০৫ অগাস্ট ২০১৬
তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে অনেক লেখা পড়া হয়ে গেছে সবার। তবে সেই ঘটনার মাঝে আমাদের জন্যে কি শেখার রয়েছে, সেটাই সবচাইতে বড় বিষয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানেই তথ্যের সবচাইতে বড় ঘাটতি লক্ষ্যনীয়। আজকে সেই দিকটা নিয়েই আলোচনা করবো। ২০১৬ সালের প্রায় পাঁচ মাস বাকি; এখনই এই বছর একটা ঘটনাবহুল বছর বলে সবার কাছে পারিচিতি পেতে যাচ্ছে। প্রতি মাসে নয়, এমনকি প্রতি সপ্তাহেও নয়; একেবারে প্রতিদিনই কিছু কিছু বড় ধরনের ঘটনা দেখতে হচ্ছে টিভির পর্দায় এবং খবরের কাগজে। প্রতিদিন এরকম ওজনদার খবরের ভারে মানুষের নুয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। যদিও নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে বিপদের আশংকার কথা বলছিলাম অনেকদিন থেকেই, এটা মোটামুটি জানা ছিল যে মাথার উপরে কিছু একটা ভেঙ্গে না পড়লে মানুষের সন্বিত ফেরে না। আর সেটা আমাদের ফিরেছে গুলশানের ঘটনার পরে। এখন আন্তর্জাতিক বড় ঘটনাগুলিকেও যেন খুব বেশি দূরের মনে হচ্ছে না।
তুরস্কের সমস্যা এর ইতিহাসের মাঝে নিহিত…
তুরস্কে কি কি ঘটেছে সেটা বর্ণনা না করে বরং ঘটনাগুলির অর্থ কি দাঁড়ায়, সেটা নিয়ে কথা বলবো; কারণ সেখানেই আমাদের জন্যে শেখার রয়েছে। প্রথমে বুঝতে হবে তুরস্কের রাজনীতির মূল বিষয়; যার মাঝ দিয়ে তুরস্কের ইতিহাস পর্যালোচনা জরুরি। ভূরাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত সাড়ে চার’শ বছরের বেশি সময় ধরে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ছিল ইস্তাম্বুলে। বিশ্বের মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব ছিল ইস্তাম্বুলে আসীন খলিফার নেতৃত্বের উপরে। বিশ্বের বাকি মুসলিম শাসকগণও ইস্তাম্বুলকেই ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে মেনে চলতেন এবং মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার্থে খলিফার সাহায্য চাইতেন। এরকমই একটা উদাহরণ এর আগের একটা লেখায় দিয়েছিলাম, যখন খলিফা আচেহ-এর (ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরে) সুলতানকে সহায়তা দান করেছিলেন পর্তুগীজদের থামাতে। সেটা ছিল খলিফার আদর্শিক হস্তক্ষেপ। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে উসমানিয়া খিলাফতের অধীনের পুরো এলাকা ব্রিটিশরা দখল করে নেয় এবং ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে এই এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির জন্ম দেয়। এর মাঝে একটি দেশ হচ্ছে তুরস্ক, যার ক্ষমতা চলে যায় মুস্তফা কেমাল (কেমাল আতাতুর্ক) নামের একজন সামরিক অফিসারের হাতে। ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চরা কেমালকে ক্ষমতায় যেতে সবধরণের সহায়তা দান করেছিল। কেমাল ১৯২৩ সালে ক্ষমতা নিয়ে খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং দেশ থেকে ইসলামের সকল চিহ্ন মুছে ফেলতে সক্রিয় হন। কেমালের অত্যন্ত কঠোর এই প্রক্রিয়াকে চালু রাখার দায়িত্ব নেয় কেমালের আদর্শে দীক্ষিত সেকুলার সেনাবাহিনী, যারা ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চদের দ্বারা সমর্থনপুষ্ট ছিল। এভাবে তুরস্কের জন্ম হয় ইউরোপিয়ানদের হাতে। তবে মার্কিনীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে তুরস্ককে ইউরোপিয় প্রভাব থেকে বের করে আনতে ব্যর্থ হয়। তবে মোটা দাগে কমিউনিজমের বিপক্ষে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে নিয়ে খুশিই ছিল, যদিও দেশটিতে গণতন্ত্রের প্রচলন ছিল না বললেই চলে।
১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তুরস্কের সেনাবাহিনী বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে রাজনীতিতে ইসলামের প্রবেশ রোধ করে, যদিও মানুষ বারংবার ইসলামের পক্ষেই রায় দিচ্ছিল। কেমালের তৈরি সেনাবাহিনীর এই স্বেচ্ছাচারিতা এবং পশ্চিমাদের তাতে পরোক্ষ সমর্থন তুরস্কের জনগণের মাঝে সেকুলার-বিরোধী এবং পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। এই সুযোগে রিসেপ তাইয়িপ এরদোগানের একেপি দলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে। একেপি নামমাত্র ইসলামিক দল হিসেবে জনগণের ভোট আদায়ে সক্ষম হয় এবং ২০০২ সাল থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপিয় সমর্থিত সেনাবাহিনীর সেকুলার অংশের ক্ষমতা কমতে থাকে। ইসলামের নামে রাজনীতি করার কারণে এরদোগানকে জনগণ ক্ষমতা প্রদান করতে থাকে এবং সেই ক্ষমতা এরদোগান তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকেন। তবে ইস্তাম্বুলের সুলতানরা যেভাবে মুসলিম বিশ্বকে সহায়তা দিয়েছিল, সেটা এরদোগান করেননি। বরং মার্কিনীদের স্বার্থই রক্ষা করে চলেছেন তিনি। তুরস্কের পাশেই সিরিয়াতে পাঁচ বছরে পাঁচ লক্ষ মুসলিমের জীবনাবসানও এরদোগানকে নড়াতে পারেনি, কারণ সেটা করতে গেলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হতেন। তবে তুরস্কের মানুষ এরপরেও এরদোগানের সাথেই থাকে, কারণ তাদের কাছে এরদোগানের শাসন কেমালের সেকুলার সামরিকতন্ত্রের কঠোরতার তুলনায় ভালো মনে হয়েছে। তুরস্কও আশেপাশের দেশগুলির যুদ্ধ থেকে দূরে থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের এই নীতি পছন্দ হয়নি। তারা তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত দেখতে চেয়েছে। এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে নামতে পারেননি তুরস্কের জনগণের সমর্থনের অভাবে। পরপর কয়েকটি জঙ্গী হামলাও তুরস্কের নীতি পরিবর্তন করতে পারেনি।
সেকুলার বিদ্রোহ…
ঠিক এই সময়টাতেই সামরিক অভ্যত্থানের সূচনা হয়, যখন অভ্যত্থানকারীরা টিভি স্টেশন দখল করে এটাকে জোর গলাতেই ‘সেকুলার অভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দিতে থাকে। বিদ্রোহী সেনাদের এই শব্দগুলি শুনে তুরস্কের মানুষ চোখের সামনে আবারও কেমালের বিভীষিকাময় আধ্যায়কে দেখতে পায়। যদিও ইউরোপীয় সমর্থিত সেকুলার গোষ্ঠী এই অভ্যুত্থানে জড়িত থেকেছে, তথাপি তুরস্কের মাটিতে ইনচিরলিক বিমান ঘাঁটি (যা কিনা মার্কিনীরা নিয়ন্ত্রণ করে) এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ায় সন্দেহের তীর যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই তাক হয়। এরদোগান এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী ফেতুল্লা গুলেনকে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার কথা বলতে থাকেন, যদিও সবাই জানে যে গুলেনের দল নিতান্তই দন্তহীন। এরদোগান এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেবেন, যাদের একটা বড় অংশ থাকবে ইউরোপিয়-সমর্থিত সেকুলার সমাজের লোকজন।
তবে এরদোগান কর্তৃত্ব করতে চাচ্ছেন বলে ‘মানবাধিকার’এর দোহাই দিয়ে এখন আবার পশ্চিমা-সমর্থিত অভ্যুত্থানকারীদেরও বাঁচানোর চেষ্টা চলবে। দেশের বিরুদ্ধে, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে যে লোকগুলি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো, তাদেরকেই এখন ‘দয়া’ দেখানোর কথা বলা হবে। অথচ এদের হাতে বহু তুর্কী মৃত্যুবরণ করেছে। আবার তুরস্কের ভেতরে যুগ যুগ ধরে subversion চালানো এজেন্টরা ধরা পরে যাবার পরে এখন বিদেশের দিকে চেয়ে থাকবে। এরা বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান সফল করতে সেকুলার সেনাদের সরাসরি সমর্থন দিয়ে তুর্কী জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। বিদেশী এজেন্টদের এহেন জঘন্য কার্যকলাপের পরেও এদের বাঁচানোর চেষ্টাটা নিঃসন্দেহে অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি পশ্চিমাদের সরাসরি সমর্থনের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করবে। এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আঙ্গুল তাক করবেন দেশের মানুষের যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী চেতনাকে কাজে লাগানোর জন্য। গাজা অপারেশনের সময়ে ইস্রাইলীরা তুরস্কের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মেরে ফেললেও এরদোগান কিন্তু মুখেই বকর বকর করেছিলেন; কাজে কিছুই করেননি। এবারেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি শুধু মুখেই খই ফোটাবেন।
এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী সরানোর কার্যকলাপ ইউরোপিয়রা পছন্দ করছে না এবং তুরস্ককে ন্যাটো থেকে বের করে দেবার কথাও তারা তুলছেন। কিন্তু যেই তুরস্ক সাড়ে চার’শ বছরেরও বেশি সময় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে, যে তুরস্ককে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়েছে যাতে তাদের ইসলামের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা না থাকে, যে তুরস্কে ইসলামের পূনরাবির্ভাব ঠেকাতে সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করেছে পশ্চিমারা, যে তুরস্ককে তার ইতিহাস থেকে সরিয়ে রাখতেই তাকে ন্যাটোর মাঝে আটকে রাখা হয়েছে, সেই তুরস্ককে একুশ শতকে এসে ছেড়ে দেবার পাত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়। ন্যাটোর সদস্যপদই তুরস্ককে ভূরাজনৈতিকভাবে আটকে রাখার পদ্ধতি। আর এই আটকে রাখার চেষ্টা যে স্থায়ী হবে না, সেটা পশ্চিমারা জানেন অনেক আগ থেকেই। ভূরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব স্যামুয়েল হান্টিংটনের কথায়ঃ
“What, however, if Turkey redefined itself? At some point, Turkey could be ready to give up its frustrating and humiliating role as a beggar pleading for membership in the West and to resume its much more impressive and elevated historical role as the principal Islamic interlocutor and antagonist of the West…. Having experienced the bad and the good of the West in secularism and democracy, Turkey may be equally qualified to lead Islam. But to do so it would have to reject Ataturk’s legacy more thoroughly than Russia has rejected Lenin’s”.
হান্টিংটন এই কথাগুলি লিখেছিলেন তার “The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order” বইতে, যা দুই দশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। হান্টিংটন এখানে এরদোগান বা কোন রাজনৈতিক দলের কথা চিন্তা করে এই কথাগুলি বলেননি; বলেছিলেন তুরস্কের মানুষের কথা চিন্তা করে, কারণ ভূরাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব খুব কম, বরং জনগণের গুরুত্ব বেশি। রাজনৈতিক দল আসবে-যাবে, কিন্তু দেশ চলবে জনগণ যেদিকে যেতে যায়, সেদিকে। তাই তুরস্কের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে এবং অভ্যত্থান চেষ্টার বাস্তবসম্মত হিসেব কষতে গেলে তুরস্কের জনগণ কি চায়, সেটা বুঝতে হবে।
তুরস্কের ভূরাজনীতি তুরস্কের জনগণের হাতে, এরদোগানের হাতে নয়
অভ্যত্থান চেষ্টা প্রথমে দেখে মনে হচ্ছিল সফল হচ্ছে, কিন্তু সব পালটে গেল যখন ৩০-৪০ জনের একদল সাহসী বেসামরিক লোক “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিয়ে বিদ্রোহী সেনাদের ট্যাঙ্কের সামনে চলে আসে। সৈন্যরা ভয় পেয়ে গুলি চালিয়ে বসে; তারা চিন্তাও করেনি যে কতবড় ভুল তারা করেছে। বীর এই বেসমরিক নাগরিকদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তুরস্কের মানুষ আর নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকতে পারেনি। কেমালের দুস্বপ্ন তাদের পেয়ে বসে এবং দলে দলে তারা বিদ্রোহকারীদের উপরে চড়াও হয়। রাস্তায় মানুষ দেখে সেনাবাহিনীতেও একই ঘটনা ঘটে। ইনচিরলিক ঘাঁটিতে বিপদের বাঁশি বেজে ওঠে। মার্কিনীরা বুঝে ফেলে যে কিছুক্ষণ আগেও যা নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছিল, তা এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত। রাস্তায় মোতায়েন বিদ্রোহী সেনারা আত্মসমর্পণ করতে থাকে এবং জনগণ খালি হাতে এদের উপরে প্রতিশোধ নিতে থাকে। ট্যাঙ্কের সামনে আত্মাহুতি দেয়া মানুষগুলি এরদোগানের প্রতি ভালোবাসার কারণে জীবন উতসর্গ করেনি, করেছে ইসলামের উপরে আঘাতের আশংকায়। জনগণের এই চিন্তাটাই স্যামুয়েল হান্টিংটনসহ অন্যান্য পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা বুঝেছিলেন। যেকারণে তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছে সবসময়।
আইসিস-এর হামলা তুরস্ককে নড়াতে পারছিল না, তাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ছিল পশ্চিমারা। এখানে এরদোগান আসলে তেমন বড় কোন বিষয় নয়, যদিও মিডিয়া এরদোগানকেই বড় করে প্রচার করছে। এরদোগানকে ছোট্ট করে ফেলেছে সাধারণ মানুষের ছোট্ট একটি দল, যারা বিশাল হৃদয় নিয়ে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জনগণের শক্তির সামনে ‘সুলতান এরদোগান’ নামে খ্যাত পশ্চিমের বন্ধুটিকে দুর্বল মনে হয়েছে। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীও হতে যাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক সেসময় তুরস্কের জনগণ দেখিয়ে দিল যে ভূরাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করে, এরদোগান নয়।
আমরা কি করবো, তার আগে বরং ঠিক করি “কি করবো না”
তুরস্কের জনগণের ভাষা বুঝতে যদি আমরা ভুল করি, তাহলে জনগণের শক্তিকেও আমরা বুঝতে ভুল করবো। পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের সাথে যে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি নিয়েছে, সেটা থেকে উদ্ধার পেতে জনগণকে একত্রিত হতে হবে। ভূরাজনীতিতে আমাদের অবস্থান বোঝার সময় আমাদের হয়েছে। আদর্শিক যুদ্ধের পূণরাবির্ভাবের মাঝে আমাদের অবস্থান কোথায়, সেটা বুঝতে হবে আমাদের। পাকিস্তানের মতো ভুল পথে চললে দেশের এবং দেশের মানুষের উপরে ভয়াবহ বিপর্যয় চলে আসবে।
২০০১ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সকালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মুশাররফ বৈঠক করছিলেন আগের রাতে নিউ ইয়র্কে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে, যখন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কলিন পাওয়েলের ফোন এলো। মুশাররফ বললেন যে বৈঠক শেষে কল-ব্যাক করবেন। কিন্তু পাওয়েল চাইলেন যে মুশাররফ যেন বৈঠক ছেড়ে এসে ফোন ধরেন। আজ্ঞাবহ দাসের মতো মুশাররফ তা-ই করলেন। পাওয়েল বললেন, “You are either with us or against us”. পরদিন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রধান, যিনি তখন ওয়াশিংটনে ছিলেন, জানালেন যে ডেপুটি পররাষ্ট্র সচিব রিচার্ড আরমিটেজ তাকে বলেছেন পাকিস্তানকে ঠিক করতে হবে যে তারা কোন দলে থাকবে। যদি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে পাকিস্তান “should be prepared to be bombed back to the Stone Age.” মুশাররফ এসবকিছু বর্ণনা করেছে তারা বই “In the Line of Fire: A Memoir”-এ। তিনি পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
“My decision was based on the well-being of my people and the best interests of my country – Pakistan always comes first. I war-gamed the United States as an adversary. There would be a violent and angry reaction if we didn’t support the United States. Thus the question was: if we do not join them, can we confront them and withstand the onslaught? The answer was no, we could not”.
পারভেজ মুশাররফের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা আজ সকলের সামনে পরিষ্কার। এটা বলতে দ্বিধা করি না যে মুশাররফের মতো নেতৃত্ব আমাদের দেশে আসেনি বলেই আমরা এখনো পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাইনি। নাহলে এদেশে জঙ্গী তৈরির কারখানাকে ফুয়েল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করা থেকেও আমরা পিছপা হতাম না। সেই ড্রোন ঘাঁটি ব্যবহার করে ‘ভুল করে’ হামলা করা হতো কওমী মাদ্রাসাগুলিতে, আর তারপর থেকে জঙ্গী তৈরির প্রোডাকশন লাইন প্রস্তুত হয়ে যেত! সেই জঙ্গীদের দিয়ে হামলা করাতো সেনাবাহিনীর পরিবারদের উপরে, যাতে সেনাবাহিনী ক্ষেপে গিয়ে জঙ্গীদের পরিবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলে – ঠিক যা যা পাকিস্তানে করা হয়েছে। দেশকে টুকরা টুকরা করে ফেলার চমতকার এক ফর্মূলা, যা পাকিস্তানে বেশ সফলতা পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সমস্যা যে পাকিস্তানের সরকার নয়, বরং সেদেশের জনগণ, তার প্রমাণ আমরা পাই প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন-এর লেখা ‘Hard Choices’ বইতে। তিনি সেখানে লিখেছেন যে ২০০৯ সালে পাকিস্তানের জনগণের মুখোমুখি হতে তিনি কতটা শঙ্কিত ছিলেন। তিনে লিখেন যে, “পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্বেষও বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের মিডিয়াগুলো অসন্তোষের আগুনে বরাবরই ডিজেল ঢেলেছে। তারা পাকিস্তানে তালিবান দৌরাত্ম বাড়ার জন্যে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে। এছাড়াও আরও প্রচার হতে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র নাকি ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানের পেছনে লেগেছে। এসব ছাড়াও আরও অনেক কারণে, বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেয়ার পরেও, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব বাড়তেই থাকে। আর এজন্যেই পাকিস্তান সরকারের পক্ষেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে থাকে”। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো হিলারি ক্লিনটন পাকিস্তানের সরকারকে বন্ধু মনে করছেন; আর জনগণকে মনে করছেন সমস্যা! এ-ই হলো গণতন্ত্রের তথাকথিত ধারক ও বাহক। তিনি আরও বলেন, “উদ্দেশ্য … পাকিস্তানিদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব কমানো। …… সবাই বললো, ‘পাবলিক মনের ঝাল সব আপনার উপর ঝাড়বে’। আমি বললাম, ‘ঝাড়তে দাও’”। তিনি লাহোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সাথে এক বৈঠক করতে গিয়ে অত্যন্ত বাজে সব প্রশ্নের সন্মুখীন হন। তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে তিনি ছাত্রছাত্রীদের উত্তর দিয়ে খুশি করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে তার বই থেকে এ-ও তুলে ধরতে পারি - “২০০৭ সালের এক জরিপে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তুর্কীদের সমর্থন ৯ শতাংশে নেমে এসেছে”। আবার, তিনি এরদোগান (তখন প্রধানমন্ত্রী) সম্পর্কে বলছেন যে, “যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক এই তুর্কী প্রধানমন্ত্রী”। এখানে আমরা তুর্কী জনগণ এবং পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একই রকম নীতি দেখতে পাই। আবার তুর্কী রাজনীতিবিদ এবং পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সাথে মার্কিনীদের সুসম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারি। এটা আমাদেরকে অবাক করার কথা নয়, কারণ মিশরের হোসনি মুবারক ও এল-সিসি, জর্ডানের বাদশা হুসেন ও বাদশা আবদুল্লাহ, সৌদি রাজপরিবার, ওমানের আমির, ইত্যাদি যত সব একনায়করা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সবসময় সমর্থন পেয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসিদ্ধি করার অপর নামই হচ্ছে গণতন্ত্র!
১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পারভেজ মুশাররফ পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বাস্তবায়ন করেন, যদিও ততকালীন নওয়াজ শরীফ সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। তুরস্কেও হয়তো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া-ইরাক-তুরস্কসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তার স্বার্থ বাস্তবায়ন করতো, যদিও এরদোগানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। ভূরাজনীতি এখানে আমাদের জন্যে কয়েকটি শিক্ষনীয় ব্যাপার রেখেছে।
আমরা যা শিখলাম
প্রথমতঃ তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছে যে ভূরাজনীতিতে তুরস্কের গুরুত্ব তুরস্কের জনগণের কারণে। তাদের মার্কিন সমর্থিত সরকার শুধুমাত্র তুর্কী জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখার পশ্চিমা চেষ্টায় ফুয়েল দিচ্ছে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে তুর্কী জনগণ মার্কিন পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণও পাকিস্তানের জনগণ, তাদের মার্কিন তাঁবেদার সরকার নয়। ঠিক একইভাবে, বাংলাদেশের মানুষকেও একত্রিত হতে হবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রুখতে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে, অন্য কোন কারণে নয়। দেশের স্বার্থ, দেশের জনগণের স্বার্থ, ইসলামের স্বার্থ বুঝতে হবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে। দেশের মানুষকে এই প্রসেসে সরাসরি যুক্ত করাটা জরুরি। চিন্তাহীন জাতির সামনে চিন্তার দুয়ার খুলে দিতে হবে, যাতে তারা বিদেশী ষড়যন্ত্র ধরতে পারে। জনগণের উপরে চাপ সৃষ্টি করাটা পশ্চিমা উদ্দেশ্য; জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করাটা হবে আমাদের উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমা চাপে নতি স্বীকার না করলে নয়, বরং করলেই একটা দেশের সর্বনাশ হবে। পাকিস্তান এর উতকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে। আমাদের সেই উদাহরণ এড়িয়ে চলা উচিত। আমরা পশ্চিমা পরিকল্পনার ঘোরের মাঝে পড়ে গেলে আর কোনদিন উঠতে হবে না সেখান থেকে। পশ্চিমা চাপের কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না; অন্যথায় পাকিস্তান হতে হবে!
তৃতীয়তঃ ভূরাজনীতিতে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ এর ঐতিহ্যপূর্ণ ইসলামি ইতিহাসের জন্যে, কেমাল আতাতুর্কের ‘অন্ধ-সেকুলারিজম’-এর জন্যে নয়। ধর্মান্ধতা যেমন পরিবেশ দূষণ করে, ঠিক তেমনি ‘অন্ধ-সেকুলারিজম’-ও তা-ই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে তাঁর বহুবার জেল খাটার কাহিনীর মাঝে বারংবার লিখেছেন কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে ফিরেছেন। একবার তিনি লিখেন, “মওলানা সাহেবের [মওলানা ভাসানী] সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমদের জন্যে বাঁধা নিয়ম ছিল”। আরেকবার লিখেন, “আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খন্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি”। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সৃষ্টিকর্তাকে কোথায় রেখেছেন জানিনা, তবে এটা ভাবতেই অবাক লাগে যে তুরস্কের মানুষ কি করে কেমাল আতাতুর্কের শাসনের অধীনে দিনাতিপাত করেছে, যেখানে নামাজ-রোজা-কোরআন-ইসলামিক আলোচনা ছিল হারাম বস্তু!! দম আটকে মারা যাবার কথা তুর্কীদের। অবাক হইনা, যখন দেখি তুর্কীরা সেকুলারদের বিদ্রোহ দেখে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েকটি প্রাণ বাঁচিয়েছে কোটি মুসলিমের অধিকার। বঙ্গবন্ধু নিজে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেছেন, কিন্তু তিনিও যদি কেমালের তুরস্কে থাকতেন, তাহলে সেখানে টিকতে পারতেন কিনা সন্দেহ। অথচ তুরস্কের সেই গোড়ামিপূর্ণ সেকুলার লোকটির নামে আমাদের ঢাকা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণও করা হয়েছে! কত কম জানি এবং বুঝি আমরা! ইসলাম ত্যাগ নয়, বরং ইসলামকে সঠিকভাবে বোঝার মাঝেই পশ্চিমা ষড়যন্ত্র রোখার অস্ত্র নিহিত।
চতুর্থতঃ জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সামরিক-বেসামরিক বলে কোন কিছু যেমন নেই, ঠিক তেমনি সরকারি-বেসরকারি বলেও কিছু নেই। যে তুর্কী জনগণ ট্যাঙ্কের সামনে জীবন দিয়েছে, তারা না সামরিক বাহিনীর সদস্য, না সরকারের সদস্য। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগ দেশকে পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়েছে। এই লোকগুলির আত্মত্যাগ শুধু জনগণকে রাস্তায় নামায়নি, সামরিক বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদেরকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে। দেশের স্বার্থে সামরিক-বেসামরিক জনগণের মাঝে কোন বিভেদ থাকে না। এই দুই সমাজের মাঝে ব্যবধান পশ্চিমাদের তৈরি। পশ্চিমাদের এই দূরভিসন্ধিমূলক ‘ডিভাইড-এন্ড-রুল’ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যারা নিয়মিত সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্বে ইন্ধন দেয়, এরা দেশের মানুষকে ভাগ করে দেশকে দুর্বল করতে উদ্যত। পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র রুখতে হলে এদের রুখতে হবে।
পঞ্চমতঃ দেশের বিরুদ্ধে, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য কোন ক্ষমা দেখানোর প্রশ্নই ওঠে না। ‘মানবাধিকার’-এর কথা বলে যুদ্ধাপরাধীদের যেমন মাফ করে দেয়া যায় না, ঠিক তেমনি, পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের অংশ হবার কারণে দেশী-বিদেশী এজেন্টদেরও ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না।
শেষতঃ বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের, তথা গোটা বিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশকে দুনিয়া থেকে আলাদা করে ভাবে, এরকম কূপমুন্ডুকদের তালিকায় আমাদের নাম যদি এখনও থেকে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আমাদের নাম বাদ দিতে হবে।
তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছে যে ভূরাজনীতিক্তে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ সেই দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে; সেই দেশের শাসকে জন্যে নয়, যাকে নিয়ে কিনা মিডিয়াতে সবচাইতে বেশি আলোচনা হচ্ছে। |
তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে অনেক লেখা পড়া হয়ে গেছে সবার। তবে সেই ঘটনার মাঝে আমাদের জন্যে কি শেখার রয়েছে, সেটাই সবচাইতে বড় বিষয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানেই তথ্যের সবচাইতে বড় ঘাটতি লক্ষ্যনীয়। আজকে সেই দিকটা নিয়েই আলোচনা করবো। ২০১৬ সালের প্রায় পাঁচ মাস বাকি; এখনই এই বছর একটা ঘটনাবহুল বছর বলে সবার কাছে পারিচিতি পেতে যাচ্ছে। প্রতি মাসে নয়, এমনকি প্রতি সপ্তাহেও নয়; একেবারে প্রতিদিনই কিছু কিছু বড় ধরনের ঘটনা দেখতে হচ্ছে টিভির পর্দায় এবং খবরের কাগজে। প্রতিদিন এরকম ওজনদার খবরের ভারে মানুষের নুয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। যদিও নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে বিপদের আশংকার কথা বলছিলাম অনেকদিন থেকেই, এটা মোটামুটি জানা ছিল যে মাথার উপরে কিছু একটা ভেঙ্গে না পড়লে মানুষের সন্বিত ফেরে না। আর সেটা আমাদের ফিরেছে গুলশানের ঘটনার পরে। এখন আন্তর্জাতিক বড় ঘটনাগুলিকেও যেন খুব বেশি দূরের মনে হচ্ছে না।
তুরস্কের সমস্যা এর ইতিহাসের মাঝে নিহিত…
তুরস্কে কি কি ঘটেছে সেটা বর্ণনা না করে বরং ঘটনাগুলির অর্থ কি দাঁড়ায়, সেটা নিয়ে কথা বলবো; কারণ সেখানেই আমাদের জন্যে শেখার রয়েছে। প্রথমে বুঝতে হবে তুরস্কের রাজনীতির মূল বিষয়; যার মাঝ দিয়ে তুরস্কের ইতিহাস পর্যালোচনা জরুরি। ভূরাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত সাড়ে চার’শ বছরের বেশি সময় ধরে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ছিল ইস্তাম্বুলে। বিশ্বের মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব ছিল ইস্তাম্বুলে আসীন খলিফার নেতৃত্বের উপরে। বিশ্বের বাকি মুসলিম শাসকগণও ইস্তাম্বুলকেই ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে মেনে চলতেন এবং মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার্থে খলিফার সাহায্য চাইতেন। এরকমই একটা উদাহরণ এর আগের একটা লেখায় দিয়েছিলাম, যখন খলিফা আচেহ-এর (ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরে) সুলতানকে সহায়তা দান করেছিলেন পর্তুগীজদের থামাতে। সেটা ছিল খলিফার আদর্শিক হস্তক্ষেপ। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে উসমানিয়া খিলাফতের অধীনের পুরো এলাকা ব্রিটিশরা দখল করে নেয় এবং ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে এই এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির জন্ম দেয়। এর মাঝে একটি দেশ হচ্ছে তুরস্ক, যার ক্ষমতা চলে যায় মুস্তফা কেমাল (কেমাল আতাতুর্ক) নামের একজন সামরিক অফিসারের হাতে। ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চরা কেমালকে ক্ষমতায় যেতে সবধরণের সহায়তা দান করেছিল। কেমাল ১৯২৩ সালে ক্ষমতা নিয়ে খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং দেশ থেকে ইসলামের সকল চিহ্ন মুছে ফেলতে সক্রিয় হন। কেমালের অত্যন্ত কঠোর এই প্রক্রিয়াকে চালু রাখার দায়িত্ব নেয় কেমালের আদর্শে দীক্ষিত সেকুলার সেনাবাহিনী, যারা ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চদের দ্বারা সমর্থনপুষ্ট ছিল। এভাবে তুরস্কের জন্ম হয় ইউরোপিয়ানদের হাতে। তবে মার্কিনীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে তুরস্ককে ইউরোপিয় প্রভাব থেকে বের করে আনতে ব্যর্থ হয়। তবে মোটা দাগে কমিউনিজমের বিপক্ষে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে নিয়ে খুশিই ছিল, যদিও দেশটিতে গণতন্ত্রের প্রচলন ছিল না বললেই চলে।
১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তুরস্কের সেনাবাহিনী বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে রাজনীতিতে ইসলামের প্রবেশ রোধ করে, যদিও মানুষ বারংবার ইসলামের পক্ষেই রায় দিচ্ছিল। কেমালের তৈরি সেনাবাহিনীর এই স্বেচ্ছাচারিতা এবং পশ্চিমাদের তাতে পরোক্ষ সমর্থন তুরস্কের জনগণের মাঝে সেকুলার-বিরোধী এবং পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। এই সুযোগে রিসেপ তাইয়িপ এরদোগানের একেপি দলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে। একেপি নামমাত্র ইসলামিক দল হিসেবে জনগণের ভোট আদায়ে সক্ষম হয় এবং ২০০২ সাল থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপিয় সমর্থিত সেনাবাহিনীর সেকুলার অংশের ক্ষমতা কমতে থাকে। ইসলামের নামে রাজনীতি করার কারণে এরদোগানকে জনগণ ক্ষমতা প্রদান করতে থাকে এবং সেই ক্ষমতা এরদোগান তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকেন। তবে ইস্তাম্বুলের সুলতানরা যেভাবে মুসলিম বিশ্বকে সহায়তা দিয়েছিল, সেটা এরদোগান করেননি। বরং মার্কিনীদের স্বার্থই রক্ষা করে চলেছেন তিনি। তুরস্কের পাশেই সিরিয়াতে পাঁচ বছরে পাঁচ লক্ষ মুসলিমের জীবনাবসানও এরদোগানকে নড়াতে পারেনি, কারণ সেটা করতে গেলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হতেন। তবে তুরস্কের মানুষ এরপরেও এরদোগানের সাথেই থাকে, কারণ তাদের কাছে এরদোগানের শাসন কেমালের সেকুলার সামরিকতন্ত্রের কঠোরতার তুলনায় ভালো মনে হয়েছে। তুরস্কও আশেপাশের দেশগুলির যুদ্ধ থেকে দূরে থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের এই নীতি পছন্দ হয়নি। তারা তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত দেখতে চেয়েছে। এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে নামতে পারেননি তুরস্কের জনগণের সমর্থনের অভাবে। পরপর কয়েকটি জঙ্গী হামলাও তুরস্কের নীতি পরিবর্তন করতে পারেনি।
কেমাল আতাতুর্কের বিভীষিকাময় সেকুলার-তন্ত্রের ভয়েই তুরস্কের জনগণ রাস্তায় নেমে ট্যাঙ্কের সামনে জীবন দিয়েছে। ইসলামের উপরে আঘাত ঠেকাতেই তারা এটা করেছে; এরদোগানকে বাঁচাতে নয়! |
সেকুলার বিদ্রোহ…
ঠিক এই সময়টাতেই সামরিক অভ্যত্থানের সূচনা হয়, যখন অভ্যত্থানকারীরা টিভি স্টেশন দখল করে এটাকে জোর গলাতেই ‘সেকুলার অভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দিতে থাকে। বিদ্রোহী সেনাদের এই শব্দগুলি শুনে তুরস্কের মানুষ চোখের সামনে আবারও কেমালের বিভীষিকাময় আধ্যায়কে দেখতে পায়। যদিও ইউরোপীয় সমর্থিত সেকুলার গোষ্ঠী এই অভ্যুত্থানে জড়িত থেকেছে, তথাপি তুরস্কের মাটিতে ইনচিরলিক বিমান ঘাঁটি (যা কিনা মার্কিনীরা নিয়ন্ত্রণ করে) এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ায় সন্দেহের তীর যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই তাক হয়। এরদোগান এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী ফেতুল্লা গুলেনকে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার কথা বলতে থাকেন, যদিও সবাই জানে যে গুলেনের দল নিতান্তই দন্তহীন। এরদোগান এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেবেন, যাদের একটা বড় অংশ থাকবে ইউরোপিয়-সমর্থিত সেকুলার সমাজের লোকজন।
তবে এরদোগান কর্তৃত্ব করতে চাচ্ছেন বলে ‘মানবাধিকার’এর দোহাই দিয়ে এখন আবার পশ্চিমা-সমর্থিত অভ্যুত্থানকারীদেরও বাঁচানোর চেষ্টা চলবে। দেশের বিরুদ্ধে, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে যে লোকগুলি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো, তাদেরকেই এখন ‘দয়া’ দেখানোর কথা বলা হবে। অথচ এদের হাতে বহু তুর্কী মৃত্যুবরণ করেছে। আবার তুরস্কের ভেতরে যুগ যুগ ধরে subversion চালানো এজেন্টরা ধরা পরে যাবার পরে এখন বিদেশের দিকে চেয়ে থাকবে। এরা বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান সফল করতে সেকুলার সেনাদের সরাসরি সমর্থন দিয়ে তুর্কী জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। বিদেশী এজেন্টদের এহেন জঘন্য কার্যকলাপের পরেও এদের বাঁচানোর চেষ্টাটা নিঃসন্দেহে অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি পশ্চিমাদের সরাসরি সমর্থনের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করবে। এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আঙ্গুল তাক করবেন দেশের মানুষের যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী চেতনাকে কাজে লাগানোর জন্য। গাজা অপারেশনের সময়ে ইস্রাইলীরা তুরস্কের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মেরে ফেললেও এরদোগান কিন্তু মুখেই বকর বকর করেছিলেন; কাজে কিছুই করেননি। এবারেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি শুধু মুখেই খই ফোটাবেন।
এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী সরানোর কার্যকলাপ ইউরোপিয়রা পছন্দ করছে না এবং তুরস্ককে ন্যাটো থেকে বের করে দেবার কথাও তারা তুলছেন। কিন্তু যেই তুরস্ক সাড়ে চার’শ বছরেরও বেশি সময় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে, যে তুরস্ককে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়েছে যাতে তাদের ইসলামের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা না থাকে, যে তুরস্কে ইসলামের পূনরাবির্ভাব ঠেকাতে সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করেছে পশ্চিমারা, যে তুরস্ককে তার ইতিহাস থেকে সরিয়ে রাখতেই তাকে ন্যাটোর মাঝে আটকে রাখা হয়েছে, সেই তুরস্ককে একুশ শতকে এসে ছেড়ে দেবার পাত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়। ন্যাটোর সদস্যপদই তুরস্ককে ভূরাজনৈতিকভাবে আটকে রাখার পদ্ধতি। আর এই আটকে রাখার চেষ্টা যে স্থায়ী হবে না, সেটা পশ্চিমারা জানেন অনেক আগ থেকেই। ভূরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব স্যামুয়েল হান্টিংটনের কথায়ঃ
“What, however, if Turkey redefined itself? At some point, Turkey could be ready to give up its frustrating and humiliating role as a beggar pleading for membership in the West and to resume its much more impressive and elevated historical role as the principal Islamic interlocutor and antagonist of the West…. Having experienced the bad and the good of the West in secularism and democracy, Turkey may be equally qualified to lead Islam. But to do so it would have to reject Ataturk’s legacy more thoroughly than Russia has rejected Lenin’s”.
হান্টিংটন এই কথাগুলি লিখেছিলেন তার “The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order” বইতে, যা দুই দশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। হান্টিংটন এখানে এরদোগান বা কোন রাজনৈতিক দলের কথা চিন্তা করে এই কথাগুলি বলেননি; বলেছিলেন তুরস্কের মানুষের কথা চিন্তা করে, কারণ ভূরাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব খুব কম, বরং জনগণের গুরুত্ব বেশি। রাজনৈতিক দল আসবে-যাবে, কিন্তু দেশ চলবে জনগণ যেদিকে যেতে যায়, সেদিকে। তাই তুরস্কের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে এবং অভ্যত্থান চেষ্টার বাস্তবসম্মত হিসেব কষতে গেলে তুরস্কের জনগণ কি চায়, সেটা বুঝতে হবে।
তুরস্কের ভূরাজনীতি তুরস্কের জনগণের হাতে, এরদোগানের হাতে নয়
অভ্যত্থান চেষ্টা প্রথমে দেখে মনে হচ্ছিল সফল হচ্ছে, কিন্তু সব পালটে গেল যখন ৩০-৪০ জনের একদল সাহসী বেসামরিক লোক “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিয়ে বিদ্রোহী সেনাদের ট্যাঙ্কের সামনে চলে আসে। সৈন্যরা ভয় পেয়ে গুলি চালিয়ে বসে; তারা চিন্তাও করেনি যে কতবড় ভুল তারা করেছে। বীর এই বেসমরিক নাগরিকদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তুরস্কের মানুষ আর নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকতে পারেনি। কেমালের দুস্বপ্ন তাদের পেয়ে বসে এবং দলে দলে তারা বিদ্রোহকারীদের উপরে চড়াও হয়। রাস্তায় মানুষ দেখে সেনাবাহিনীতেও একই ঘটনা ঘটে। ইনচিরলিক ঘাঁটিতে বিপদের বাঁশি বেজে ওঠে। মার্কিনীরা বুঝে ফেলে যে কিছুক্ষণ আগেও যা নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছিল, তা এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত। রাস্তায় মোতায়েন বিদ্রোহী সেনারা আত্মসমর্পণ করতে থাকে এবং জনগণ খালি হাতে এদের উপরে প্রতিশোধ নিতে থাকে। ট্যাঙ্কের সামনে আত্মাহুতি দেয়া মানুষগুলি এরদোগানের প্রতি ভালোবাসার কারণে জীবন উতসর্গ করেনি, করেছে ইসলামের উপরে আঘাতের আশংকায়। জনগণের এই চিন্তাটাই স্যামুয়েল হান্টিংটনসহ অন্যান্য পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা বুঝেছিলেন। যেকারণে তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছে সবসময়।
আইসিস-এর হামলা তুরস্ককে নড়াতে পারছিল না, তাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ছিল পশ্চিমারা। এখানে এরদোগান আসলে তেমন বড় কোন বিষয় নয়, যদিও মিডিয়া এরদোগানকেই বড় করে প্রচার করছে। এরদোগানকে ছোট্ট করে ফেলেছে সাধারণ মানুষের ছোট্ট একটি দল, যারা বিশাল হৃদয় নিয়ে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জনগণের শক্তির সামনে ‘সুলতান এরদোগান’ নামে খ্যাত পশ্চিমের বন্ধুটিকে দুর্বল মনে হয়েছে। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীও হতে যাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক সেসময় তুরস্কের জনগণ দেখিয়ে দিল যে ভূরাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করে, এরদোগান নয়।
আমরা কি করবো, তার আগে বরং ঠিক করি “কি করবো না”
তুরস্কের জনগণের ভাষা বুঝতে যদি আমরা ভুল করি, তাহলে জনগণের শক্তিকেও আমরা বুঝতে ভুল করবো। পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের সাথে যে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি নিয়েছে, সেটা থেকে উদ্ধার পেতে জনগণকে একত্রিত হতে হবে। ভূরাজনীতিতে আমাদের অবস্থান বোঝার সময় আমাদের হয়েছে। আদর্শিক যুদ্ধের পূণরাবির্ভাবের মাঝে আমাদের অবস্থান কোথায়, সেটা বুঝতে হবে আমাদের। পাকিস্তানের মতো ভুল পথে চললে দেশের এবং দেশের মানুষের উপরে ভয়াবহ বিপর্যয় চলে আসবে।
২০০১ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সকালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মুশাররফ বৈঠক করছিলেন আগের রাতে নিউ ইয়র্কে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে, যখন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কলিন পাওয়েলের ফোন এলো। মুশাররফ বললেন যে বৈঠক শেষে কল-ব্যাক করবেন। কিন্তু পাওয়েল চাইলেন যে মুশাররফ যেন বৈঠক ছেড়ে এসে ফোন ধরেন। আজ্ঞাবহ দাসের মতো মুশাররফ তা-ই করলেন। পাওয়েল বললেন, “You are either with us or against us”. পরদিন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রধান, যিনি তখন ওয়াশিংটনে ছিলেন, জানালেন যে ডেপুটি পররাষ্ট্র সচিব রিচার্ড আরমিটেজ তাকে বলেছেন পাকিস্তানকে ঠিক করতে হবে যে তারা কোন দলে থাকবে। যদি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে পাকিস্তান “should be prepared to be bombed back to the Stone Age.” মুশাররফ এসবকিছু বর্ণনা করেছে তারা বই “In the Line of Fire: A Memoir”-এ। তিনি পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
“My decision was based on the well-being of my people and the best interests of my country – Pakistan always comes first. I war-gamed the United States as an adversary. There would be a violent and angry reaction if we didn’t support the United States. Thus the question was: if we do not join them, can we confront them and withstand the onslaught? The answer was no, we could not”.
পারভেজ মুশাররফের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা আজ সকলের সামনে পরিষ্কার। এটা বলতে দ্বিধা করি না যে মুশাররফের মতো নেতৃত্ব আমাদের দেশে আসেনি বলেই আমরা এখনো পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাইনি। নাহলে এদেশে জঙ্গী তৈরির কারখানাকে ফুয়েল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করা থেকেও আমরা পিছপা হতাম না। সেই ড্রোন ঘাঁটি ব্যবহার করে ‘ভুল করে’ হামলা করা হতো কওমী মাদ্রাসাগুলিতে, আর তারপর থেকে জঙ্গী তৈরির প্রোডাকশন লাইন প্রস্তুত হয়ে যেত! সেই জঙ্গীদের দিয়ে হামলা করাতো সেনাবাহিনীর পরিবারদের উপরে, যাতে সেনাবাহিনী ক্ষেপে গিয়ে জঙ্গীদের পরিবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলে – ঠিক যা যা পাকিস্তানে করা হয়েছে। দেশকে টুকরা টুকরা করে ফেলার চমতকার এক ফর্মূলা, যা পাকিস্তানে বেশ সফলতা পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সমস্যা যে পাকিস্তানের সরকার নয়, বরং সেদেশের জনগণ, তার প্রমাণ আমরা পাই প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন-এর লেখা ‘Hard Choices’ বইতে। তিনি সেখানে লিখেছেন যে ২০০৯ সালে পাকিস্তানের জনগণের মুখোমুখি হতে তিনি কতটা শঙ্কিত ছিলেন। তিনে লিখেন যে, “পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্বেষও বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের মিডিয়াগুলো অসন্তোষের আগুনে বরাবরই ডিজেল ঢেলেছে। তারা পাকিস্তানে তালিবান দৌরাত্ম বাড়ার জন্যে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে। এছাড়াও আরও প্রচার হতে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র নাকি ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানের পেছনে লেগেছে। এসব ছাড়াও আরও অনেক কারণে, বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেয়ার পরেও, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব বাড়তেই থাকে। আর এজন্যেই পাকিস্তান সরকারের পক্ষেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে থাকে”। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো হিলারি ক্লিনটন পাকিস্তানের সরকারকে বন্ধু মনে করছেন; আর জনগণকে মনে করছেন সমস্যা! এ-ই হলো গণতন্ত্রের তথাকথিত ধারক ও বাহক। তিনি আরও বলেন, “উদ্দেশ্য … পাকিস্তানিদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব কমানো। …… সবাই বললো, ‘পাবলিক মনের ঝাল সব আপনার উপর ঝাড়বে’। আমি বললাম, ‘ঝাড়তে দাও’”। তিনি লাহোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সাথে এক বৈঠক করতে গিয়ে অত্যন্ত বাজে সব প্রশ্নের সন্মুখীন হন। তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে তিনি ছাত্রছাত্রীদের উত্তর দিয়ে খুশি করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে তার বই থেকে এ-ও তুলে ধরতে পারি - “২০০৭ সালের এক জরিপে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তুর্কীদের সমর্থন ৯ শতাংশে নেমে এসেছে”। আবার, তিনি এরদোগান (তখন প্রধানমন্ত্রী) সম্পর্কে বলছেন যে, “যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক এই তুর্কী প্রধানমন্ত্রী”। এখানে আমরা তুর্কী জনগণ এবং পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একই রকম নীতি দেখতে পাই। আবার তুর্কী রাজনীতিবিদ এবং পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সাথে মার্কিনীদের সুসম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারি। এটা আমাদেরকে অবাক করার কথা নয়, কারণ মিশরের হোসনি মুবারক ও এল-সিসি, জর্ডানের বাদশা হুসেন ও বাদশা আবদুল্লাহ, সৌদি রাজপরিবার, ওমানের আমির, ইত্যাদি যত সব একনায়করা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সবসময় সমর্থন পেয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসিদ্ধি করার অপর নামই হচ্ছে গণতন্ত্র!
১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পারভেজ মুশাররফ পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বাস্তবায়ন করেন, যদিও ততকালীন নওয়াজ শরীফ সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। তুরস্কেও হয়তো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া-ইরাক-তুরস্কসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তার স্বার্থ বাস্তবায়ন করতো, যদিও এরদোগানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। ভূরাজনীতি এখানে আমাদের জন্যে কয়েকটি শিক্ষনীয় ব্যাপার রেখেছে।
আমরা যা শিখলাম
প্রথমতঃ তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছে যে ভূরাজনীতিতে তুরস্কের গুরুত্ব তুরস্কের জনগণের কারণে। তাদের মার্কিন সমর্থিত সরকার শুধুমাত্র তুর্কী জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখার পশ্চিমা চেষ্টায় ফুয়েল দিচ্ছে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে তুর্কী জনগণ মার্কিন পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণও পাকিস্তানের জনগণ, তাদের মার্কিন তাঁবেদার সরকার নয়। ঠিক একইভাবে, বাংলাদেশের মানুষকেও একত্রিত হতে হবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রুখতে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে, অন্য কোন কারণে নয়। দেশের স্বার্থ, দেশের জনগণের স্বার্থ, ইসলামের স্বার্থ বুঝতে হবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে। দেশের মানুষকে এই প্রসেসে সরাসরি যুক্ত করাটা জরুরি। চিন্তাহীন জাতির সামনে চিন্তার দুয়ার খুলে দিতে হবে, যাতে তারা বিদেশী ষড়যন্ত্র ধরতে পারে। জনগণের উপরে চাপ সৃষ্টি করাটা পশ্চিমা উদ্দেশ্য; জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করাটা হবে আমাদের উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমা চাপে নতি স্বীকার না করলে নয়, বরং করলেই একটা দেশের সর্বনাশ হবে। পাকিস্তান এর উতকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে। আমাদের সেই উদাহরণ এড়িয়ে চলা উচিত। আমরা পশ্চিমা পরিকল্পনার ঘোরের মাঝে পড়ে গেলে আর কোনদিন উঠতে হবে না সেখান থেকে। পশ্চিমা চাপের কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না; অন্যথায় পাকিস্তান হতে হবে!
তৃতীয়তঃ ভূরাজনীতিতে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ এর ঐতিহ্যপূর্ণ ইসলামি ইতিহাসের জন্যে, কেমাল আতাতুর্কের ‘অন্ধ-সেকুলারিজম’-এর জন্যে নয়। ধর্মান্ধতা যেমন পরিবেশ দূষণ করে, ঠিক তেমনি ‘অন্ধ-সেকুলারিজম’-ও তা-ই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে তাঁর বহুবার জেল খাটার কাহিনীর মাঝে বারংবার লিখেছেন কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে ফিরেছেন। একবার তিনি লিখেন, “মওলানা সাহেবের [মওলানা ভাসানী] সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমদের জন্যে বাঁধা নিয়ম ছিল”। আরেকবার লিখেন, “আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খন্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি”। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সৃষ্টিকর্তাকে কোথায় রেখেছেন জানিনা, তবে এটা ভাবতেই অবাক লাগে যে তুরস্কের মানুষ কি করে কেমাল আতাতুর্কের শাসনের অধীনে দিনাতিপাত করেছে, যেখানে নামাজ-রোজা-কোরআন-ইসলামিক আলোচনা ছিল হারাম বস্তু!! দম আটকে মারা যাবার কথা তুর্কীদের। অবাক হইনা, যখন দেখি তুর্কীরা সেকুলারদের বিদ্রোহ দেখে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েকটি প্রাণ বাঁচিয়েছে কোটি মুসলিমের অধিকার। বঙ্গবন্ধু নিজে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেছেন, কিন্তু তিনিও যদি কেমালের তুরস্কে থাকতেন, তাহলে সেখানে টিকতে পারতেন কিনা সন্দেহ। অথচ তুরস্কের সেই গোড়ামিপূর্ণ সেকুলার লোকটির নামে আমাদের ঢাকা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণও করা হয়েছে! কত কম জানি এবং বুঝি আমরা! ইসলাম ত্যাগ নয়, বরং ইসলামকে সঠিকভাবে বোঝার মাঝেই পশ্চিমা ষড়যন্ত্র রোখার অস্ত্র নিহিত।
চতুর্থতঃ জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সামরিক-বেসামরিক বলে কোন কিছু যেমন নেই, ঠিক তেমনি সরকারি-বেসরকারি বলেও কিছু নেই। যে তুর্কী জনগণ ট্যাঙ্কের সামনে জীবন দিয়েছে, তারা না সামরিক বাহিনীর সদস্য, না সরকারের সদস্য। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগ দেশকে পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়েছে। এই লোকগুলির আত্মত্যাগ শুধু জনগণকে রাস্তায় নামায়নি, সামরিক বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদেরকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে। দেশের স্বার্থে সামরিক-বেসামরিক জনগণের মাঝে কোন বিভেদ থাকে না। এই দুই সমাজের মাঝে ব্যবধান পশ্চিমাদের তৈরি। পশ্চিমাদের এই দূরভিসন্ধিমূলক ‘ডিভাইড-এন্ড-রুল’ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যারা নিয়মিত সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্বে ইন্ধন দেয়, এরা দেশের মানুষকে ভাগ করে দেশকে দুর্বল করতে উদ্যত। পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র রুখতে হলে এদের রুখতে হবে।
পঞ্চমতঃ দেশের বিরুদ্ধে, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য কোন ক্ষমা দেখানোর প্রশ্নই ওঠে না। ‘মানবাধিকার’-এর কথা বলে যুদ্ধাপরাধীদের যেমন মাফ করে দেয়া যায় না, ঠিক তেমনি, পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের অংশ হবার কারণে দেশী-বিদেশী এজেন্টদেরও ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না।
শেষতঃ বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের, তথা গোটা বিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশকে দুনিয়া থেকে আলাদা করে ভাবে, এরকম কূপমুন্ডুকদের তালিকায় আমাদের নাম যদি এখনও থেকে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আমাদের নাম বাদ দিতে হবে।
আপনার লেখা গুলু খুব ভাল লাগে।আশা করি পুরো ব্লগ সাইট টাই পরবো
ReplyDelete