০৩ জুন ২০১৬
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমরনায়কদের তালিকায় যাদের নাম পাওয়া যাবে, তারা সকলেই যেসব গুণ রাখতেন, তার মাঝে ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অন্যতম। আলেক্সান্ডার দি গ্রেট খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে যখন যুদ্ধে বের হয়েছিলেন, তখনই বিভিন্ন যুদ্ধে প্রমাণ করেছিলেন যে geographical features তিনি কতটা ভালো বুঝতেন। ভূগোল জানা না থাকলে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে হ্যানিবল বার্কা উত্তর আফ্রিকা থেকে জিব্রালটার পার হয়ে আল্পস পর্বত ডিঙ্গিয়ে রোম আক্রমণ করতে পারতেন না। মরুভূমির পথকে সেইরকমভাবে না বুঝলে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে খালিদ বিন ওয়ালিদ মেসোপটেমিয়া থেকে পানিবিহীন মরু অতিক্রম করে সিরিয়ার ইয়ারমুকে উপস্থিত হতে পারতেন না। নেপোলিয়নের পক্ষেও উলম ও অস্টারলিটজ-এর মতো বিজয় অর্জন সম্ভব ছিল না পুরো ইউরোপের মানচিত্রকে একত্রে চোখের সামনে চিন্তা করতে না পারলে। অর্থাৎ সামরিক দিক থেকে সফলতা পেতে ভূগোল বোঝা ফরয কাজ। একটা জাতির সবাইকে ভূগোলের মাস্টার হবার দরকার নেই। কিন্তু কিছু প্রধান বিষয়ে শিক্ষা সকলেরই নিতে হয়, যা না হলে পরবর্তীতে advanced studies-এর জন্যে লোকই পাওয়া যাবে না। প্রাথমিক আগ্রহ থেকেই একজন মানুষের কোন একটি বিষয়ে আরও বিশদ জানার আগ্রহ হয়। কিন্তু সেই প্রাথমিক আগ্রহই যদি থামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আর বিষদ জানার কেউ থাকবে না। ভূগোল তেমনই একটা বিষয়। সকলের যেমন আইনস্টাইন হতে হয় না, আবার একইভাবে আইনস্টাইনকেও একসময় নামতা শিখে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ সকলের জন্যে নামতা শেখাটা সমাজে একটা আইনস্টাইন তৈরির জন্যে জরুরি।
ভূগোল হচ্ছে এমন একটা বিষয়, যা আমাদেরকে situational awareness দেয়। অর্থাৎ আমার আশেপাশের তুলনায় আমি কোথায় আছি, সেটা বোঝাটা ভূগোলেরই অংশ। এই অর্থে ভূগোল শুধু যোদ্ধাদের জন্যে নয়, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী – এরকম সকল ক্ষেত্রে উন্নত মানুষ তৈরির জন্যে জরুরি। আর এসকল ক্ষেত্রে উন্নত মানুষ তৈরি করতে না পারলে জাতি হয় অন্ধের মতো। অন্ধ যেভাবে ছড়ি দিয়ে তার আশপাশ বোঝার চেষ্টা করে, ঠিক তেমনি অবস্থা হয় সেই জাতির। সেসময় যে-ই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সে তারই হাত ধরতে বাধ্য হয়; কারণ সে তো দেখতে পাচ্ছে না। আসলে ব্যাপারটা শুধু ভূগোলের ক্ষেত্রে নয়। ভূগোল হলো একটা মানুষ গড়ার ছোট্ট একটা হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার আবার হাতিয়ার সংক্রান্ত বিষয়ের অন্তর্গত – সেটা হচ্ছে শিক্ষা।
ভূগোল তো উন্নত শিক্ষারই অংশ
উন্নত শিক্ষায় ভূগোল থাকবেই; তবে সেখানে আরও অনেক কিছুই থাকবে। যে চিন্তা থেকে উন্নত শিক্ষার জন্ম হয়, সে চিন্তা ভূগোল বাদ দেবে না কোন কালেই। উন্নত চিন্তার শিক্ষা জন্ম দেবে এমন সব নাগরিকের, যারা কিনা উন্নত চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে। ভূগোল জানা সেই উন্নত চিন্তার একটা অপরিহার্য অংশ। একটা জাতিকে উন্নত চিন্তা থেকে দূরে রাখতে তার শিক্ষা ব্যবস্থার বারোটা বাজাতে হবে। সেটা কিভাবে করা? কেউ কি নিজের গলা নিজে কাটবে? কাটবে; যদি তাকে শেখানো যায় যে নিজের গলা কাটাটাই উত্তম কাজ! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সেটা করা সম্ভব এবং সেটা করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ আমাদের দেশেও!
একটা জাতির শিক্ষার বারোটা বাজাতে শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে এমন কিছু মানুষকে হাত করতে হবে, যারা স্বেচ্ছায় সেই গলা কাটার কাজটি করবে। তারপরের কাজটি খুব কঠিন নয়। যারা এই গলা কাটার ব্যাপারটা ধরতে পারবে, সেই লোকগুলিকে দূরে সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা বাড়া ভাতে ছাই না ফেলে। এই প্রসেসটা পূর্ণ করতে একটা জেনারেশন পুরোপুরি লেগে যাবে, কারণ একটা জেনারেশনকে এই গলা কাটার ট্রেনিং দিতে হবে। মোটামুটিভাবে ১৫-২০ বছরের মাঝে এই ব্যাপারটা একটা আকৃতি নিতে থাকবে। প্রসেসটা চালু করাটা তেমন কঠিন নয়। শুধু ধরিয়ে দিতে হবে যে যেসব বিষয় পড়ে জীবিকা অর্জন করা সম্ভব নয়, সেসব বিষয় পড়ে পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই। ব্যাস! হয়ে গেল! ওই বাতিল বিষয়ের লিস্টে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকবে; ভূগোলও থাকবে। আবার বিষয়গুলির ডিজাইনও অন্যরকম হয়ে যাবে। বইগুলি হয়ে যাবে বাস্তবতা বিবর্জিত। কল্পনাপ্রবণ গল্প-কবিতা দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা ভর্তি করা হবে। নৈতিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দেয়, এমন এমন সব ব্যাপার দিয়ে বইগুলি ভর্তি থাকবে, যা সামাজিক অসমাঞ্জস্যতা এবং অপরাধের কারণ হবে। সরকারের নিয়মের বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ভাবে বিষয় ও বই পড়াতে পারবে, যেখানে কি শেখানো হচ্ছে, তা দেখার কেউ থাকবে না। অর্থাৎ যে কেউ ইচ্ছামতো সমাজের কিছু টার্গেটেড গ্রুপের মাঝে নিজের বিশেষ প্রজেক্ট চালাতে পারবে। এর ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হবে (একেক গ্রুপে ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, অভিভাবক, কর্মচারী, নির্ভরশীল গোষ্ঠী থাকবে), যারা একে অপর থেকে আলাদা মনে করবে, এবং জাতীয় একাত্মতায় সমস্যার জন্ম দেবে। নিজেদের মনগড়া স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জন্ম দেবে। শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ব্যবসার মতো। কত টাকা খরচ করে পড়াশোনা করলাম, আর কতদিনে সেই টাকা চাকরির মাধ্যমে উঠে আসবে- সেগুলি হয়ে যাবে মূল চিন্ত্যনীয় বিষয়। বই পড়ার আগে চিন্তা করবে যে এটা পড়লে টাকা উপার্জনের নতুন কোন পন্থা পাওয়া যাবে কিনা; না হলে সে বই কিনবে না। তাই বইয়ের দোকানগুলিও সেরকম বই-ই সামনে সাজিয়ে রাখবে। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করার পেছনেই থাকবে তার পুরো চেষ্টা; তার পুরো সময় চলে যাবে পরীক্ষা-ভিত্তিক পড়াশোনায়। যা পড়ে পরীক্ষায় নম্বর বাড়ে না, সেটা পড়ার কোন সময়ও তার থাকবে না। মোট কথা, জীবিকা উপার্জনের জন্যে; পেটের দায়ে পড়া। জ্ঞান অর্জন; দেশ গড়া; জাতিকে শক্তিশালী করা; নৈতিকভাবে নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা – এগুলি উদ্দেশ্য ধূলায় লুটাবে। সেই জাতি তখন একটা সময়ে গিয়ে সমরবিদ, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী – এরকম কোন ক্যাটাগরিতেই উন্নত মানুষ জন্ম দিতে অক্ষম হবে। পুরো জাতিই উদ্দেশ্যহীনভাবে ভুল পথে হাঁটবে।
‘গলা কাটা লোক’
উপরে একটা জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেবার যে বর্ণনা দিয়েছি, সেটা Subversion-এর একটা অংশ। এই প্রসেস পৃথিবীর বহু দেশে চালানো হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। জেমস বন্ডের espionage নিয়ে সবাই ব্যাস্ত থাকলেও এই গুরুগম্ভীর ব্যাপারগুলিই ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলির আসল কাজ হিসেবে পরিগণিত। যুদ্ধ না করে যুদ্ধজয়। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হওয়ায় এর পেছনে চেষ্টাও বেশি, বাজেটও বেশি, এবং পুরো প্রসেসটা গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা থাকে। এই প্রসেস সাধারণ মানুষের পক্ষে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে প্রসেসের রেজাল্ট দেখে খুব সহজেই বোঝা যাবে যে প্রসেস কার্যকরভাবে চলছে। উপরে এই উপসর্গগুলি নিয়েই কথা বলেছি। এই প্রসেসের মাধ্যমে একটা জাতিকে চিন্তা থেকে দূরে রাখা হয়, যাতে করে সে জাতিকে তার বিপদের সময়ে হাত বাড়ালে সে কোন চিন্তা না করেই সেই হাত ধরে ফেলে; একেবারে অন্ধের মতো। তার গাইড তাকে যেদিকে নেবে, সে সেদিকেই যাবে। শিক্ষা হচ্ছে একটা জাতির দৃষ্টিশক্তির মতো। এই দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস করতে দরকার হবে কিছু ‘গলা কাটা লোক’, যাদের কথা উপরে বলেছি। এরা এজেন্ট হয়ে কাজ করবে দেশের ভেতরে, যা কেউই বুঝতে পারবে না। এদেরকে সর্বোপরি কার্যকর করে তুলতে ১৫-২০ বছর লেগে যাবে। সিস্টেমের মাঝে চিন্তাহীন লোকদের দিয়ে কাজগুলি করিয়ে নেয়া হবে। কারণ যে চিন্তা করতে পারে, সে তো এসব কাজে বাধা দেবে। যেহেতু আরেকজনের মাধ্যমে কাজটি করিয়ে নেয়া হবে, তাই কারা আসল কাজ করছে, সেটা সরাসরি দেখা যাবে না। এই বাজে কাজটা করার জন্যে যাদের রিক্রুট করা হবে, তার প্রধান যোগ্যতাই হবে দেশদ্রোহিতা। এই এজেন্টদেরকে সময়মতো এবং জায়গামতো ডাকা হবে এবং এরা এদের দেশদ্রোহী কাজ চালিয়ে নেবে।
এতক্ষণে বাংলাদেশের পাঠক বুঝে যাবেন যে তিনি যে সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে এই প্রসেসখানা কতটা গভীরভাবে চলেছে। এবং সেখানে কেউ বাধা দেয়নি, বা চেষ্টা করেনি, বা বাধা দেবার সুযোগ পায়নি। চিন্তা করে দেখুন তো, আপনার পাশের মানুষটিকে শিক্ষার উদ্দেশ্য কি বলা হয়েছে? জীবিকা উপার্জনের বাইরে শিক্ষা নেবার চেষ্টা কতটুকু করা হয়েছে? ‘এটা পড়ে চাকরি পাওয়া যাবে না; এটা পড়ে জীবনে দাঁড়ানো যাবে না; এটা না পড়লে পরিবারের মুখ থাকবে না’ – এগুলি বলা হয়েছে কিনা? ‘পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে; জিপিএ-৫ পেতে হবে, নাহলে ভবিষ্যত অন্ধকার’- এগুলি বলা হয়েছে কিনা? এই ধারণাগুলি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ কথা না বলে এবং ভেড়ার পালের মতো মেনে নেয়। এই ব্যাপারগুলি চলছে ধীরে ধীরে – গত ২০-২৫ বছর ধরে। এদেশের যুবসমাজকে অন্ধ করে গড়ে তোলা হয়েছে। জীবিকা অর্জন ছাড়া তার আর কোন যোগ্যতা নেই; আসলে সেটাতেও সে দক্ষ নয়। একটা প্রশ্ন করার ক্ষমতা তার নেই; কারণ সে চিরকাল উত্তরই মুখস্ত করেছে। দেশকে উপরে ওঠানো; বিপদে দেশকে রক্ষা করা; দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া –এগুলি কাজে সে পুরোপুরিভাবে অক্ষম। সে নিজের উদ্দেশ্য যেমন জানে না, দেশের উদ্দেশ্যও না। এরাই হবে এদেশের ভবিষ্যত। এরাই জাতির উদ্দেশ্য ঠিক করবে একটা সময়।
শিক্ষার সাথে ভূ-রাজনীতির সম্পর্কটা আসলে কি?
এর মাঝেও অবশ্য কিছু rotten apple পাওয়া যাবে, যাদেরকে Subversion-এর মাধ্যমে পুরোপুরি কাবু করা যায়নি। তারা এই প্রসেস ধরতে পারবে এবং প্রশ্ন করে বসবে। কারণ তারা অন্ধ হলেও তাদের অন্য ইন্দ্রিয়গুলি কাজ করছিলো। অন্য ইন্দ্রিয়গুলি এই শিক্ষার প্রসেসের বাইরে থেকে আসতে পারে। তাই সেই ইন্দ্রিয়গুলিকে ভোঁতা করতে আরেকটি প্রসেস লাগে, যদিও সেটাও শিক্ষার সাথে সমান্তরালে চলে। সেটাও subversion-ই অংশ। বেঁচে থাকলে সেটা নিয়ে আরেকদিন লিখবো আশা রাখি। subversion-এর অন্য বিষয়গুলি নিয়েও লিখবো আশা রাখি। subversion-এর উপরে লেখা বই সম্পর্কে মানুষ আজ অজ্ঞ। সেটাও ওই একই বৃহত পরিকল্পনারই অংশ; যাতে কেউ হঠাত করে ঘুম থেকে জেগে না যায়। তবে এতক্ষণ শিক্ষা নিয়ে যে প্যাঁচাল পারলাম, সেটার সাথে ভূরাজনীতির কি সম্পর্ক আছে যে এই লেখাটা লিখলাম? সেটাই বলছি।
আমরা সবাই অস্বস্তিত ভুগছি যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিরাট সমস্যায় পতিত। কিন্তু যেহেতু আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করা হয়েছে, তাই আমরা এর কোন সমাধান দিতে পারিনা। দশ জনে দশটা সমাধান নিয়ে আসবে; কেউ কেউ আবার উমুক-তুমুক দেশের উদাহরণও নিয়ে আসবেন। এর কারণ হলো কারুরই সমাধান দেবার ক্ষমতা নেই। স্ট্র্যাটেজিক জায়গাগুলিতে বসিয়ে দেয়া এজেন্টদেরকে এড়িয়ে কিছুই করা সম্ভব হবে না। আর সিস্টেমটা ডিজাইন করা হয়েছে এমনভাবে যে তাদেরকে বাইপাস করার কোন সুযোগ থাকবে না। এই এজেন্টদের মাঝেও আবার গ্রুপিং তৈরি করা থাকবে, যাদের কাজ হবে একে অপরের সাথে ঝগড়া করে দেশকে পিছিয়ে দেয়া। শিক্ষা পিচিয়ে যাওয়া মানেই দেশ দুর্বল হওয়া। এখন এটা প্রাথমিকভাবে বোঝাই যায় যে এই দেশ দুর্বল হলে সরাসরি লাভবান কারা হচ্ছে। তবে যারা সরাসরি লাভবান হচ্ছে, তাদের লাভালাভ স্বল্প সময়ের। যেটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে না তা হলো পরোক্ষভাবে কারা লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি আজকে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের শক্তিশালী ভাবতে আরম্ভ করে, তাহলে তো বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাবে। এই ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেলে তো এটাকে আবার নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক কষ্ট হবে (অথবা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবেই না কখনো)। শুধু তা-ই নয়, একবার এই ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেলে এটা বাকি বিশ্বের জন্যে ‘বাজে’ উদাহরণ হয়ে যাবে। তখন তো পুরো বিশ্বই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যালান্স রেখে দুনিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা যাদের উদ্দেশ্যের মাঝে পড়ে, প্রকৃত সুবিধা তারাই পাবে। বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ গায়ের জোরে হয় না; হয় চিন্তার জোরে। তাই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মানেই দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ।
পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করাটা যেন একেবারে জীবন-মরন সমস্যা। দেশকে গড়তে এই 'পরীক্ষার রেজাল্ট'-কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যাবস্থার গুরুত্ব কতটুকু? |
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমরনায়কদের তালিকায় যাদের নাম পাওয়া যাবে, তারা সকলেই যেসব গুণ রাখতেন, তার মাঝে ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অন্যতম। আলেক্সান্ডার দি গ্রেট খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে যখন যুদ্ধে বের হয়েছিলেন, তখনই বিভিন্ন যুদ্ধে প্রমাণ করেছিলেন যে geographical features তিনি কতটা ভালো বুঝতেন। ভূগোল জানা না থাকলে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে হ্যানিবল বার্কা উত্তর আফ্রিকা থেকে জিব্রালটার পার হয়ে আল্পস পর্বত ডিঙ্গিয়ে রোম আক্রমণ করতে পারতেন না। মরুভূমির পথকে সেইরকমভাবে না বুঝলে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে খালিদ বিন ওয়ালিদ মেসোপটেমিয়া থেকে পানিবিহীন মরু অতিক্রম করে সিরিয়ার ইয়ারমুকে উপস্থিত হতে পারতেন না। নেপোলিয়নের পক্ষেও উলম ও অস্টারলিটজ-এর মতো বিজয় অর্জন সম্ভব ছিল না পুরো ইউরোপের মানচিত্রকে একত্রে চোখের সামনে চিন্তা করতে না পারলে। অর্থাৎ সামরিক দিক থেকে সফলতা পেতে ভূগোল বোঝা ফরয কাজ। একটা জাতির সবাইকে ভূগোলের মাস্টার হবার দরকার নেই। কিন্তু কিছু প্রধান বিষয়ে শিক্ষা সকলেরই নিতে হয়, যা না হলে পরবর্তীতে advanced studies-এর জন্যে লোকই পাওয়া যাবে না। প্রাথমিক আগ্রহ থেকেই একজন মানুষের কোন একটি বিষয়ে আরও বিশদ জানার আগ্রহ হয়। কিন্তু সেই প্রাথমিক আগ্রহই যদি থামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আর বিষদ জানার কেউ থাকবে না। ভূগোল তেমনই একটা বিষয়। সকলের যেমন আইনস্টাইন হতে হয় না, আবার একইভাবে আইনস্টাইনকেও একসময় নামতা শিখে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ সকলের জন্যে নামতা শেখাটা সমাজে একটা আইনস্টাইন তৈরির জন্যে জরুরি।
ভূগোল হচ্ছে এমন একটা বিষয়, যা আমাদেরকে situational awareness দেয়। অর্থাৎ আমার আশেপাশের তুলনায় আমি কোথায় আছি, সেটা বোঝাটা ভূগোলেরই অংশ। এই অর্থে ভূগোল শুধু যোদ্ধাদের জন্যে নয়, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী – এরকম সকল ক্ষেত্রে উন্নত মানুষ তৈরির জন্যে জরুরি। আর এসকল ক্ষেত্রে উন্নত মানুষ তৈরি করতে না পারলে জাতি হয় অন্ধের মতো। অন্ধ যেভাবে ছড়ি দিয়ে তার আশপাশ বোঝার চেষ্টা করে, ঠিক তেমনি অবস্থা হয় সেই জাতির। সেসময় যে-ই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সে তারই হাত ধরতে বাধ্য হয়; কারণ সে তো দেখতে পাচ্ছে না। আসলে ব্যাপারটা শুধু ভূগোলের ক্ষেত্রে নয়। ভূগোল হলো একটা মানুষ গড়ার ছোট্ট একটা হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার আবার হাতিয়ার সংক্রান্ত বিষয়ের অন্তর্গত – সেটা হচ্ছে শিক্ষা।
ভূগোল তো উন্নত শিক্ষারই অংশ
উন্নত শিক্ষায় ভূগোল থাকবেই; তবে সেখানে আরও অনেক কিছুই থাকবে। যে চিন্তা থেকে উন্নত শিক্ষার জন্ম হয়, সে চিন্তা ভূগোল বাদ দেবে না কোন কালেই। উন্নত চিন্তার শিক্ষা জন্ম দেবে এমন সব নাগরিকের, যারা কিনা উন্নত চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে। ভূগোল জানা সেই উন্নত চিন্তার একটা অপরিহার্য অংশ। একটা জাতিকে উন্নত চিন্তা থেকে দূরে রাখতে তার শিক্ষা ব্যবস্থার বারোটা বাজাতে হবে। সেটা কিভাবে করা? কেউ কি নিজের গলা নিজে কাটবে? কাটবে; যদি তাকে শেখানো যায় যে নিজের গলা কাটাটাই উত্তম কাজ! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সেটা করা সম্ভব এবং সেটা করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ আমাদের দেশেও!
বই পড়ার আগে এখন আমরা চিন্তা করি সেটা জীবিকা অর্জনে কতটা সাহায্য করবে। বই পড়াটা এখন জীবনের উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত নয়। |
একটা জাতির শিক্ষার বারোটা বাজাতে শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে এমন কিছু মানুষকে হাত করতে হবে, যারা স্বেচ্ছায় সেই গলা কাটার কাজটি করবে। তারপরের কাজটি খুব কঠিন নয়। যারা এই গলা কাটার ব্যাপারটা ধরতে পারবে, সেই লোকগুলিকে দূরে সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা বাড়া ভাতে ছাই না ফেলে। এই প্রসেসটা পূর্ণ করতে একটা জেনারেশন পুরোপুরি লেগে যাবে, কারণ একটা জেনারেশনকে এই গলা কাটার ট্রেনিং দিতে হবে। মোটামুটিভাবে ১৫-২০ বছরের মাঝে এই ব্যাপারটা একটা আকৃতি নিতে থাকবে। প্রসেসটা চালু করাটা তেমন কঠিন নয়। শুধু ধরিয়ে দিতে হবে যে যেসব বিষয় পড়ে জীবিকা অর্জন করা সম্ভব নয়, সেসব বিষয় পড়ে পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই। ব্যাস! হয়ে গেল! ওই বাতিল বিষয়ের লিস্টে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকবে; ভূগোলও থাকবে। আবার বিষয়গুলির ডিজাইনও অন্যরকম হয়ে যাবে। বইগুলি হয়ে যাবে বাস্তবতা বিবর্জিত। কল্পনাপ্রবণ গল্প-কবিতা দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা ভর্তি করা হবে। নৈতিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দেয়, এমন এমন সব ব্যাপার দিয়ে বইগুলি ভর্তি থাকবে, যা সামাজিক অসমাঞ্জস্যতা এবং অপরাধের কারণ হবে। সরকারের নিয়মের বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ভাবে বিষয় ও বই পড়াতে পারবে, যেখানে কি শেখানো হচ্ছে, তা দেখার কেউ থাকবে না। অর্থাৎ যে কেউ ইচ্ছামতো সমাজের কিছু টার্গেটেড গ্রুপের মাঝে নিজের বিশেষ প্রজেক্ট চালাতে পারবে। এর ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হবে (একেক গ্রুপে ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, অভিভাবক, কর্মচারী, নির্ভরশীল গোষ্ঠী থাকবে), যারা একে অপর থেকে আলাদা মনে করবে, এবং জাতীয় একাত্মতায় সমস্যার জন্ম দেবে। নিজেদের মনগড়া স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জন্ম দেবে। শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ব্যবসার মতো। কত টাকা খরচ করে পড়াশোনা করলাম, আর কতদিনে সেই টাকা চাকরির মাধ্যমে উঠে আসবে- সেগুলি হয়ে যাবে মূল চিন্ত্যনীয় বিষয়। বই পড়ার আগে চিন্তা করবে যে এটা পড়লে টাকা উপার্জনের নতুন কোন পন্থা পাওয়া যাবে কিনা; না হলে সে বই কিনবে না। তাই বইয়ের দোকানগুলিও সেরকম বই-ই সামনে সাজিয়ে রাখবে। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করার পেছনেই থাকবে তার পুরো চেষ্টা; তার পুরো সময় চলে যাবে পরীক্ষা-ভিত্তিক পড়াশোনায়। যা পড়ে পরীক্ষায় নম্বর বাড়ে না, সেটা পড়ার কোন সময়ও তার থাকবে না। মোট কথা, জীবিকা উপার্জনের জন্যে; পেটের দায়ে পড়া। জ্ঞান অর্জন; দেশ গড়া; জাতিকে শক্তিশালী করা; নৈতিকভাবে নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা – এগুলি উদ্দেশ্য ধূলায় লুটাবে। সেই জাতি তখন একটা সময়ে গিয়ে সমরবিদ, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী – এরকম কোন ক্যাটাগরিতেই উন্নত মানুষ জন্ম দিতে অক্ষম হবে। পুরো জাতিই উদ্দেশ্যহীনভাবে ভুল পথে হাঁটবে।
‘গলা কাটা লোক’
উপরে একটা জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেবার যে বর্ণনা দিয়েছি, সেটা Subversion-এর একটা অংশ। এই প্রসেস পৃথিবীর বহু দেশে চালানো হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। জেমস বন্ডের espionage নিয়ে সবাই ব্যাস্ত থাকলেও এই গুরুগম্ভীর ব্যাপারগুলিই ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলির আসল কাজ হিসেবে পরিগণিত। যুদ্ধ না করে যুদ্ধজয়। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হওয়ায় এর পেছনে চেষ্টাও বেশি, বাজেটও বেশি, এবং পুরো প্রসেসটা গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা থাকে। এই প্রসেস সাধারণ মানুষের পক্ষে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে প্রসেসের রেজাল্ট দেখে খুব সহজেই বোঝা যাবে যে প্রসেস কার্যকরভাবে চলছে। উপরে এই উপসর্গগুলি নিয়েই কথা বলেছি। এই প্রসেসের মাধ্যমে একটা জাতিকে চিন্তা থেকে দূরে রাখা হয়, যাতে করে সে জাতিকে তার বিপদের সময়ে হাত বাড়ালে সে কোন চিন্তা না করেই সেই হাত ধরে ফেলে; একেবারে অন্ধের মতো। তার গাইড তাকে যেদিকে নেবে, সে সেদিকেই যাবে। শিক্ষা হচ্ছে একটা জাতির দৃষ্টিশক্তির মতো। এই দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস করতে দরকার হবে কিছু ‘গলা কাটা লোক’, যাদের কথা উপরে বলেছি। এরা এজেন্ট হয়ে কাজ করবে দেশের ভেতরে, যা কেউই বুঝতে পারবে না। এদেরকে সর্বোপরি কার্যকর করে তুলতে ১৫-২০ বছর লেগে যাবে। সিস্টেমের মাঝে চিন্তাহীন লোকদের দিয়ে কাজগুলি করিয়ে নেয়া হবে। কারণ যে চিন্তা করতে পারে, সে তো এসব কাজে বাধা দেবে। যেহেতু আরেকজনের মাধ্যমে কাজটি করিয়ে নেয়া হবে, তাই কারা আসল কাজ করছে, সেটা সরাসরি দেখা যাবে না। এই বাজে কাজটা করার জন্যে যাদের রিক্রুট করা হবে, তার প্রধান যোগ্যতাই হবে দেশদ্রোহিতা। এই এজেন্টদেরকে সময়মতো এবং জায়গামতো ডাকা হবে এবং এরা এদের দেশদ্রোহী কাজ চালিয়ে নেবে।
এতক্ষণে বাংলাদেশের পাঠক বুঝে যাবেন যে তিনি যে সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে এই প্রসেসখানা কতটা গভীরভাবে চলেছে। এবং সেখানে কেউ বাধা দেয়নি, বা চেষ্টা করেনি, বা বাধা দেবার সুযোগ পায়নি। চিন্তা করে দেখুন তো, আপনার পাশের মানুষটিকে শিক্ষার উদ্দেশ্য কি বলা হয়েছে? জীবিকা উপার্জনের বাইরে শিক্ষা নেবার চেষ্টা কতটুকু করা হয়েছে? ‘এটা পড়ে চাকরি পাওয়া যাবে না; এটা পড়ে জীবনে দাঁড়ানো যাবে না; এটা না পড়লে পরিবারের মুখ থাকবে না’ – এগুলি বলা হয়েছে কিনা? ‘পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে; জিপিএ-৫ পেতে হবে, নাহলে ভবিষ্যত অন্ধকার’- এগুলি বলা হয়েছে কিনা? এই ধারণাগুলি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ কথা না বলে এবং ভেড়ার পালের মতো মেনে নেয়। এই ব্যাপারগুলি চলছে ধীরে ধীরে – গত ২০-২৫ বছর ধরে। এদেশের যুবসমাজকে অন্ধ করে গড়ে তোলা হয়েছে। জীবিকা অর্জন ছাড়া তার আর কোন যোগ্যতা নেই; আসলে সেটাতেও সে দক্ষ নয়। একটা প্রশ্ন করার ক্ষমতা তার নেই; কারণ সে চিরকাল উত্তরই মুখস্ত করেছে। দেশকে উপরে ওঠানো; বিপদে দেশকে রক্ষা করা; দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া –এগুলি কাজে সে পুরোপুরিভাবে অক্ষম। সে নিজের উদ্দেশ্য যেমন জানে না, দেশের উদ্দেশ্যও না। এরাই হবে এদেশের ভবিষ্যত। এরাই জাতির উদ্দেশ্য ঠিক করবে একটা সময়।
শিক্ষার সাথে ভূ-রাজনীতির সম্পর্কটা আসলে কি?
এর মাঝেও অবশ্য কিছু rotten apple পাওয়া যাবে, যাদেরকে Subversion-এর মাধ্যমে পুরোপুরি কাবু করা যায়নি। তারা এই প্রসেস ধরতে পারবে এবং প্রশ্ন করে বসবে। কারণ তারা অন্ধ হলেও তাদের অন্য ইন্দ্রিয়গুলি কাজ করছিলো। অন্য ইন্দ্রিয়গুলি এই শিক্ষার প্রসেসের বাইরে থেকে আসতে পারে। তাই সেই ইন্দ্রিয়গুলিকে ভোঁতা করতে আরেকটি প্রসেস লাগে, যদিও সেটাও শিক্ষার সাথে সমান্তরালে চলে। সেটাও subversion-ই অংশ। বেঁচে থাকলে সেটা নিয়ে আরেকদিন লিখবো আশা রাখি। subversion-এর অন্য বিষয়গুলি নিয়েও লিখবো আশা রাখি। subversion-এর উপরে লেখা বই সম্পর্কে মানুষ আজ অজ্ঞ। সেটাও ওই একই বৃহত পরিকল্পনারই অংশ; যাতে কেউ হঠাত করে ঘুম থেকে জেগে না যায়। তবে এতক্ষণ শিক্ষা নিয়ে যে প্যাঁচাল পারলাম, সেটার সাথে ভূরাজনীতির কি সম্পর্ক আছে যে এই লেখাটা লিখলাম? সেটাই বলছি।
আমরা সবাই অস্বস্তিত ভুগছি যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিরাট সমস্যায় পতিত। কিন্তু যেহেতু আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করা হয়েছে, তাই আমরা এর কোন সমাধান দিতে পারিনা। দশ জনে দশটা সমাধান নিয়ে আসবে; কেউ কেউ আবার উমুক-তুমুক দেশের উদাহরণও নিয়ে আসবেন। এর কারণ হলো কারুরই সমাধান দেবার ক্ষমতা নেই। স্ট্র্যাটেজিক জায়গাগুলিতে বসিয়ে দেয়া এজেন্টদেরকে এড়িয়ে কিছুই করা সম্ভব হবে না। আর সিস্টেমটা ডিজাইন করা হয়েছে এমনভাবে যে তাদেরকে বাইপাস করার কোন সুযোগ থাকবে না। এই এজেন্টদের মাঝেও আবার গ্রুপিং তৈরি করা থাকবে, যাদের কাজ হবে একে অপরের সাথে ঝগড়া করে দেশকে পিছিয়ে দেয়া। শিক্ষা পিচিয়ে যাওয়া মানেই দেশ দুর্বল হওয়া। এখন এটা প্রাথমিকভাবে বোঝাই যায় যে এই দেশ দুর্বল হলে সরাসরি লাভবান কারা হচ্ছে। তবে যারা সরাসরি লাভবান হচ্ছে, তাদের লাভালাভ স্বল্প সময়ের। যেটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে না তা হলো পরোক্ষভাবে কারা লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি আজকে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের শক্তিশালী ভাবতে আরম্ভ করে, তাহলে তো বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাবে। এই ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেলে তো এটাকে আবার নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক কষ্ট হবে (অথবা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবেই না কখনো)। শুধু তা-ই নয়, একবার এই ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেলে এটা বাকি বিশ্বের জন্যে ‘বাজে’ উদাহরণ হয়ে যাবে। তখন তো পুরো বিশ্বই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যালান্স রেখে দুনিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা যাদের উদ্দেশ্যের মাঝে পড়ে, প্রকৃত সুবিধা তারাই পাবে। বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ গায়ের জোরে হয় না; হয় চিন্তার জোরে। তাই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মানেই দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ।
No comments:
Post a Comment