১৮ই অগাস্ট ২০১৮
লাক্সারি লাইনারে সৈন্য পরিবহণ
১৯৮২ সালের ২রা এপ্রিল আর্জেন্টিনা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার প্রায় সাথে সাথেই ফকল্যান্ডস পুনর্দখল করতে পরিকল্পনা শুরু করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ই এপ্রিল এবং ২৭শে এপ্রিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী ফকল্যান্ড যুদ্ধের জন্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে পাঠানোর অনুরোধ করে। ব্রিটিশ সরকার এই ব্রিগেডকে পাঠাবার অনুমতি দেয় ২রা মে। এই ইউনিটকে সেখানে পাঠাবার সবচাইতে ভালো পদ্ধতি হিসেবে নতুন কোন পরিবহণ জাহাজ রিকুইজিশন করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ৩রা মে ব্রিটিশ সরকার শিপিং কোম্পানি কুনার্ড লাইন-এর মালিকানায় থাকা লাইনার জাহাজ ‘এসএস কুইন এলিজাবেথ ২’-কে রিকুইজিশন করে। মাত্র ১৯ ঘন্টা পরেই জাহাজটার ভূমধ্যসাগর ভ্রমণে যাবার কথা ছিল। ২৯৩ মিটার লম্বা ৬৭ হাজার টনের বিশাল এই জাহাজটা ছিল সমুদ্রের বিলাসবহুল মার্সিডিস গাড়ির মতো! ম্যান কোম্পানির তৈরি ১০,৬২৫ কিলোওয়াটের ৯টা ইঞ্জিন জাহাজটাকে সর্বোচ্চ ৩৪ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলার সক্ষমতা দেয়। তবে এর স্বাভাবিক গতি ছিল ২৮ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল, যা বেশিরভাগ যুদ্ধজাহাজের চাইতে বেশি বা কমপক্ষে সমতুল্য। ৫ই মে জাহাজটাকে ভসপার থর্নিক্রফট শিপইয়ার্ডে পাঠানো হয় কিছু মডিফিকেশনের জন্যে। জাহাজের উপরে পেছনের সুইমিং পুল এবং সামনের ডেকের উপরে দুইটা হেলিডেক তৈরি করা হয়। জাহাজের মাঝ দিয়ে জ্বালানি পরিবহণের জন্য লম্বা পাইপলাইন বসানো হয়। পাইপলাইনের মাধ্যমে অন্য জাহাজ থেকে তেল নিয়ে ইঞ্জিনরুম পর্যন্ত নেবার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজের পাবলিক লাউঞ্জগুলিকে সেনাদের থাকার ডরমিটরিতে রূপান্তর করা হয়। জাহাজের পুরো দৈর্ঘ্যের প্রায় চার ভাগের এক ভাগকে স্টিল প্লেটিং-এর মাধ্যমে শক্তিশালী করা হয়। এন্টি-ম্যাগনেটিক কয়েল স্থাপনের মাধ্যমে ম্যাগনেটিক মাইন থেকে জাহাজকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজের সাথে জাহাজের ৬৫০ জন ক্রু ফকল্যান্ডে যাবার জন্যে স্বেচ্ছায় নাম লেখায়। মাত্র এক সপ্তাহের মডিফিকেশনের কাজ করার পর ১২ই মে ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ৩,২০০ সৈন্যকে নিয়ে এই জাহাজ রওয়ানা হয়। যখন জাহাজ রওয়ানা হয়, তখন জাহাজের তিনটা বয়লারের মাঝে মাত্র একটা কাজ করছিল। বাকি দুইটাকে যাত্রাপথে মেরামত করে নেয়া হয়। যাত্রাপথে জাহাজটার রাডার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং জাহাজের কোন বাতি যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়, তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে কেউ জাহাজটাকে খুঁজে না পায়। মডার্ন কোন ন্যাভিগেশন এইড ছাড়াই জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকে পৌঁছায়।
সামরিক কাজে বেসামরিক জাহাজ
যে নিয়মের মাধ্যমে এই বেসামরিক জাহাজগুলি ব্রিটিশ সরকার রিকুইজিশন বা চার্টার করেছিল, তা পরিচিত ছিল ‘শিপ টেকেন আপ ফ্রম ট্রেড’ বা স্টাফট নামে, যা ১৯৮২ সালের ৪ঠা মে (ফকল্যান্ড দখলের দুই দিন পর) ইস্যু করা হয়। ‘স্টাফট’এর বদৌলতে ব্রিটিশ সরকার যেকোন জাহাজ রিকুইজিশন করতে পারবে। এর আগে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা বেসরকারি জাহাজ কাজে লাগিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার নিয়ম করেছিল যে, শুধুমাত্র ব্রিটিশ ফ্ল্যাগের জাহাজই রিকুইজিশন করা হবে এবং ব্রিটিশ ক্রুরাই এসব জাহাজ চালাবে। ‘কুনার্ড কাউন্টেস’-কে রিকুইজিশন করা হয়েছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের পরে – ১৯৮২ সালের অক্টোবরে – ৬ মাসের জন্যে। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসেনশন দ্বীপ পর্যন্ত সৈন্যদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয় এই জাহাজে। কারণ ফকল্যন্ডের পোর্ট স্ট্যানলি বিমান বন্দরকে তখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কয়েক মাসের ব্যবধানে ব্রিটিশ সরকার ৩৩ জন মালিকের কাছ থেকে ৫৪টা জাহাজ রিকুইজিশন করেছিল। এই জাহাজগুলিকে এমন হতে হয়েছিল, যাতে করে তারা বহুদূরের সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে পারে এবং খারাপ আবহাওয়ায় সমস্যা না হয়। দক্ষিণ আটলান্টিকের খারাপ আবহাওয়ার আবার বেশ খ্যাতি রয়েছে। এই ৫৪টা জাহাজে ১ লক্ষ টন মালামাল, ৪ লক্ষ ১০ হাজার টন জ্বালানি তেল, ৯ হাজার সৈন্য এবং ৯৫টা বিমান বহন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজগুলিতে যা বহণ করা সম্ভব ছিল, তা ফকল্যন্ড মিশনের জন্যে যথেষ্ট ছিল না। লম্বা মিশনে খারাপ আবহাওয়ায় সৈন্য এবং রসদ পরিবহণের জন্যে যাত্রীবাহী ওশান লাইনার জাহাজগুলিকেই বেশি উপযুক্ত মনে হয়েছিল ব্রিটিশদের। ‘কুইন এলজাবেথ-২’ জাহাজটা যতক্ষণে দক্ষিন আটলান্টিকে পৌঁছেছিল, ততদিনে যুদ্ধ বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ সেনারা ইতোমধ্যেই ফকল্যান্ডে নেমেছে। ‘কুইন এলিজাবেথ-২’ ফকল্যান্ডের উপকূলে সৈন্য নামায়নি; নামিয়েছিল ফকল্যান্ডের কাছাকাছি সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে, যা কিনা সেবছরের ২৫শে এপ্রিল ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছিল। সেখান থেকে অন্য জাহাজে করে ফকল্যান্ডে নামানো হয় সৈন্যদের। ‘কুইন এলিজাবেথ’এর মতো আরও কিছু জাহাজ রিকুইজিশন করা হয়েছিল।
জাহাজ থেকে জাহাজে সৈন্য ট্রান্সফার
ভূমধ্যসাগর থেকে ফেরা যাত্রীবাহী জাহাজ এসএস ক্যানবেরা (৪৫ হাজার টন) ৬ই এপ্রিল ব্রিটেনে এসে পৌঁছায়। এই জাহাজের ৪০০ ক্রু ছিল এশিয়ান, যাদেরকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন একজন রয়াল নেভাল রিজার্ভের অফিসার। জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার ওঠা-নামার জন্যে হেলিডেক বসানো হয়। ৯ই এপ্রিল ৪০তম ও ৪২তম কমান্ডো, রয়াল মেরিন এবং ৩য় প্যারা ব্যাটালিয়নকে নিয়ে জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সেখানে ব্রিটিশ অধীনে থাকা এসেনশন দ্বীপে দুই সপ্তাহ মহড়া দেয়া হয় এবং ফকল্যান্ডে সৈন্য নামাবার জন্যে জাহাজটাকে রেডি করা হয়। ২১শে মে ফকল্যান্ডের উপকূলে গিয়ে ২ হাজার সৈন্যকে নামিয়ে দেয় জাহাজটা। এরপর জাহাজটা আড়াই হাজার মাইল দূরের সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে গিয়ে ‘কুইন এলিজাবেথ-২’ জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া সৈন্যদের তুলে নেয়। ক্যানবেরার সাথে ‘নরল্যান্ড’ এবং ‘আরএফএ স্ট্রমনেস’ বাকি সেনাদের পরিবহণ করে। এই সেনাদেরকে ক্যানবেরা এবং বাকি জাহাজগুলি আবারও ফকল্যান্ডে নামিয়ে দেয় ২রা জুন। ল্যান্ডিং ক্রাফট, জাহাজের নিজস্ব বোট এবং ১০০টা হেলিকপ্টার লিফটের মাধ্যমে এই সেনাদের সেখানে নামানো হয়। সৈন্য নামাবার সময় ক্যানবেরার আশেপাশের রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজগুলিকে আর্জেন্টাইন যুদ্ধবিমানগুলি হামলা করেছে, কিন্তু ক্যানবেরায় বোমা পড়েনি একটাও। আর্জেন্টাইনরা ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার-ফ্রিগেটগুলিকে হামলা করতেই বেশি আগ্রহী ছিল; সাপ্লাই বা ট্রুপ-ক্যারিয়ারগুলিকে নয়। ব্রিটিশরা নিশ্চিত ছিল যে, ক্যানবেরায় বোমা পড়লেও সাড়ে ৩৫ ফুট ড্রাফটের এই জাহাজ ফকল্যান্ডের উপকূলের অগভীর পানিতে ডুববে না। যুদ্ধের শেষে ১৫ই জুন ৪,০০০-এরও বেশি আর্জেন্টাইন যুদ্ধবন্দীদের পরিবহণ করে জাহাজটা। এই কাজ শেষে রয়াল মেরিন সেনাদের ১১ই জুন আবারও দেশে ফেরত নিয়ে আসে।
সৈন্যের সাথে অস্ত্র এবং রসদ
৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ৩,৯৬১ জনের সেনাদলের ৩৫ দিনের অপারেশনের জন্যে দরকার ছিল ১,০৮৪ টন গোলাবারুদ, ১,১৪৭ টন রসদপাতি, ২০১৫টা গাড়ি এবং ১৯টা হেলিকপ্টার। এত্তসব জিনিস নেবার জন্যে তো আরও জাহাজ দরকার। ২৬ হাজার টনের ‘এমভি নরল্যান্ড’ রিকুইজিশন করা হয় ১৭ই এপ্রিল। এটা ছিল একটা রো-রো ফেরি। এতে দ্বিতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন এবং নেভাল এভিয়েশনের ৮০০ জন সেনাকে পরিবহণ করা হয়। জাহাজের ডিজাইন অবশ্য ব্রিটিশদের জন্যে সুবিধার ছিল না। ব্রিটিশরা তাদের লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ-গুলির সাথে মেক্সিফ্লোট নামের পন্টুনের মতো কিছু ল্যান্ডিং ক্রাফট বহন করেছিল। এগুলির উপর ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ভেহিকল এবং অন্যান্য গাড়ি তুলে দিয়ে উপকূলে নামানো হতো। নরল্যান্ড একটা রো-রো ফেরি হলেও এই জাহাজের ভেহিকল র্যাম্প মেক্সিফ্লোটগুলির উচ্চতা পর্যন্ত নামতোই না। অর্থাৎ এই জাহাজে গাড়ি বহন করলে মেক্সিফ্লোটে সেই গাড়ি নামাবার কোন উপায় নেই। কিন্তু ব্রিটিশদের উপায় ছিল না, কারণ সুবিধামত জাহাজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতি চারটা জাহাজ ইন্সপেকশনের পর একটা মাত্র জাহাজ রিকুইজিশনের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল।
বাণিজ্যিক জাহাজে যুদ্ধবিমান পরিবহণ
‘পিএন্ডও লাইন’এর সাড়ে ৫ হাজার টনের ‘এমএস এল্ক’ রো-রো ফেরি বহন করেছিল ১০০টা গাড়ি, ২ হাজার টন এমুনিশন এবং আরও কয়েক’শ টন রসদপাতি। ৮টা লাইট ট্যাঙ্কও নেয়া হয় এতে। হেলিপ্যাড বসানো হয় যাতে ৩টা সী-কিং হেলিকপ্টার বহন করা যায়। ৪,২০০ টনের ‘এমএস ইউরোপিক ফেরি’ রিকুইজিশন করা হয় ১৯শে এপ্রিল। এতে হেলিপ্যাড যুক্ত করা হয় সেনাবাহিনীর ৪টা হেলিকপ্টার বহন করার জন্যে; সৈন্য, গাড়ি এবং রসদও নেয়া হয় এতে। ১৯,০০০ টনের রো-রো ফেরি ‘এমএস বল্টিক ফেরি’ ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ১০৫ জন সৈন্যের সাথে ১,৮৭৪ টন রসদপাতি নিয়েছিল। এছাড়াও জাহাজটার উপর হেলিপ্যাড বসানো হয় এবং সেনাবাহিনীর তিনটা হেলিকপ্টার বহন করা হয় এতে। এই জাহাজের সিস্টার শিপ ‘এমএস নরডিক ফেরি’কেও রিকুইজিশন করা হয়। ‘কুনার্ড’এর ১৫ হাজার টনের কনটেইনার জাহাজ ‘এসএস আটলান্টিক কনভেয়র’ এবং ‘এসএস আটলান্টিক কজওয়ে’-কে রিকুইজিশন করা হয় ১৪ই এপ্রিল। জাহাজদু’টিতে বেশকিছু পরিবর্তন করে বিমান পরিবহণের জন্যে উপযুক্ত ক্রয়া হয়েছিল। বিমান ছাড়াও অনেক জ্বালানি এবং গোলাবারুদ নেয় জাহাজদু’টি। ‘আটলান্টিক কনভেয়র’ বহণ করছিল নৌবাহিনীর ৬টা ওয়েসেক্স হেলিকপ্টার এবং রয়াল এয়ার ফোর্সের ৫টা চিনুক হেলিকপ্টার। এসেনশন দ্বীপে এসে জাহাজটা নৌবাহিনীর ৮টা এবং বিমান বাহিনীর ৬টা হ্যারিয়ার বিমান নেয়। ফকল্যান্ডের কাছাকাছি এসে হ্যারিয়ার বিমানগুলিকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর একটা চিনুক হেলিকপ্টার ইতোমধ্যেই এসেনশন দ্বীপে নেমে গিয়েছিল। ২৫শে মে আর্জেন্টাইন নৌবাহিনীর সুপার এটেনডার্ড বিমানের ছোঁড়া এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে জাহাজটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আগুনে ৬টা ওয়েসেক্স, ৩টা চিনুক এবং একটা লিঙ্কস (অন্য জাহাজ থেকে আসা) হেলিকপ্টার পুরো অঙ্গার হয়। অপরদিকে আটলান্টিক কনভেয়রের সিস্টার শিপ আটলান্টিক কজওয়ে ১৪ই মে রওয়ানা দিয়ে নৌবাহিনীর ৮টা সী-কিং এবং ২০টা ওয়েসেক্স হেলিকপ্টার বহন করে ২৭শে মে ফকল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছায়। যুদ্ধের মাঝে এই জাহাজের উপরে ৪,০০০ বার হেলিকপ্টার অবতরণ করে এবং ৫০০ বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও মিসাইল হামলার শিকার রয়াল ফ্লিট অক্সিলারির লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ ‘স্যার গালাহ্যাড’ এবং ‘স্যার ট্রিসট্রাম’-এর ১৭০ জন ক্রুকে এই জাহাজ আশ্রয় দেয়। সাড়ে ১১ হাজার টনের কন্টেইনার জাহাজ ‘এমভি কন্টেন্ডার বেজান্ট’ ৯টা ওয়াস্প, ৩টা চিনুক হেলিকপ্টার এবং ৪টা হ্যারিয়ার বিমান নিয়ে যখন ফকল্যান্ড পৌঁছায়, তখন যুদ্ধ শেষ। এই জাহাজটা রয়াল নেভি পরবর্তীতে রেখে দেয় ‘আরএফএ আরগাস’ নামে। ২৮ হাজার টনের কনটেইনার জাহাজ ‘এমভি এস্ট্রোনমার’-এ বেশকিছু পরিবর্তন করা হয় ১৩টা হেলিকপ্টার বহণ করার জন্যে। এই জাহাজটাও যুদ্ধ শেষে পৌঁছায়, এবং এটাকেও রয়াল নেভি সার্ভিসে নিয়ে নেয় ‘আরএফএ রিলায়ান্ট’ নামে। এই জাহাজটাই ১৯৮৪ সালে বৈরুত থেকে ৫,০০০ ব্রিটিশ নাগরিক এবং সৈন্যকে উদ্ধার করে।
সব জাহাজই কাজে লাগে
ব্রিটিশরা ৩টা যাত্রীবাহী লাইনার, ৮টা রো-রো ফেরি, ৫টা কনটেইনার জাহাজ, ৭টা কার্গো জাহাজ, ১৫টা ট্যাংকার এবং আরও ৮টা সাপোর্ট জাহাজ রিকুইজিশন ও চার্টার করেছিল। এই ৪৬টা বাণিজ্যিক জাহাজের মাঝে অনেকগুলিতেই হেলিপ্যাড বসানো হয়েছিল – সবগুলি যাত্রীবাহী লাইনার, রো-রো ফেরি, কনটেইনার জাহাজ; ৭টা কার্গো জাহাজের মাঝে ৩টা, এবং ৮টা সাপোর্ট শিপের মাঝে ৩টা। ১৫টা বাণিজ্যিক ট্যাঙ্কারের মাঝে ২টাকে সমুদ্রে রিফুয়েলিং-এর জন্যে যন্ত্র বসানো হয়েছিল। আবার অনান্য সকল জাহাজকেও মাঝ সমুদ্রে জ্বালানি গ্রহণ করতে পারার জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছিল। অনেক জাহাজে যাত্রাপথেও মডিফিকেশনের কাজ চলছিল। অন্যদিকে রয়াল নেভির অধীনে মোট ৬৮টা জাহাজ ফকল্যান্ড মিশনে গিয়েছিল - ২টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ২টা ডক ল্যান্ডিং শিপ, ৮টা ডেস্ট্রয়ার, ১৫টা ফ্রিগেট, ৩টা প্যাট্রোল ভেসেল, ৬টা সাবমেরিন, ৩টা সার্ভে জাহাজ (ব্যবহৃত হয়েছিল হসপিটাল জাহাজ হিসেবে), ৫টা ফিশিং ট্রলার (ব্যবহৃত হয়েছিল মাইনসুইপার হিসেবে), ১০টা রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার, ৬টা লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ, ৫টা সাপ্লাই শিপ, ১টা হেলিকপ্টার সাপোর্ট শিপ, ২টা ওশান টাগবোট। ২টা ডেস্ট্রয়ার, ২টা ফ্রিগেট, ১টা লজিস্টিক ল্যান্ডিং জাহাজ, ১টা কনটেইনার জাহাজ, ১টা ইউটিলিটি ল্যান্ডিং ক্রাফট, ২৪টা হেলিকপ্টার ও ১০টা ফাইটার বিমান হারায় ব্রিটিশরা। প্রতিটা জাহাজই সেখানে কাজে লেগেছিল। ডুবে যাওয়া বা আঘাতপ্রাপ্ত জাহাজকে আশেপাশের জাহাজগুলি সহায়তা দিয়েছে; আগুন নিভাতে সহায়তা দিয়েছে; তাদের ক্রুদের পানি থেকে তুলে নিয়েছে। এছাড়াও জাহাজগুলি হেলিকপ্টারগুলিকে রিফুয়েলিং করেছে; ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ ও বিমানগুলিকে রিপেয়ার করতে সহায়তা দিয়েছে; খাবার-দাবার ও রসদ সরবরাহ করেছে; মেডিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছে; সৈন্যদের রেস্টহাউজ হিসেবে কাজ করেছে; কুরিয়ার বা ডেসপ্যাচ ভেসেল হিসেবেও কাজ করেছে।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ থেকে এই আলোচনা সাপেক্ষে কিছু শিক্ষনীয় রয়েছে।
- ব্রিটিশ নৌবহরের দুর্বলতা - বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তিশালী নৌবহর ব্রিটেন ততদিনে হারিয়েছে। ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজগুলিতে যতো সৈন্য পরিবহণ করা সম্ভব ছিল, তা দিয়ে ফফল্যান্ডস-এর মতো ছোট দ্বীপও পূনর্দখল করা ছিল কঠিন। তাই বেসামরিক বাণিজ্যিক জাহাজের উপরেই নির্ভর করছে হয়েছিল ব্রিটেনকে।
- ব্রিটিশদের আদর্শিক চিন্তার দুর্বলতা - ব্রিটিশদের আদর্শিক চিন্তার দুর্বলতা আরও বহু আগে থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় সেটা আরও কঠিনভাবে সামনে আসলো। ব্রিটিশ এডমিরালটি সকল জাহাজের ডিজাইন নিয়ন্ত্রণ করতো। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেন শত-শত বাণিজ্যিক জাহাজকে রিকুইজিশন করে নৌবাহিনীতে নিয়েছিল। সেটা তারা পেরেছিল, কারণ প্রতিটা জাহাজের ডিজাইন করা হতো ভবিষ্যতের যেকোন সামরিক দরকারের কথা চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৮২ সালে ব্রিটেন বেসামরিক জাহাজ রিকুইজিশন করতে গিয়ে দেখলো যে, বেশিরভাগ জাহাজই সামরিক ব্যবহারের অনুপযোগী। যেগুলিকে সামরিক কাজের জন্যে নির্বাচিত করা হয়েছিল, সেগুলিরও ছিল ব্যাপক সমস্যা। ফকল্যান্ডে বাণিজ্যিক পরিবহণ জাহাজ থেকে সৈন্য নামাতে গিয়ে তাদের এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে হিমসিম খেতে হয়েছিল।
- যুদ্ধের সময়ে যেকোন জাহাজই কাজে লাগে। কিছু জাহাজ ফকল্যান্ডের আশেপাশে প্যাট্রোল এবং ইন্টেলিজেন্স যোগাড়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। ৪টা সার্ভে জাহাজকে মডিফাই করে হসপিটাল শিপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অয়েল প্ল্যাটফর্মের সাপোর্ট জাহাজগুলি অত্যন্ত ভালো ফ্লোটিং ওয়ার্কশপ বা রিপেয়ার শিপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। ৫টা বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলারকে রিকুইজিশন করে সোনার বসিয়ে নেয়া হয়েছিল মাইনসুইপিং-এর কাজে।
- বেসামরিক জাহাজ যে সহজেই সামরিক কাজে লাগানো সম্ভব, তা আবারও প্রমাণ হলো ফকল্যান্ডের যুদ্ধের সময়। যাত্রীবাহী লাইনারগুলিকে সহজেই ট্রুপ ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা গেছে। কনটেইনার জাহাজগুলিকে কিছুটা পরিবর্তন করে বিমান পরিবহণ করানো হয়েছে। এমনকি কোন ধরনের মডিফিকেশন ছাড়াও একটা জাহাজ সামরিক কাজে ব্যবহার হতে পারে। যেমন – ফকল্যান্ডের কাছাকাছি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলিকে জ্বালানি ও রসদ সরবরাহ করা; আক্রান্ত বা ডুবন্ত যুদ্ধজাহাজকে অগ্নি নির্বাপণে সহায়তা দেয়া ও সেসব জাহাজের ক্রুদের আশ্রয় দেয়া, ইত্যাদি।
- হেলিকপ্টার অপারেশনের গুরুত্ব - বিমান/হেলিকপ্টার নৌ-অপারেশনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হলো আবারও। বাণিজ্যিক প্রায় সকল জাহাজকেই মডিফাই করা হয়েছিল ফকল্যান্ডের জন্যে। প্রধান মডিফিকেশন ছিল হেলিপ্যাড বসানো। জাহাজে বহণ করা সৈন্য এবং রসদ জাহাজ থেকে ওঠা-নামানো জন্যে হেলিকপ্টার ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বাহন। আর ফকল্যান্ডের উপকূলে হেলিকপ্টার অপারেশনের সময় এই জাহাজগুলি ক্রমাগত হেলিকপ্টারগুলিকে জ্বালানি সরবরাহ করেছিল এবং দরকারে মেইনটেন্যান্স/রিপেয়ারের ব্যবস্থা করেছিল।
- অক্সিলারি বিমানবাহী জাহাজ - বাণিজ্যিক কনটেইনার জাহাজগুলিতে বহণ করা হ্যারিয়ার বিমানগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই জাহাজগুলি অক্সিলারি বিমানবাহী জাহাজের কাজ করেছিল। এই বিমানগুলি জাহাজের হেলিপ্যাড থেকে উড়ে গিয়ে বিমানবাহী জাহাজগুলিতে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধে হারানো হ্যারিয়ারগুলির প্রতিস্থাপক ছিল এগুলি। বিমানবাহী জাহাজ ‘হার্মিস’ সর্বোচ্চ বহন করেছিল রয়াল নেভির ১৬টা সী-হ্যারিয়ার, বিমান বাহিনীর ১০টা হ্যারিয়ার জিআর-৩, আর ১০টা সী-কিং হেলিকপ্টার। ‘ইনভিনসিবল’ বহন করেছিল ১২টা সী-হ্যারিয়ার এবং ১০টা সী-কিং হেলিকপ্টার। ডুবে যাওয়া কনটেইনার জাহাজ ‘আটলান্টিক কনভেয়র’ নিয়ে এসেছিল নৌবাহিনীর ৮টা, আর বিমান বাহিনীর ৬টা হ্যারিয়ার। ডুবে যাবার আগেই বিমানগুলি বিমানবাহী জাহাজে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। আর্জেন্টিনার ১২০-এর উপর ফাইটার বিমানের বিরুদ্ধে এগুলিই ছিল ব্রিটিশদের ভরসা। হ্যারিয়ারগুলি ২১টা আর্জেন্টাইন বিমান ভূপাতিত করেছিল।
আরও পড়ুনঃ
আর্জেন্টিনা কি পারবে?
লাক্সারি লাইনারে সৈন্য পরিবহণ
১৯৮২ সালের ২রা এপ্রিল আর্জেন্টিনা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার প্রায় সাথে সাথেই ফকল্যান্ডস পুনর্দখল করতে পরিকল্পনা শুরু করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ই এপ্রিল এবং ২৭শে এপ্রিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী ফকল্যান্ড যুদ্ধের জন্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে পাঠানোর অনুরোধ করে। ব্রিটিশ সরকার এই ব্রিগেডকে পাঠাবার অনুমতি দেয় ২রা মে। এই ইউনিটকে সেখানে পাঠাবার সবচাইতে ভালো পদ্ধতি হিসেবে নতুন কোন পরিবহণ জাহাজ রিকুইজিশন করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ৩রা মে ব্রিটিশ সরকার শিপিং কোম্পানি কুনার্ড লাইন-এর মালিকানায় থাকা লাইনার জাহাজ ‘এসএস কুইন এলিজাবেথ ২’-কে রিকুইজিশন করে। মাত্র ১৯ ঘন্টা পরেই জাহাজটার ভূমধ্যসাগর ভ্রমণে যাবার কথা ছিল। ২৯৩ মিটার লম্বা ৬৭ হাজার টনের বিশাল এই জাহাজটা ছিল সমুদ্রের বিলাসবহুল মার্সিডিস গাড়ির মতো! ম্যান কোম্পানির তৈরি ১০,৬২৫ কিলোওয়াটের ৯টা ইঞ্জিন জাহাজটাকে সর্বোচ্চ ৩৪ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলার সক্ষমতা দেয়। তবে এর স্বাভাবিক গতি ছিল ২৮ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল, যা বেশিরভাগ যুদ্ধজাহাজের চাইতে বেশি বা কমপক্ষে সমতুল্য। ৫ই মে জাহাজটাকে ভসপার থর্নিক্রফট শিপইয়ার্ডে পাঠানো হয় কিছু মডিফিকেশনের জন্যে। জাহাজের উপরে পেছনের সুইমিং পুল এবং সামনের ডেকের উপরে দুইটা হেলিডেক তৈরি করা হয়। জাহাজের মাঝ দিয়ে জ্বালানি পরিবহণের জন্য লম্বা পাইপলাইন বসানো হয়। পাইপলাইনের মাধ্যমে অন্য জাহাজ থেকে তেল নিয়ে ইঞ্জিনরুম পর্যন্ত নেবার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজের পাবলিক লাউঞ্জগুলিকে সেনাদের থাকার ডরমিটরিতে রূপান্তর করা হয়। জাহাজের পুরো দৈর্ঘ্যের প্রায় চার ভাগের এক ভাগকে স্টিল প্লেটিং-এর মাধ্যমে শক্তিশালী করা হয়। এন্টি-ম্যাগনেটিক কয়েল স্থাপনের মাধ্যমে ম্যাগনেটিক মাইন থেকে জাহাজকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজের সাথে জাহাজের ৬৫০ জন ক্রু ফকল্যান্ডে যাবার জন্যে স্বেচ্ছায় নাম লেখায়। মাত্র এক সপ্তাহের মডিফিকেশনের কাজ করার পর ১২ই মে ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ৩,২০০ সৈন্যকে নিয়ে এই জাহাজ রওয়ানা হয়। যখন জাহাজ রওয়ানা হয়, তখন জাহাজের তিনটা বয়লারের মাঝে মাত্র একটা কাজ করছিল। বাকি দুইটাকে যাত্রাপথে মেরামত করে নেয়া হয়। যাত্রাপথে জাহাজটার রাডার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং জাহাজের কোন বাতি যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়, তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে কেউ জাহাজটাকে খুঁজে না পায়। মডার্ন কোন ন্যাভিগেশন এইড ছাড়াই জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকে পৌঁছায়।
সামরিক কাজে বেসামরিক জাহাজ
যে নিয়মের মাধ্যমে এই বেসামরিক জাহাজগুলি ব্রিটিশ সরকার রিকুইজিশন বা চার্টার করেছিল, তা পরিচিত ছিল ‘শিপ টেকেন আপ ফ্রম ট্রেড’ বা স্টাফট নামে, যা ১৯৮২ সালের ৪ঠা মে (ফকল্যান্ড দখলের দুই দিন পর) ইস্যু করা হয়। ‘স্টাফট’এর বদৌলতে ব্রিটিশ সরকার যেকোন জাহাজ রিকুইজিশন করতে পারবে। এর আগে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা বেসরকারি জাহাজ কাজে লাগিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার নিয়ম করেছিল যে, শুধুমাত্র ব্রিটিশ ফ্ল্যাগের জাহাজই রিকুইজিশন করা হবে এবং ব্রিটিশ ক্রুরাই এসব জাহাজ চালাবে। ‘কুনার্ড কাউন্টেস’-কে রিকুইজিশন করা হয়েছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের পরে – ১৯৮২ সালের অক্টোবরে – ৬ মাসের জন্যে। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসেনশন দ্বীপ পর্যন্ত সৈন্যদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয় এই জাহাজে। কারণ ফকল্যন্ডের পোর্ট স্ট্যানলি বিমান বন্দরকে তখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কয়েক মাসের ব্যবধানে ব্রিটিশ সরকার ৩৩ জন মালিকের কাছ থেকে ৫৪টা জাহাজ রিকুইজিশন করেছিল। এই জাহাজগুলিকে এমন হতে হয়েছিল, যাতে করে তারা বহুদূরের সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে পারে এবং খারাপ আবহাওয়ায় সমস্যা না হয়। দক্ষিণ আটলান্টিকের খারাপ আবহাওয়ার আবার বেশ খ্যাতি রয়েছে। এই ৫৪টা জাহাজে ১ লক্ষ টন মালামাল, ৪ লক্ষ ১০ হাজার টন জ্বালানি তেল, ৯ হাজার সৈন্য এবং ৯৫টা বিমান বহন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজগুলিতে যা বহণ করা সম্ভব ছিল, তা ফকল্যন্ড মিশনের জন্যে যথেষ্ট ছিল না। লম্বা মিশনে খারাপ আবহাওয়ায় সৈন্য এবং রসদ পরিবহণের জন্যে যাত্রীবাহী ওশান লাইনার জাহাজগুলিকেই বেশি উপযুক্ত মনে হয়েছিল ব্রিটিশদের। ‘কুইন এলজাবেথ-২’ জাহাজটা যতক্ষণে দক্ষিন আটলান্টিকে পৌঁছেছিল, ততদিনে যুদ্ধ বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ সেনারা ইতোমধ্যেই ফকল্যান্ডে নেমেছে। ‘কুইন এলিজাবেথ-২’ ফকল্যান্ডের উপকূলে সৈন্য নামায়নি; নামিয়েছিল ফকল্যান্ডের কাছাকাছি সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে, যা কিনা সেবছরের ২৫শে এপ্রিল ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছিল। সেখান থেকে অন্য জাহাজে করে ফকল্যান্ডে নামানো হয় সৈন্যদের। ‘কুইন এলিজাবেথ’এর মতো আরও কিছু জাহাজ রিকুইজিশন করা হয়েছিল।
জাহাজ থেকে জাহাজে সৈন্য ট্রান্সফার
ভূমধ্যসাগর থেকে ফেরা যাত্রীবাহী জাহাজ এসএস ক্যানবেরা (৪৫ হাজার টন) ৬ই এপ্রিল ব্রিটেনে এসে পৌঁছায়। এই জাহাজের ৪০০ ক্রু ছিল এশিয়ান, যাদেরকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন একজন রয়াল নেভাল রিজার্ভের অফিসার। জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার ওঠা-নামার জন্যে হেলিডেক বসানো হয়। ৯ই এপ্রিল ৪০তম ও ৪২তম কমান্ডো, রয়াল মেরিন এবং ৩য় প্যারা ব্যাটালিয়নকে নিয়ে জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সেখানে ব্রিটিশ অধীনে থাকা এসেনশন দ্বীপে দুই সপ্তাহ মহড়া দেয়া হয় এবং ফকল্যান্ডে সৈন্য নামাবার জন্যে জাহাজটাকে রেডি করা হয়। ২১শে মে ফকল্যান্ডের উপকূলে গিয়ে ২ হাজার সৈন্যকে নামিয়ে দেয় জাহাজটা। এরপর জাহাজটা আড়াই হাজার মাইল দূরের সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে গিয়ে ‘কুইন এলিজাবেথ-২’ জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া সৈন্যদের তুলে নেয়। ক্যানবেরার সাথে ‘নরল্যান্ড’ এবং ‘আরএফএ স্ট্রমনেস’ বাকি সেনাদের পরিবহণ করে। এই সেনাদেরকে ক্যানবেরা এবং বাকি জাহাজগুলি আবারও ফকল্যান্ডে নামিয়ে দেয় ২রা জুন। ল্যান্ডিং ক্রাফট, জাহাজের নিজস্ব বোট এবং ১০০টা হেলিকপ্টার লিফটের মাধ্যমে এই সেনাদের সেখানে নামানো হয়। সৈন্য নামাবার সময় ক্যানবেরার আশেপাশের রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজগুলিকে আর্জেন্টাইন যুদ্ধবিমানগুলি হামলা করেছে, কিন্তু ক্যানবেরায় বোমা পড়েনি একটাও। আর্জেন্টাইনরা ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার-ফ্রিগেটগুলিকে হামলা করতেই বেশি আগ্রহী ছিল; সাপ্লাই বা ট্রুপ-ক্যারিয়ারগুলিকে নয়। ব্রিটিশরা নিশ্চিত ছিল যে, ক্যানবেরায় বোমা পড়লেও সাড়ে ৩৫ ফুট ড্রাফটের এই জাহাজ ফকল্যান্ডের উপকূলের অগভীর পানিতে ডুববে না। যুদ্ধের শেষে ১৫ই জুন ৪,০০০-এরও বেশি আর্জেন্টাইন যুদ্ধবন্দীদের পরিবহণ করে জাহাজটা। এই কাজ শেষে রয়াল মেরিন সেনাদের ১১ই জুন আবারও দেশে ফেরত নিয়ে আসে।
সৈন্যের সাথে অস্ত্র এবং রসদ
৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ৩,৯৬১ জনের সেনাদলের ৩৫ দিনের অপারেশনের জন্যে দরকার ছিল ১,০৮৪ টন গোলাবারুদ, ১,১৪৭ টন রসদপাতি, ২০১৫টা গাড়ি এবং ১৯টা হেলিকপ্টার। এত্তসব জিনিস নেবার জন্যে তো আরও জাহাজ দরকার। ২৬ হাজার টনের ‘এমভি নরল্যান্ড’ রিকুইজিশন করা হয় ১৭ই এপ্রিল। এটা ছিল একটা রো-রো ফেরি। এতে দ্বিতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন এবং নেভাল এভিয়েশনের ৮০০ জন সেনাকে পরিবহণ করা হয়। জাহাজের ডিজাইন অবশ্য ব্রিটিশদের জন্যে সুবিধার ছিল না। ব্রিটিশরা তাদের লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ-গুলির সাথে মেক্সিফ্লোট নামের পন্টুনের মতো কিছু ল্যান্ডিং ক্রাফট বহন করেছিল। এগুলির উপর ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ভেহিকল এবং অন্যান্য গাড়ি তুলে দিয়ে উপকূলে নামানো হতো। নরল্যান্ড একটা রো-রো ফেরি হলেও এই জাহাজের ভেহিকল র্যাম্প মেক্সিফ্লোটগুলির উচ্চতা পর্যন্ত নামতোই না। অর্থাৎ এই জাহাজে গাড়ি বহন করলে মেক্সিফ্লোটে সেই গাড়ি নামাবার কোন উপায় নেই। কিন্তু ব্রিটিশদের উপায় ছিল না, কারণ সুবিধামত জাহাজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতি চারটা জাহাজ ইন্সপেকশনের পর একটা মাত্র জাহাজ রিকুইজিশনের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল।
বাণিজ্যিক জাহাজে যুদ্ধবিমান পরিবহণ
‘পিএন্ডও লাইন’এর সাড়ে ৫ হাজার টনের ‘এমএস এল্ক’ রো-রো ফেরি বহন করেছিল ১০০টা গাড়ি, ২ হাজার টন এমুনিশন এবং আরও কয়েক’শ টন রসদপাতি। ৮টা লাইট ট্যাঙ্কও নেয়া হয় এতে। হেলিপ্যাড বসানো হয় যাতে ৩টা সী-কিং হেলিকপ্টার বহন করা যায়। ৪,২০০ টনের ‘এমএস ইউরোপিক ফেরি’ রিকুইজিশন করা হয় ১৯শে এপ্রিল। এতে হেলিপ্যাড যুক্ত করা হয় সেনাবাহিনীর ৪টা হেলিকপ্টার বহন করার জন্যে; সৈন্য, গাড়ি এবং রসদও নেয়া হয় এতে। ১৯,০০০ টনের রো-রো ফেরি ‘এমএস বল্টিক ফেরি’ ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ১০৫ জন সৈন্যের সাথে ১,৮৭৪ টন রসদপাতি নিয়েছিল। এছাড়াও জাহাজটার উপর হেলিপ্যাড বসানো হয় এবং সেনাবাহিনীর তিনটা হেলিকপ্টার বহন করা হয় এতে। এই জাহাজের সিস্টার শিপ ‘এমএস নরডিক ফেরি’কেও রিকুইজিশন করা হয়। ‘কুনার্ড’এর ১৫ হাজার টনের কনটেইনার জাহাজ ‘এসএস আটলান্টিক কনভেয়র’ এবং ‘এসএস আটলান্টিক কজওয়ে’-কে রিকুইজিশন করা হয় ১৪ই এপ্রিল। জাহাজদু’টিতে বেশকিছু পরিবর্তন করে বিমান পরিবহণের জন্যে উপযুক্ত ক্রয়া হয়েছিল। বিমান ছাড়াও অনেক জ্বালানি এবং গোলাবারুদ নেয় জাহাজদু’টি। ‘আটলান্টিক কনভেয়র’ বহণ করছিল নৌবাহিনীর ৬টা ওয়েসেক্স হেলিকপ্টার এবং রয়াল এয়ার ফোর্সের ৫টা চিনুক হেলিকপ্টার। এসেনশন দ্বীপে এসে জাহাজটা নৌবাহিনীর ৮টা এবং বিমান বাহিনীর ৬টা হ্যারিয়ার বিমান নেয়। ফকল্যান্ডের কাছাকাছি এসে হ্যারিয়ার বিমানগুলিকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর একটা চিনুক হেলিকপ্টার ইতোমধ্যেই এসেনশন দ্বীপে নেমে গিয়েছিল। ২৫শে মে আর্জেন্টাইন নৌবাহিনীর সুপার এটেনডার্ড বিমানের ছোঁড়া এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে জাহাজটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আগুনে ৬টা ওয়েসেক্স, ৩টা চিনুক এবং একটা লিঙ্কস (অন্য জাহাজ থেকে আসা) হেলিকপ্টার পুরো অঙ্গার হয়। অপরদিকে আটলান্টিক কনভেয়রের সিস্টার শিপ আটলান্টিক কজওয়ে ১৪ই মে রওয়ানা দিয়ে নৌবাহিনীর ৮টা সী-কিং এবং ২০টা ওয়েসেক্স হেলিকপ্টার বহন করে ২৭শে মে ফকল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছায়। যুদ্ধের মাঝে এই জাহাজের উপরে ৪,০০০ বার হেলিকপ্টার অবতরণ করে এবং ৫০০ বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও মিসাইল হামলার শিকার রয়াল ফ্লিট অক্সিলারির লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ ‘স্যার গালাহ্যাড’ এবং ‘স্যার ট্রিসট্রাম’-এর ১৭০ জন ক্রুকে এই জাহাজ আশ্রয় দেয়। সাড়ে ১১ হাজার টনের কন্টেইনার জাহাজ ‘এমভি কন্টেন্ডার বেজান্ট’ ৯টা ওয়াস্প, ৩টা চিনুক হেলিকপ্টার এবং ৪টা হ্যারিয়ার বিমান নিয়ে যখন ফকল্যান্ড পৌঁছায়, তখন যুদ্ধ শেষ। এই জাহাজটা রয়াল নেভি পরবর্তীতে রেখে দেয় ‘আরএফএ আরগাস’ নামে। ২৮ হাজার টনের কনটেইনার জাহাজ ‘এমভি এস্ট্রোনমার’-এ বেশকিছু পরিবর্তন করা হয় ১৩টা হেলিকপ্টার বহণ করার জন্যে। এই জাহাজটাও যুদ্ধ শেষে পৌঁছায়, এবং এটাকেও রয়াল নেভি সার্ভিসে নিয়ে নেয় ‘আরএফএ রিলায়ান্ট’ নামে। এই জাহাজটাই ১৯৮৪ সালে বৈরুত থেকে ৫,০০০ ব্রিটিশ নাগরিক এবং সৈন্যকে উদ্ধার করে।
অয়েল রিগ সাপোর্ট শিপ 'স্টেনা ইন্সপেক্টর'কে রয়াল নেভি ফকল্যান্ড নিয়ে গিয়েছিল রিপেয়ার শিপ হিসেবে। জাহাজটার এতটাই কাজে লেগেছিল যে, ব্রিটিশরা পরবর্তীতে জাহাজটাকে সার্ভিসে নিয়ে নেয় 'আরএফএ ডিলিজেন্স' নামে। |
সব জাহাজই কাজে লাগে
ব্রিটিশরা ৩টা যাত্রীবাহী লাইনার, ৮টা রো-রো ফেরি, ৫টা কনটেইনার জাহাজ, ৭টা কার্গো জাহাজ, ১৫টা ট্যাংকার এবং আরও ৮টা সাপোর্ট জাহাজ রিকুইজিশন ও চার্টার করেছিল। এই ৪৬টা বাণিজ্যিক জাহাজের মাঝে অনেকগুলিতেই হেলিপ্যাড বসানো হয়েছিল – সবগুলি যাত্রীবাহী লাইনার, রো-রো ফেরি, কনটেইনার জাহাজ; ৭টা কার্গো জাহাজের মাঝে ৩টা, এবং ৮টা সাপোর্ট শিপের মাঝে ৩টা। ১৫টা বাণিজ্যিক ট্যাঙ্কারের মাঝে ২টাকে সমুদ্রে রিফুয়েলিং-এর জন্যে যন্ত্র বসানো হয়েছিল। আবার অনান্য সকল জাহাজকেও মাঝ সমুদ্রে জ্বালানি গ্রহণ করতে পারার জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছিল। অনেক জাহাজে যাত্রাপথেও মডিফিকেশনের কাজ চলছিল। অন্যদিকে রয়াল নেভির অধীনে মোট ৬৮টা জাহাজ ফকল্যান্ড মিশনে গিয়েছিল - ২টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ২টা ডক ল্যান্ডিং শিপ, ৮টা ডেস্ট্রয়ার, ১৫টা ফ্রিগেট, ৩টা প্যাট্রোল ভেসেল, ৬টা সাবমেরিন, ৩টা সার্ভে জাহাজ (ব্যবহৃত হয়েছিল হসপিটাল জাহাজ হিসেবে), ৫টা ফিশিং ট্রলার (ব্যবহৃত হয়েছিল মাইনসুইপার হিসেবে), ১০টা রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার, ৬টা লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ, ৫টা সাপ্লাই শিপ, ১টা হেলিকপ্টার সাপোর্ট শিপ, ২টা ওশান টাগবোট। ২টা ডেস্ট্রয়ার, ২টা ফ্রিগেট, ১টা লজিস্টিক ল্যান্ডিং জাহাজ, ১টা কনটেইনার জাহাজ, ১টা ইউটিলিটি ল্যান্ডিং ক্রাফট, ২৪টা হেলিকপ্টার ও ১০টা ফাইটার বিমান হারায় ব্রিটিশরা। প্রতিটা জাহাজই সেখানে কাজে লেগেছিল। ডুবে যাওয়া বা আঘাতপ্রাপ্ত জাহাজকে আশেপাশের জাহাজগুলি সহায়তা দিয়েছে; আগুন নিভাতে সহায়তা দিয়েছে; তাদের ক্রুদের পানি থেকে তুলে নিয়েছে। এছাড়াও জাহাজগুলি হেলিকপ্টারগুলিকে রিফুয়েলিং করেছে; ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ ও বিমানগুলিকে রিপেয়ার করতে সহায়তা দিয়েছে; খাবার-দাবার ও রসদ সরবরাহ করেছে; মেডিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছে; সৈন্যদের রেস্টহাউজ হিসেবে কাজ করেছে; কুরিয়ার বা ডেসপ্যাচ ভেসেল হিসেবেও কাজ করেছে।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ থেকে এই আলোচনা সাপেক্ষে কিছু শিক্ষনীয় রয়েছে।
- ব্রিটিশ নৌবহরের দুর্বলতা - বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তিশালী নৌবহর ব্রিটেন ততদিনে হারিয়েছে। ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজগুলিতে যতো সৈন্য পরিবহণ করা সম্ভব ছিল, তা দিয়ে ফফল্যান্ডস-এর মতো ছোট দ্বীপও পূনর্দখল করা ছিল কঠিন। তাই বেসামরিক বাণিজ্যিক জাহাজের উপরেই নির্ভর করছে হয়েছিল ব্রিটেনকে।
- ব্রিটিশদের আদর্শিক চিন্তার দুর্বলতা - ব্রিটিশদের আদর্শিক চিন্তার দুর্বলতা আরও বহু আগে থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় সেটা আরও কঠিনভাবে সামনে আসলো। ব্রিটিশ এডমিরালটি সকল জাহাজের ডিজাইন নিয়ন্ত্রণ করতো। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেন শত-শত বাণিজ্যিক জাহাজকে রিকুইজিশন করে নৌবাহিনীতে নিয়েছিল। সেটা তারা পেরেছিল, কারণ প্রতিটা জাহাজের ডিজাইন করা হতো ভবিষ্যতের যেকোন সামরিক দরকারের কথা চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৮২ সালে ব্রিটেন বেসামরিক জাহাজ রিকুইজিশন করতে গিয়ে দেখলো যে, বেশিরভাগ জাহাজই সামরিক ব্যবহারের অনুপযোগী। যেগুলিকে সামরিক কাজের জন্যে নির্বাচিত করা হয়েছিল, সেগুলিরও ছিল ব্যাপক সমস্যা। ফকল্যান্ডে বাণিজ্যিক পরিবহণ জাহাজ থেকে সৈন্য নামাতে গিয়ে তাদের এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে হিমসিম খেতে হয়েছিল।
রয়াল নেভির সার্ভে শিপ 'এইচএমএস হেরাল্ড' ও এর ২টা সিস্টার শিপ ফকল্যান্ড গিয়েছিল হসপিটাল শিপ হিসেবে। যুদ্ধে যেকোন জাহাজই কাজে লাগানো সম্ভব - এটার ভালো উদাহরণ এটি। |
- যুদ্ধের সময়ে যেকোন জাহাজই কাজে লাগে। কিছু জাহাজ ফকল্যান্ডের আশেপাশে প্যাট্রোল এবং ইন্টেলিজেন্স যোগাড়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। ৪টা সার্ভে জাহাজকে মডিফাই করে হসপিটাল শিপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অয়েল প্ল্যাটফর্মের সাপোর্ট জাহাজগুলি অত্যন্ত ভালো ফ্লোটিং ওয়ার্কশপ বা রিপেয়ার শিপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। ৫টা বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলারকে রিকুইজিশন করে সোনার বসিয়ে নেয়া হয়েছিল মাইনসুইপিং-এর কাজে।
- বেসামরিক জাহাজ যে সহজেই সামরিক কাজে লাগানো সম্ভব, তা আবারও প্রমাণ হলো ফকল্যান্ডের যুদ্ধের সময়। যাত্রীবাহী লাইনারগুলিকে সহজেই ট্রুপ ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা গেছে। কনটেইনার জাহাজগুলিকে কিছুটা পরিবর্তন করে বিমান পরিবহণ করানো হয়েছে। এমনকি কোন ধরনের মডিফিকেশন ছাড়াও একটা জাহাজ সামরিক কাজে ব্যবহার হতে পারে। যেমন – ফকল্যান্ডের কাছাকাছি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলিকে জ্বালানি ও রসদ সরবরাহ করা; আক্রান্ত বা ডুবন্ত যুদ্ধজাহাজকে অগ্নি নির্বাপণে সহায়তা দেয়া ও সেসব জাহাজের ক্রুদের আশ্রয় দেয়া, ইত্যাদি।
- হেলিকপ্টার অপারেশনের গুরুত্ব - বিমান/হেলিকপ্টার নৌ-অপারেশনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হলো আবারও। বাণিজ্যিক প্রায় সকল জাহাজকেই মডিফাই করা হয়েছিল ফকল্যান্ডের জন্যে। প্রধান মডিফিকেশন ছিল হেলিপ্যাড বসানো। জাহাজে বহণ করা সৈন্য এবং রসদ জাহাজ থেকে ওঠা-নামানো জন্যে হেলিকপ্টার ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বাহন। আর ফকল্যান্ডের উপকূলে হেলিকপ্টার অপারেশনের সময় এই জাহাজগুলি ক্রমাগত হেলিকপ্টারগুলিকে জ্বালানি সরবরাহ করেছিল এবং দরকারে মেইনটেন্যান্স/রিপেয়ারের ব্যবস্থা করেছিল।
- অক্সিলারি বিমানবাহী জাহাজ - বাণিজ্যিক কনটেইনার জাহাজগুলিতে বহণ করা হ্যারিয়ার বিমানগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই জাহাজগুলি অক্সিলারি বিমানবাহী জাহাজের কাজ করেছিল। এই বিমানগুলি জাহাজের হেলিপ্যাড থেকে উড়ে গিয়ে বিমানবাহী জাহাজগুলিতে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধে হারানো হ্যারিয়ারগুলির প্রতিস্থাপক ছিল এগুলি। বিমানবাহী জাহাজ ‘হার্মিস’ সর্বোচ্চ বহন করেছিল রয়াল নেভির ১৬টা সী-হ্যারিয়ার, বিমান বাহিনীর ১০টা হ্যারিয়ার জিআর-৩, আর ১০টা সী-কিং হেলিকপ্টার। ‘ইনভিনসিবল’ বহন করেছিল ১২টা সী-হ্যারিয়ার এবং ১০টা সী-কিং হেলিকপ্টার। ডুবে যাওয়া কনটেইনার জাহাজ ‘আটলান্টিক কনভেয়র’ নিয়ে এসেছিল নৌবাহিনীর ৮টা, আর বিমান বাহিনীর ৬টা হ্যারিয়ার। ডুবে যাবার আগেই বিমানগুলি বিমানবাহী জাহাজে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। আর্জেন্টিনার ১২০-এর উপর ফাইটার বিমানের বিরুদ্ধে এগুলিই ছিল ব্রিটিশদের ভরসা। হ্যারিয়ারগুলি ২১টা আর্জেন্টাইন বিমান ভূপাতিত করেছিল।
আরও পড়ুনঃ
আর্জেন্টিনা কি পারবে?
এক্টাই কথা প্রযোজ্য-
ReplyDelete"Thoughts are the greatest wealth of any nation."
কয়েক দিন আগে জার্মানির সামরিক শক্তির অক্ষমতা সমন্ধে আর্টিক্যালটি পড়লাম, ভাল লাগল। তাই আমেরিকার বিকল্পে নতুনকরে ইউরোপের উত্থান প্রসঙ্গে জার্মানির নেতৃত্ব, এ সমন্ধে অনুগ্রহ করে যদি একটি সুষ্পষ্ট লেখনী আশা করি।
ReplyDeleteমার্কিন বিকল্প যে জার্মানি নয়, তা ঐ লেখাতেই পাবেন। আর জার্মানি ছাড়া যে ইউরোপ চলতে পারবে না, তা-ও সেখানে বলা হয়েছে। আশা করি কোন বিরোধ নেই এখানে।
Deletehttp://shampratikdeshkal.com/international/2018/09/06/8422/print
আর এই লেখাটা ছিল গত বছরের জুনের; যখন পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়নি। তখন পর্যন্ত জার্মানি পূর্ব ইউরোপের দিকেই দৃষ্টি দিচ্ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরার আভাস দিচ্ছিল জার্মানি। ট্রাম্পের বদৈলতে সেটা এখন অনেকদূর গরিয়েছে। বিশ্বের নিয়মকানুন পরিবর্তিত হচ্ছে এখন। তাই বিভিন্ন রকমের টানা-পোড়েন চোখে পড়তে থাকবে বিশ্বব্যাপী।
http://shampratikdeshkal.com/international/2017/06/08/5278/print