Saturday 4 March 2017

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশে কি চাচ্ছে?

০৫ মার্চ ২০১৭
 
আপাততঃ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর রেডিনেস এবং লজিস্টিক্যাল কন্ডিশন যে পর্যায়ে আছে, তাতে নতুন কোন ফ্রন্টলাইন খোলাটা তাদের জন্যে কতোটা বাস্তবসম্পন্ন হবে, তা নিয়ে বিতর্ক করাই যায়। তথাপি তারা ভারতকে “কিছু করা”র জন্যে অনুপ্রাণিত করতে পারে। রাষ্ট্রকে দুর্বল করার Subversion-এর পদ্ধতিগুলি ভারত (যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে) কাজে লাগাতে চাইবে। যেসব অস্ত্রগুলি তারা কাজে লাগাতে চাইবে, সেগুলি স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঐ প্রতিবেদনে পরোক্ষভাবে উল্লেখ রয়েছে- তথাকথিত জঙ্গী কর্মকান্ড, বিদেশী-‘মুক্তমনা’-মানবাধিকার কর্মী-সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, শ্রমিক অসন্তোষ, গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের নামে অরাজকতা, ইত্যাদি।

 

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০১৬ সালের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে পরোক্ষ হুমকি দেবার পর এ নিয়ে কিছু আলোচনা বাঞ্ছনীয় হয়ে উঠেছে। হুমকি হিসেবে এবার আইসিস-এর স্থলে এসেছে আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট বা একিউআইএস-এর নাম। নতুন নতুন যা কিছুই উদ্ভাবন করা হোক না কেন, মূল লক্ষ্য একটাই থাকবে – ইসলামকে অসহিষ্ণু জঙ্গী বিশ্বাস হিসেবে প্রমাণ করা। ইসলামের নামে যতো সব খারাপ কাজের সূচনা করে ইসলাম থেকে মানুষকে দূরে সরাবার এই ঘৃণ্য চেষ্টা এখন এতোটাই নগ্নভাবে সামনে চলে আসছে যে তা এখন একজন রিক্সাওয়ালা, চায়ের দোকানদার বা সিএনজি চালকও জানে। ভারতের সাথে করা LEMOA চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মাটিতে সামরিক বিমান মোতায়েন করতে পারে। [১] তবে আপাততঃ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর রেডিনেস এবং লজিস্টিক্যাল কন্ডিশন যে পর্যায়ে আছে, তাতে নতুন কোন ফ্রন্টলাইন খোলাটা তাদের জন্যে কতোটা বাস্তবসম্পন্ন হবে, তা নিয়ে বিতর্ক করাই যায়। [২] তথাপি তারা ভারতকে “কিছু করা”র জন্যে অনুপ্রাণিত করতে পারে। রাষ্ট্রকে দুর্বল করার Subversion-এর পদ্ধতিগুলি ভারত (যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে) কাজে লাগাতে চাইবে। যেসব অস্ত্রগুলি তারা কাজে লাগাতে চাইবে, সেগুলি স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঐ প্রতিবেদনে পরোক্ষভাবে উল্লেখ রয়েছে- তথাকথিত জঙ্গী কর্মকান্ড, বিদেশী-‘মুক্তমনা’-মানবাধিকার কর্মী-সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, শ্রমিক অসন্তোষ, গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের নামে অরাজকতা, ইত্যাদি। এই কাজগুলি তারা সাম্প্রতিক সময়ে করেই আসছে, যার কিছু রেশ পাওয়া যাবে –

১। ধর্ষণ-হত্যার পর সমাজের অধঃপতনকে দায়ী না করে ক্যান্টনমেন্ট (সামরিক বাহিনীকে) টার্গেট করা
২। তুচ্ছ দাবীকে উপজীব্য করে দফায় দফায় নৌ ও সড়ক পরিবহণ ধর্মঘট করে দেশকে অচল করে ফেলা এবং সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা, যদিও শ্রমিকদের অবস্থার কোনদিনও উন্নতি হয় না
৩। গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে আনা, যখন শ্রমিকরা নিজেরাই জানে না যে কেন তারা কাজ বন্ধ করেছে
৪। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাস্তায় নামিয়ে আনা, অথচ আসল সামাজিক ইস্যুগুলি নিয়ে চুপ থাকা
৫। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুচ্ছ করে বিভিন্ন হেতুতে (যেমন- পরিবেশ, কৃষকের অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, ভোক্তা অধিকার, নারীর অধিকার, ইত্যাদি) হাতে গোনা বিশেষ কিছু ইস্যুতে ধর্মঘটের ডাক এবং বাকি সময়ে চুপ করে থাকা
৬। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেডিকেল কলেজ-হাসপাতালগুলিতে কর্মবিরতি পালন করে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা
৭। সংখ্যালঘুদের উপরে হামলা করে সেখানে বিশেষ কিছু লোককে পাঠানো, যাতে তারা মানুষকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে
৮। উপরের সবগুলি ব্যাপারে মিডিয়াতে এমনভাবে রিপোর্ট করা, যাতে জনগণ ভয়ে থাকে

এই হুমকি দেবার কারণ আসলে কি? (প্রতিবেদনে উল্লেখ করা) বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড? অবৈধ আটক? রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সংযোগে গুম? জঙ্গি মতবাদে উদ্বুদ্ধ গ্রুপের হত্যাকাণ্ড? নারী ও শিশু নির্যাতন? শ্রমিক নির্যাতন? নাকি সবগুলি? এর উত্তর পাওয়া সম্ভব বাকি বিশ্বের দিকে তাকালে। মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলির মানবাধিকার কোন পর্যায়ে রয়েছে আজ, তা খুব একটা কষ্ট করে বোঝাতে হবে না। ঐ দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক খাতির রয়েছে; তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের জন্যে সামরিক-বেসামরিক চুক্তিও রয়েছে। অর্থাৎ এই হত্যাকান্ড, আটক, নির্যাতন –এগুলি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ইরাকের আবু ঘরাইব কারাগার এবং গুয়ান্তানামো বে-তে যা করেছে, তাতে তথাকথিত মানবাধিকার নিয়ে তাদের আদৌ কোন মাথাব্যাথা থাকাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তানে বিমান হামলা করে তারা কতো মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে Collateral Damage বলে ঘোষণা দিয়েছে, তার হিসাব করে বলা সম্ভব নয়। তাহলে কি কারণে এই হুমকি? কারণটা উপরে উল্লিখিত তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রগুলির তালিকার মাঝ থেকে বাদ রাখা হয়েছে, যা কিছু পাঠক হয়তো ধরতে পারবেন। এই কারণটা সেটাই যেটা উপরে উল্লিখিত সকল মানবাধিকার ভঙ্গকারী দেশও মেনে চলেছে, কিন্তু এখানে মানা হয়নি। এই কারণটা সেই চিন্তার গোড়ায় আঘাত হেনেছে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা ধর্মবিশ্বাসের মতো অনুসরণ করে। সারা বিশ্বে মানুষের বাস্তবতা একদিকে প্রবাহিত হলেও সেই চিন্তাকে ধরে রাখতে তারা বদ্ধ পরিকর। এই চিন্তাটি হচ্ছে “নারীর অধিকার” নামের মরীচিকা। এই চিন্তার একটি মূল স্তম্ভ হলো “১৮ বছরের আগে কোন নারীকে বিয়ে করতে দেয়া যাবে না, তা সে যত প্রতিকূলতার মাঝেই পড়ুক না কেন”। ব্যাভিচারের মাধ্যমে জন্মলাভ করা পিতৃপরিচয়হীন সন্তানে দেশের সকল ডাস্টবিন ভরে যাওয়াটা এই রাষ্ট্রের সংস্কৃতি হতে পারে না। একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস্তবতার সাথে না গেলেও এই অসুস্থ্য চিন্তাকে লালন করতে তারা ছিল বদ্ধ পরিকর। আর তাই কয়েকটি প্রভাবশালী পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল বেশ কিছুদিন তাদের পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলের গাড়িতে এবং দেয়ালে দেয়ালে “১৮” অঙ্কটি লিখে সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছে। এদের সেই বিফলতা প্রকৃতপক্ষে ছিল স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিফলতা, যা কিনা এই কুরুচিপূর্ণ প্রতিবেদনের জন্ম দিয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের তালিকায় থাকা বাকি “মানবাধিকার লঙ্ঘন”এর যে ক্ষেত্রটি নিয়ে এতো কথা, তা হলো তথাকথিত “বাল্য বিবাহ”।

যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক মানবাধিকারের হাত ধরে বঙ্গোপসাগরে ডোবার মতো অবস্থায় আজ নেই সাড়ে ১৬ কোটি মানুষ (আসলে দুনিয়ার কেউই নেই)। দুনিয়ার আজকের বাস্তবতা হলো যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের সাথেই যুদ্ধরত। তার আদর্শকে সে জলাঞ্জলি দিয়েছে নিজেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। [৩] আর সেই আদর্শকেই এখনও সে সারা দুনিয়াতে বাজারজাত করতে চাচ্ছে তার এজেন্টদের মাধ্যমে। মার্কিন আদর্শ বাকি দুনিয়ার কাছে তার আকর্ষণ হারিয়েছে আরও আগেই; এখন শুধু এর বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যাচ্ছে তার আদর্শিক চিন্তাগুলিকে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দেবার মাধ্যমে। তার হুমকিও এখন মানুষের কাছে মূল্য হারিয়েছে। তার এজেন্টরা এখন ভীত। তাদের মনিবই তো চিন্তাকে বিসর্জন দিয়েছে; তাহলে তারা এখন কি করবে? মোটকথা চালকের আসনে পরিবর্তন যে আসছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে। আদর্শিক দ্বন্দ্বে পরাজয়ের মুখে যুক্তরাষ্ট্র এখন যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটাই স্বাভাবিক।



[১] ‘অতঃপর যুক্তরাষ্ট্রের ভারত জয়?’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

[২] ‘প্রশ্নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৬

‘ওবামার যুদ্ধগুলো লড়বে কে?’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৯ জানুয়ারী ২০১৭

[৩] ‘যুক্তরাষ্ট্র কি নিজের যঙ্গেই যুদ্ধরত?’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

No comments:

Post a Comment