১৬ জুলাই ২০১৪
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৌবহর দেখে একটা
ধারণা কিন্তু নেওয়া সম্ভব যে তাদের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে। কারণ নৌবহর হলো
এমন একটা জিনিস যেটা সমুদ্রে ভেসে যেতে পারে বহুদূর; যেখানে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা
তাদের দাবি করে, সেখানেই গিয়ে হাজির হতে পারে। এজন্যেই পররাষ্ট্রিনীতিতে
পরাক্রমশালী দেশগুলি বরাবরই শক্তিশালী নৌবহর তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত অনেক দেশ এই লিস্টের মধ্যে থাকলেও শেষ পর্যন্ত
মার্কিনীরাই একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছে এই ক্ষেত্রে। আর নৌবহর চেনারও কিছু
উপায় আছে! একটা নৌবহরের কিছু জাহাজ দেখলেই একটা ধারণা করে নেওয়া সম্ভব তাদের নৌবহরের
প্রধান কাজ কি। ঠিক এই ধরণেরই কিছু জাহাজের সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা
এখানে করবো; যা পরবর্তী আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে
আরকি।
পররাষ্ট্রনীতির
সাথে যুদ্ধজাহাজের ধরণের সম্পর্ক
একটা দেশের নৌবহর পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে
নিয়ে যেতে পারবে তখনই, যখন সেই নৌবহর অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই দেশ থেকে হাজার
হাজার মাইল দূরে গিয়ে কোন মিশন শেষ করে আসতে পারবে। এই ধরণের দূরবর্তী মিশন চালাতে
একটা নৌবহরের তিন ধরণের জাহাজের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে – ১)
বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ২) উভচর বাহিনী এবং ৩) সরবরাহকারী জাহাজ। এই জাহাজগুলিকে
রক্ষা করার জন্যে আরও অন্যান্য জাহাজও লাগে, যেমন ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাবমেরিন,
মাইনসুইপার, ইত্যাদি। এই জাহাজগুলি অবশ্য অনেক দেশেরই থাকে। শুধুমাত্র একা একা এই
ধরণের জাহাজগুলি পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে পারে না; তাদেরকে প্রথমে বলা ঐ তিন
ধরনের জাহাজের অন্তত একটি বা দু’টির সাহায্য নিতে হবে। বিমানবাহী
যুদ্ধজাহাজ দেশ থেকে অনেক দূরে নিজেদের বাহিনীর উপরে বিমান প্রতিরক্ষা দেবে আর
শত্রুপক্ষের বাহিনীকে আক্রমণ করবে। এটা না থাকলে অন্য দেশের বিমান বাহিনী নিজেদের
নৌবহরের বারোটা বাজাবে। উভচর বাহিনী দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে শত্রুভাবাপন্ন কোন
দেশের সমুদ্রসৈকতে জোর করে অবতরণ করতে পারবে, আর স্থলযুদ্ধের মাধ্যমে শেষ করতে
পারবে যুদ্ধ। এই বাহিনী না থাকলে নৌবহরকে শুধুমাত্র উপকূলে ঘুরাঘুরি করেই দেশে
ফেরত যেতে হবে। সরবরাহকারী জাহাজ দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে নিজেদের নৌবহরকে
সমুদ্রে টিকে থাকতে সহায়তা করবে। এই জাহাজগুলি না থাকলে নৌবহরকে মিশন শেষ না করেই
দেশে ফেরত আসতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ঐ তিন ধরনের জাহাজে পুরোপুরি
স্বয়ংসম্পূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানকে মোকাবিলা করতে
যেয়ে তারা এই জাহাজগুলির বিশেষজ্ঞ বনে গেছে। আর যুদ্ধের শেষে এই জাহাজগুলিকে তারা ডিজাইনের
দিক থেকে আরও অনেক বেশি কর্মক্ষম করেছে।
চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'লিয়াওনিং'। চীনা নৌ-কূটনীতি এখন দ্রুত ভারত মহাসাগরে বিস্তৃত হচ্ছে। |
বিমানবাহী
যুদ্ধজাহাজ
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধের শেষে মার্কিনীদের
ধারেকাছেও কেউ ছিল না; এখনো অনেকটা নেই বললেই চলে। বিশ্বযুদ্ধের শেষে হাজার হাজার
যুদ্ধজাহাজ রাতারাতি অদরকারি হয়ে পড়ে। তখন অনেক দেশই ব্রিটিশ আর মার্কিনীদের থেকে
নৌবহর সাজানোর সরঞ্জামাদি পেয়েছিল। কেউ কেউ পেয়েছিল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ অথবা
উভচর মিশনে যাবার মতো যুদ্ধজাহাজ। ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও যুদ্ধ
শেষ হবার পরে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মালিক হয়েছিল হল্যান্ড (১৯৪৮), ব্রাজিল
(১৯৫৬), আর্জেন্টিনা (১৯৫৮), ভারত (১৯৫৭) ও স্পেন (১৯৬৭)। এই পুরোনো জাহাজগুলিকে তারা বেশ অনেকদিন সার্ভিসে
রেখেছিল; অর্জন করেছে এইরকম জাহাজ পরিচালনা করার দক্ষতা। সেই দক্ষতা আজ পর্যন্ত
ধরে রেখেছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ভারত ও স্পেন। এরা পুরোনো জাহাজকে নতুন জাহাজ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে
পেরেছে। বাকিরা অর্থনীতির ভারে বাধ্য হয়েছে তাদের নৌবাহিনীর নীতিতে পরিবর্তন আনতে।
ইটালি (১৯৮৫) ও থাইল্যান্ড (১৯৯৭) নতুন করে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মালিক হয়েছে। এখানে
উল্লেখযোগ্য একটা ব্যাপার হচ্ছে খরচ। একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ কেনা আর পরিচালনা
করার মতো অর্থনীতি খুব বেশি দেশের নেই। থাইল্যান্ডে তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘চাক্রি নারুয়েবেট’ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।
কারণ সেটা কেনার পরবর্তীতে দেশের দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনায় অংশ নেয়া ছাড়া কোন কাজেই
আসেনি; পররাষ্ট্রনীতিতে সাহায্য করা তো বহুদূর! স্পেন তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার
কারণে ২০১৩ সালে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘প্রিনসিপে ডে এস্তুরিয়াস’ ডিকমিশন করে দিতে বাধ্য হয়েছে; তবে অন্য আরেকটি (‘হুয়ান
কার্লোস ১’) তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। ব্রিটেন,
ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন, ভারত – এরা সবাই তাদের
পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করেছে। সোভিয়েট ইউনিয়ন
তাদের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে ১৯৭৫ সালে। রাশিয়া সেই নৌবহরের কিছুটা
পেলেও সেটাকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
এর একটা বড় কারণ হলো আন্তর্জাতিক বিবাদে রাশিয়া যে পক্ষে থেকেছে, সেই পক্ষে
নৌশক্তি দিয়ে রাশিয়াকে সাহায্য করার মতো কোন দেশ ছিল না। আর রাশিয়ার একার পক্ষেও
সমুদ্রে তেমন কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। অপরদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন – এরা সকলে একত্রে একপক্ষে থেকেছে; একে অপরকে পরিপূর্ণ করেছে। একের দুর্বলতা
অন্যে ঢেকে দিয়েছে। আর তার সাথে অপার শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র তো রয়েছেই। চীন
বর্তমানে ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছে নৌশক্তিকে পররাষ্ট্রনীতির একটা দিক হিসেবে
ব্যবহার করতে। আর এই কারণেই চীন ইউক্রেন থেকে সোভিয়েত সময়ের অর্ধসমাপ্ত একটা বিমানবাহী
যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করে ২০১২ সালে ‘লিয়াওনিং’ নামে কমিশন করেছে। এতক্ষণ যেই
বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের কথা বললাম, সেগুলি মার্কিন নৌবাহিনীর ডজনখানেক বিমানবাহী
যুদ্ধজাহাজ থেকে বহু পিছিয়ে। আসলে মার্কিনিদের উভচর নৌবহরে ১০টার মতো জাহাজ আছে
যেগুলি উপরের বেশিরভাগ দেশের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে অনেক বড় এবং বেশি
শক্তিশালী। এগুলিকে আমেরিকানরা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বলেই না! উভচর এই নৌবহর
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ব্যাপারটা পৃথিবীর অনেক
দেশ বুঝতে পেরে সেই দিকেই এগুচ্ছে।
ব্রিটিশ 'উভচর এসল্ট শিপ' এইচএমএস ওশান। দেখতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো হলেও এটাকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বলা হয় না। |
উভচর বাহিনী
মার্কিন নৌবাহিনী উভচর যুদ্ধে অবিসংবাদিত
নেতৃত্ব পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে। তারা নতুন নতুন থিওরি আবিষ্কার করেছে;
নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে, যা এখন পৃথিবীর সকলে উভচর যুদ্ধের বাইবেল
হিসেবে দেখে। তাদের তৈরি করা এই বাইবেলের সমুদ্রগামী সবচেয়ে ছোট উভচর যুদ্ধজাহাজ
হচ্ছে ‘ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্ক’ (Landing Ship Tank or LST)। এই জাহাজগুলি সমুদ্র সৈকতে উঠে যায়; সামনের বিরাট একটা দরজা খুলে ভেতর থেকে ট্যাঙ্ক
ও অন্যান্য রসদ সরাসরি ভূমিতে নেমে আসে। এই জাহাজগুলি বেশ বড় (৩,০০০ থেকে ৮,০০০টন)
হলেও এদের সমস্যা হচ্ছে রসদ উঠানামা করতে এদের প্রধানত সৈকতে উঠে আসতে হয়
(যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি জাহাজগুলি অবশ্য এর চাইতে আরও বেশি কার্যকর)। পররাষ্ট্রনীতিতে সবসময় সৈকতে উঠে কাজ করার
সুযোগ থাকে না। সেদিক থেকে ‘ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক’ (Landing Transport
Dock or LPD)
অনেক বেশি কার্যকরী। এই জাহাজগুলি সকল সৈন্য এবং রসদ ছাড়াও ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং
উভচর যান বহন করে; যেগুলি জাহাজের পেছনের ডক থেকে সরাসরি পানিতে নেমে আসে। এরা
আবার হেলিকপ্টারও বহন করতে পারে। এভাবে বিশাল (৮,০০০-২৫,০০০টন) এই জাহাজগুলি
উপকূলের কিছুটা দূরে থেকেই সৈন্য ও রসদ উঠানামা করতে পারে। ২০০ থেকে ১,০০০ পর্যন্ত
সৈন্য বহন করতে পারে এই ধরণের জাহাজ। এই ‘এলপিডি’-গুলি একটা দেশের নৌবহরকে দূরের দেশে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা অক্ষুন্ন
রাখতে সহায়তা করতে পারে। একই রকমের জাহাজ ‘ল্যান্ডিং
শিপ ডক’ (Landing Ship
Dock or LSD)
যেগুলি কিছু কম সৈন্য নেয় ল্যান্ডিং ক্রাফট বেশি নেবার জন্য। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই
অবশ্য এগুলি ব্যবহার করে। এরও উপরে যে জাহাজগুলি আছে সেগুলির চেহারা অনেকটাই
বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। এগুলিকে সাধারণভাবে বললে ‘উভচর
এসল্ট শিপ’ (Amphibious Assault Ship) বলা যায়। এরা প্রচুর সৈন্য ও রসদ বহন করা
ছাড়াও হেলিকপ্টার এবং অনেক ক্ষেত্রে ফাইটার বিমান বহন করতে পারে। এই ধরনের যে
জাহাজগুলির পিছনে ডক রয়েছে, সেগুলি ‘ল্যান্ডিং হেলিকপ্টার ডক’ (Landing Helicopter
Dock or LHD; Landing Helicopter Assault or LHA); আর যেগুলির ডক নেই, সেগুলি ‘ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম হেলিকপ্টার’ (Landing Platform Helicopter or LPH)। এগুলি যথেষ্ট বড় (১৮,০০০-৪৫,০০০টন) এবং ব্যয়বহূল জাহাজ।
অনেক দেশই আলাদাভাবে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ আর উভচর বাহিনী রাখতে পারছে না বাজেটে
সঙ্কুলান না হওয়ায়। তারা এই ধরনের ‘উভচর এসল্ট শিপ’-এর দিকে যাচ্ছে। এতে এক জাহাজ কয়েক ধরনের মিশন নিতে পারছে। যুক্তরাজ্য (১টি
LPH), ফ্রান্স (৩টি LHD), স্পেন (১টি LHD), দক্ষিণ কোরিয়া (১টি LPH) – এই
পথেই এগিয়েছে। রাশিয়া (২টি LHD) এবং
অস্ট্রেলিয়াও (২টি LHD) ভবিষ্যতে
এগুচ্ছে সেদিকে। এই জাহাজগুলি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘পুওর
ম্যানস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার’! তবে এখানে সবচাইতে বড়
ব্যাপার হলো, এই দেশগুলি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় শক্তি
প্রদর্শনকে প্রাধান্য দিয়েছে বলেই এই জাহাজগুলি বানিয়েছে বা ক্রয় করেছে। আর যারা ‘উভচর এসল্ট শিপ’-ও যোগার করতে পারেনি, তারা অন্তত ‘ল্যান্ডিং
ট্র্যান্সপোর্ট ডক’ (Landing Transport Dock or LPD)-এর দিকে অগ্রসর হয়েছে। সিঙ্গাপুর (৪টি), ইন্দোনেশিয়া
(৪টি), আলজেরিয়া (১টি তৈরি হচ্ছে), হল্যান্ড (২টি), চিলি (১টি), পেরু (২টি তৈরি
হচ্ছে), ফিলিপাইন (২টি অর্ডারে করেছে) এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আরও বেশ কিছু দেশ
একই লাইনে চিন্তা ভাবনা করছে। ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ডও
নিজেদের মতো কিছু জাহাজ বানিয়েছে; তবে তাদের উদ্দেশ্যও কিন্তু উপরের বাকি সবার
মতোই। আবার এদের চাইতে বড় নৌবহরগুলিও এই ধরনের (LPD) জাহাজের দিকে ঝুঁকেছে অথবা তৈরি করা অব্যহত রেখেছে – ব্রিটেন (৫টি), ফ্রান্স (১টি), ব্রাজিল (১টি), চীন (৩টি), ইটালি (৩টি), ভারত
(১টি), অস্ট্রেলিয়া (১টি)।
ইন্দোনেশিয়ার 'ম্যাকাসার-ক্লাস' 'ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম ডক'। নৌ-কূটনীতিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ আর 'উভচর এসল্ট শিপের' পরেই এই ধরনের জাহাজের স্থান। |
নতুন অর্থনীতি
৩০-৪০ বছর আগের সাথে তুলনা করলে আজকে পৃথিবীর
অনেক দেশই কিন্তু একটা মোটামুটি অর্থনীতির অধিকারী। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর,
মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া – এই দেশগুলি খুব বেশিদিন হয়নি
অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। আর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে জাতীয় নিরাপত্তাও নিজেদের
সমুদ্রসীমা অতিক্রম করেছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন আর ফ্রান্স ছাড়া অন্য কোন
দেশের হাতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ‘উভচর এসল্ট শিপ’ (Amphibious Assault Ship) এবং ‘ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক’
(Landing Transport
Dock or LPD) ছিল
না। এখন মোটামুটিভাবে ১৪-১৫টা দেশের কাছেই এই ধরনের যুদ্ধজাহাজ রয়েছে; আরও বেশকিছু
দেশ এগুলি পেতে চলেছে অচিরেই। ২০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটা যুদ্ধজাহাজ
কিনতে পারার মতো অর্থনীতি এখন অনেক দেশের। এরা সবাই এখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে
তাদের প্রভাবের ন্যায্য হিস্যা চাইছে। আর ন্যায্য হিস্যা চাইতে গেলে সেইধরণের
উপকরণও যে দরকার, সেটা বুঝেছে অনেকেই।
জাপানি নৌবহরের ১৪,০০টনের 'ওসুমি-ক্লাস'-এর এই জাহাজগুলি প্রথম জানান দেয় জাপানের 'যুদ্ধ-বিরোধী' সংবিধানের অবাস্তবতার |
জাপানি নৌবাহিনীর ১৯,০০টনের 'হাইয়ূগা-ক্লাস' "হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার", যাকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বললে দোষ হয় না। |
জাপান
আমরা সবাই চীনকে নিয়ে কথা বলতেই ব্যাস্ত।
চীনের নৌবহরের জাহাজগুলি আজকাল ভারত মহাসাগরে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেউ একবারও
চিন্তা করে দেখিনি যে চীন সমুদ্রে এগুতে থাকলে তার প্রতিবেশী জাপান আর দক্ষিণ
কোরিয়াও থেমে রইবে না। গত বিশ বছরে কোরিয়া তাদের নৌবাহিনীর বিশাল উন্নতি করেছে। আর
দশ-পনর বছরের মাঝেই কোরিয়ার নৌবহর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনেকটা প্রভাব
বিস্তার করবে। তবে সেই প্রভাব জাপানের ধারেকাছেও হবে কিনা সেটা দেখার বিষয় হবে।
যেখানে কোরিয়া তাদের জিডিপি-এর ২.৮% সামরিক খাতে খরচ করছে, সেখানে জাপান করছে
মাত্র ১%। অথচ তারপরেও জাপানের সামরিক বাজেট (৪৯ বিলিয়ন ডলার) কোরিয়ার (৩৪ বিলিয়ন
ডলার) চাইতে অনেক বেশি। এই ১%-এর সামরিক বাজেটেই জাপান পৃথিবীর সবচাইতে বড় নৌবহরের
একটির মালিক! এর অর্থ হচ্ছে, প্রায় তেমন কোন পরিশ্রম ছাড়াই জাপান এই নৌবহর অর্জন
করতে পারছে। তাদের সামনে এগুনোর পথে সবচাইতে বড় বাধা ছিল তাদের সংবিধান। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিনীদের প্রণীত এ ‘যুদ্ধ-বিরোধী’ সংবিধান জাপানীরা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে বহু বছর। এই সংবিধান
জাপানের সামরিক বাহিনীকে জাপানের বাইরে কোথাও মোতায়েনে বাধা দিয়েছে; আক্রমণাত্মক
কোন অস্ত্র (যেমন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ) তৈরিতে বাধা দিয়েছে। তবে মার্কিনীরা
অনেকদিন ধরেই বলে আসছিল যে এই পরিবর্তিত বিশ্বে জাপানের আরও বেশী কার্যকর ভূমিকা
নেওয়া উচিত। তারাও চাইছিল যে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীল না থেকে নিজেদের
প্রতিরক্ষা যেন নিজেরাই দেখা শুরু করে। জাপানের সংবিধানের সেই বাধা অল্প কিছুদিন
আগেই উঠে গেছে। এটা চীনের জন্যে অনেক বড় একটা ভীতির খবর। পুরাতন সংবিধানকে পাশ
কাটিয়েই জাপান ১৯৯৫ সাল থেকে নৌবাহিনীর জন্যে এমন কিছু জাহাজ বানানোর প্রস্তুতি
নিয়েছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলিকে চিন্তিত করেছে। ‘ওসুমি-ক্লাস’-এর ‘ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক’ (Landing Transport Dock or LPD) গোছের তিনটি জাহাজ বানাবার
পরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল, কারণ ১৪,০০০টন এই জাহাজগুলি দেখতে ছোটখাটো বিমানবাহী
যুদ্ধজাহাজের মতো। জাপান তখন বলেছিল – এগুলি ‘ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্ক’; জাপান থেকে দূরে ব্যবহারের
জন্য নয়। এরপরে ২০০৬ সালে বানানো শুরু করে ১৯,০০০টনের ‘হাইয়ূগা-ক্লাস’-এর দু’টি জাহাজ; যেগুলিকে জাপান ‘হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার’ বললেও সেগুলিকে প্রায়
পুরোপুরিই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বলা চলে। যদি এটাও কম হয়ে যায়, তাহলে ২০১২ সালে
শুরু হয়েছে আরও দু’টা জাহাজের কাজ। ২৭,০০০টনের ‘ইজুমো-ক্লাস’-এর এই দু’টি
জাহাজ এর আগে বানানো যেকোন জাহাজের চাইতে অনেক অনেক বড়! এবারেও জাপানি নৌবাহিনীর ওই একই কথা - এগুলি
আসলে ‘হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার’। এসবই হয়েছিল
সংবিধানের ‘আর্টিকেল-৯’-কে
পাশ কাটিয়ে। এখন এর চাইতেও আরও বড় ও শক্তিশালী জাহাজ বানাতে জাপানের কোন বাধাই
থাকলো না। উত্তর কোরিয়া আর চীন জাপানকে উঠতে সাহায্য করছে। এই দুই দেশের সামরিক
প্রস্তুতি জাপানিদের নৌবহর বৃদ্ধিতে, আর সংবিধান সংশোধনে উদ্বুদ্ধ করেছে।
জার্মান ফ্রিগেট 'এমডেন' ও আমেরিকান ডেস্ট্রয়ার 'শোউপ'-কে সমুদ্রে সাপ্লাই দিচ্ছে ফ্রেঞ্চ সাপ্লাই জাহাজ 'মার্ন'। পারস্পরিক সহযোগিতার কারণে আমেরিকা ও তার মিত্ররা সমুদ্রে অনেক বেশি শক্তিশালী |
সাপ্লাই চেইন
এরই মাঝে জাপানি নৌবহরে যুক্ত হয়েছে
১৫,০০০টনের ৩টি ও ২৫,০০০টনের দু’টি সরবরাহ বা সাপ্লাই জাহাজ। উপরে
বর্ণিত এত্ত বড় বড় জাহাজের বিতর্কের গভীরে এই সাপ্লাই জাহজগুলি হারিয়েই গেছে। খুব
কম লোকই প্রশ্ন করেছে যে এই জাহাজগুলি কি বানানো হয়েছে জাপানের উপকূল প্রহরায়
সহায়তা দিতে, নাকি ভারত মহাসাগর পর্যন্ত পাহারা দিতে? যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেশ কিছু
দেশ তাদের নৌবহরের আকৃতির অনুপাতে অনেক
বেশি এবং বড় সাপ্লাই জাহাজ রাখে, যেমন –যুক্তরাজ্য (৮টি), ফ্রান্স
(৪টি), ইটালি (৩টি), স্পেন (২টি), জার্মানি (১১টি), হল্যান্ড (১টি), অস্ট্রেলিয়া
(২টি), কানাডা (২টি)। বিভিন্ন মিশনে এরা একজন
আরেকজনকে পরিপূর্ণ করছে। একজন হয়তো পাঠাচ্ছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ; আরেকজন
পাঠাচ্ছে ফ্রিগেট; আরেকজন সাপ্লাই জাহাজ। এভাবে একত্রে তারা খুব দ্রুত একটা
শক্তিশালী নৌবহরের জন্ম দিচ্ছে। এটা হচ্ছে তাদের ‘কালেকটিভ
সিকিউরিটি’-এর একটা অংশ।
কে কোথায়? আমরা কোথায়?
এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের ইউরোপীয়
এবং অন্যান্য মিত্ররা একত্রে সহজেই ভারত মহাসাগরে অথবা পারস্য উপসাগরে অথবা
ভূমধ্যসাগরে তাদের নৌবহর পাঠিয়ে দিচ্ছে, এবং অনেকদিন সেখানে রাখতেও পারছে। এদের
সাথে যোগ দিতে অথবা এদেরকে চ্যালেঞ্জ করতে যোগ দিয়েছে বা অচিরেই যোগ দিচ্ছে চীন,
জাপান, ভারত ও কোরিয়া। এদের মাঝে চলবে প্রধান প্রতিযোগিতা। এর মাঝে ছোট ছোট অনেক
নৌবাহিনী তাদের স্থান খুঁজে নিচ্ছে; নেবে। তাদের মাঝেও থাকবে প্রতিযোগিতা। এই
প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও আছে তাদের ছোট্ট নৌবহর নিয়ে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী দু’টি জাহাজ (একটি ফ্রিগেট ও একটি প্যাট্রোল জাহাজ) ভূমধ্যসাগরে জাতিসঙ্ঘের
মিশনে মোতায়েন রেখেছে ২০১০ সাল থেকে। উপরে যে ধরনের জাহাজ নিয়ে আলোচনা করেছি,
সেগুলি কেনার বা বানাবার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাংলাদেশের এখনো হয়নি; তবে অচিরেই
হতে চলেছে। ইউরোপীয় দেশগুলি বাজেটের ঘাটতির কারণে তাদের নৌবহরের আকৃতিতে ব্যাপক
পরিবর্তন এনেছে। অন্যদিকে এশিয়াতে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে নৌবহরের আকৃতি
বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সমুদ্রসীমা, খনিজ সম্পদ, প্রতিবেশী
রাজনীতি, ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে নৌবাহিনীর গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। নৌবাহিনী হতে
চলেছে কূটনীতির একটা অংশ। সামনের বছরগুলিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিই বলে দেবে যে
আগামী ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের নৌ-কূটনীতি বঙ্গোপসাগরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি
ভারত মহাসাগর এবং অন্যান্য সমুদ্রেও তার অবস্থান খুঁজবে।
ধন্যবাদ, অনেক তথ্য বহুল পোস্ট !! ধন্যবাদ
ReplyDeleteআপনাকেও অনেক ধন্যবাদ পুরোটা পড়ার জন্য এবং কমেন্টের জন্য!
Deletemaratok vi. khub valo
ReplyDeleteপড়ার এবং কমেন্ট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ!
Deleteভাই আপনার লিখাগুলো পড়ার সময় মনে আমি যেন চট্রগ্রামের এম ই এস কলেজে প্রফেসার ওমর শফিউললাহ ল্যাকচর শুনতে ক্লাসে বসে । i salute you sir . দুঃক্ষ হয় যখন দেখি আপনার মত মানূষগুলো যেখানে থাকা দরকার সেখানে হয়না , হয় কোন অযোগ্য । তাই আমাদের সামরিকখাত নিচু মানের হয়ে আছে এখনো ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। বাকি লেখাগুলোও পড়বেন আশা করি।
Delete