Friday 26 August 2016

একটা রাষ্ট্রকে যেভাবে দুর্বল করা হয়……

২৬ অগাস্ট ২০১৬

  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফাইটার বিমানের মাঝে একটি ছিল Republic P-47 Thunderbolt. বিমানটি তৈরি করেছিল Republic নামের একটি বিমান নির্মাতা কোম্পানি। আমাদের দেশের প্রথম যুদ্ধবিমানের নাম কি হবে – Akij P-88, নাকি Bashundhara X-3, নাকি PHP N-52, নাকি অন্য কোন নাম?
ঘটনা ১-

১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত সুরক্ষিত মার্কিন নৌ এবং বিমান ঘাঁটি পার্ল হারবারের মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা লক্ষ্য করলো যে সকালের আকাশে ঝাঁক বেঁধে গগন-বিদারী শব্দে আবির্ভূত হয়েছে জাপানি নৌবাহিনীর ‘রাইজিং সান’ মার্কিং-এর শতশত যুদ্ধবিমান। আক্রমণকারী বাহিনীর প্রথম বহরে ছিল ১৮৩টি বিমান – ৮৯টি Nakajima B5N বোমারু এবং টর্পেডোবাহী বিমান, ৫১টি Aichi D3A ডাইভ বম্বার এবং ৪৩টি Mitsubishi A6M “Zero” ফাইটার বিমান।

ঘটনা ২-

১৯৪৩ সাল। মার্কিন বিমান বাহিনীর ৮ম, ৯ম এবং ১২তম এয়ার ফোর্স ব্যাপক বোমাহামলা চালাচ্ছে জার্মান অধিকৃত ইউরোপের উপর। এই হামলায় অংশ নিচ্ছে মার্কিন বিমান বাহিনীর শতশত Boeing B-17 Flying Fortress এবং Consolidated B-24 Liberator বোমারু বিমান, এবং এগুলিকে এসকর্ট দিচ্ছে Republic P-47 Thunderbolt, North American P-51 Mustang, Lockheed P-38 Lightning ফাইটার বিমান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দু’টা আলাদা ঘটনাকে বর্ণনা করলাম এখানে। আসলে ঘটনা বর্ণনার চাইতে এখানে তুলে ধরলাম ওই দুই যুদ্ধের ঘটনায় ব্যবহৃত বিমানগুলির নাম। খেয়াল করলেই দেখবেন যে এই বিমানগুলির নামের শুরুতে রয়েছে – Nakajima, Aichi, Mitsubishi, Boeing, Consolidated, Republic, North American এবং Lockheed, যা কিনা আসলে কতগুলি বিমান ডিজাইন এবং ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির নাম। এর আগের লেখায় লিখেছিলেম যে বাংলাদেশের শিল্পপতিদের নিজেদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি নামে পরিচিতি পেতে চান – মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় আন্ডারওয়্যার সাপ্লাই দিয়ে, নাকি দেশের জন্যে প্রথম যুদ্ধবিমান ডিজাইন করে। আমাদের দেশের প্রথম যুদ্ধবিমানের নাম কি হবে – Akij P-88, নাকি Bashundhara X-3, নাকি PHP N-52, নাকি অন্য কোন নাম? আজকে এই চিন্তাটাকেই আরেকটু প্রসারিত করবো।
   
আলেক্সান্ডার ডে-সিভিয়ার্সস্কি একজন অসফল বিমান নির্মাতা। কিন্তু তার সামরিক চিন্তাগুলি ১৯৪২ সালে Victory Through Air Power নামের একটি বইতে প্রকাশ করে তিনি বিখ্যাত হয়ে যান। হলিউডের ওয়াল্ট ডিজনি তার সেই বইকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একটি ডকুমেন্টারি মুভি তৈরি করেন যুদ্ধের পক্ষে জনগণের মতামত আনার লক্ষ্যে। ছবিতে সিভিয়ার্সস্কিকে সেই মুভিতেই দেখা যাচ্ছে। সিভিয়ার্সস্কি এবং ডিজনি দুজনেই এখানে রাষ্ট্রের কাজ করেছেন।

বই থেকে মুভি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়েই আরও কিছু কথা বলবো। অনেক বড় ছিল ওই যুদ্ধখানা। বহু বিষয়ে কথা বলার জন্যে বহু উদাহরণ রয়েছে সেই যুদ্ধে; তাই তর্কের খাতিরেই হোক, আর নিছক উদাহরণ হিসেবেই হোক, সেই যুদ্ধের কথা বারংবার আসবেই। যাই হোক, আসল কথায় আসি। আলেক্সান্ডার ডে-সিভিয়ার্সস্কি (Alexander P. de Seversky, 1894-1974) ছিলেন রাশিয়ায় জন্ম নেয়া একজন মার্কিন বিমান নির্মাতা এবং সামরিক চিন্তাবিদ। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ান বিমান বাহিনীতে পাইলট ছিলেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন বলবত হবার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হন। সেখানে ১৯২৩ সালে নিউ ইয়র্কে তিনি সিভিয়ার্সস্কি এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানি চালানো ক্ষেত্রে সিভিয়ার্সস্কি মোটেই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। আর জাপানিদের কাছে ২০টি ফাইটার বিক্রি করার পরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিরাগভাজন হন তিনি (তথাকথিত মুক্ত বাণিজ্য!)। মার্কিন সরকারের কারসাজিতে তার কোম্পানি অন্য শিল্পপতিদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়, যেখানে সিভিয়ার্সস্কি তার নিজের তৈরি কোম্পানিতেই সকল ক্ষমতা হারান। ১৯৩৯ সালে নতুন কোম্পানির নাম হয় Republic Aviation Corporation, যা কিনা পরবর্তীতে উপরে উল্লিখিত P-47 Thunderbolt বিমান তৈরি করে বিখ্যাত হয়ে যায়। সিভিয়ার্সস্কি এসব ক্রেডিট থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হন। সকলেই মনে করছিল যে এই লোকটির ক্যারিয়ার শেষ।

নিজের কোম্পানি হারাবার পরে মাথা কুটে মরেননি সিভিয়ার্সস্কি। তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন তার সমর-চিন্তাতে। পার্ল হারবারে জাপানি হামলার পরপরই তিনি তার চিন্তাগুলি বই আকারে প্রকাশ করলেন, যার নাম Victory Through Air Power. এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালের এপ্রিলে। বইটি ৫০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে রেকর্ড তৈরি করে ফেলে। কৌশলগতভাবে বিমান শক্তিকে ব্যবহার করে কি করে জার্মানি-জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জেতা সম্ভব, সেই তত্ত্ব তিনি দেন সেই লেখায়। হাজার হাজার বোমারু বিমান তৈরি করে জার্মানি এবং জাপানের সামরিক উতপাদন শক্তিকে ধ্বংসের মাধ্যমে যুদ্ধ জয়ের কথা বলেন তিনি। বইটির নাম যখন সকলের মুখে মুখে, তখন এই ঘটনার মাঝে মার্কিন মুভি জগতের বিখ্যাত নাম ওয়াল্ট ডিজনির (Walt Disney) আবির্ভাব হয়।

ডিজনি সিভিয়ার্সস্কির বই পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হন এবং তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে এই বার্তা তিনি হলিউডে তার নিজের শক্তিশালী অবস্থানকে ব্যবহার করে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ লোকজন এবং সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছে দেবেন। ডিজনি নিজ পয়সায় সিভিয়ার্সস্কির বইয়ের উপরে ভিত্তি করে ১৯৪৩ সালে Victory Through Air Power নামে একটি এনিমেশন ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। ডিজনিকে সবাই চিনতোই এনিমেশন কার্টুনের জন্যে; তিনি তার সেই শক্তিশালী অবস্থানের মাঝে থেকেই যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করেন। ডিজনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বই পড়ে সেই মেসেজ বুঝতে পারা আর motion picture-এর মাধ্যমে সেই একই মেসেজ বুঝতে পারার মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। ডিজনি এই মুভিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলকে কানাডার কুইবেকে ১৯৪৩ সালের অগাস্টে দুই নেতার বৈঠকের সময়ে তাদের সামনে দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ১৯৪২ সালে সিভিয়ার্সস্কির বইখানা বের হবার পর থেকে মার্কিনীরা তাদের সামরিক চিন্তাতে সিভিয়ার্সস্কির তত্ত্ব খাটাতে থাকেন। আর মুভিখানা মুভি থিয়েটারে দেখানোর মাধ্যমে রুজভেল্ট সরকার তাদের সামরিক সিদ্ধান্তগুলি সামরিক অফিসার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। যুদ্ধের সময়ে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে জনমত গড়ার পেছনে এই মুভি বেশ কাজে দিয়েছিল। এই মুভির মাধ্যমে কৌশলগত বোমাহামলায় যে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, সেটাকে সামরিক লক্ষ্যের আলোকে যুক্তিযুক্ত করে তোলা হয়। মোটকথা, মুভিটি যুদ্ধের সময়ে মার্কিন সরকারের propaganda tool হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

রাষ্ট্র = জনগণ + সরকারী কর্মকর্তা + সামরিক সদস্য + শিল্পপতি + মুভি ইন্ডাস্ট্রি + ……

আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম কতগুলি বিমান-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে। এরপর সেখান থেকে গিয়েছি একজন অসফল বিমান নির্মাতার কাছে, যার সামরিক চিন্তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপরে বিরাট প্রভাব ফেলে এবং সেই চিন্তার উপরে ভিত্তি করে হলিউডের এক বিখ্যাত মুভি নির্মাতা মুভি তৈরি করেন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন সরকারের যুদ্ধ-সিদ্ধান্তের পক্ষে propaganda tool হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই সকল কিছু যখন আমরা মিলিয়ে দেখবো, তখন দেখবো যে এখানে অনেকগুলি প্রাইভেট কোম্পানি এবং ব্যক্তির নাম এসে গিয়েছে, যারা কিনা বিশাল যুদ্ধের মাঝে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেউ তার দ্বায়িত্ব পালন করেন বিমান ডিজাইন করে, কেউবা সামরিক চিন্তার উপরে বই লিখে, কেউবা যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে মুভি তৈরি করে। এই ব্যাপারগুলি সম্ভব হয়েছিল কারণ মার্কিন সমাজে সামরিক এবং বেসামরিক সমাজ বলে আলাদা সমাজ ছিল না। এক হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন আলাদা করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে মার্কিন জনগণ, সরকারী আমলা, সামরিক বাহিনীর সদস্য, শিল্পপতি, সামরিক শিল্প, মুভি ইন্ডাস্ট্রি, মুভি সেলেব্রিটি – সকল কিছুই ছিল একই সূত্রে গাঁথা। এর পুরোটাই কাজ করেছে একত্রে – আলাদা করার কোন পদ্ধতিই ছিল না। যখন একটি রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যে কাজ করে, তখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ এবং ব্যক্তিকে আলাদা করে দেখানো সম্ভব নয়। এটাই হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের শক্তির মূল উতস। কিন্তু এই উতস কিভাবে তারা পেল? রাষ্ট্রের সকল শক্তিকে একত্র করতে পারলো তারা কি করে? আমাদের দেশে তো জনগণ, সরকারী আমলা, সামরিক বাহিনীর সদস্য, শিল্পপতি, মুভি ইন্ডাস্ট্রি, মুভি সেলেব্রিটি – এগুলিকে একত্র করা আর তেলের সাথে পানি, মধু আর ঘি একত্রে মিশানো একই কথা! আমরা কেনো পারি না? সেই উত্তর খোঁজার কাজটা আমরা কখনোই করি না; বরং দায়সাড়া কিছু উত্তর খুঁজে অন্যের উপরে দোষ চাপিয়ে দিয়ে হাল্কা হতে চাই।

রাষ্ট্র একটা শরীরের মতো…

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তথা পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তার সাথে খাপ খাওয়ানোর দরকার নেই, বরং উপরের আলোচনায় যেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে তা হলো – একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র চলে একটা একটা চিন্তার উপরে ভর করে। এই চিন্তাই রাষ্ট্রকে একটি লক্ষ্যে ধাবিত করে। সেই চিন্তা পুরো রাষ্ট্রের শরীরে ধমনীর ন্যায় প্রবাহিত হয়; কোন অঙ্গকেই অন্য অঙ্গ থেকে আলাদা করা যায় না। পায়ে চিমটি কাটলে হাত টের পায়; জেগে ওঠে। এক অঙ্গে আঘাত করলে অন্য অঙ্গ বাধা দেয়। আর সকল অঙ্গ কাজ করে একটি শরীরের মাঝে – যা হচ্ছে রাষ্ট্র। সকল অঙ্গই এই শরীরের অংশ। একটি অঙ্গ আলাদা করে ফেললে শরীর রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে পড়বে। এই চিন্তার মাঝে আমরা যদি আমাদের অবস্থাটা ‘ফিট’ করি, তাহলে কি দেখি?

আমরা আসলে রক্তশূণ্য! আমাদের ধমনী দিয়ে কিছুই প্রবাহিত হয় না। এক অঙ্গ অন্য অঙ্গকে টের পায় না; তাই একটা অঙ্গকে কেটে ফেললে অন্য অঙ্গ ঘুমিয়ে থাকে; বাধা দেয় না। একটা শরীরকে দুর্বল করে ফেলতে হলে তাকে রক্তশূণ্য করে ফেলতে হয়; তাহলে তার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আলাদা করে ফেলা যায়; কেটে ফেলতে হয় না। এই পদ্ধতির নামই হচ্ছে Subversion, যাকে আভিধানিক অর্থে বলে দুর্বল করে ফেলা। একে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ বা নাশকতাও বলা হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে নাশকতা শব্দটাকে এতটাই হাল্কাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে আমরা নাশকতা বলতে এখন শুধুই বুঝি বোমাবাজি। তাই আমার লেখাতে আমি নাশকতা শব্দটা একেবারেই ব্যবহার করি না; করি Subversion শব্দটির ব্যবহার। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি Subversion-এর মাধ্যমে অন্য দেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে রাখে; রক্তশূণ্য করে ফেলে। এই কর্মকান্ড তারা বেশি করে সেইসকল দেশের ক্ষেত্রে, যেগুলি শক্তিশালী দেশের জন্যে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। অদরকারি দেশের মাঝে Subversion-এর মাধ্যমে কেউ অর্থ অপচয় করে না। শক্তিশালী দেশের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলির একটা বড় বাজেট থাকে Subversion-এর জন্যে। Subversion-এর কাজটা রাষ্ট্রযন্ত্রের মাঝে একটা ভাইরাসের ন্যায় কাজ করে।

রাষ্ট্রের শরীরে ভাইরাস…

Subversion প্রসেসের মূল ব্যাপারটা Divide and Rule চিন্তার উপরে ভিত্তি করে হয়। প্রথমে সমাজের দুর্বল দিকগুলিকে কাজে লাগিয়ে কিছু এজেন্ট তৈরি করা হয়, যাদের মূল শর্ত থাকে ‘দেশদ্রোহিতা’। কাজটা কঠিন হলেও কিছু লোক এটা করতে রাজি হয় নিজেদের স্বার্থের জন্যে। এই লোকগুলি সমাজের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে সমস্যা সৃষ্টি করে, যাতে রাষ্ট্রযন্ত্র উপরে যেরকম বলেছি, সেরকম ‘একটি শরীর’ হিসেবে কাজ না করতে পারে না। এই প্রসেসখানা যেসব সেক্টরে কাজ করে, তার একটা ছোট্ট বর্ণনা নিচে দেয়া হলো। উল্লেখ্য যে এই বাইরেও আরও অনেক সেক্টর রয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করিনি। তবে পাঠকের বোঝার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট মনে করছি।

১. ন্যায়ের উৎসে কুঠার মারাঃ সমাজে ন্যায়পরায়ণতার মূল উৎস হলো ধর্ম। আর Subversion সফল হতে হলে সমাজের ন্যায়-নীতিকে আক্রমণ করতে হয়। কাজেই ধর্মকে উপরে আক্রমণ দিয়েই Subversion-এর শুরু। ধর্মের মাঝে বিভাজন তৈরি করা হয়, যাতে নানা ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়। এতে মানুষ ধর্মের উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং ন্যায়নীতি তার কাছে relative হয় যায়, অর্থাৎ কারো কাছে একটা কাজ অন্যায়ের হলেও অন্যের কাছে সেটা ন্যায় হিসেবে ঠেকে। ধর্মের নামে খারাপ কাজ করানো হয়, যাতে ধর্মকে আক্রমণ করা সহজ হয় (এর আগে লিখেছি এ নিয়ে)। কাজেই সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং ন্যায়-নীতি থাকে না বলে মানুষ শুধুমাত্র ব্যাক্তিস্বার্থ দ্বারা ধাবিত হয়।

২. শিক্ষার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে ফেলাঃ ন্যায়ের উৎসে কুঠারের পরে শিক্ষার মূল উপড়ে ফেলা হয়। যেহেতু ধর্মের অবর্তমানে ন্যায়-নীতিতে ধ্বস নামে, কাজেই সকলে ব্যক্তিস্বার্থের জন্যে শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়। নিজেকে তুলে ধরার ব্যাপারটা শিক্ষাক্ষেত্রে আসে একটি বিকৃত চিন্তার মাধ্যমে – “শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হলো অর্থ উপার্জন”। একজন ইঞ্জিনিয়ার দেশের সম্পদ না হয়ে দেশের উপরে একজন বেকার বোঝায় রূপান্তরিত হয়। একজন শিক্ষক শিক্ষা দেয় জ্ঞান বিতরণের জন্যে নয়, শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্যে। অর্থ হয়ে ওঠে মূল চিন্তা এবং এতে চিন্তাশক্তি পুরোপুরি লোপ পায়। দীর্ঘমেয়াদে জাতির ঘুরে দাঁড়াবার পদ্ধতিও এতে বন্ধ হয়ে যায়। বই পড়া এবং জ্ঞান-চর্চা অদরকারি হয়ে পড়ে (এর আগে এ নিয়ে লিখেছি)।

৩. নিরাপত্তাকে ভূলুন্ঠিত করাঃ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে মানুষের কাছে বিকৃতরূপে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে মানুষ সামরিক বা নিরাপত্তার ক্যারিয়ার থেকে দূরে থাকে। যে বিকৃত চিন্তাটি তুলে ধরা হয় তা হলো – “যাদের বুদ্ধি নেই, বা যাদের নীতির অভাব রয়েছে বা যাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, তারাই নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগদান করে”। এভাবে সামরিক এবং বেসামরিক – দু’টি আলাদা সমাজের জন্ম হয় (যা নিয়ে এর আগে লিখেছি) এবং এদের মাঝে লেগে থাকে রেষারেষি। সামরিক বাহিনীর যেকোন কর্মকান্ডকে বেসামরিক লোকজন সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। দেশ সামরিকভাবে আক্রান্ত হলে এই বিভাজনের ফলে দেশের উপরে মহাবিপদ নেমে আসে। এই কাজটাকে বাস্তবে রূপ দিতে এবং সর্বদা এই বিভেদ জারি রাখতে মিডিয়া এবং এনজিও ব্যাপক সহযোগিতা করে।

৪. মিডিয়ার মাধ্যমে ভেড়ার পাল নিয়ন্ত্রণঃ মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো দেশের মানুষকে বিভিন্ন বিকৃত চিন্তা দেয়া হয়। অথর্ব লোকগুলিকে মিডিয়াতে বারংবার সামনে এনে দেশের মানুষের সামনে সেলেব্রিটি করে তোলা হয়, যারা নতুন কোন কথা বলতে তো পারেই না, বরং বছরের পর বছর মানুষকে একই গতবাধা কথা বলে ভুল পথে প্রবাহিত করে। এই লোকগুলি ভেড়ার পালের পাহাড়াদার কুকুর হিসেবে কাজ করে। গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানে এজেন্টদের দৌড়াত্ম থাকায় মিডিয়ার এই Subversion-এর বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকে না। এরা সমাজের অন্যান্য স্থানে কর্মরত এজেন্টদের বড়সড় ব্যাকআপ দেয়। দরকারবিশেষে কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নে একনাগারে শুধুমাত্র এজেন্টদেরকেই এরা হাইলাইট করতে থাকে।

৫. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ নেয়াঃ যে কাজগুলি সরকার সমাজের মানুষের জন্যে করার কথা ছিল, সে কাজগুলি বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিক্ষেত্রে তুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ সরকারের কাজ ব্যক্তি করতে থাকে। ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রাইভেট সংস্থা (এনজিও) বাইরের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়। এভাবে সমাজে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছুটে যায় এবং বাইরের অর্থদাতারা দেশের তৃণমূলে কাজকর্মের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এদের তৈরি করা নেটওয়ার্ক তারা যেকোন সময় দেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে, কারণ বহু মানুষ তাদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং নিজেদের কোন চিন্তা না থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কোন সন্দেহ প্রকাশ করে না।

৬. রাষ্ট্রের উপরে চাপ সৃষ্টি করাঃ বিভিন্ন এনজিও, সাহায্য সংস্থা, এবং ব্যক্তিকে ব্যবহার করা হয় প্রেসার গ্রুপ হিসেবে। এরা বিভিন্ন উছিলা দেখিয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বন্ধ করার জন্যে মামলা করে, রাস্তায় বিক্ষোভ করে, আন্তর্জাতিকভাবে চাল সৃষ্টির চেষ্টা চালায়, ইত্যাদি। সামরিক বাহিনীর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টগুলির বিরুদ্ধে এরা জনমত গড়ার চেষ্টা চালায়। বিমান বাহিনীর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে মনে করে এরা যেকোন এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত হয়। দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল প্রমাণ করে বিদেশের কাছে হাত পাতার প্রেসক্রিপশনও দেয় তারা। মিডিয়াতে বসে থাকা এজন্টরা এদেরকে সরাসরি সাহায্য করে।

৭. ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়াঃ অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করে ফেলার জন্যে শিল্প এবং বিভিন্ন ব্যবসাক্ষেত্রে মালিক এবং শ্রমিকের মাঝে আরও একটি পক্ষকে আনা হয়, যাকে আমরা শ্রমিক নেতা বলে জানি। মালিকপক্ষ তার স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়; যার ফলে সে শ্রমিক নেতার সাথে স্বার্থের সমন্বয় করে ফেলে। যেহেতু মালিকপক্ষ নীতি থেকে আগেই সরে এসেছে, তাই স্বার্থান্বেষী এই কাজ করতে তার কোন কষ্টই হয় না। এতে সাধারণ শ্রমিক বঞ্চিত হয় এবং এই বঞ্চনা কোনদিনই যায় না। এভাবে শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক অসন্তোষ কখনোই যায় না এবং যখন ইচ্ছে এজেন্টদের ব্যবহার করে শ্রমিকদের উস্কে দেয়া যায়। যানবাহন ধর্মঘট উস্কে দিয়ে পুরো দেশকে অচল করে ফেলা যায়। শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলা যায়। আবার শ্রমিকদের মাঝে এজেন্টদের ব্যবহার করে কারখানায় আগুন, যন্ত্রপাতিতে বিস্ফোরণ, লিফট ছিড়ে পড়া, অবাস্তব দুর্ঘটনা, ইত্যাদি মানব-সৃষ্ট দুর্যোগের সৃষ্টি করা হয়।

৮. শিল্পের লাগাম টেনে ধরাঃ দেশের material power-কে দুর্বল করার লক্ষ্যে কৌশলগত শিল্পের ব্যাঘাত ঘটানো। বিভিন্ন শিল্পে খবরদারি করা হয়, যাতে – স্টিল ইন্ডাস্ট্রিতে যেন মিলিটারি গ্রেড স্টিল তৈরি না করা হয়, অথবা সিমেন্ট মিলে যেন সুপার স্ট্রেংথ কোন মিক্সচার ডেভেলপ করা না হয়, অথবা পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কয়েকটি বিশেষ কেমিক্যাল যেন তৈরির ব্যবস্থা করা না হয়, অথবা মেশিন ফ্যাক্টরিগুলিতে বিশেষ কিছু প্রসেসিং ক্যাপাসিটি না বসানো হয়, অথবা গ্লাস ফ্যাক্টরিতে এক্সট্রা-স্ট্রং গ্লাস উইন্ডশিল্ড তৈরি করার ক্ষমতা না থাকে, অথবা মিডিয়াম সাইজের ইঞ্জিন তৈরির কাস্টিং সক্ষমতা না হয়, অথবা হাই-টেক সার্কিট-বোর্ড তৈরির চেষ্টা না করা হয়, ইত্যাদি। এসব শিল্প দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়, তাই এগুলির উপরে নজরদারির জন্যে এজেন্টদের লেলিয়ে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীদের মাঝেও কিছু এজেন্ট তৈরি করা হয়, যাতে তারা বিদেশী ব্যবসার স্বার্থ দেখে সর্বদা। এরা দেশে শিল্প গড়ার চাইতে দেশকে আমদানি-নির্ভর করতে বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্য শিল্পপতিদেরকেও এরা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।

এবং যেভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে চলে যায়…

উপরের এই সকল সেক্টরের কাজগুলি সফল হয় কারণ প্রথম সেক্টরে ন্যায়-নীতি থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে ফেলা হয় এবং দ্বিতীয় সেক্টরে চিন্তার ভিত্তি ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই প্রসেস পেকে লাল হতে মোটামুটি ১৫-২০ বছর লেগেই যায় – যা কিনা এজেন্টদের এক জেনারেশনকে ট্রেনিং দেবার সমান। এজেন্টরা পরিপক্ক হলেই কাজগুলি পাকতে শুরু করে। একসময় প্রতিটি সেক্টরের সমস্যা এতটাই ঘনীভূত হয়ে যায় যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ভারে শেষঅবধি পুরো রাষ্ট্রই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। এমতাবস্থায় বাইরে থেকে রাষ্ট্রের জন্যে একটি সমাধান দেয়া হয়, যা কিনা দেশের জনগণ মেনে নেয়া ছাড়া কোন গতি দেখে না। তার বিনা বাক্যে মেনে নেয়, কারণ ১) তাদের ন্যায়-নীতির মাপকাঠি ধ্বংস করা হয়েছে এবং ২) তাদের চিন্তাশক্তির বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে যায় বাইরের শক্তির হাতে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি এসময় নিজেদের মধ্যে কুকুরের মতো কামড়া-কামড়ি করতে থাকে দেশটির দখল নেবার জন্যে। মাঝেমধ্যে হিংস্র কুকুরের খাদ্যরূপে দেশটির বিভাজনও ঘটে যায়!

উপরে যা যা লিখেছি, এদেশের মাঝে এগুলির উতস খুঁজে পেতে কোন কষ্টই করতে হবে না। আমাদের দেশে প্রায় সকল সেক্টরেই Subversion চলেছে; চলছে। এদেশকে রক্তশূণ্য করে রাখা হয়েছে; এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের জন্যে চিন্তা করে না – মনে করে ওর সমস্যা; আমার কি? এই প্রসেস কতদিন চলবে, তা ঠিক করবে দু’টো জিনিস – ১) ভূরাজনীতিতে বাইরের শক্তিদের নিজেদের শক্তির অবস্থা এবং ২) আমাদের মৌলিক চিন্তার অবস্থা। প্রথম ক্ষেত্রটিকে মেনে নেয়া মানে আমরা নিজেদের প্রিয়জনকে চোখের সামনে বিরামহীনভাবে ধর্ষন হতে দেখেই যাবো। একজন ধর্ষণকারীর পরে আরেকজনের আবির্ভাব হবে; আমরা তাকেও মেনে নিতে বাধ্য হবো! আর দ্বিতীয়টির অর্থ হলো, এই অসহ্য যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করে নিজেদের চোখের চশমা খুলে ফেলা এবং রাষ্ট্রের ধমনীতে রক্তের মতো নিজেদেরকে প্রবাহিত করা। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের শরীরের যেকোন অঙ্গের আঘাত আমাদের নিজেদের গায়ে ক্ষতের সৃষ্টি না করবে, বুঝতে হবে যে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের চিন্তা মুক্তি পায়নি। এই মৌলিক চিন্তা কাজ করবে এন্টি-ভাইরাসের মতো। যখন আমরা রাষ্ট্রের সকল অঙ্গে ভাইরাস ধরতে শিখতে শুরু করবো, শুধুমাত্র তারপরেই কথা উঠতে পারে রাষ্ট্রকে পুরোপুরি ভাইরাস-মুক্ত করার। Subversion-এর প্রসেসেই বলে দেয় যে এই চিন্তার মূল শক্তি কোথায়।

4 comments:

  1. সুন্দর পর্যবেক্ষণ।

    ReplyDelete
  2. সুন্দর পর্যবেক্ষণ। দয়াকরে বাংলা ভাষায় লিখা কয়েকটি Subversion সংক্রান্ত বইয়ের নাম বলেন।এতে আমি উপকৃত হব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য।

      আমার জানা মতে সাবভার্সনের উপর বাংলা বই নেই। ইংরেজী বই-ই খুব সীমিত। আর কিছু বই আছে খোলা বাজারে পাওয়াও যায় না। নাম উচ্চারণ করলেও নেট-এ মার্কড হয়ে থাকবে। আসলে এটা এমন একটা সাবজেক্ট, যা কিনা সকলে জানলে এটা করা সম্ভব নয়। আর যারা এটা প্র্যাকটিস করে, তারা চাইবে না যে সাধারণ মানুষ এগুলির প্রয়োগ জানুক। আশা করি বুঝতে পারছেন।

      Delete