেন। ফ্রাঞ্চিসকো মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন এবং পররাষ্ট্র সচিব জেমস ম্যাডিসনের সাথেও একান্ত বৈঠক করেন। যুক্তরাষ্ট্র ফ্রাঞ্চিসকোকে সরাসরি সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানান, কারণ ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তখনও পক্ষ নেয়নি। ফ্রাঞ্চিসকো থেমে যাননি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ এবং জনবল যোগাড় করায় মনোনিবেশ করেন, যা ব্যবহার করে তিনি ভেনিজুয়েলাতে সামরিক অপারেশনে যাবেন। দু’শ-এর মতো ভাড়াটে সৈন্য এ অভিযানে যেতে রাজি হয়। তার সাথে থাকে ফ্রাঞ্চিসকোর পুরোনো বন্ধু মার্কিন কর্নেল উইলিয়াম স্টিফেন স্মিথ। মার্কিন ব্যবসায়ী স্যামুয়েল ওগডেনের কাছ থেকে তিনি ২০টি কামানের একটা জাহাজ ভাড়া নেন; নাম দেন ‘লিয়্যান্ডার’। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে ফ্রাঞ্চিসকো আরও দু’টা জাহাজ সাথে নেন। এই সময়েই তিনি ভেনিজুয়েলার পতাকার ডিজাইন করে ১২ই মার্চ উত্তোলন করেন। পতাকাটা ছিল তিনটি রঙের সমান্তরাল দাগ – হলুদ, নীল এবং লাল। তবে ফ্রাঞ্চিসকোর মিশন সফল হলো না। ১৮০৬ সালের ২৮শে এপ্রিল ভেনিজুয়েলার উপকূলে অবতরণ করতে গিয়ে ফ্রাঞ্চিসকো স্প্যানিশ নৌবাহিনীর কাছে তার ক্যারিবিয়ান থেকে সংগৃহীত দু’টি জাহাজই হারান। ৬০ জন নাবিক বন্দী হয়, যাদের বিচারের পরে ১০ জনের মৃত্যুদন্ড দিয়ে মরদেহ কয়েক খন্ড করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফ্রাঞ্চিসকো অবশ্য লিয়্যান্ডার-এ চড়ে প্রাণ নিয়ে পালান। তাকে পলায়নে সহায়তা দেয় ব্রিটিশ রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজ ‘লিলি’। ব্রিটিশরা ফ্রাঞ্চিসকোকে ব্রিটিশ উপনিবেশ বার্বাডোসে নিয়ে যায়, এবং ফাঞ্চিসকোকে আরেকবার সামরিক অভিযানে সহায়তা দিতে আগ্রহী হয়।

ফ্রাঞ্চিসকোর দ্বিতীয় অভিযান - যুক্তরাষ্ট্রের স্থানে ব্রিটেন

১৮০৬ সালের ২৪শে জুলাই ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেন থেকে ফ্রাঞ্চিসকোর নতুন অভিযানের শুরু হয়। তার যুদ্ধজাহাজ লিয়্যান্ডার-এর সাথে রয়েছে রয়াল নেভির ৪টা যুদ্ধজাহাজ। ফ্রাঞ্চিসকোর ভাড়াটে সেনারা এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনীর নাবিকেরা উপকূলে নেমে কিছুদিন তাদের দখলের চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু স্প্যানিশ সৈন্যদের সংখ্যাধিক্যের কারণে অগাস্টের মাঝেই তিনি তার অভিযান গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। এই ব্যর্থ অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ফ্রাঞ্চিসকোকে সহায়তা করার জন্যে কর্নেল উইলিয়াম স্মিথ এবং ব্যবসায়ী স্যামুয়েল ওগডেনের বিরুদ্ধে মামলা করে। অভিযোগ ছিল যে, তারা দস্যুতা করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষতাকে নষ্ট করেছেন। আদালতে হাজির হয়ে কর্নেল স্মিথ বীরদর্পে বলেন যে, তিনি এই অপারেশনে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন এবং পররাষ্ট্র সচিব জেমস ম্যাডিসনের নির্দেশে। এই রাজনীতিবিদেরা উভয়েই আদালতে যেতে অস্বীকৃতি জানান এবং ফলশ্রুতিতে স্মিথ এবং ওগডেন উভয়কেই নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। আসলে এই অপারেশনটা প্রথমে ছিল মার্কিন। এরপর প্রথম ব্যর্থতার পর ব্রিটিশরা সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলাতেই যতো বিপত্তির সৃষ্টি হয়। ভেনিজুয়েলাকে স্পেন থেকে আলাদা করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উভয়েই সেটার নিয়ন্ত্রণ চাইছিল।


  
আর্জেন্টিনার প্রতিষ্ঠাতা হোজে ডে স্যান মার্টিন এবং চিলির প্রতিষ্ঠাতা বার্নার্ডো ও'হিগিন্স আন্দিজ পর্বত পাড়ি দিচ্ছেন চিলির উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশরা আর্জেন্টিনায় অভিযান চালানোর পর পুরো ল্যাটিন আমেরিকা স্প্যানিস শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। আপাতদৃষ্টিতে ব্রিটিশ অপারেশনকে ব্যর্থ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ল্যাটিন আমেরিকাকে স্পেন থেকে আলাদা করাই ছিল ব্রিটিশ পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বাধীনতাকামী নেতারা বিরাট ভূমিকা পালন করে। 


ব্রিটিশরা কি দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যার্থ হয়েছিল?

এর মাঝেই ১৮০৬-০৭ সালের মাঝে ব্রিটিশ সরকার বর্তমান আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সে একটা সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। স্প্যানিসদের বেশিরভাগ সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত ছিল ভেনিজুয়েলাতে; আর্জেন্টিনার আশেপাশে শক্তি ছিল খুবই কম; যেকারণেই ব্রিটিশরা সেখানে অপারেশনে যায়। এরপরেও সরাসরি সাফল্য না পেয়ে ব্রিটিশরা সেখান থেকে চলে আসে। ফ্রাঞ্চিসকো এবার লন্ডন যান এবং নতুন করে ভেনিজুয়েলা আভিযানের জন্যে ব্রিটিশ সহায়তা চাইতে থাকেন। কিন্তু ঠিক সেসময় বিরাট এক রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়ে যায়। ১৮০৫ সালে ফরাসী-স্প্যানিস নৌবহর ব্রিটিশদের হাতে ত্রাফালগার-এর যুদ্ধে পরাজিত হলে পর্তুগীজরা আত্মায় শক্তি পায় এবং ব্রিটিশদের পক্ষে চলে যায়। এতে ন্যাপোলিয়ন ক্ষেপে গিয়ে স্পেন এবং পর্তুগালে সৈন্য পাঠান। এভাবে স্পেন হয়ে যায় ব্রিটিশ বন্ধু; এবং দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিস উপনিবেশকে স্পেন থেকে আলাদা করার পরিকল্পনা মুলতুবি করা হয়। কিন্তু ততদিনে যা হবার, তা হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আক্রমণের ফলশ্রুতিতে ভেনিজুয়েলা এবং আর্জেন্টিনায় বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। ১৮১০ সালের মে মাসে আর্জেন্টিনায় বিদ্রোহীরা স্প্যানিস নেতৃত্বের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়। আর্জেন্টিনার বিদ্রোহীরা হোজে ডে স্যান মার্টিনের নেতৃত্বে এরপর চিলি এবং পেরুকে স্পেন থেকে আলাদা করে ফেলে।

প্রায় তিন’শ বছর ধরে ব্রিটিশরা দক্ষিণ আমেরিকায় বড় কোন অপারেশনে যায়নি। ন্যাপোলিয়নের অভিযানকে উপজীব্য করে ব্রিটিশরা স্পেনের উপনিবেশগুলিকে স্পেন থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়া শুরু করে। সেই প্রক্রিয়াতে ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা সহায়তা করেছিলেন শুধু। মিরান্ডার আঁকা পতাকাকেই পরবর্তীতে ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডর নিজেদের জাতীয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেয়। ১৮১০ সালের ১৯শে এপ্রিল ভেনিজুয়েলার কারাকাসে বিদ্রোহীরা স্প্যানিস নেতৃত্বকে বন্দী করে ফেলে। সিমন বলিভার এবং আন্দ্রেস বেলোর নেতৃত্বে তারা লন্ডনে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি চায় এবং সরাসরি ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ কামনা করে। তারা ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডাকেও তাদের সাথে ভেনিজুয়েলাতে নিয়ে আসে। ১৮১১ সালের জুলাই মাসে স্বাধীন ভেনিজুয়েলার ঘোষণা দেয়া এবং ফ্রাঞ্চিসকোর ব্যবহার করা তিন রঙের ভেনিজুয়েলার পতাকাকে অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু ১৮১২ সালে এক প্রতিবিপ্লবের মাঝ দিয়ে স্পেনপন্থীরা আবারও ক্ষমতা দখল করে নেয়। ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা স্প্যানিসদের সাথে চুক্তি করতে গেলে সিমন বলিভার এতে নাখোশ হন। বলিভারের হিসবে সেটা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। ফ্রাঞ্চিসকোকে তারা স্প্যানিস নেতৃত্বের হাতে তুলে দেয়, আর এর বিনিয়মে চুক্তি মোতাবেক সিমন বলিভারকে নিরাপদে স্পেনে ভ্রমণ করার অনুমতি দেয় স্প্যানিয়ার্ডরা। ১৮১৬ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা বিচারাধীন অবস্থায়ই স্পেনে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার লাশ গণকবরে দাফন করা হয়, যাতে কোনটা তার কবর, সেটা যেন খুঁজে পাওয়া না যায়।
  

জার্মান দার্শনিক উলফগ্যাং ফন গোথে ভেনিজুয়েলার পতাকার রংগুলি বেছে নিতে সহায়তা করেছিলেন। পতাকার ডিজাইন করেছিলেন ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা। পরবর্তীতে এই তিন রঙের পতাকাই ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরের পতাকায় স্থান পায়। উৎস একই বলে ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশগুলির মাঝে পার্থক্য করা কঠিন।

যেভাবে তিন দেশের পতাকা আঁকা হলো

ফ্রাঞ্চিসকো ভেনিজুয়েলার পতাকার ধারণাকে আকারে রূপ দিতে কথা বলেছিলেন জার্মান দার্শনিক জোহান উলফগ্যাং ফন গোথে এবং রুশ কূটনীতিবিদ সাইমন রোমানোভিচ ভরনজফের সাথে। গোথের সাথে ফ্রাঞ্চিসকোর পতাকা নিয়ে কথা হয় ১৭৮৫ সালে। গোথে তাকে বলেন যে, তিনটা মূল রঙ থেকেই আলোর সৃষ্টি হয় – হলুদ, নীল এবং লাল। এই তিনটা রঙ আলাদাভাবে শুরু হলেও শেষ হয় এক লক্ষ্যে। ফ্রাঞ্চিসকোরও তাই এরকমই এক লক্ষ্যে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ। ফ্রাঞ্চিসকো চাইছিলেন আমেরিকাতে পুরো স্প্যানিস উপনিবেশ মিলিয়ে বিশাল এক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। একেবারে বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম এবং মধ্যাংশ থেকে শুরু করে মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, কিউবা সহ, দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর মিলে সেই রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ফ্রাঞ্চিসকো। ব্রিটিশদের কাছে উপস্থাপিত তার পরিকল্পনা তেমনই ছিল। মূলতঃ স্পেন থেকে আলাদা হবার কাজটাই তিনি করেছিলেন। বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ স্থানে উপস্থিত থাকায় স্পেন তাকে ব্রিটিশ গুপ্তচর হিসেবে মনে করতো। ফরাসী বিপ্লবের সময়ে বিপ্লবের বিপক্ষের রাজতন্ত্রকামীদের (যাদেরকে ব্রিটিশরা সহায়তা করতো) পক্ষে একাধিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা তার স্প্যানিস দোষারোপকে মুছে ফেলতে সহায়তা করে না। স্পেন ন্যাপোলিয়নের পক্ষে থাকার সময় তিনি ব্রিটিশদের সহায়তায় ল্যাটিন আমেরিকার বিদ্রোহ উস্কে দেন। এরপর স্পেন ব্রিটিশদের পক্ষে গেলেও তার কর্মকান্ড চালিয়ে যান, এবং স্পেন থেকে তার সকল ল্যাটিন আমেরিকার উপনিবেশ আলাদা করে ফেলেন। তিনি স্থিতিশীল কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি; যে কাজটা পরে সিমন বলিভার করেছিলেন।
 

ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সিমন বলিভারের ছবির সামনে কথা বলছেন। সিমন বলিভার ল্যাটিন আমেরিকার জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে স্বীকৃত হলেও তিনি আসলে কয়েকটা দেশের জন্মদাতা। ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা যেখানে ল্যাটিন আমেরিকাকে স্পেন থেকে আলাদা করেছিলেন, বলিভার সেই আলাদা হওয়া ল্যাটিন আমেরিকাকে টুকরো টুকরো করায় অংশ নিয়েছেন।

 
সিমন বলিভার এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভক্তি

সিমন বলিভার ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিস অঞ্চলগুলিকে টুকরো টুকরো করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৮১৯ সালে রিপাবলিক অব কলম্বিয়া তৈরি করে নিজে প্রেসিডেন্ট হন, এবং দুই জন ভাইস প্রেসিডেন্টের অধীনে দেশটাকে দুই ভাগ করেন। একটার নাম দেয়া হয় ভেনিজুয়েলা, আর আরেকটা নিউ গ্রানাডা (পরবর্তীতে কলম্বিয়া)। তবে দেশগুলি যে একই উৎস থেকে এসেছিল, তা ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরের পতাকা দেখলেই বোঝা যায়। তিন দেশের পতাকাতেই একই রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, যা কিনা ফ্রাঞ্চিসকোর আঁকা। বলিভার এবং ফ্রাঞ্চিসকোর চিন্তাধারায় কিছুটা দ্বিমত ছিল। যেখানে ফ্রাঞ্চিসকো ছিলেন ব্রিটিশপন্থী, বলিভার ছিলেন সমাজতন্ত্রী। বলিভারের সমাজন্তন্ত্রী চিন্তাধারা তার শিক্ষক ডন সিমন রদ্রিগেজ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল। তারা দু’জনে মিলে ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন এবং ১৮০৫ সালে মিলানে ইতালির রাজা হিসেবে ন্যাপোলিয়নের রাজকীয় অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। রদ্রিগেজ ১৭৯৭ সালেই স্প্যানিস শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জড়িত থাকার অপরাধে ভেনিজুয়েলা ছেড়েছিলেন। বলিভার ১৮২১ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নামানুসারে ‘গ্র্যান কলম্বিয়া’ নামে আরেকটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাঝে ছিল বর্তমানের ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, পানামা, ইকুয়েডর। আর্জেন্টিনার জেনারেল হোজে ডে স্যান মার্টিন-এর সাথে একত্রিত হয়ে বলিভার পেরু এবং ইকুয়েডরকে আলাদা করেন। সকলের কাছে এই কাজটি ছিল স্পেন থেকে মুক্ত করার কাজ। প্রকৃতপক্ষে তারা আলাদা কয়েকটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যাদের মাঝে আলাদা হবার কোন কারণই ছিল না। আলাদা আলাদা নেতৃত্ব দেয়া হয় এসব স্থানে, যারা খুব শিগগিরই নিজেদের আখের গোছাতে আলাদা রাষ্ট্র চাইতে থাকেন। ১৮২৫ সালের ৬ই অগাস্ট নতুন আরেকটি দেশের জন্ম দেয়া হয়; যার নামকরণ করা হয় সিমন বলিভারের নামে – বলিভিয়া। এই সবগুলিই তখন ছিল গ্র্যান কলম্বিয়ার অধীনে, যার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন বলিভার। কিন্তু ১৮৩০ সালের মাঝেই গ্র্যান কলম্বিয়া ভেঙ্গে ভেনিজুয়েলা, নিউ গ্রানাডা (কলম্বিয়া) এবং ইকুয়েডর তৈরি হয়; প্রত্যেকটির একচ্ছত্র অধিপতি হন বলিভারেরই সমালোচকেরা, যারা একসময় বলিভারের একনায়কোচিত কার্যকলাপের বিরোধী ছিলেন।
  
খুব অল্প সময়ের মাঝেই ল্যাটিন আমেরিকার পুরো এলাকা স্প্যানিসদের হাতছাড়া তো হয়ই, তদুপরি অনেকগুলি দেশে বিভক্ত হয়ে যায়। সুপারপাওয়ার ব্রিটেন ল্যাটিন আমেরিকাকে একত্রিত দেখতে চায়নি।


ব্রিটেন – সুপারপাওয়ারের রাজনীতিই সবকিছু

ন্যাপোলিয়নের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশরা দক্ষিণ আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করেনি। গায়ানা উপকূলের অল্প কিছু অঞ্চল ডাচ এবং ফ্রেঞ্চদের অধীনে ছাড়া এর প্রায় পুরোটাই ছিল পর্তুগাল এবং স্পেনের অধীনে। ১৮৩০ সাল নাগাদ পর্তুগীজদের অধীনে ব্রাজিল ছাড়াও সৃষ্টি হয় রিও ডে লা প্লাটা (আর্জেন্টিনা), উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, চিলি, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এবং ভেনিজুয়েলা। ব্রিটিশরাও গায়ানা উপকূলে একটা উপনিবেশ করে ফেলে। স্প্যানিস উপনিবেশিক এলাকাটা কেটে টুকরা টুকরা করে ৯টা দেশ তৈরি হলেও ব্রাজিল একত্রেই থাকে; কেউ একে ভাঙ্গেনি। কারণ ব্রাজিল ছিল ব্রিটিশদের বন্ধু পর্তুগালের উপনিবেশ। ব্রিটিশরা চায়নি ব্রাজিল ভেঙ্গে যাক।

ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি স্বপ্নে পাওয়া জাতীয়তার উপরে প্রতিষ্ঠিত। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা নিজেদের মাঝে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে গিয়ে দেশগুলিকে টুকরো টুকরো করেছে। আলাদা করে জাতীয় পতাকা ডিজাইন করার সময় রয়েছে কার? ফ্রাঞ্চিসকো তো কষ্ট করে ডিজাইন করেই দিয়ে গেছেন; তাই ওটার উপরেই কেটে-চিরে দাঁড়িয়ে আছে আজকের পতাকাগুলি। এই পতাকাকে ঘিরেই কতনা আবেগ; উচ্ছ্বাস! কেউ চিন্তাও করেনি যে ৯টা পতাকা মানে ৯টা আলাদা জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত তারা; যদিও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আকৃতি, সকলকিছুই এক! এদের সকলেই একবাক্যে ফ্রাঞ্চিসকো, বলিভার, স্যান মার্টিন-এর মতো কয়েক ব্যক্তিকেই স্মরণ করে; কারণ তাদের সকলেরই জন্ম এদের হাতে। আর এরা আবার কাজটা সম্পাদন করেছে তৎকালীন সুপারপাওয়ার ব্রিটিশদের হাত ধরে। ব্রিটিশরা স্পেন থেকে ল্যাটিন আমেরিকার অঞ্চলকে আলাদা করলেও এদেরকে একত্রে বিরাট এক দেশ হিসেবে দেখতে চায়নি। ছোট ছোট দেশে বিভক্ত হয়ে তারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের মাঝে ব্যাস্ত থেকেছে। জাতীয় পতাকা, সঙ্গীত এবং প্রতীকগুলি তাদের সেই ইন্ধন যুগিয়েছে। হাল্কা বিষয়গুলি তাদের আবেগকে নাড়া দিয়েছে এবং আবেগ হয়েছে তাদের চালিকাশক্তি। ফ্রাঞ্চিসকো, বলিভার, স্যান মার্টিন-এর সৃষ্ট দেশগুলি ভূরাজনীতিতে তাই শিশুই রয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ
আর্জেন্টিনা কি পারবে?

No comments:

Post a Comment