০৮ নভেম্বর ২০১৪
নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলা হলেও সেই নদীমাতৃকতার কতটুকু আজ অবশিষ্ট আছে, সেটা সত্যিই হিসেব কষে দেখতে হবে। এই দেশের শতশত নদ-নদীর বহুবিধ অবদানের কথা অস্বীকার করে আমরা এখন প্রায় কাদা বা ধূলা-মাতৃক দেশে রূপান্তরিত হয়েছি। এদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে নদ-নদীর যথেষ্ট প্রভাব ছিল বলেই আমরা নিজেদের নদীমাতৃক দেশ বলতে পেরেছি বহুকাল (এখনও বলি অবশ্য)। শুধুমাত্র অনেক নদী থাকার জন্যেই নয়; নদীর গুরুত্বকে অন্তরের মাঝে অনুভব করতে পারার কারণেই আমরা নিজেদের নদীমাতৃক বলেছি। এখানে 'মাতৃ' বা 'মাতা' বলে কথা। আত্মিক বন্ধন না থাকলে তো মাতা হতে পারে না। আমি উপড়ে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছি আমাদের নদীমাতৃকতা নিয়ে, সেটার উতপত্তি এই মাতৃত্বের আত্মিকতার অভাববোধ থেকেই। এখন আর নদীর আর্তনাদ আমাদের কাঁদায় না; সুখের সাথী হিসেবে নদীকে পাই না কাছে। শুধু কষ্টের কারণ হিসেবেই নদী আমাদের সামনে অবির্ভূত হচ্ছে প্রতি নিয়ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় আমরা নদীর সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন ফিরে পাবার চেষ্টা করলে সেটা কি পাগলের প্রলাপ হবে? মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা ঠিক হয়ে যাবার পর থেকে যেই "সমুদ্র অর্থনীতি" বা "ব্লু ইকনমি"-এর কথা বলা হচ্ছে, সেটার সাথে আমাদের নদীমাতৃকতার সম্পর্কটা কোথায়? সেটাই বের করার একটা ছোট্ট প্রয়াস চালাচ্ছি এখানে।
মানুষের জীবকার উপরে যেই জিনিসটি অনেক প্রভাব বিস্তার করে থাকবে, সেটি যে অন্য যেকোন কিছুর চাইতে বেশি গুরুত্ববহ হবে, তা আর বলে দিতে হবে না। বাংলাদেশের মানুষের জীবকার উপরে এদেশের নদনদীগুলিরও সেই একই রকম প্রভাব বিদ্যমান ছিল বহুকাল। সেই প্রভাব কমলেও এখনও আছে বললে পুরোপুরি ভুল না হবেনা, কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে একটু না ঘাটালে অনেক বড় একটা বিষয়কে আমরা উপেক্ষা করে যাবো। উজানের প্রতিবেশী দেশে অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধের পর বাঁধ দেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের নদনদীর উপরে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে, তা থেকেই আমাদের নদনদীগুলির সেই প্রভাব হারানোর সূত্রপাত। আর সেই কমে যাওয়া গুরুত্বের নদনদীগুলির শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা কিন্তু আমরাই করেছি। নদীগুলিকে মেরে এই শূণ্যস্থান কি দিয়ে পূরণ হলো, সেটা বের করাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
নদী কি প্রতিবন্ধকতা?
পানির অপর নাম জীবন। বেঁচে থাকার তাগিদেই নদীর মরুকরণ দেখে আমরা খুঁড়েছি মাটি; পেয়েছি পানি। সেই পানি শুধু পানই করিনি, শস্য ফলাতেও ব্যবহার করেছি। যেই নদী ছিল একসময়কার বাংলার যাতায়াতের সবচাইতে সহজ মাধ্যম, সেই নদীতে হাজার হাজার কিলোমিটার চর পড়তে থাকায় আমরা নদীর উপর দিয়ে তৈরি করলাম সেতু; বানালাম সড়ক পরিবহণ নেটওয়ার্ক। নদীতে পানি কমার সাথে সাথে নদীর প্রাণীজ সম্পদেরও ঘাটতি পড়তে লাগলো; আমরা যেন ভুলেই যেতে বসেছিলাম - মাছে-ভাতে বাঙ্গালী। আজ বেঁচে থাকার বেশিরভাগ কর্মকান্ডের জন্যেই আমরা নদীর উপরে নির্ভশীলতা কমাতে পারলেই যেন বেঁচে যাই। শুধুমাত্র দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকার মানুষ ছাড়া বাকিরা প্রায় সবাই নদীপথের চাইতে নদীর উপর দিয়ে উড়াল দিয়ে তৈরি করা পথে যাতায়াতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পথিমধ্যে এমন কোন নদী যদি পরে, যেটা উড়াল দিয়ে পার হওয়া যায় না, সেটাকে আমরা উটকো ঝামেলা হিসেবেই দেখি। নদনদী এখন বছর বছর কূল ছাপিয়ে বন্যারই অন্য নাম মাত্র। ভয়াল নদীভাঙ্গন হয়ে উঠলো নদীর হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি। নদনদী হলো কষ্ট; যাকে ছাপিয়ে যেতে পারলেই যেন আমাদের শান্তি। সেই আত্মিক বন্ধনের পরিসমাপ্তি এখানেই। তবে এই লেখার পরিসমাপ্তি এখানেই নয়; বরং শুরু। মনস্তাত্বিকভাবে নদীর সাথে বিচ্ছেদের পর থেকেই আমরা হয়ে গেলাম স্থলজ প্রাণী। এমন না যে আমরা আগে জলজ ছিলাম; কিন্তু পানির সাথে বসবাসের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাধারাও পানির সাথেই দোল খেত। সেই চিন্তাধারা এখন পানি থেকে অনেক দূরে সরে আসায় পানিতে আমাদের চোখে শুধু বন্যাই দেখি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্র থেকে দূরে বসবাস করায় পানির সাথে সৃষ্ট এই দূরত্ব বিশেষ গুরুত্ব বহণ করে। আমাদের চিন্তা চেতনা থেকে পানিকে আমরা প্রায় বাদই দিতে বসেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই চিন্তাধারা সামষ্টিকভাবে আমাদের পিছিয়ে দেবার জন্যে একটা বিরাট বাধা তৈরি করেছে। সমুদ্র অর্থনীতির বাস্তবায়নের পথে এটি একটি বিষাক্ত কাঁটা!
"পানিশিক্ষা"
অর্থনৈতিক উন্নতির সিঁড়ি বাইতে হলে সমুদ্রের দিকে আমাদের হাত বাড়াতেই হবে - এই কথাটা আজ সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু যে জাতি তাদের হাজার বছরের পানির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি, তাদেরকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেললে তার ডুবে যাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। ঢেউয়ের উপরে ভাসতে না জানলে ঢেউকে কাজে লাগাবার প্রশ্নই ওঠে না। অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব বাধা সরানোর পেছনে আমাদের আজ থেকেই উঠে পড়ে লাগতে হবে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই "পানিবিমূখতা"। এই বাধা সরানোর উপায় একটিই - আজ থেকেই সকলকে "পানিশিক্ষা"-য় শিক্ষিত করা। পানির সাথে বসবাসের সেই পুরোনো গল্পটা আবার নতুন করে বলতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের পানি বিষয়ক সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। কারণ তাতে পরবর্তী প্রজন্ম খাপছাড়াভাবে আলাদা আলাদা দিক থেকে পানিকে চিনবে; একটিমাত্র তীখন দূরদৃষ্টি দিয়ে চিনবে না। ফোকাস না থাকলে ভিত্তি গড়া সম্ভব নয়। আর টেকসই উন্নয়নের জন্যে ভিত্তি হতে হবে শক্ত।
নদীমাতৃকতা আসলে একটা সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে শুধু নদী নিয়ে রচনা লিখলেই হবে না; নদীমাতৃকতাকে ঘিরে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে আনতে হবে হাতে কলমের সম্পৃক্ততা। পানি, নদী ও সমুদ্র গবেষণাতে আসতে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এখানে শুধুমাত্র মিষ্টি কথা বলেই কাউকে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নয়; তাদের দেখাতে হবে সত্যিকারের আশা; তৈরি করতে হবে 'রোল মডেল', যাদেরকে অনুসরণ করে নতুনেরা প্রবেশ করবে। গবেষণাতে নতুন প্রজন্মকে এনে আমরা অন্তত ভবিষ্যতের পরিকল্পনাকারীদের জন্য একটা দিকনির্দেশনা দিয়ে যেতে পারি। আমাদের ছেড়ে যাওয়া কাজ যেন তারা করে নিতে পারে খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই। নতুনদের দেখাতে হবে আশা; যেটার শুরু করতে হবে একেবারে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই থেকেই। এটা হবে "পানিশিক্ষা"-এর শুরুটা এখানেই হতে হবে।
খেলাধূলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে যত সহজে আকৃষ্ট করা যায়, অন্য কোন মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। পানির উপরে নির্ভর খেলাগুলিকে সামনে নিয়ে আসাটা এই "পানিশিক্ষা"-এর গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হতে পারে। সাঁতার এবং নৌকাবাইচের যে কত ধরন রয়েছে সারা দুনিয়াতে; আমরা ক'টা ধরনকে উঠিয়ে আনতে পেরেছি? আমাদের যেই প্রজন্ম ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবে, তাদেরকে এই খেলা আকৃষ্ট করতে পেরেছে কি? ক্রিকেট খেলাতো প্রায় সবাই দেখছে; নৌকাবাইচ দেখেছে কতজন? পালতোলা নৌকা চালাতে পারে কতজন? 'সেইলিং' নামে যে একটা খেলা আছে দুনিয়াতে সেটা কি আমরা জানি?
এই "পানিশিক্ষা"-কে আমরা এখন থেকেই যদি গুরুত্ব দেওয়া শুরু না করি, তাহলে একটা সময় আসবে যখন আমরা অনেকদূর এগিয়েও পিছিয়ে যাবো; কারণ কোন এক সময়ে আমরা দূরদৃষ্টি নিয়ে কাজ করিনি। ভবিষ্যতের ব্লু ইকনমি বা ম্যারিটাইম নেশন যেই ধারণার প্রতিষ্ঠার কথাই বলি না কেন, মনস্তাত্বিক দিক থেকে নিজেদেরকে তৈরি করতে না পারলে প্রকৃতপক্ষে এগুলি শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না যে বাকি বিশ্বও থেমে নেই। এখানে অন্যদের চাইতে বেশি গতিতে না চলতে পারলে নিজেদের তুলনামূলকভাবে স্থবিরই মনে হবে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলা হলেও সেই নদীমাতৃকতার কতটুকু আজ অবশিষ্ট আছে, সেটা সত্যিই হিসেব কষে দেখতে হবে। এই দেশের শতশত নদ-নদীর বহুবিধ অবদানের কথা অস্বীকার করে আমরা এখন প্রায় কাদা বা ধূলা-মাতৃক দেশে রূপান্তরিত হয়েছি। এদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে নদ-নদীর যথেষ্ট প্রভাব ছিল বলেই আমরা নিজেদের নদীমাতৃক দেশ বলতে পেরেছি বহুকাল (এখনও বলি অবশ্য)। শুধুমাত্র অনেক নদী থাকার জন্যেই নয়; নদীর গুরুত্বকে অন্তরের মাঝে অনুভব করতে পারার কারণেই আমরা নিজেদের নদীমাতৃক বলেছি। এখানে 'মাতৃ' বা 'মাতা' বলে কথা। আত্মিক বন্ধন না থাকলে তো মাতা হতে পারে না। আমি উপড়ে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছি আমাদের নদীমাতৃকতা নিয়ে, সেটার উতপত্তি এই মাতৃত্বের আত্মিকতার অভাববোধ থেকেই। এখন আর নদীর আর্তনাদ আমাদের কাঁদায় না; সুখের সাথী হিসেবে নদীকে পাই না কাছে। শুধু কষ্টের কারণ হিসেবেই নদী আমাদের সামনে অবির্ভূত হচ্ছে প্রতি নিয়ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় আমরা নদীর সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন ফিরে পাবার চেষ্টা করলে সেটা কি পাগলের প্রলাপ হবে? মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা ঠিক হয়ে যাবার পর থেকে যেই "সমুদ্র অর্থনীতি" বা "ব্লু ইকনমি"-এর কথা বলা হচ্ছে, সেটার সাথে আমাদের নদীমাতৃকতার সম্পর্কটা কোথায়? সেটাই বের করার একটা ছোট্ট প্রয়াস চালাচ্ছি এখানে।
মানুষের জীবকার উপরে যেই জিনিসটি অনেক প্রভাব বিস্তার করে থাকবে, সেটি যে অন্য যেকোন কিছুর চাইতে বেশি গুরুত্ববহ হবে, তা আর বলে দিতে হবে না। বাংলাদেশের মানুষের জীবকার উপরে এদেশের নদনদীগুলিরও সেই একই রকম প্রভাব বিদ্যমান ছিল বহুকাল। সেই প্রভাব কমলেও এখনও আছে বললে পুরোপুরি ভুল না হবেনা, কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে একটু না ঘাটালে অনেক বড় একটা বিষয়কে আমরা উপেক্ষা করে যাবো। উজানের প্রতিবেশী দেশে অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধের পর বাঁধ দেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের নদনদীর উপরে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে, তা থেকেই আমাদের নদনদীগুলির সেই প্রভাব হারানোর সূত্রপাত। আর সেই কমে যাওয়া গুরুত্বের নদনদীগুলির শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা কিন্তু আমরাই করেছি। নদীগুলিকে মেরে এই শূণ্যস্থান কি দিয়ে পূরণ হলো, সেটা বের করাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
উজানে বাঁধ দেওয়ায় নদীতে না আছে পানি, না আছে প্রাণীজ সম্পদ, না চালানো যায় নৌকা। এই নদীর সাথে মাতৃকতার আত্মিক বন্ধন কতটুকু, সেটা ভেবে দেখার মতো। |
নদী কি প্রতিবন্ধকতা?
পানির অপর নাম জীবন। বেঁচে থাকার তাগিদেই নদীর মরুকরণ দেখে আমরা খুঁড়েছি মাটি; পেয়েছি পানি। সেই পানি শুধু পানই করিনি, শস্য ফলাতেও ব্যবহার করেছি। যেই নদী ছিল একসময়কার বাংলার যাতায়াতের সবচাইতে সহজ মাধ্যম, সেই নদীতে হাজার হাজার কিলোমিটার চর পড়তে থাকায় আমরা নদীর উপর দিয়ে তৈরি করলাম সেতু; বানালাম সড়ক পরিবহণ নেটওয়ার্ক। নদীতে পানি কমার সাথে সাথে নদীর প্রাণীজ সম্পদেরও ঘাটতি পড়তে লাগলো; আমরা যেন ভুলেই যেতে বসেছিলাম - মাছে-ভাতে বাঙ্গালী। আজ বেঁচে থাকার বেশিরভাগ কর্মকান্ডের জন্যেই আমরা নদীর উপরে নির্ভশীলতা কমাতে পারলেই যেন বেঁচে যাই। শুধুমাত্র দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকার মানুষ ছাড়া বাকিরা প্রায় সবাই নদীপথের চাইতে নদীর উপর দিয়ে উড়াল দিয়ে তৈরি করা পথে যাতায়াতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পথিমধ্যে এমন কোন নদী যদি পরে, যেটা উড়াল দিয়ে পার হওয়া যায় না, সেটাকে আমরা উটকো ঝামেলা হিসেবেই দেখি। নদনদী এখন বছর বছর কূল ছাপিয়ে বন্যারই অন্য নাম মাত্র। ভয়াল নদীভাঙ্গন হয়ে উঠলো নদীর হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি। নদনদী হলো কষ্ট; যাকে ছাপিয়ে যেতে পারলেই যেন আমাদের শান্তি। সেই আত্মিক বন্ধনের পরিসমাপ্তি এখানেই। তবে এই লেখার পরিসমাপ্তি এখানেই নয়; বরং শুরু। মনস্তাত্বিকভাবে নদীর সাথে বিচ্ছেদের পর থেকেই আমরা হয়ে গেলাম স্থলজ প্রাণী। এমন না যে আমরা আগে জলজ ছিলাম; কিন্তু পানির সাথে বসবাসের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাধারাও পানির সাথেই দোল খেত। সেই চিন্তাধারা এখন পানি থেকে অনেক দূরে সরে আসায় পানিতে আমাদের চোখে শুধু বন্যাই দেখি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্র থেকে দূরে বসবাস করায় পানির সাথে সৃষ্ট এই দূরত্ব বিশেষ গুরুত্ব বহণ করে। আমাদের চিন্তা চেতনা থেকে পানিকে আমরা প্রায় বাদই দিতে বসেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই চিন্তাধারা সামষ্টিকভাবে আমাদের পিছিয়ে দেবার জন্যে একটা বিরাট বাধা তৈরি করেছে। সমুদ্র অর্থনীতির বাস্তবায়নের পথে এটি একটি বিষাক্ত কাঁটা!
"পানিশিক্ষা"
অর্থনৈতিক উন্নতির সিঁড়ি বাইতে হলে সমুদ্রের দিকে আমাদের হাত বাড়াতেই হবে - এই কথাটা আজ সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু যে জাতি তাদের হাজার বছরের পানির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি, তাদেরকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেললে তার ডুবে যাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। ঢেউয়ের উপরে ভাসতে না জানলে ঢেউকে কাজে লাগাবার প্রশ্নই ওঠে না। অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব বাধা সরানোর পেছনে আমাদের আজ থেকেই উঠে পড়ে লাগতে হবে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই "পানিবিমূখতা"। এই বাধা সরানোর উপায় একটিই - আজ থেকেই সকলকে "পানিশিক্ষা"-য় শিক্ষিত করা। পানির সাথে বসবাসের সেই পুরোনো গল্পটা আবার নতুন করে বলতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের পানি বিষয়ক সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। কারণ তাতে পরবর্তী প্রজন্ম খাপছাড়াভাবে আলাদা আলাদা দিক থেকে পানিকে চিনবে; একটিমাত্র তীখন দূরদৃষ্টি দিয়ে চিনবে না। ফোকাস না থাকলে ভিত্তি গড়া সম্ভব নয়। আর টেকসই উন্নয়নের জন্যে ভিত্তি হতে হবে শক্ত।
নদীমাতৃকতা আসলে একটা সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে শুধু নদী নিয়ে রচনা লিখলেই হবে না; নদীমাতৃকতাকে ঘিরে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে আনতে হবে হাতে কলমের সম্পৃক্ততা। পানি, নদী ও সমুদ্র গবেষণাতে আসতে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এখানে শুধুমাত্র মিষ্টি কথা বলেই কাউকে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নয়; তাদের দেখাতে হবে সত্যিকারের আশা; তৈরি করতে হবে 'রোল মডেল', যাদেরকে অনুসরণ করে নতুনেরা প্রবেশ করবে। গবেষণাতে নতুন প্রজন্মকে এনে আমরা অন্তত ভবিষ্যতের পরিকল্পনাকারীদের জন্য একটা দিকনির্দেশনা দিয়ে যেতে পারি। আমাদের ছেড়ে যাওয়া কাজ যেন তারা করে নিতে পারে খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই। নতুনদের দেখাতে হবে আশা; যেটার শুরু করতে হবে একেবারে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই থেকেই। এটা হবে "পানিশিক্ষা"-এর শুরুটা এখানেই হতে হবে।
নৌকা বাইচের মতো খেলাগুলিকে আমরা দেশের মানুষের কতটুকু কাছে নিয়ে যেতে পেরেছি? ভবিষ্যতে যারা দেশের হাল ধরবে, তাদেরকে কি এই খেলা আকর্ষণ করতে পেরেছে? |
এই "পানিশিক্ষা"-কে আমরা এখন থেকেই যদি গুরুত্ব দেওয়া শুরু না করি, তাহলে একটা সময় আসবে যখন আমরা অনেকদূর এগিয়েও পিছিয়ে যাবো; কারণ কোন এক সময়ে আমরা দূরদৃষ্টি নিয়ে কাজ করিনি। ভবিষ্যতের ব্লু ইকনমি বা ম্যারিটাইম নেশন যেই ধারণার প্রতিষ্ঠার কথাই বলি না কেন, মনস্তাত্বিক দিক থেকে নিজেদেরকে তৈরি করতে না পারলে প্রকৃতপক্ষে এগুলি শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না যে বাকি বিশ্বও থেমে নেই। এখানে অন্যদের চাইতে বেশি গতিতে না চলতে পারলে নিজেদের তুলনামূলকভাবে স্থবিরই মনে হবে।
No comments:
Post a Comment