১৮ অগাস্ট ২০১৬
কনটেইনারে কি সুবিধা?
গভীর সমুদ্র বন্দরকে বুঝতে গেলে আমাদের কনটেইনার জাহাজের সুবিধা বুঝতে হবে। আর কনটেইনার জাহাজের সুবিধা বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে কন্টেইনার কি জিনিস। কন্টেইনার একটা স্টিলের বাক্স, যা কিনা পণ্য পরিবহণে কিছু সুবিধা দেয়। যেসব সুবিধা দেয়, তার মাঝে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনৈতিক সুবিধা। একটি কনটেইনারের মাঝে, বাক্স-ভর্তি করে পাঠানো হয় – এরকম অনেক পণ্য একত্রে ঠেঁসে দেয়া যায়। এতে একটা কনটেইনার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরালে আলাদা আলাদা করে অনেকগুলি বাক্স সরাতে হয় না। এতে পণ্য ওঠাতে-নামাতে সময়, শ্রম ও খরচ কম লাগে। প্রথমবার যখন কনটেইনার ব্যবস্থার প্রচলন হয়, তখন স্ট্যান্ডার্ড ২০ফিট বা ৪০ফিট কনটেইনারের মাপে কোন অবকাঠামোই তৈরি ছিল না। এগুলি ১৯৬০-এর দশক থেকে কয়েক যুগ ধরে তৈরি করা হয়েছে। এখন জাহাজ, মোটরযান, রেল – সকল পরিবহণই স্ট্যান্ডার্ড কনটেইনার ডিজাইন মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। যেমন কনটেইনার বহণ করতে রেলের আলাদা ‘ফ্ল্যাট-কার’ লাগে; রাস্তা দিয়ে নিতে লাগে সেমি-ট্রেইলার; আর কনটেইনার পরিবহণের আলাদা জাহাজ তো আছেই। তবে প্রথমবার কনটেইনার পরিবহণের জন্যে এগুলি তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল। তবে এখানে মূল চিন্তাটা হচ্ছে খরচ বাঁচানো – ১০টা বাক্সকে আলাদা পরিবহণ না করে ১টি বাক্সে পরিবহণ করা।
এই খরচ বাঁচানোর ফলে এক ধরনের Economy of Scale তৈরি হয়, যার ফলে পূর্বের ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহণ নতুন ব্যবস্থার সাথে আর পেরে ওঠে না। এখন এই কনটেইনার নামের অপেক্ষাকৃত বড় বাক্সখানা যে যত বেশি পরিমাণে একত্রে পরিবহণ করতে পারবে, তার খরচ ততোই কম পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, ২,৫০০ স্ট্যান্ডার্ড সাইজের কনটেইনার যে সাইজের জাহাজে পরিবহণ করা যায়, ৪,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে তার তুলনায় প্রতি কনটেইনারে ২৯.৭% খরচ কম পরে; ৬,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে ৪৫.৫% খরচ কম পরে; ১০,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে ৫০.২% খরচ কম পরে। ১৯৬৮ সালে Weser Express-এর ধারণক্ষমতা ছিল ৭৩৬ টিইউএস; ১৯৮১ সালে Frankfurt Express এটাকে নিয়ে গেল ৩,০৫০-এ; ১৯৯৭ সালে Susan Maersk ছিল ৮,৮৯০ টিইউএস; ২০০৩ সালে Gjertrud Maersk ছিল ১০,৫০০ টিইউএস; ২০০৬ সালে সবচাইতে বড় কনটেইনার জাহাজ ছিল Emma Maersk, ১৫,৫০০ টিইউএস; ২০১৫ সালে MSC Oscar-এর ধারণক্ষমতা ১৯,২২৪ টিইউএস। শেষ বারো বছরে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৮৩% এবং শেষ নয় বছরে ২৪% বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে! বর্তমানে ১৩,০০০ টিইউএস ধারণক্ষমতার বেশি কমপক্ষে ১১০টি জাহাজ সমুদ্রে রয়েছে। বর্তমানে বাল্ক বা খোলা পণ্য ছাড়া যত পণ্য রয়েছে, তার ৯০% পণ্যই কনটেইনারে পরিবহণ করা হয় – কারণ একটাই – খরচ কম। এখানে যে Economy of Scale তৈরি হচ্ছে, তার কারণে ছোট জাহাজ যারা অপারেট করে, তারা বড় জাহাজের সাথে প্রতিযোগিতায় পারবে না। একইভাবে যার বড় জাহাজের সংখ্যা বেশি থাকবে, সে কম সংখ্যক জাহাজ আছে এরকম কোম্পানিকে ব্যবসা থেকেই ছিটকে ফেলে দেবে। বড় কনটেইনার জাহাজগুলি নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করে; এই রুটগুলিকে লাইনার বলে। বড় কনটেইনার জাহাজের এই লাইনারগুলি এমন সব বন্দরে ভিড়ে, যেখানে পণ্যের যথেষ্ট আসা-যাওয়া রয়েছে। সেখানেই বড় জাহাজ ঢোকার ব্যবস্থা করতে হয়। এখন কনটেইনার কিভাবে ওঠা-নামা করানো হয়, সেটা বুঝতে হবে; তাহলে আমরা আমাদের বাস্তবতার সাথে কনটেইনারের বাস্তবতা মেলাতে পারবো।
বাংলাদেশের বন্দরের বাস্তবতা…
আমাদের দেশে বেশিরভাগ পণ্যই (প্রায় তিন-চতুর্থাংশ) ওঠানামা করা হয় বহির্নোঙ্গরে; অর্থাৎ সমুদ্রের মাঝখানে। বড় জাহাজ (৫০,০০০টন বা তারও বেশি) সেখানে আসার পরে নোঙ্গর করে। এরপর ছোট জাহাজ (৫০০টন থেকে ২,০০০ টন পর্যন্ত হয়), যেগুলিকে লাইটার জাহাজ বলে, সেগুলি বড় জাহাজের পাশে এসে ভিড়ে। তখন কোন একটা পদ্ধতি করে (পণ্যের ধরণের উপরে নির্ভর করে) সেই পণ্য ছোট লাইটার জাহাজে খালাশ করা হয়। লাইটার জাহাজ তখন হয় চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে মাল খালাশ করে অথবা নদীপথ ব্যবহার করে পণ্যের ব্যবহারকারীর কাছে (ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, বাঘাবাড়ি, চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, গোপালগঞ্জ, আশুগঞ্জ, এবং অন্যান্য স্থানে) সরাসরি পোঁছে যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই লাইটার জাহাজের চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরের চেহারাও দেখা লাগে না। নদীপথে বড় জাহাজের মালামাল খালাশ করে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানো খুবই সহজ একটা পদ্ধতি। বাংলাদেশে এরকম হাজার খানেক লাইটার জাহাজ রয়েছে। তবে এই পদ্ধতি সেসব দেশেই কাজ করবে যেখানে সমুদ্র থেকে নদীর মাধ্যমে কারখানা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানো যাবে। এক্ষেত্রে নাব্য নদী থাকলেই শুধু হবে না, নদীগুলি এমনমুখী হতে হবে, যাতে নদী দেশের অভ্যন্তরে মূল শিল্পাঞ্চলগুলিকে সমুদ্রের সাথে সরাসরি জুড়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের নদীগুলি এই দিক থেকে বিশ্বসেরা; সমুদ্র থেকে একেবারে গাছের শাখা-প্রশাখার মতো করে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর সবচাইতে বেশি নাব্য নদীপথ রয়েছে রাশিয়াতে। কিন্তু রাশিয়ার নদীগুলির একটিও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলিকে সমুদ্রের সাথে যুক্ত করেনা। নদী তো মনুষ্য-সৃষ্ট জিনিস নয় – সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জিনিস; রাশিয়া সেটা পায়নি। তাই সবচাইতে বিশাল (১ লক্ষ কিলোমিটারের বেশি; যেখানে বাংলাদেশে ৩ থেকে ৬ হাজার কিলোমিটার) নৌপথ থাকা সত্ত্বেও সেটা তাদের কাজে লাগে না।
এখন এভাবে কিন্তু সকল পণ্য খালাশ করা সম্ভব নয়। আবার অনেক পণ্যই খালাশ করা সম্ভব। আমাদের আমদানি পণ্যের চার ভাগের তিন ভাগ পণ্যই বাল্ক পণ্য, যা কিনা সমুদ্রের মাঝখানে লাইটার জাহাজে খালাশ করা যায়। ২০১৫-১৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ৫ কোটি ৩৭ লক্ষ টন পণ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে এর মাঝে যেসব পণ্য পরে – সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল (প্রায় ২৮%), জ্বালানি তেল (১১%-এর উপরে), গম (৭%), কয়লা (৪%), ঢেউটিনের কাঁচামাল স্টিল কয়েল (৪%), ভোজ্যতেল (৩%) – এগুলি মিলে প্রায় ৫০%-এর মতো পণ্য। এর বাইরে রয়েছে চাল, ডাল, পাথর, কেমিক্যাল, লবণ, অপরিশোধিত চিনি, তুলা, রাসায়নিক সার, স্ক্র্যাপ লোহা – এগুলির সবগুলিই ৫ লক্ষ টন থেকে ১০ লক্ষ টনের কম না, যদিও আলাদাভাবে শতাংশের হিসেবে খুব বড় কিছু নয়। এর বাইরে স্ক্র্যাপ জাহাজ রয়েছে, যেগুলি চট্টগ্রাম বন্দরে না গিয়ে একবারে সীতাকুন্ডে সমুদ্রতটে উঠিয়ে ফেলা হয়; এরকম জাহাজ থেকে আসে প্রায় ৩০ লক্ষ টন লোহা, যা উপরের হিসেবের বাইরে। এই বাল্ক পণ্যগুলির কিছু আবার জাহাজ জেটিতে এনে ক্রেনের মাধ্যমে খালাশ করা হয় – যেমন স্ক্র্যাপ লোহা। তবে বেশিরভাগ বাল্কই খালাশ হয় সমুদ্রের মাঝে। আর ইউরোপের জাহাজের বাজারে মন্দার পর থেকে এই খালাশ করা লাইটার জাহাজই এখন আমাদের জাহাজ নির্মান শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আগামী কয়েক বছরের মাঝে এই হাজার খানেক লাইটার জাহাজ প্রতিস্থাপন ছাড়াও নতুন ধরনের অনেক জাহাজ আমাদের তৈরি করতে হচ্ছে, যা কিনা আমদের ‘ব্লু ইকনমি’ এবং ‘ম্যারিটাইম নেশন’-এর ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বালানি তেল খালাশের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নামে একটি প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে কুতুবদিয়ার কাছাকাছি, যার মাধ্যমে সমুদ্রের মাঝ পর্যন্ত একটি পাইপ নিয়ে ভাসমান জেটিতে যুক্ত করা হবে। সেই জেটির পাশেই তেলবাহী বড় জাহাজ ভিড়বে। পাইপের মাধ্যমে পাম্প করে তেল সরাসরি চট্টগ্রামের স্টোরেজে চলে যাবে। এলনজি টার্মিনালর প্রজেক্টও এভাবেই তৈরি হচ্ছে – ভাসমান জেটিতে তরল গ্যাস খালাশ করার পরে ভাসমান প্রসেসিং সেন্টারে সেটা গ্যাসে রূপান্তরিত করে পাইপের মাধ্যমে গ্যাস দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়ে যাবে। এগুলিতে লাইটার জাহাজের ব্যবহার থাকছে না।
চট্টগ্রাম বন্দর একটি প্রাকৃতিক বন্দর। এখানে কৃত্রিমভাবে কোন কিছুই তৈরি করতে হয়নি জেটিগুলি ছাড়া। এখানে ৯.৫ মিটার ড্রাফটের এবং ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজ ঢুকতে পারে। প্রায় ৩৫,০০০ টনের ক্ষমতার জাহাজ এই সাইজে ফিট করে; এর চাইতে বড় হলে পারে না। (কনটেইনার জাহাজ আসতে পারে ১,৫০০ টিইউএস সাইজের।) বাল্ক পণ্য নিয়ে যেসব জাহাজ আসে তার বেশিরভাগই এর চাইতে অনেক বড়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬-এর অগাস্টে পায়রা বন্দরে যে জাহাজের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর পাথর নিয়ে আসা হয়েছে, তা ৫৩,০০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এর চাইতে আরও অনেক বড় জাহাজ নিয়মিত খালাশ করা হয়। আবুল খায়ের গ্রুপের একটি জাহাজ রয়েছে ৫৭,০০০ টনের। এখানে মূল বিষয়টি হলো – এই বড় আকৃতির জাহাজগুলিও বাংলাদেশে খালাশ করা যাচ্ছে। ডীপ সী পোর্ট যদি আমাদের না-ই থাকবে, তাহলে এত্তোবড় জাহাজ আমরা কি করে খালাশ করলাম?? মালামাল খালাশ করতে আমাদের জেটি লাগেনা, এটা আমাদের নদী সম্পদের প্রাচুর্য্যের কারণে, বন্দরের অসুবিধার কারণে নয়। অন্য দেশের এই সুবিধা নেই বলে আমরা কি আমাদের এই সুবিধাকে unfair advantage মনে করবো?? সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই সুবিধা দিয়েছেন – এটা অন্যদের ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু আমরা সেটা না বুঝে অন্যের প্ররোচনাতে পথভ্রষ্ট হবো কেন? এভাবে মালামাল খালাশ দেখতে sexy নয়, কিন্তু এটা অনেক বেশি কার্যকর। এই পণ্যগুলি সব মিলে যদি বন্দরে নামানো হতো, তাহলে বন্দর যে হিমসিম খেয়ে উঠতো সেটাই শুধু নয়, সেই মালামাল ঢাকা এবং এর আশেপাশের শিল্পাঞ্চলে আনতে হতো রাস্তা এবং রেল ব্যবহার করে, যা কিনা নৌপথের চাইতে অনেক বেশি ব্যয়সাধ্য। বর্তমানে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোট কনটেইনার জাহাজের (১৪০ থেকে ১৮০ টিইউএস) মাধ্যমে ঢাকার আশেপাশে ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল তৈরি করে কনটেইনার নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি, যা খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গভীর সমুদ্র বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে শুরু করলে ছোট জাহাজের স্পেস কতটুকু থাকবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। মানে আবারও সেই রাস্তার উপরেই চাপ দেয়া। আর আমাদের নদীমাতৃক দেশে রাস্তা এবং রেলপথ তৈরি করতে প্রচুর সেতু তৈরি করতে হয়; আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তা তাড়াতাড়ি নষ্টও হয়ে যায়। রাস্তা তৈরির পুরো বিটুমিন আমদানি-নির্ভর।
এই বাল্ক পণ্যগুলি ছাড়া যে পণ্যগুলি রয়েছে, সেগুলি খালাশ করতে জাহাজকে জেটির পাশে আসতে হয়। যেমন মোটরগাড়ি; যা আনা হয় roll-on/roll-off জাহাজে, যেগুলিতে গাড়ি নিজের চাকায় চালিয়ে জাহাজে ঢোকানো এবং বের করা হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারি রয়েছে কিছু, যেগুলি জেটি ছাড়া খালাশ করা যায় না। আর রয়েছে কনটেইনার, যা খালাশ করতে জেটি লাগে; লাগে ক্রেন। তার মানে কনটেইনার খালাশ করতে বা কনটেইনার ভরতে জাহাজের সাইজের সাথে বন্দরকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আমাদের চট্টগ্রাম, মংলা এবং পায়রা বন্দরের ‘সমস্যা’ এখানেই। এটা আসলে কতোটা বড় ‘সমস্যা’, সেটা এখন আলোচনা করা যাক।
ডিমের সাইজ অনুযায়ী মুরগি?
উপরে কনটেইনার জাহাজের যে লাইনারের কথা বলেছি, সেগুলি হলো শহরের বাস সার্ভিসের মতো। কয়েকটা বিশেষ স্টেপেজেই থামবে। আপনাকে বাসায় যেতে হলে বাস স্টপেজ থেকে পায়ে হাঁটতে হবে বা রিক্সা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমি যদি বলি যে বাসকে আমার বাড়ি পর্যন্ত আসতে হবে, তাহলে আমার বাড়ির দরজা পর্যন্ত রাস্তা বাস আসার মতো চওড়া করতে হবে। আর আমাকে শিওর করতে হবে যে আমার বাড়ি থেকে বাস ভর্তি করে মানুষ উঠবে, শুধু এক-দুইজন নয়। আমি যদি আজকে এই বাস আমার বাসা পর্যন্ত আনতে গিয়ে রাস্তা প্রশস্ত করি, তাহলে আমাকে শিওর হতে হবে যে ভবিষ্যতে সেই বাস আবার অন্য কোন যুক্তি দেখিয়ে আমার বাসা পর্যন্ত আসা বন্ধ করে দেবে না। কারণ সেই বাস কেনার সাধ্য আমার নেই; অন্যের বাসের উপরেই আমার নির্ভর করতে হবে। আমি নিজে কিনলে ছোট গাড়ি কিনবো, যে দিয়ে যাতায়াত করলে খরচ অনেক বেশি পড়ে যাবে। অর্থাৎ আমার বাসা পর্যন্ত বাসের রুট আনতে হলে ওই ব্যাটা বাস-অলাদের Economy of Scale-এর সাথে আমাকে খাপ খাওয়াতে হবে। মানে আমাকে জাহাজের সাথে মিলিয়ে বন্দর বানাতে হবে, যা কিনা ডিমের সাইজ মাথায় রেখে মুরগি ডিজাইন করার মতো হয়ে যাচ্ছে!!
বিশাল আকৃতির এই জাহাজগুলিকে বন্দরে ঢোকানোর জন্যে বিপুল পরিমাণ ড্রেজিং করতে হচ্ছে; বিশাল খরচ করে তৈরি করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। অতিরিক্ত ড্রেজিং-এর কারণে পরিবেশের বারোটা বাজছে। জার্মানির এলব নদীতে রয়েছে ইউরোপের অন্যতম বড় বন্দর হামবুর্গ। জোয়াড়ের সময়ে এখানে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারে, যা মোটেই কম নয়। আমাদের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্যেও এমনই কিছু পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু হামবুর্গ বন্দরের লোকজন চাইছিলেন এখানে আরও বড় জাহাজ আসুক, নাহলে বন্দর হিসেবে হামবুর্গের গুরুত্ব কমে যাবে। নতুন তৈরি করা বিশাল জাহাজগুলি অন্য বন্দরে চলে যাবে। আরও বড় জাহাজ আনতে গেলে বন্দরের গভীরতা বাড়ালেই শুধু হচ্ছে না, চ্যানেলের প্রশস্ততাও বাড়াতে হবে, নাহলে জাহাজ ঘোরানো সম্ভব হবে না। হামবুর্গে এই পরিকল্পনার প্রতিবাদে পরিবেশ আন্দোলন গ্রুপগুলি আদালত পর্যন্ত গিয়েছে; কারণ এই বিশাল ড্রেজিং-এর ফলে পরিবেশগত প্রভাব মোটেই অনুকূল হবে না। তবে যেহেতু পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ বন্দরই বেসরকারি মালিকানায় রয়েছে, তাই অর্থই যে সকল চিন্তার মূলে থাকবে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাতে পড়ার পর থেকে খরচ কমানোর চিন্তা নেতৃত্বে থাকা কোম্পানিগুলিকে আরও বেশি পেয়ে বসেছে। জাহাজের মাপ অনুযায়ী তারা সকলকে বন্দর তৈরি করে নিতে বলছে, যদি তারা চায় যে তাদের দেশে ঐসব বড় কনটেইনার জাহাজগুলি আসতে হবে। তবে বন্দর তৈরি করে ফেলার পরে নতুন কোন ফ্যাক্টর এখানে চলে আসবে না – এই প্রতিশ্রুতি জাহাজ কোম্পানিরা দেবে না। আর সেই গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে গিয়ে আবার ভূরাজনৈতিক রেষারেষিতে পড়েছে অনেক দেশ। পাকিস্তানে, শ্রীলংকায় আর মিয়ানমারে বন্দর বানিয়েছে চীন; ইরানে বন্দর বানাচ্ছে ভারত। জাহাজ কোম্পানিগুলির টাকার চিন্তাকে প্রাধান্য দেবার ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই উদ্ভট পরিস্থিতি। বাংলাদেশেও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে কম ঠেলাঠেলি হয়নি চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে; এখনও চলছে। কিন্তু কেউ একবারও বললো না যে এই বন্দর বানাতে তো ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে; জাহাজ কোম্পানিগুলি বরং কয়টাদিন কম লাভে ব্যবসা করে না কেন? অত বড় জাহাজ না বানিয়ে একটু ছোট জাহাজে কি একেবারেই হবে না? খরচ বাঁচাতে গিয়ে গত কয়েক বছরে শীর্ষ বিশ জাহাজ কোম্পানির মাঝে কয়েকটি merger বা একত্রীকরণ হয়েছে। পরিস্থিতি যেভাবে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে গুটি কয়েক কোম্পানির হাতেই দুনিয়ার সকল বাণিজ্য চলে যাবে। কারণ সেই Economy of Scale ছাড়া তো সে আর কোনকিছুকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। তার লাভ তো সে কমাবে না কিছুতেই!
যুক্তি আসবে যে আমাদের দেশে যেভাবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়ছে, তাতে আমরা ডীপ সী পোর্ট তৈরি না করে কি করে পারবো? কথা হচ্ছে কনটেইনার ওঠাতে-নামাতে কনটেইনার টার্মিনাল লাগে, ডীপ সী পোর্ট লাগে না। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার টার্মিনাল ছাড়াও আমরা মংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং-এর ব্যবস্থা করতে পারি অতি সহজেই (পশ্চিমা কোম্পানির হাতে বন্দর তুলে না দিয়ে); সেটা গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো এতো খরচ হবে না। সেখানে বর্তমানে যে সাইজের ফীডার ভেসেল (১,০০০ থেকে ১,৫০০ টিইউএস) দিয়ে কনটেইনার আনা-নেওয়া হচ্ছে, সেটাই চলবে। আর আমরা নিজেদের দেশে ওই সাইজের কিছু জাহাজ তৈরি করে সমুদ্রে চালাতে পারবো। সেখানে নাবিক থাকবে আমাদের নিজেদের লোক। জাহাজ তৈরির এই অর্ডারগুলিও পাবে দেশের শিপইয়ার্ড। এটাই হবে ম্যারিটাইম নেশনের বুনিয়াদ। বর্তমানে বিদেশী জাহাজ দিয়েই আমরা সকল বাণিজ্য করছি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসেবে পণ্য আমদানিতে খরচ হয়েছে মোট ৩৯.৭১ বিলিয়ন ডলার, আর রপ্তানি হয়েছে ৩৩.৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য (মোট রপ্তানি আয় যদিও ৩৪.২৪ বিলিয়ন)। দু’টা মিলিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য হয় ৭৩.১৫ বিলিয়ন, যার প্রায় পুরোটাই বিদেশী জাহাজের উপর ভর করে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসেবে বলা হয়েছে যে পণ্যের মূল্যের কমপক্ষে ১০% পর্যন্ত খরচ হয় শিপিং-এ। এই হিসেবে আমরা গত অর্থবছরে কমপক্ষে ৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা দিয়েছি বিদেশী শিপিং কোম্পানিগুলিকে!! আমরা নিজেরা নিজেদের মার্চেন্ট ফ্লিট তৈরি করতে চাইলে বিদেশী শিপিং কোম্পানিগুলি এর বিরুদ্ধে নামবে নিঃসন্দেহে। এই দুর্মূল্য বাজারে কেউ ৭ বিলিয়ন ডলারের লোভ সামলাতে পারবে না। অন্ততঃ যাদের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আরও টাকা উপার্জন, তার কাছে এটা জীবন-মরণের মতো ব্যাপার।
আদৌ কি আমাদের কোন লাভের আশা ছিল?
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করলে কি আমরা একটা জাহাজ লাইনার কোম্পানি তৈরি করতে পারবো? ওই ২০ফিট ৪০ফিট বাক্সের উপরে আমাদের একটা নাম কি সেঁটে দিতে পারবো? কয়েক লক্ষ টনের গোটা পাঁচেক জাহাজ বানাতে পারবো? এই উত্তরগুলি যদি ‘সম্ভবত না’ হয়, তাহলে কোন হিসেবে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়ে আমরা গভীর সমুদ্র বন্দর করতে চাইছি? জাহাজ কোম্পানিগুলির Economy of Scale-এ সুবিধা দেবার জন্যে? কনটেইনারের ভেতরে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয় সেগুলির সুবিধার্থে তো, তাই না? তো কতো টাকার সুবিধা আমরা পাবো, যেটার জন্যে আমাদের সেই বন্দর বানিয়ে প্রতি বছর মেইনটেন্যান্স খরচ উসুল হবে? আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টস (যা কিনা নিজেই আমদানি-নির্ভর) থেকে আমরা কতটা value addition পাই (এবং ভবিষ্যতেও পেতে থাকবো) যেটা আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দরের খরচ উঠিয়ে দেবে? দর্জির মাইনে দিয়ে কি ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধ করা যাবে (সুদ সহ)?
এরপর এই গভীর সমুদ্রবন্দর প্রজেক্টের রয়েছে কিছু বাই-প্রডাক্ট। যেমন কোন জাহাজকেই আর কলম্বো বা সিঙ্গাপুর বা কেলাং যেতে-আসতে হবে না; বড় জাহাজ কোম্পানির দৈত্যাকৃতি জাহাজগুলিই আমাদের এখানে চলে আসবে। অর্থাৎ কোন জাহাজে আর বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ ওড়ানোর দরকার নেই! আমাদের নিজেদের কোন জাহাজ আর থাকবে না। এখনও খুব একটা আছে যে তা নয়, তবে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে আর থাকার প্রশ্নও থাকবে না। আমরা নাবিক তৈরি করবো বিদেশী জাহাজের জন্যে, যদি তারা কোন অভিজ্ঞতা ছাড়া বাংলাদেশী নাবিক নিতে ইচ্ছুক হয় (কারণ হাতেকলমে শেখানোর জন্যেও আমাদের কোন বাণিজ্য জাহাজ থাকবে না)। যারা বড় কোম্পানি তারাই বাংলাদেশের বন্দরে জাহাজ ঢোকাবে আর বের করবে। বাংলাদেশের কোন জাহাজ সমুদ্রে না থাকা মানে গুডবাই ‘ব্লু ইকনমি’ এবং ‘ম্যারিটাইম নেশন’। আমরা শুধু যেটা করতে পারবো তা হলো বড় কোম্পানিগুলির জন্যে গতর খেটে জাহাজ তৈরি করে দিতে পারবো। আমাদের জাহাজ তৈরি শিল্পের অবস্থাও হবে বাঙ্গালীর চিংড়ি চাষের মতো – এত্তো এত্তো চিংড়ি সে উতপাদন করে, কিন্তু সবটাই সে নিজে না খেয়ে অন্য জাতির কাছে বিক্রি করে দেয় – শুধুমাত্র ক’টা টাকা পাবে বলে। আহা রে!
আমরা এই খেলাটা ধরতে পারবো কবে?
কোম্পানির লোগো লাগানো ওই বাক্সগুলি কতো শক্তিশালী তাই না? আসলেই কি তাই? না, তা নয়। ওই বাক্সকে আবর্তে যে চিন্তাটা, সেটা হচ্ছে শক্তিশালী। বাক্সটা তৈরি করা কতো সহজ; কিন্তু ইচ্ছে করলেই সেটা তৈরি করা যায় না। কি অদ্ভূত! চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশগুলিও এই বাক্স ওঠা-নামার বন্দর তৈরি করতে গিয়ে মারামারি করছে! এই বাক্সের চিন্তা এসেছে ১৯৬০-এর দশক থেকে, যখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার দখল নিতে থাকে। কনটেইনার কোম্পানিগুলির বেশিরভাগই গত দুই-তিন দশকে তৈরি হয়েছে; পুরোনো কোম্পানি আছে খুব কমই – যেমন APM-Maersk, CMA CGM, Hapag-Lloyd, APL এবং জাপানি দুই-একটা। বাকি বেশিরভাগই, যেমন MSC, Evergreen, COSCO, CSCL, Hanjin ইত্যাদি – এ এসবই তৈরি হয়েছে গত কয়েক দশকে। পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সবচাইতে বেশি, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এখানে মাত্র একটি – APL, তা-ও আবার সেটা অত বড় নয়, তা-ও আবার সেটা সিঙ্গাপুরে বিক্রি হয়ে গেছে। তার মানে কি এই যে যেই সমুদ্র বাণিজের দখল নিতে ইউরোপিয়রা কয়েক’শ বছর যুদ্ধ করেছে সেই সমুদ্র বাণিজ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদাসীন? প্রশ্নই আসে না। পরাশক্তি তার শক্তির কিছু স্থানে ছাড় দেবে না; আর সেগুলির একটি হচ্ছে সমুদ্র বাণিজ্য। মার্কিনীরা সমুদ্রের নিয়মগুলি ঠিক করে দেয় শুধু। বাকিরা সবাই সেই নিয়ম মেনে চলে। এবং নিয়মের দাস হিসেবে থাকে। এবং সেই নিয়মকে ধর্মগ্রন্থরূপে ধরে নিয়ে নিজেদের মাঝে প্রভাবের লড়াই করে চলে – যেমনটি চীন এবং ভারত করছে।
আসলে বাংলাদেশের পুরো সমুদ্র উপকূলই গভীর সমুদ্র বন্দর – শুধুমাত্র ভৌগোলিক কারণে, যা কিনা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। বাংলাদেশে নদীগুলি না থাকলে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমরা পদ্মা সেতুর জন্যে ৫৩,০০০ টনের জাহাজে পাথর এনে খালাশ করতে পারতাম না – এটা আমরা কতটুকু বুঝি?? ব্রিটিশরা যে এই এলাকার maritime potential উপলব্ধি করেছিল, সেটা এর আগেই লিখেছি। আমরা যতদিন চিন্তাহীনভাবে অন্যের কথায় নাচতে থাকবো, ততোদিন আমরা অন্যের ক্রীড়নকই থেকে যাবো। কনটেইনার খারাপ জিনিস নয়, কিন্তু যে চিন্তাটা কনটেইনারের সাথে আসে, সেই চিন্তাখানা বুঝতে হবে। কনটেইনারকে না বুঝে কনটেইনার পোর্ট নিয়ে বেহুদা লম্ফ-ঝম্ফ বোকার স্বর্গে বসবাস। কনটেইনার কোম্পানিগুলি কি আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে বানাতে তাদের কোন নীতিতে পরিবর্তন আনবে না? কে গ্যারান্টি দিচ্ছে যে ১০ বিলিয়ন খরচ করে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে করতেই সেটা obsolete হয়ে যাবে না?? যে বাক্সের মোহ আমাদের দেখানো হচ্ছে, সেটার মাঝে আমাদের ব্লু ইকনমি নেই, ম্যারিটাইম দেশ নেই; রয়েছে ওই সমুদ্রের মধ্যিখানে। বাক্সের মোহে আমরা শুধু আমাদের সমুদ্রাভিযানকে পিছিয়েই দেব না, আমাদের দাসত্বের শৃংখলকে চিরস্থায়ী করে নেব!
বাক্সে বাক্সে বন্দী বাক্স
বাক্সে বাক্সে বন্দী বাসা
বাক্স দিয়ে বাক্স গড়া
বাক্সতে সব স্বপ্ন আশা।।
গভীর সমুদ্রবন্দরের ভিত্তিতেই যে আছে কনটেইনার নামের বাক্সটি - সেটা আসলে কি জিনিস? আমরা কি সেই বাক্সের গুরুত্ব বুঝি? |
কনটেইনারে কি সুবিধা?
গভীর সমুদ্র বন্দরকে বুঝতে গেলে আমাদের কনটেইনার জাহাজের সুবিধা বুঝতে হবে। আর কনটেইনার জাহাজের সুবিধা বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে কন্টেইনার কি জিনিস। কন্টেইনার একটা স্টিলের বাক্স, যা কিনা পণ্য পরিবহণে কিছু সুবিধা দেয়। যেসব সুবিধা দেয়, তার মাঝে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনৈতিক সুবিধা। একটি কনটেইনারের মাঝে, বাক্স-ভর্তি করে পাঠানো হয় – এরকম অনেক পণ্য একত্রে ঠেঁসে দেয়া যায়। এতে একটা কনটেইনার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরালে আলাদা আলাদা করে অনেকগুলি বাক্স সরাতে হয় না। এতে পণ্য ওঠাতে-নামাতে সময়, শ্রম ও খরচ কম লাগে। প্রথমবার যখন কনটেইনার ব্যবস্থার প্রচলন হয়, তখন স্ট্যান্ডার্ড ২০ফিট বা ৪০ফিট কনটেইনারের মাপে কোন অবকাঠামোই তৈরি ছিল না। এগুলি ১৯৬০-এর দশক থেকে কয়েক যুগ ধরে তৈরি করা হয়েছে। এখন জাহাজ, মোটরযান, রেল – সকল পরিবহণই স্ট্যান্ডার্ড কনটেইনার ডিজাইন মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। যেমন কনটেইনার বহণ করতে রেলের আলাদা ‘ফ্ল্যাট-কার’ লাগে; রাস্তা দিয়ে নিতে লাগে সেমি-ট্রেইলার; আর কনটেইনার পরিবহণের আলাদা জাহাজ তো আছেই। তবে প্রথমবার কনটেইনার পরিবহণের জন্যে এগুলি তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল। তবে এখানে মূল চিন্তাটা হচ্ছে খরচ বাঁচানো – ১০টা বাক্সকে আলাদা পরিবহণ না করে ১টি বাক্সে পরিবহণ করা।
এই খরচ বাঁচানোর ফলে এক ধরনের Economy of Scale তৈরি হয়, যার ফলে পূর্বের ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহণ নতুন ব্যবস্থার সাথে আর পেরে ওঠে না। এখন এই কনটেইনার নামের অপেক্ষাকৃত বড় বাক্সখানা যে যত বেশি পরিমাণে একত্রে পরিবহণ করতে পারবে, তার খরচ ততোই কম পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, ২,৫০০ স্ট্যান্ডার্ড সাইজের কনটেইনার যে সাইজের জাহাজে পরিবহণ করা যায়, ৪,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে তার তুলনায় প্রতি কনটেইনারে ২৯.৭% খরচ কম পরে; ৬,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে ৪৫.৫% খরচ কম পরে; ১০,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে ৫০.২% খরচ কম পরে। ১৯৬৮ সালে Weser Express-এর ধারণক্ষমতা ছিল ৭৩৬ টিইউএস; ১৯৮১ সালে Frankfurt Express এটাকে নিয়ে গেল ৩,০৫০-এ; ১৯৯৭ সালে Susan Maersk ছিল ৮,৮৯০ টিইউএস; ২০০৩ সালে Gjertrud Maersk ছিল ১০,৫০০ টিইউএস; ২০০৬ সালে সবচাইতে বড় কনটেইনার জাহাজ ছিল Emma Maersk, ১৫,৫০০ টিইউএস; ২০১৫ সালে MSC Oscar-এর ধারণক্ষমতা ১৯,২২৪ টিইউএস। শেষ বারো বছরে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৮৩% এবং শেষ নয় বছরে ২৪% বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে! বর্তমানে ১৩,০০০ টিইউএস ধারণক্ষমতার বেশি কমপক্ষে ১১০টি জাহাজ সমুদ্রে রয়েছে। বর্তমানে বাল্ক বা খোলা পণ্য ছাড়া যত পণ্য রয়েছে, তার ৯০% পণ্যই কনটেইনারে পরিবহণ করা হয় – কারণ একটাই – খরচ কম। এখানে যে Economy of Scale তৈরি হচ্ছে, তার কারণে ছোট জাহাজ যারা অপারেট করে, তারা বড় জাহাজের সাথে প্রতিযোগিতায় পারবে না। একইভাবে যার বড় জাহাজের সংখ্যা বেশি থাকবে, সে কম সংখ্যক জাহাজ আছে এরকম কোম্পানিকে ব্যবসা থেকেই ছিটকে ফেলে দেবে। বড় কনটেইনার জাহাজগুলি নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করে; এই রুটগুলিকে লাইনার বলে। বড় কনটেইনার জাহাজের এই লাইনারগুলি এমন সব বন্দরে ভিড়ে, যেখানে পণ্যের যথেষ্ট আসা-যাওয়া রয়েছে। সেখানেই বড় জাহাজ ঢোকার ব্যবস্থা করতে হয়। এখন কনটেইনার কিভাবে ওঠা-নামা করানো হয়, সেটা বুঝতে হবে; তাহলে আমরা আমাদের বাস্তবতার সাথে কনটেইনারের বাস্তবতা মেলাতে পারবো।
যে লাইটার জাহাজগুলি বিশাল জাহাজগুলিকে আনলোড করে ফেলছে, সেগুলিকে আমরা কেন গুরুত্ব দিই না? পশ্চিমা দেশে এগুলি ব্যবহার করার সুযোগ নেই বলে? তাহলে আমরা এগুলি ব্যবহার করলে কার সমস্যা? |
বাংলাদেশের বন্দরের বাস্তবতা…
আমাদের দেশে বেশিরভাগ পণ্যই (প্রায় তিন-চতুর্থাংশ) ওঠানামা করা হয় বহির্নোঙ্গরে; অর্থাৎ সমুদ্রের মাঝখানে। বড় জাহাজ (৫০,০০০টন বা তারও বেশি) সেখানে আসার পরে নোঙ্গর করে। এরপর ছোট জাহাজ (৫০০টন থেকে ২,০০০ টন পর্যন্ত হয়), যেগুলিকে লাইটার জাহাজ বলে, সেগুলি বড় জাহাজের পাশে এসে ভিড়ে। তখন কোন একটা পদ্ধতি করে (পণ্যের ধরণের উপরে নির্ভর করে) সেই পণ্য ছোট লাইটার জাহাজে খালাশ করা হয়। লাইটার জাহাজ তখন হয় চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে মাল খালাশ করে অথবা নদীপথ ব্যবহার করে পণ্যের ব্যবহারকারীর কাছে (ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, বাঘাবাড়ি, চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, গোপালগঞ্জ, আশুগঞ্জ, এবং অন্যান্য স্থানে) সরাসরি পোঁছে যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই লাইটার জাহাজের চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরের চেহারাও দেখা লাগে না। নদীপথে বড় জাহাজের মালামাল খালাশ করে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানো খুবই সহজ একটা পদ্ধতি। বাংলাদেশে এরকম হাজার খানেক লাইটার জাহাজ রয়েছে। তবে এই পদ্ধতি সেসব দেশেই কাজ করবে যেখানে সমুদ্র থেকে নদীর মাধ্যমে কারখানা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানো যাবে। এক্ষেত্রে নাব্য নদী থাকলেই শুধু হবে না, নদীগুলি এমনমুখী হতে হবে, যাতে নদী দেশের অভ্যন্তরে মূল শিল্পাঞ্চলগুলিকে সমুদ্রের সাথে সরাসরি জুড়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের নদীগুলি এই দিক থেকে বিশ্বসেরা; সমুদ্র থেকে একেবারে গাছের শাখা-প্রশাখার মতো করে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর সবচাইতে বেশি নাব্য নদীপথ রয়েছে রাশিয়াতে। কিন্তু রাশিয়ার নদীগুলির একটিও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলিকে সমুদ্রের সাথে যুক্ত করেনা। নদী তো মনুষ্য-সৃষ্ট জিনিস নয় – সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জিনিস; রাশিয়া সেটা পায়নি। তাই সবচাইতে বিশাল (১ লক্ষ কিলোমিটারের বেশি; যেখানে বাংলাদেশে ৩ থেকে ৬ হাজার কিলোমিটার) নৌপথ থাকা সত্ত্বেও সেটা তাদের কাজে লাগে না।
এখন এভাবে কিন্তু সকল পণ্য খালাশ করা সম্ভব নয়। আবার অনেক পণ্যই খালাশ করা সম্ভব। আমাদের আমদানি পণ্যের চার ভাগের তিন ভাগ পণ্যই বাল্ক পণ্য, যা কিনা সমুদ্রের মাঝখানে লাইটার জাহাজে খালাশ করা যায়। ২০১৫-১৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ৫ কোটি ৩৭ লক্ষ টন পণ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে এর মাঝে যেসব পণ্য পরে – সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল (প্রায় ২৮%), জ্বালানি তেল (১১%-এর উপরে), গম (৭%), কয়লা (৪%), ঢেউটিনের কাঁচামাল স্টিল কয়েল (৪%), ভোজ্যতেল (৩%) – এগুলি মিলে প্রায় ৫০%-এর মতো পণ্য। এর বাইরে রয়েছে চাল, ডাল, পাথর, কেমিক্যাল, লবণ, অপরিশোধিত চিনি, তুলা, রাসায়নিক সার, স্ক্র্যাপ লোহা – এগুলির সবগুলিই ৫ লক্ষ টন থেকে ১০ লক্ষ টনের কম না, যদিও আলাদাভাবে শতাংশের হিসেবে খুব বড় কিছু নয়। এর বাইরে স্ক্র্যাপ জাহাজ রয়েছে, যেগুলি চট্টগ্রাম বন্দরে না গিয়ে একবারে সীতাকুন্ডে সমুদ্রতটে উঠিয়ে ফেলা হয়; এরকম জাহাজ থেকে আসে প্রায় ৩০ লক্ষ টন লোহা, যা উপরের হিসেবের বাইরে। এই বাল্ক পণ্যগুলির কিছু আবার জাহাজ জেটিতে এনে ক্রেনের মাধ্যমে খালাশ করা হয় – যেমন স্ক্র্যাপ লোহা। তবে বেশিরভাগ বাল্কই খালাশ হয় সমুদ্রের মাঝে। আর ইউরোপের জাহাজের বাজারে মন্দার পর থেকে এই খালাশ করা লাইটার জাহাজই এখন আমাদের জাহাজ নির্মান শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আগামী কয়েক বছরের মাঝে এই হাজার খানেক লাইটার জাহাজ প্রতিস্থাপন ছাড়াও নতুন ধরনের অনেক জাহাজ আমাদের তৈরি করতে হচ্ছে, যা কিনা আমদের ‘ব্লু ইকনমি’ এবং ‘ম্যারিটাইম নেশন’-এর ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বালানি তেল খালাশের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নামে একটি প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে কুতুবদিয়ার কাছাকাছি, যার মাধ্যমে সমুদ্রের মাঝ পর্যন্ত একটি পাইপ নিয়ে ভাসমান জেটিতে যুক্ত করা হবে। সেই জেটির পাশেই তেলবাহী বড় জাহাজ ভিড়বে। পাইপের মাধ্যমে পাম্প করে তেল সরাসরি চট্টগ্রামের স্টোরেজে চলে যাবে। এলনজি টার্মিনালর প্রজেক্টও এভাবেই তৈরি হচ্ছে – ভাসমান জেটিতে তরল গ্যাস খালাশ করার পরে ভাসমান প্রসেসিং সেন্টারে সেটা গ্যাসে রূপান্তরিত করে পাইপের মাধ্যমে গ্যাস দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়ে যাবে। এগুলিতে লাইটার জাহাজের ব্যবহার থাকছে না।
চট্টগ্রাম বন্দর একটি প্রাকৃতিক বন্দর। এখানে কৃত্রিমভাবে কোন কিছুই তৈরি করতে হয়নি জেটিগুলি ছাড়া। এখানে ৯.৫ মিটার ড্রাফটের এবং ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজ ঢুকতে পারে। প্রায় ৩৫,০০০ টনের ক্ষমতার জাহাজ এই সাইজে ফিট করে; এর চাইতে বড় হলে পারে না। (কনটেইনার জাহাজ আসতে পারে ১,৫০০ টিইউএস সাইজের।) বাল্ক পণ্য নিয়ে যেসব জাহাজ আসে তার বেশিরভাগই এর চাইতে অনেক বড়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬-এর অগাস্টে পায়রা বন্দরে যে জাহাজের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর পাথর নিয়ে আসা হয়েছে, তা ৫৩,০০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এর চাইতে আরও অনেক বড় জাহাজ নিয়মিত খালাশ করা হয়। আবুল খায়ের গ্রুপের একটি জাহাজ রয়েছে ৫৭,০০০ টনের। এখানে মূল বিষয়টি হলো – এই বড় আকৃতির জাহাজগুলিও বাংলাদেশে খালাশ করা যাচ্ছে। ডীপ সী পোর্ট যদি আমাদের না-ই থাকবে, তাহলে এত্তোবড় জাহাজ আমরা কি করে খালাশ করলাম?? মালামাল খালাশ করতে আমাদের জেটি লাগেনা, এটা আমাদের নদী সম্পদের প্রাচুর্য্যের কারণে, বন্দরের অসুবিধার কারণে নয়। অন্য দেশের এই সুবিধা নেই বলে আমরা কি আমাদের এই সুবিধাকে unfair advantage মনে করবো?? সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই সুবিধা দিয়েছেন – এটা অন্যদের ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু আমরা সেটা না বুঝে অন্যের প্ররোচনাতে পথভ্রষ্ট হবো কেন? এভাবে মালামাল খালাশ দেখতে sexy নয়, কিন্তু এটা অনেক বেশি কার্যকর। এই পণ্যগুলি সব মিলে যদি বন্দরে নামানো হতো, তাহলে বন্দর যে হিমসিম খেয়ে উঠতো সেটাই শুধু নয়, সেই মালামাল ঢাকা এবং এর আশেপাশের শিল্পাঞ্চলে আনতে হতো রাস্তা এবং রেল ব্যবহার করে, যা কিনা নৌপথের চাইতে অনেক বেশি ব্যয়সাধ্য। বর্তমানে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোট কনটেইনার জাহাজের (১৪০ থেকে ১৮০ টিইউএস) মাধ্যমে ঢাকার আশেপাশে ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল তৈরি করে কনটেইনার নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি, যা খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গভীর সমুদ্র বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে শুরু করলে ছোট জাহাজের স্পেস কতটুকু থাকবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। মানে আবারও সেই রাস্তার উপরেই চাপ দেয়া। আর আমাদের নদীমাতৃক দেশে রাস্তা এবং রেলপথ তৈরি করতে প্রচুর সেতু তৈরি করতে হয়; আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তা তাড়াতাড়ি নষ্টও হয়ে যায়। রাস্তা তৈরির পুরো বিটুমিন আমদানি-নির্ভর।
এই বাল্ক পণ্যগুলি ছাড়া যে পণ্যগুলি রয়েছে, সেগুলি খালাশ করতে জাহাজকে জেটির পাশে আসতে হয়। যেমন মোটরগাড়ি; যা আনা হয় roll-on/roll-off জাহাজে, যেগুলিতে গাড়ি নিজের চাকায় চালিয়ে জাহাজে ঢোকানো এবং বের করা হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারি রয়েছে কিছু, যেগুলি জেটি ছাড়া খালাশ করা যায় না। আর রয়েছে কনটেইনার, যা খালাশ করতে জেটি লাগে; লাগে ক্রেন। তার মানে কনটেইনার খালাশ করতে বা কনটেইনার ভরতে জাহাজের সাইজের সাথে বন্দরকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আমাদের চট্টগ্রাম, মংলা এবং পায়রা বন্দরের ‘সমস্যা’ এখানেই। এটা আসলে কতোটা বড় ‘সমস্যা’, সেটা এখন আলোচনা করা যাক।
বড় বড় জাহাজ কোম্পানিগুলি তাদের জাহাজের আকৃতি বড় করছে প্রতি নিয়ত। আর সারা দুনিয়ার মানুষকে বলে দিচ্ছে বন্দরের সাইজ বড় করার জন্যে। তাহলে গভীর সমুদ্র বন্দর কার সুবিধার জন্যে? |
ডিমের সাইজ অনুযায়ী মুরগি?
উপরে কনটেইনার জাহাজের যে লাইনারের কথা বলেছি, সেগুলি হলো শহরের বাস সার্ভিসের মতো। কয়েকটা বিশেষ স্টেপেজেই থামবে। আপনাকে বাসায় যেতে হলে বাস স্টপেজ থেকে পায়ে হাঁটতে হবে বা রিক্সা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমি যদি বলি যে বাসকে আমার বাড়ি পর্যন্ত আসতে হবে, তাহলে আমার বাড়ির দরজা পর্যন্ত রাস্তা বাস আসার মতো চওড়া করতে হবে। আর আমাকে শিওর করতে হবে যে আমার বাড়ি থেকে বাস ভর্তি করে মানুষ উঠবে, শুধু এক-দুইজন নয়। আমি যদি আজকে এই বাস আমার বাসা পর্যন্ত আনতে গিয়ে রাস্তা প্রশস্ত করি, তাহলে আমাকে শিওর হতে হবে যে ভবিষ্যতে সেই বাস আবার অন্য কোন যুক্তি দেখিয়ে আমার বাসা পর্যন্ত আসা বন্ধ করে দেবে না। কারণ সেই বাস কেনার সাধ্য আমার নেই; অন্যের বাসের উপরেই আমার নির্ভর করতে হবে। আমি নিজে কিনলে ছোট গাড়ি কিনবো, যে দিয়ে যাতায়াত করলে খরচ অনেক বেশি পড়ে যাবে। অর্থাৎ আমার বাসা পর্যন্ত বাসের রুট আনতে হলে ওই ব্যাটা বাস-অলাদের Economy of Scale-এর সাথে আমাকে খাপ খাওয়াতে হবে। মানে আমাকে জাহাজের সাথে মিলিয়ে বন্দর বানাতে হবে, যা কিনা ডিমের সাইজ মাথায় রেখে মুরগি ডিজাইন করার মতো হয়ে যাচ্ছে!!
বিশাল আকৃতির এই জাহাজগুলিকে বন্দরে ঢোকানোর জন্যে বিপুল পরিমাণ ড্রেজিং করতে হচ্ছে; বিশাল খরচ করে তৈরি করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। অতিরিক্ত ড্রেজিং-এর কারণে পরিবেশের বারোটা বাজছে। জার্মানির এলব নদীতে রয়েছে ইউরোপের অন্যতম বড় বন্দর হামবুর্গ। জোয়াড়ের সময়ে এখানে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারে, যা মোটেই কম নয়। আমাদের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্যেও এমনই কিছু পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু হামবুর্গ বন্দরের লোকজন চাইছিলেন এখানে আরও বড় জাহাজ আসুক, নাহলে বন্দর হিসেবে হামবুর্গের গুরুত্ব কমে যাবে। নতুন তৈরি করা বিশাল জাহাজগুলি অন্য বন্দরে চলে যাবে। আরও বড় জাহাজ আনতে গেলে বন্দরের গভীরতা বাড়ালেই শুধু হচ্ছে না, চ্যানেলের প্রশস্ততাও বাড়াতে হবে, নাহলে জাহাজ ঘোরানো সম্ভব হবে না। হামবুর্গে এই পরিকল্পনার প্রতিবাদে পরিবেশ আন্দোলন গ্রুপগুলি আদালত পর্যন্ত গিয়েছে; কারণ এই বিশাল ড্রেজিং-এর ফলে পরিবেশগত প্রভাব মোটেই অনুকূল হবে না। তবে যেহেতু পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ বন্দরই বেসরকারি মালিকানায় রয়েছে, তাই অর্থই যে সকল চিন্তার মূলে থাকবে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাতে পড়ার পর থেকে খরচ কমানোর চিন্তা নেতৃত্বে থাকা কোম্পানিগুলিকে আরও বেশি পেয়ে বসেছে। জাহাজের মাপ অনুযায়ী তারা সকলকে বন্দর তৈরি করে নিতে বলছে, যদি তারা চায় যে তাদের দেশে ঐসব বড় কনটেইনার জাহাজগুলি আসতে হবে। তবে বন্দর তৈরি করে ফেলার পরে নতুন কোন ফ্যাক্টর এখানে চলে আসবে না – এই প্রতিশ্রুতি জাহাজ কোম্পানিরা দেবে না। আর সেই গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে গিয়ে আবার ভূরাজনৈতিক রেষারেষিতে পড়েছে অনেক দেশ। পাকিস্তানে, শ্রীলংকায় আর মিয়ানমারে বন্দর বানিয়েছে চীন; ইরানে বন্দর বানাচ্ছে ভারত। জাহাজ কোম্পানিগুলির টাকার চিন্তাকে প্রাধান্য দেবার ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই উদ্ভট পরিস্থিতি। বাংলাদেশেও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে কম ঠেলাঠেলি হয়নি চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে; এখনও চলছে। কিন্তু কেউ একবারও বললো না যে এই বন্দর বানাতে তো ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে; জাহাজ কোম্পানিগুলি বরং কয়টাদিন কম লাভে ব্যবসা করে না কেন? অত বড় জাহাজ না বানিয়ে একটু ছোট জাহাজে কি একেবারেই হবে না? খরচ বাঁচাতে গিয়ে গত কয়েক বছরে শীর্ষ বিশ জাহাজ কোম্পানির মাঝে কয়েকটি merger বা একত্রীকরণ হয়েছে। পরিস্থিতি যেভাবে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে গুটি কয়েক কোম্পানির হাতেই দুনিয়ার সকল বাণিজ্য চলে যাবে। কারণ সেই Economy of Scale ছাড়া তো সে আর কোনকিছুকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। তার লাভ তো সে কমাবে না কিছুতেই!
যুক্তি আসবে যে আমাদের দেশে যেভাবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়ছে, তাতে আমরা ডীপ সী পোর্ট তৈরি না করে কি করে পারবো? কথা হচ্ছে কনটেইনার ওঠাতে-নামাতে কনটেইনার টার্মিনাল লাগে, ডীপ সী পোর্ট লাগে না। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার টার্মিনাল ছাড়াও আমরা মংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং-এর ব্যবস্থা করতে পারি অতি সহজেই (পশ্চিমা কোম্পানির হাতে বন্দর তুলে না দিয়ে); সেটা গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো এতো খরচ হবে না। সেখানে বর্তমানে যে সাইজের ফীডার ভেসেল (১,০০০ থেকে ১,৫০০ টিইউএস) দিয়ে কনটেইনার আনা-নেওয়া হচ্ছে, সেটাই চলবে। আর আমরা নিজেদের দেশে ওই সাইজের কিছু জাহাজ তৈরি করে সমুদ্রে চালাতে পারবো। সেখানে নাবিক থাকবে আমাদের নিজেদের লোক। জাহাজ তৈরির এই অর্ডারগুলিও পাবে দেশের শিপইয়ার্ড। এটাই হবে ম্যারিটাইম নেশনের বুনিয়াদ। বর্তমানে বিদেশী জাহাজ দিয়েই আমরা সকল বাণিজ্য করছি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসেবে পণ্য আমদানিতে খরচ হয়েছে মোট ৩৯.৭১ বিলিয়ন ডলার, আর রপ্তানি হয়েছে ৩৩.৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য (মোট রপ্তানি আয় যদিও ৩৪.২৪ বিলিয়ন)। দু’টা মিলিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য হয় ৭৩.১৫ বিলিয়ন, যার প্রায় পুরোটাই বিদেশী জাহাজের উপর ভর করে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসেবে বলা হয়েছে যে পণ্যের মূল্যের কমপক্ষে ১০% পর্যন্ত খরচ হয় শিপিং-এ। এই হিসেবে আমরা গত অর্থবছরে কমপক্ষে ৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা দিয়েছি বিদেশী শিপিং কোম্পানিগুলিকে!! আমরা নিজেরা নিজেদের মার্চেন্ট ফ্লিট তৈরি করতে চাইলে বিদেশী শিপিং কোম্পানিগুলি এর বিরুদ্ধে নামবে নিঃসন্দেহে। এই দুর্মূল্য বাজারে কেউ ৭ বিলিয়ন ডলারের লোভ সামলাতে পারবে না। অন্ততঃ যাদের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আরও টাকা উপার্জন, তার কাছে এটা জীবন-মরণের মতো ব্যাপার।
আদৌ কি আমাদের কোন লাভের আশা ছিল?
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করলে কি আমরা একটা জাহাজ লাইনার কোম্পানি তৈরি করতে পারবো? ওই ২০ফিট ৪০ফিট বাক্সের উপরে আমাদের একটা নাম কি সেঁটে দিতে পারবো? কয়েক লক্ষ টনের গোটা পাঁচেক জাহাজ বানাতে পারবো? এই উত্তরগুলি যদি ‘সম্ভবত না’ হয়, তাহলে কোন হিসেবে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়ে আমরা গভীর সমুদ্র বন্দর করতে চাইছি? জাহাজ কোম্পানিগুলির Economy of Scale-এ সুবিধা দেবার জন্যে? কনটেইনারের ভেতরে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয় সেগুলির সুবিধার্থে তো, তাই না? তো কতো টাকার সুবিধা আমরা পাবো, যেটার জন্যে আমাদের সেই বন্দর বানিয়ে প্রতি বছর মেইনটেন্যান্স খরচ উসুল হবে? আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টস (যা কিনা নিজেই আমদানি-নির্ভর) থেকে আমরা কতটা value addition পাই (এবং ভবিষ্যতেও পেতে থাকবো) যেটা আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দরের খরচ উঠিয়ে দেবে? দর্জির মাইনে দিয়ে কি ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধ করা যাবে (সুদ সহ)?
এরপর এই গভীর সমুদ্রবন্দর প্রজেক্টের রয়েছে কিছু বাই-প্রডাক্ট। যেমন কোন জাহাজকেই আর কলম্বো বা সিঙ্গাপুর বা কেলাং যেতে-আসতে হবে না; বড় জাহাজ কোম্পানির দৈত্যাকৃতি জাহাজগুলিই আমাদের এখানে চলে আসবে। অর্থাৎ কোন জাহাজে আর বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ ওড়ানোর দরকার নেই! আমাদের নিজেদের কোন জাহাজ আর থাকবে না। এখনও খুব একটা আছে যে তা নয়, তবে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে আর থাকার প্রশ্নও থাকবে না। আমরা নাবিক তৈরি করবো বিদেশী জাহাজের জন্যে, যদি তারা কোন অভিজ্ঞতা ছাড়া বাংলাদেশী নাবিক নিতে ইচ্ছুক হয় (কারণ হাতেকলমে শেখানোর জন্যেও আমাদের কোন বাণিজ্য জাহাজ থাকবে না)। যারা বড় কোম্পানি তারাই বাংলাদেশের বন্দরে জাহাজ ঢোকাবে আর বের করবে। বাংলাদেশের কোন জাহাজ সমুদ্রে না থাকা মানে গুডবাই ‘ব্লু ইকনমি’ এবং ‘ম্যারিটাইম নেশন’। আমরা শুধু যেটা করতে পারবো তা হলো বড় কোম্পানিগুলির জন্যে গতর খেটে জাহাজ তৈরি করে দিতে পারবো। আমাদের জাহাজ তৈরি শিল্পের অবস্থাও হবে বাঙ্গালীর চিংড়ি চাষের মতো – এত্তো এত্তো চিংড়ি সে উতপাদন করে, কিন্তু সবটাই সে নিজে না খেয়ে অন্য জাতির কাছে বিক্রি করে দেয় – শুধুমাত্র ক’টা টাকা পাবে বলে। আহা রে!
আমরা এই খেলাটা ধরতে পারবো কবে?
কোম্পানির লোগো লাগানো ওই বাক্সগুলি কতো শক্তিশালী তাই না? আসলেই কি তাই? না, তা নয়। ওই বাক্সকে আবর্তে যে চিন্তাটা, সেটা হচ্ছে শক্তিশালী। বাক্সটা তৈরি করা কতো সহজ; কিন্তু ইচ্ছে করলেই সেটা তৈরি করা যায় না। কি অদ্ভূত! চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশগুলিও এই বাক্স ওঠা-নামার বন্দর তৈরি করতে গিয়ে মারামারি করছে! এই বাক্সের চিন্তা এসেছে ১৯৬০-এর দশক থেকে, যখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার দখল নিতে থাকে। কনটেইনার কোম্পানিগুলির বেশিরভাগই গত দুই-তিন দশকে তৈরি হয়েছে; পুরোনো কোম্পানি আছে খুব কমই – যেমন APM-Maersk, CMA CGM, Hapag-Lloyd, APL এবং জাপানি দুই-একটা। বাকি বেশিরভাগই, যেমন MSC, Evergreen, COSCO, CSCL, Hanjin ইত্যাদি – এ এসবই তৈরি হয়েছে গত কয়েক দশকে। পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সবচাইতে বেশি, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এখানে মাত্র একটি – APL, তা-ও আবার সেটা অত বড় নয়, তা-ও আবার সেটা সিঙ্গাপুরে বিক্রি হয়ে গেছে। তার মানে কি এই যে যেই সমুদ্র বাণিজের দখল নিতে ইউরোপিয়রা কয়েক’শ বছর যুদ্ধ করেছে সেই সমুদ্র বাণিজ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদাসীন? প্রশ্নই আসে না। পরাশক্তি তার শক্তির কিছু স্থানে ছাড় দেবে না; আর সেগুলির একটি হচ্ছে সমুদ্র বাণিজ্য। মার্কিনীরা সমুদ্রের নিয়মগুলি ঠিক করে দেয় শুধু। বাকিরা সবাই সেই নিয়ম মেনে চলে। এবং নিয়মের দাস হিসেবে থাকে। এবং সেই নিয়মকে ধর্মগ্রন্থরূপে ধরে নিয়ে নিজেদের মাঝে প্রভাবের লড়াই করে চলে – যেমনটি চীন এবং ভারত করছে।
আসলে বাংলাদেশের পুরো সমুদ্র উপকূলই গভীর সমুদ্র বন্দর – শুধুমাত্র ভৌগোলিক কারণে, যা কিনা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। বাংলাদেশে নদীগুলি না থাকলে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমরা পদ্মা সেতুর জন্যে ৫৩,০০০ টনের জাহাজে পাথর এনে খালাশ করতে পারতাম না – এটা আমরা কতটুকু বুঝি?? ব্রিটিশরা যে এই এলাকার maritime potential উপলব্ধি করেছিল, সেটা এর আগেই লিখেছি। আমরা যতদিন চিন্তাহীনভাবে অন্যের কথায় নাচতে থাকবো, ততোদিন আমরা অন্যের ক্রীড়নকই থেকে যাবো। কনটেইনার খারাপ জিনিস নয়, কিন্তু যে চিন্তাটা কনটেইনারের সাথে আসে, সেই চিন্তাখানা বুঝতে হবে। কনটেইনারকে না বুঝে কনটেইনার পোর্ট নিয়ে বেহুদা লম্ফ-ঝম্ফ বোকার স্বর্গে বসবাস। কনটেইনার কোম্পানিগুলি কি আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে বানাতে তাদের কোন নীতিতে পরিবর্তন আনবে না? কে গ্যারান্টি দিচ্ছে যে ১০ বিলিয়ন খরচ করে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে করতেই সেটা obsolete হয়ে যাবে না?? যে বাক্সের মোহ আমাদের দেখানো হচ্ছে, সেটার মাঝে আমাদের ব্লু ইকনমি নেই, ম্যারিটাইম দেশ নেই; রয়েছে ওই সমুদ্রের মধ্যিখানে। বাক্সের মোহে আমরা শুধু আমাদের সমুদ্রাভিযানকে পিছিয়েই দেব না, আমাদের দাসত্বের শৃংখলকে চিরস্থায়ী করে নেব!
বাক্সে বাক্সে বন্দী বাক্স
বাক্সে বাক্সে বন্দী বাসা
বাক্স দিয়ে বাক্স গড়া
বাক্সতে সব স্বপ্ন আশা।।
লিটল বক্সের লিটল বক্সেস...অদ্ভুত শক্তিশালী চিন্তা !
ReplyDelete