Saturday, 7 July 2018

ব্রিটেন যেভাবে ব্রাজিলের জন্ম দিয়েছিল


ব্রাজিলের প্রথম পতাকা - ১৮২২ সাল। রাজা পেদ্রোর অধীনে ব্রাজিলের এই পতাকার সবুজ এবং হলুদ রঙ রাজা এবং রানীর পর্তুগীজ এবং অস্ট্রিয়ান রাজবংশের রঙ থেকে নেয়া। ব্রাজিলের আজকের পতাকাতেও এই রঙ চলছে। 
 
৭ই জুলাই ২০১৮

ব্রাজিল বিশ্ব মানচিত্রের বড় একটি দেশ। আমাজন নদী এবং আমাজন জঙ্গলের দেশ ব্রাজিল। ৮৫ লক্ষ বর্গ কিঃমিঃ-এর চেয়েও বড় ব্রাজিলের এলাকা, যা প্রায় ৫৮টা বাংলাদেশের সমান! ২১ কোটির মতো এর জনসংখ্যা, যা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম জনবহুল দেশ। ২,১৪০ বিলিয়ন ডলারের এর অর্থনীতি, যা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম। তবে ১০,২২৪ মার্কিন ডলারের মাথাপিছু আয় অনেক দেশের চাইতেই কম। ৫ কোটিরও বেশি মানুষ সেখানে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তবুও ব্রাজিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে বেশ এগিয়ে। দেশটি পৃথিবীর নবম বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারী দেশ। এর প্রতিরক্ষা ইন্ডাস্ট্রির খ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। ব্রাজিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হাল্কা অস্ত্র রপ্তানিকারক। ব্রাজিলের বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমব্রায়ার বিমান তৈরি করে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে। ব্রাজিলের সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩ লাখের কিছু বেশি। তবে রিজার্ভ ১৩ লাখেরও বেশি। ২৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট পৃথিবীর ১১ বৃহত্তম। ৬০ হাজার নাবিকের ব্রাজিলিয়ান নৌবাহিনী পৃথবীর সবচাইতে বড় নৌবাহিনীগুলির একটি। ফ্রিগেট-কর্ভেট-ওপিভি মিলিয়ে এসকর্ট জাহাজ রয়েছে ১৪টা, সাবমেরিন ৫টা, বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজ ৫টা। ৭৭ হাজার সেনার বিশাল বিমান বাহিনীতে স্বল্প ক্ষমতার ৯০টা হাল্কা ফাইটার এবং ৩১টা প্রপেলার কাউন্টার ইন্সারজেন্সি বিমান ছাড়া বাকিটা মূলত ১৩০টা পরিবহণ বিমান, ৯৪টা হেলিকপ্টার এবং ১৭৫টা প্রশিক্ষণ বিমান।

এতবড় দেশ; এতবড় অর্থনীতি; প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রাজিলের নাম এতো কম শোনা যায় কেন? হ্যাঁ, ‘ব্রিকস’ নিয়ে কিছুদিন বেশ হৈচৈ হলেও সেটা এখন ফাইলবন্দীই বলা চলে। ব্রাজিলের এই বাস্তবতা বুঝতে ব্রাজিলের জন্মের দিকে তাকাতে হবে। তার জন্মই বলে দেয় যে ব্রাজিল কি করবে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় অবতরণের পর থেকে ইউরোপিয়রা আমেরিকায় নিজেদের দখলদারিত্ব কায়েমের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, তার মাঝে অগ্রগামী ছিল পর্তুগীজরা। তারা দক্ষিণ আমেরিকায় বর্তমান ব্রাজিলের উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ১৮০৭ সাল পর্যন্ত ব্রাজিল পর্তুগালের একটা বড় উপনিবেশের ভূমিকাই পালন করেছে। তবে হিসেব পাল্টে যায় রাজা ষষ্ঠ জনের সময়কালে।

ষষ্ঠ জন (ষষ্ঠ জোয়াও) পর্তুগাল এবং ব্রাজিলের অধিকর্তা হন বটে, তবে ন্যাপোলিয়নের আবির্ভাবে তার ভাগ্যে উত্থান-পতন চলতে থাকে। ফরাসী-স্প্যানিসরা পর্তুগাল আক্রমণ করলে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় জন ব্রাজিলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। 
  

পর্তুগালের রাজা, নাকি ব্রাজিলের রাজা?

পর্তুগালের প্রিন্স ষষ্ঠ জন (ষষ্ঠ জোয়াও)-এর জন্ম ১৭৬৭ সালে। দেশ চালাচ্ছিলেন তার মা প্রথম মারিয়া। তবে ১৭৮৬ সাল থেকে রানী মারিয়ার মানসিক সমস্যা সকলের সামনে দৃশ্যমান হতে থাকে। সেই একই বছর তিনি তার স্বামী তৃতীয় পিটারকে হারান। ১৭৮৮ সালে মারিয়ার বড় ছেলে হোজে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জন হয়ে যায় সিংহাসনের পরবর্তী প্রার্থী। ১৭৯২ সালে পর্তুগীজ রাষ্ট্রীয় লোকজনের সিদ্ধান্তে ১৭ জন ডাক্তার একত্রে রানীকে রাজ্য চালানোর জন্যে মানসিকভাবে অযোগ্য ঘোষণা করেন। তারা জনকে ক্ষমতা নিতে বলে। ২৫ বছর বয়সে জন পর্তুগালের ‘প্রিন্স রিজেন্ট’ বা নায়েব উপাধি নিয়ে দেশ শাসন শুরু করেন।

তখন ফরাসী বিপ্লবের পরপর ইউরোপ অস্থির। ব্রিটেন ইউরোপে রাজতন্ত্রের পূনপ্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর; পর্তুগাল ও স্পেন তার সাথে রয়েছে। চতুর্দিকে যুদ্ধ চালাচ্ছে ফ্রান্সের রেভোলিউশনারি সরকার। ফ্রান্স-স্পেনের সীমান্তে তখন চলছে যুদ্ধ। ১৭৯৫ সালে স্পেন ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে হেরে গেলে ভূরাজনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন হয়। স্পেন ফ্রান্সের সাথে শান্তি চুক্তি করে ফ্রান্সের দলে ভিড়ে গেলেও ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে বলে পর্তুগাল চুক্তি করেনি; তারা ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মাঝে নিরপেক্ষ থাকার নীতি নেয়। এই নীতি পর্তুগালকে বাঁচাতে পারেনি। ১৭৯৯ সালে ন্যাপোলিয়ন ফ্রান্সে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নিলে পর্তুগালের উপর কালো ছায়া নেমে আসে। ন্যাপোলিয়ন স্পেনকে বাধ্য করেন পর্তুগালকে আল্টিমেটাম দিতে, যাতে পর্তুগালের ব্রিটেনের সংগ পরিত্যাগ করে। ১৮০১ সালে ফ্রান্সের সমর্থনে স্পেন পর্তুগাল আক্রমন করে আলোচনার টেবিলে বসাতে বাধ্য করে।

জন সকল দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তার স্ত্রী কারলোটা জোয়াকিনা ছিলেন স্প্যানিস রাজবংশের। তিনি চাইছিলেন তার স্বামী জনকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে সিংহাসন নিয়ে নিতে। ফ্রান্স এবং স্পেনের চাপের মুখে জন ব্রিটেনের সাথে গোপনে চুক্তি করেন। চুক্তি মোতাবেক ফ্রান্স-স্পেন যদি পর্তুগালে হামলা করে বসে, তাহলে ব্রিটিশরা পর্তুগালের রাজপরিবারকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ব্রাজিলে চলে যেতে সহায়তা করবে। ১৮০৭ সালের অক্টোবরে খবর আসে যে ফরাসী সেনাবাহিনী পর্তুগালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১৬ই নভেম্বর ব্রিটিশ রয়াল নেভির একটা স্কোয়াড্রন সাত হাজার সৈন্য নিয়ে লিসবন বন্দরে এসে পৌঁছায়। ফরাসী জেনারেল জঁ-আন্দোশে জুনো ৩০শে নভেম্বর লিসবন পৌঁছে দেখেন যে পর্তুগীজ রাজপরিবার তল্পিতল্পাসহ জাহাজে উঠে পালিয়েছে। পর্তুগীজ জনগণ এটা মেনে নিতে পারেনি যে তাদের নেতা এভাবে তাদের ছেড়ে যাবেন। ১৫টা জাহাজে বেশ কয়েক হাজার মানুষ গাদাগাদি করে উঠে রওয়ানা দেয়। এই সংখ্যা কত ছিল সেটা কেউ সঠিক বলতে না পারলেও সেটা ১৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে।

ষষ্ঠ জন-এর কোর্ট, রিও ডি জানেইরো, ব্রাজিল। জন তল্পিতল্পা সহ ব্রাজিলে পালিয়ে যাবার পর রাষ্ট্র পরিচালনার সকলকিছু ব্রাজিলের মাটিতে তৈরি করতে হয়েছিল। ১৩ বছর রিও থেকে শাসন করার পরে জন পর্তুগালে চলে গেলেও নতুন রাষ্ট্র ব্রাজিলের ভিত ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে।
  

ব্রাজিল – নতুন রাষ্ট্র তৈরির ভিত যেভাবে হলো

ব্রাজিল তখন ছিল পর্তুগীজ উপনিবেশ। এর মূল শহর রিও ডি-জানেইরো, যার জনসংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের মতো। সেখানে রাজপরিবারসহ পুরো সরকারের সংকুলান হবার কোন অবস্থাই ছিল না। রাতারাতি শহরের বিরাট সংখ্যক বাড়িঘর দখল নিয়ে নেয়া হয়। রাজপরিবার এবং সম্ভ্রান্ত লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয় কোনরকমে। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে রিও-তে। বহু অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার, ক্যান্টনমেন্ট ছাড়াও মিলিটারি একাডেমি, অপেরা হাউজ, মেডিক্যাল স্কুল, অস্ত্র কারখানা, প্রিন্টিং প্রেস, ইত্যাদি গড়ে উঠে। হঠাত উচ্চবংশীয় মানুষের ঢল আসায় দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে হু-হু করে। তবে সবচাইতে বড় যে ব্যাপারটি হয় তা হলো, রিও যেখানে ছিল একটা ঔপনিবেশিক শহর, সেটা মুহুর্তের মাঝে হয়ে যায় একটা রাষ্ট্রের রাজধানী শহর। রিও-তে রাজধানী স্থানান্তর হওয়ায় সেখানে প্রায় সোয়া তিন লাখেরও বেশি ক্রীতদাসের আগমণ ঘটে। জন রিও-তে নেমেই ব্রাজিলের বন্দরগুলিকে ‘ওপেন’ ঘোষণা দেন, যার মাধ্যমে ব্রাজিলে ব্রিটিশ জাহাজের অবতরণ সহজ হয়ে যায়। রিও-তে জন-এর অবতরণের কারণেই ব্রাজিল পর্তুগাল থেকে আলাদা হবার জন্যে প্রস্তুত হয়। নতুন দেশের নামকরণ করা হয় ‘ইউনাইটেড কিংডম অব পর্তুগাল, ব্রাজিল এবং এলগার্ভেস’। বলাই বাহুল্য যে দেশের নামকরণ ব্রিটিশদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।


  
১৮০৭ সালে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে রাজপরিবারকে রক্ষা করতে রাজা ষষ্ঠ জন তল্পিতল্পাসহ পর্তুগাল থেকে পালিয়ে যান। তাদের সহাহতা দেয় ব্রিটিশ রয়াল নেভি। ব্রাজিলের মাটিতে নেমেই জন ব্রিটেনকে বাণিজ্যিক এবং সামরিক সুবিধা দিতে থাকেন। একারণেই দক্ষিণ আমেরিকার স্প্যানিস উপনিবেশ ব্রিটিশরা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করলেও ব্রাজিলকে ভাঙ্গেনি। তবে ব্রাজিলকে পর্তুগাল থেকে আলাদা করে দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে বড় রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করেছে।  


ব্রিটিশরা যেভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলো

একই সময়ে ব্রিটিশরা তখন আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকায় বাকি স্প্যানিস উপনিবেশগুলিকে স্পেন থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল। জন-এর স্প্যানিস স্ত্রী কারলোটা এবার আর্জেন্টিনায় স্প্যানিস উপনিবেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন এবং জনকে বাধ্য করেন উরুগুয়েতে যুদ্ধে (১৮১৭-১৮২১) অংশ নিতে। ব্রিটিশরা এসময়ে ব্রাজিলের সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে গায়ানার উপকূলের কিছু এলাকা দখল করে নেয় এবং ব্রাজিলের সাথে অযাচিত পদ্ধতিতে একচেটিয়া বাণিজ্য করে।

১৮১৫ সালে ন্যাপোলিয়নের পতন এবং ১৮১৬ সালে পর্তুগীজ রানী মারিয়ার মৃত্যুর পরে পর্তুগীজ রাষ্ট্রীয় লোকজন জনকে পর্তুগালে ফেরত আসার জন্যে চাপ দেয়। ১৮২১ সালের জুলাই মাসে জন ব্রাজিল থেকে লিসবনে এসে পৌঁছান। তিনি প্রায় ১৩ বছর ব্রাজিলে কাটান। তিনি এখন পর্তুগালের রাজা। ব্রাজিল ত্যাগের আগেই পর্তুগাল এবং ব্রাজিলে লিবারাল গোষ্ঠী ব্যাপক ক্ষমতা অর্জন করে এবং রাজার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কর্তন করে। সেসময় পর্তুগালের শাসনভার ন্যাস্ত ছিল ব্রিটিশ সামরিক অফিসার মার্শাল উইলিয়াম কার বেরেসফোর্ড। জন পর্তুগালে ফেরত যাবার পর প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের ছায়াতলেই তাকে থাকতে হয়েছে।

ব্রাজিলের রাজা পেদ্রোর অভিষেক অনুষ্ঠান, ১৮২২ সাল। পর্তুগালের সংবিধানের উপরে শপথ নিতে পেদ্রোকে বাধ্য করা হয়। পর্তুগালের সাথে ব্রাজিলের সম্পর্কও কর্তন হয়ে যায়নি অত সহজে। পেদ্রোর কন্যা পরবর্তীতে পর্তুগালের রানীও হন। তাদের সূত্রেই ১৯১০ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের শেষ রাজার শাসন চলেছিল।
 

ব্রাজিল – নতুন দেশ, নতুন রাজা, নতুন পতাকা

জন তার ছেলে পেদ্রোকে রিও-তে রেখে আসেন এবং বলে আসেন যে, পেদ্রো যেন ব্রাজিলের রাজা হয়ে যান; নাহলে অন্য কেউ পেদ্রোর স্থান নিয়ে নেবে। ব্রাজিলের জনগণ এতদিন রাষ্ট্রের মূলে থাকার সুবিধা পেয়েছে। এখন তারা রাজার পর্তুগালে চলে যাওয়াটা ভালোভাবে দেখেনি। ব্রাজিলে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা মূলত সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। তারা পেদ্রোকে রাজা হিসেবে রেখে ১৮২২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পর্তুগালের সংবিধানের উপরে শপথ নিতে পেদ্রোকে বাধ্য করা হয়।

ব্রাজিলের জন্যে নতুন পতাকা নির্ধারিত হয়। পতাকার সবুজ জমিন এসেছে রাজা পেদ্রোর ব্রাগাঞ্জা বংশ (হাউজ অব ব্রাগাঞ্জা) থেকে আর হলুদ রঙ এসেছে পেদ্রোর স্ত্রী অস্ট্রিয়ার প্রিন্সেস মারিয়া লিওপোলডিনা-এর হ্যাপসবার্গ বংশ থেকে। ১৮৮৯ সালে ব্রাজিলিয়ান রিপাবলিক ঘোষণার আগ পর্যন্ত ব্রাজিলের এই পতাকাই থাকে। তবে ১৮৭০ সালে পতাকার মাঝের ১৯টি তারা থেকে ২০টি তারা করা হয় ব্রাজিলের রাজ্যের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে। ব্রাজিল রিপাবলিকের পতাকায় ২১টি তারা স্থান পায়, যা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একই থাকে। তবে ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে কয়েকদিনের জন্যে আরেকটা পতাকার ডিজাইন আনা হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার আদলে তৈরি করা হয়েছিল। ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব ব্রাজিল’এর সেই পতাকা প্রতিযোগিতায় টেকেনি; বরং সেই পুরোনো ব্রাজিল রাজের পতাকাকেই পরিবর্তন করে নিয়ে নতুন পতাকা আঁকা হয়। ব্রাজিলের জনগণের মূল এখনও সেই পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়া-সহ ইউরোপের বাকি দেশগুলি। ঊনিশ এবং বিংশ শতকে ইউরোপ থেকে বহু মানুষ ব্রাজিলে এসে বসবাস শুরু করেছে। তাদের আকর্ষণ করেছে ব্রাজিলের ইউরোপিয়ান ভিত। তাদের কাছে ব্রাজিল হয়ে ওঠে বিষুবীয় অঞ্চলের ইউরোপ। ব্রাজিলের পতাকায় কেউ কেউ মানচিত্র বসাতে চেয়েছিল। সেটা সফল না হলেও পতাকায় ‘সাউদার্ন ক্রস’ তারকামন্ডলী এঁকে দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্রাজিলের উপস্থিতি শুধুমাত্র দক্ষিণ গোলার্ধেই থাকবে।

ব্রাজিল রিপাবলিকের পতাকা (১৮৮৯-১৯৬০ সাল)। এই পতাকায় তারার সংখ্যা ছিল ২১টি। পরবর্তীতে আরও দুইবার পতাকাতে পরিবর্তন আনা হয় ২২তম এবং ২৩তম প্রদেশের কারণে। তবে সবুজ এবং হলুদ বহাল রাখা হয়, যা ব্রাজিল রাজের রাজবংশের প্রতিনিধিত্ব করে। 
 

ব্রিটেন যেভাবে ব্রাজিল তৈরি করেছে

পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়া উভয়েই বেশিরভাগ সময়ে ব্রিটেনের সাথে থেকেছে। তারা হয় ফ্রান্স বা রাশিয়া বা জার্মান আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্রিটেনের সাথে থেকেছে। ব্রিটেন ইউরোপে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সকে নিয়ন্ত্রণ করতে পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়াকে ব্যবহার করেছে। পরবর্তীতে জার্মানিকে নিয়ন্ত্রণ করতেও একই কাজ করেছে। ব্রাজিলের পর্তুগাল থেকে আলাদা হওয়াটা ব্রিটেনকেই সুবিধা দিয়েছে সবচাইতে বেশি। ন্যাপোলিয়ন ব্রিটেনের সাথে সারা বিশ্বে যুদ্ধে জড়িয়েছেন ঠিকই; তবে ব্রিটেনই এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছিল। ন্যাপোলিয়নের উত্থান ছিল এক ব্যক্তির উত্থান। স্পেনের সাথে যুদ্ধের সুবাদে পুরো ল্যাটিন আমেরিকার বাণিজ্যই ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। পর্তুগালের রাজাকে রিও-তে বসিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করা, আর্জেন্টিনায় ব্রিটিশ সৈন্য নামিয়ে পুরো স্প্যানিস দক্ষিণ আমেরিকায় বিদ্রোহ উস্কে দেয়া, অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ প্রিন্সেসের সাথে ব্রাজিলের হবু রাজা পেদ্রোর বিয়ের ব্যবস্থা করে ব্রিটেনের বন্ধু অস্ট্রিয়ার জনগণকে দক্ষিণ আমেরিকায় আসতে আগ্রহী করে তোলা – এগুলি সকলই ছিল সুপারপাওয়ার হিসেবে ব্রিটেনের কর্মকান্ড। ব্রাজিলে পর্তুগালের রাজা, স্পেনে জন্ম নেয়া পর্তুগালের রানী এবং অস্ট্রিয়ার প্রিন্সেসের আগমনের ফলে ব্রাজিলের জনসংখ্যা বাকি ল্যাটিন আমেরিকার চাইতে অনেক বেড়ে যায়। আরও এসেছে ইতালি এবং জার্মানি থেকে। ১৮৮০ থেকে ১৯৬৯-এর মাঝে মোটামুটি ৯০ বছরে পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি এবং জার্মানি থেকে ৪১ লাখেরও বেশি লোক ব্রাজিলে এসেছে। এছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকে এসেছিল সাড়ে ১০ লাখ মানুষ। ব্রাজিল হয়ে ওঠে ল্যাটিন আমেরিকার সবচাইতে জনবহুল দেশ। ব্রাজিল কোনভাবে ভেঙ্গে ছোটও হয়নি। অন্যদিকে স্প্যানিসদের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলি অনেকগুলি দেশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় সেগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আবার পর্তুগালের সাথে ব্রাজিলের সম্পর্কও কর্তন হয়ে যায়নি অত সহজে। পেদ্রোর কন্যা পরবর্তীতে পর্তুগালের রানীও হন। তাদের সূত্রেই ১৯১০ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের শেষ রাজার শাসন চলেছিল।


১৮৮৯ সালের নভেম্বরে কয়েক দিনের জন্যে 'ইউনাইটেড স্টেটস অব ব্রাজিল'এর পতাকা। বলাই বাহুল্য যে এই পতাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার আদলে তৈরি করা। এই পতাকা ব্রাজিলকে নিয়ে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ।


ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটিশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব

ল্যাটিন আমেরিকায় এই কর্মকান্ডের মাঝে ব্রিটেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে ব্রিটেনের কাছ থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কলম্বিয়া, পেরু, বলিভিয়া এবং ব্রাজিলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হতে থাকে, যা তাকে ব্রিটেনের সামনে দাঁড় করায়। পানামকে যুক্তরাষ্ট্র নিজ হাতে তৈরি করেছে পানাম খাল তৈরি করার নিমিত্তে। এই খালের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলের মাঝে সামুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। অন্যদিকে ব্রিটেন ক্যারিবিয়ান সাগরে কিছু দ্বীপ দখলে রেখে এই অঞ্চলের সমুদ্র বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চেয়েছে। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের হাতে রেখে ম্যাজেলান প্রণালীর সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। চিলিকে নিজেদের অধীনে রেখে পুরো ল্যাটিন আমেরিকার উপরেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।



ব্রাজিলের জন্ম ব্রিটেনের নীতির মাঝ দিয়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার বেশিরভাগ শক্তি হারিয়েছে বটে, তবে একেবারে মৃত হয়ে যায়নি। এখনও ব্রিটিশরা প্রভাবের জন্যে মার্কিনীদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ল্যাটিন আমেরিকার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ-মার্কিনীরা। ব্রাজিল আকারে বড় হলেও সুপারপাওয়ারের রাজনীতির শিকার। কারণ সুপারপাওয়ারের হাতেই তার জন্ম হয়েছিল প্রায় দু'শ বছর আগে। কিন্তু দু'শ বছর পরেও ব্রাজিল সুপারপাওয়ারের দিকেই চেয়ে থাকে। বিশ্বরাজনীতিতে ব্রাজিলের পদচারণা সুপারপাওয়ারের ইচ্ছার ব্যাতিরেকে নয়। 


আরও পড়ুনঃ
ভেনিজুয়েলা-কলম্বিয়া-ইকুয়েডরের পতাকা একইরকম কেন?
আর্জেন্টিনা কি পারবে?

5 comments:

  1. সবই সুপারপাওয়ার ব্রিটেন এর কুটনীতিক চিন্তা ভাবনার ফসল। সত্যিই এতো ছোট দেশ প্রায় গোটা পৃথিবী নিয়ন্ত্রন করেছে একসময়। এখনও কিছুটা করছে তার ভগ্ন শক্তি নিয়ে । তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আমেরিকা পিছিয়ে আসছে আর ম্যেঁক্র এর ফ্রান্স এগিয়ে যেতে চাইছে , তার পুরনো উপনিবেশিতার মানসিকতা নিয়ে। বিশ্বে এক অদ্ভুত জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চিন বিশ্বে তার প্রভাব এখনো তেমন ভাবে বিস্তার করতে পারেনি আর রাশিয়ার তো ভগ্ন দশা। এখন নতুন আইডিওলজির স্টেট দরকার , পচা-ষড়া ক্যাপিটালিজম থেকে মুক্তি দিতে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার এবং কমেন্ট করার জন্যে।
      চমৎকার কমেন্টের জন্যে আলাদাভাবে প্রশংসা পাচ্ছেন।

      আশা করি আদর্শিক যুদ্ধ নিয়ে লেখাটা পড়েছেন।
      http://koushol.blogspot.com/2016/03/ideological-war-our-readiness.html

      Delete
    2. আমি আপনার লেখনীর একনিষ্ঠ পাঠক। আপনার বিশ্লেষণগুলি এক কথায় অসাধারণ। এই লেখাগুলি বিশ্বশাসন ব্যবস্থা সহ অনেক বিষয়ে, পরিষ্কার ছবি তুলে ধরে। যদি নিম্নোক্ত বিষয় গুলিতে আলোকপাত করেন, তবে ভালো হয়-
      ১) Conspiracy Theory এর ব্যাপারে, বিশ্বে যা কিছু ঘটছে সে সবের বেশির ভাগটাই কি কিছু সংখ্যক সংস্থা বা লোক নিয়ন্ত্রণ করে?

      ২) Israel এর ব্যাপারে, এত ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও,কিভাবে বড় শক্তি বা দেশ গুলিকে নিয়ন্ত্রন করে?
      ৩) আদর্শিক বিশ্বে ইসলামিক রাষ্ট্র বা খিলাফাত এর আর্বিভাবের সম্ভাবনা কতটুকু?

      Delete
    3. Conspiracy Theory মানুষকে সমস্যার কথা বলে, কিন্তু কোন সমাধান দেয় না। মানুষকে ব্যস্ত রেখে সমাধান থেকে দূরে রাখার জন্যেই এই থিউরি তৈরি করা। যারা দুনিয়ার নিয়ন্তা, তারা এই থিউরি পছন্দ করেন; কারণ তাতে মানুষ সমাধান না পেয়ে চুপচাপ থাকে।

      ইস্রাইলের পুরো শক্তিই আসে পশ্চিমা দুনিয়া, মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইস্রাইলের নিরাপত্তা হলো ইস্রাইলের নিজস্ব শক্তিতে নয়, বরং আশেপাশের মুসলিম অঞ্চলগুলিকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আলাদা করে রেখে কিছু পশ্চিমা-অনুগত শাসকের অধীনে রাখার মাঝে।

      আর ইসলামের শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা হবার কথা আমার বলার কিছু নেই; রাসূল (সাঃ) নিজেই বলে গেছেন; কাজেই এটা হবেই।
      “তোমাদের মধ্যে নবুওয়ত থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তারপর আল্লাহ তার সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে নবুওয়তের আদলে খিলাফত। তা তোমাদের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, অতঃপর তিনি তারও সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর আসবে যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন, তা থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করবেন। এক সময় আল্লাহর ইচ্ছায় এ্ররও অবসান ঘটবে। তারপর প্রতষ্ঠিত হবে জুলুমের শাসন এবং তা তোমাদের ওপর থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করবেন। তারপর তিনি তা অপসারণ করবেন। তারপর আবার ফিরে আসবে নবুওয়তের আদলে খিলাফত।” (আহমদ)

      Delete
  2. অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete