১৪ অগাস্ট ২০১৪
নিজের কাছে যদি নিজের জীবনের কোন মূল্য না থাকে, তাহলে অন্য কারুর সাধ্য
নেই আমার জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি – এই কথাটা যদি আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস না করতে চাই, তাহলে কি এটাই প্রমাণ
হয় না যে আমার নিজের কাছেই নিজের জীবনের মূল্য নেই; অন্যেরটা না হয় বাদ-ই দিলাম।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা যখন বাস-ট্রেন-লঞ্চের ছাদে ভ্রমণে উদ্যত হই, তখন এটা কখনোই
ভাবি না যে আমরা অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা পাবার জন্য সৃষ্টিকর্তার দেওয়া
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি নিয়ে জুয়া খেলছি! এই ব্যাপারটা অর্ধশিক্ষিত অথবা
অশিক্ষিত দিনমজুর থেকে শুরু করে শিক্ষিত চাকুরিজীবী মানুষের মাঝে বিদ্যমান। এটা
যেন আমাদের বাঙ্গালীদের জাতিগত কোন একটা বৈশিষ্ট – কাছের কিছু একটা পাবার জন্য দূরে দেখার দৃষ্টি হারিয়ে ফেলি। কাজেই যারা
দূরে দেখতে পান, তাদের উপড়ে অনেক বড় দায়িত্ব বর্তায় -এই জাতিকে সঠিক পথে চালিত
করা। আমাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লীডারশিপ ছাড়া আর কোনকিছুতেই এই ‘দূরারোগ্য ব্যাধি’
যাবার নয়। যে দেশে মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, সেখানে দেশের নিরাপত্তা
বোঝার ক্ষমতা কয়জনের থাকতে পারে?
ঠিক এরকমভাবেই তিলধারণের জায়গা ছিল না পিনাক-৬ লঞ্চটিতে। জীবনের চাইতে আমাদের সময়ের মূল্য অনেক বেশি।
|
"আরে কি আর হইবো”
পিনাক-৬ লঞ্চটা যখন শত মানুষে ভরে উঠছে, তখন কতজন অনিরাপদ মনে করে লঞ্চ থেকে নেমে যেতে চেয়েছেন? কতজন সত্যিকার অর্থেই বলে উঠেছিলেন যে – আর যাত্রী উঠিও না? অবশ্য সাধারণ একজন মানুষের পক্ষে একটা জাহাজ কতজন মানুষ নিতে পারে সেটা বোঝা কঠিন হতেই পারে। কিন্তু এটাও ঠিক যে অতীতের অনেক দূর্ঘটনার কথা জানার পরে এটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারা উচিত। একটা লঞ্চে তিলধারণের জায়গা না থাকাটা এই নয় যে লঞ্চটা এতগুলা মানুষ নেবার জন্যেই তৈরি হয়েছে। একটা অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই লঞ্চ যখন ঘাট ছেড়ে যায়, তখন বিআইডব্লিউটিএ-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কখনোই বলতে পারেন না যে তারা সেটা জানতেন না। ৮৫ জনের লিমিটের জাহাজে ২৫০ জন মানুষ কিভাবে ওঠে? তাদের পকেটেও যে দু’একটা পয়সা পড়ে না, সেটা কি করে বলি? এখানেও সেই একই বাঙ্গালী ধ্যানধারণা তাকে পেয়ে বসে- ছোট্ট কিছু পাবার আশায় কয়েকশ’ মানুষের জীবন সে ছেড়ে দেয় সৃষ্টিকর্তার হাতে; মনে মনে বলে, “আরে কি আর হইবো”! সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তর আর বিআইডব্লিউটিএ-এর লোকেরা জানেন এই জাহাজে কতটা লাইফবয় আছে; আছে কতটা লাইফ জ্যাকেট। তারা জানেন এই জাহাজের ডিজাইনে সমস্যা আছে কিনা। তারা জানেন এই জাহাজ কোন নদীতে চলার ক্ষমতা রাখে বা রাখে না। কিন্তু এদের কারুরই পকেটে যে দু’একটা পয়সা পড়ে না, সেটা কি করে বলি? তারাও মনে মনে বলেন সেই একই কথা - “আরে কি আর হইবো”! আমাদের কাছে পরিবারের সাথে আগামীকাল সকালে নাস্তা করাটা সারাজীবনের জন্য নিজের সন্তানকে না দেখতে পারার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! এ জাতির কাছে জীবনের অর্থই অন্য রকমের!
জীবনের মূল্য আমারদের কাছে না থাকলেও মৃতদেহের মূল্য আমাদের কাছে অনেক। অর্ধগলিত লাশ হলেও সেটা আমার কাছে জীবন বাঁচানোর চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পিনাক-৬ ডুবে যাবার পর যে পরিমাণ শক্তি নিয়ে আমরা সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তার সিকিভাগও যদি আমরা ডুবার আগে দিতে পারতাম, তাহলে মনে হয় এতগুলা মানুষের সলিল সমাধি হতো না। বিআইডব্লিউটিএ-এর কোন অফিসার এত্তগুলা মানুষকে লঞ্চে উঠতে দিলেন, সেটা জানার চেষ্টা না করে সবাই উঠে পড়ে লাগলাম ফ্লোটিং ক্রেন ‘রুস্তম’ ও ‘নির্ভীক’ কেন নিজে চলতে পারে না; অথবা তাদেরকে টাগবোট দিয়ে ঠেলতে এত সময় কেন লাগে। (স্পীডবোট দিয়ে ঠেললে কি সমস্যা??) একবারও চিন্তা করি না যে, এই ক্রেন একটা মৃত জাহাজকে উঠানোর জন্যে ব্যবহৃত হবে; এদিয়ে কোন জীবন বাঁচবে না; ১০ ঘন্টা পরে আসলেই কি, আগে আসলেই কি। সাংবাদিক ভাইদেরও দোষ দেই কিভাবে? তারাও তো আমাদের মতোই সেই একই ‘বাঙ্গালী সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত! কয়েকটা লাশের ছবি একটা খুঁজে না পাওয়া জাহাজের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ!
ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার বোট 'অগ্নি শাসক' ও 'অগ্নি বিনাশ' কাউকে বাঁচাতে পারেনি, কারণ তারা মাওয়া নয়, অনেক দূর থেকে এসেছিল। |
লাইফগার্ড কোথায়?
কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি দিয়ে চললো ডুবে যাওয়া লঞ্চ খোঁজার পালা। টেকনোলজিরও যে লিমিট আছে, সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। নদীর ভেতরে একটা লঞ্চ খুঁজে পাওয়া যদি এত্ত কষ্ট হয়, তাহলে মালেশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৩৭০ মহাসমুদ্রে খুঁজতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। তবে যা-ই হোক, কোটি টাকার অত্যাধুনিক ‘সাইড-স্ক্যান সোনার’ আর ‘সাব-বটম প্রোফাইলার’ কিন্তু সেই মৃত লঞ্চটি খোঁজার কাজেই ব্যবহার হলো। লঞ্চটাকে জীবিত রাখার পেছনে কত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল? ঘাটে আবহাওয়ার পূর্ভাবাস দেওয়ার জন্য যে স্টেশন স্থাপনের কথা ছিল, সেটা হয়েছিল কি? উন্নত বিশ্বও লাশ খোঁজে; কিন্তু তারা লাশ খোঁজার চাইতে একশ’ গুণ বেশি খরচ করে মানুষ যাতে লাশ না হয়, সেই খাতে। মাওয়া ঘাটে এসে ফায়ার সার্ভিসের বোটগুলি লাশ খুঁজলো। অথচ এই বোটগুলি বানানোই হয়েছে মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য; লাশ খোঁজার জন্য নয়। এমেচার ভিডিওতে দেখা গেলো ১০-১৫টা স্পীডবোট কি করে মাওয়া ঘাট থেকে দ্রুতগতিতে এসে ভেসে থাকা মানুষগুলিকে বাঁচিয়ে তুললো। এরাই তো সেখানে লাইফগার্ডের দায়িত্ব পালন করলো। এই দ্রুতগামী বোটগুলি (যেকোন লঞ্চের চাইতে দুই থেকে তিন গুণ বেশি দ্রুতগামী) না থাকলে আরও অনেক বেশি মানুষ মারা যেত। সকল স্থানে না হলেও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফায়ার সার্ভিসের লাইফগার্ড স্টেশন থাকা দরকার। ফায়ার বোট না হলেও দু’য়েকটা স্পীডবোট থাকা খুব জরুরি; যারা জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে। ঢাকা বিভাগে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি নৌ স্টেশন থাকলেও মাওয়াতে ছিল না। পিনাক-৬ মিশনে এই স্টেশনগুলি থেকে ‘অগ্নি বিনাশ’ ও ‘অগ্নি শাসক’ নামে দু’টা ফায়ার ফ্লোট (বোট) পাঠানো হয়েছিল। বোটগুলি মাওয়া ঘাটে থাকলেও হয়তো কিছুটা কাজে আসতো। তবে এই ধরনের বোট বেশ দামী; সব জায়গায় রাখা সম্ভব হবে না। তবে কিছু স্পীডবোট রাখাটা অতটা কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে হয় না।
মাওয়ায় বিআইডব্লিউটিএ-এর ফ্লোটিং ক্রেন 'নির্ভীক'-এর বাঁ পাশে বেকার দাঁড়িয়ে আছে টাগবোট। জানান দিচ্ছে যে এই জাহাজগুলির পানির নিচে জাহাজ খোঁজার কোন সামর্থ নেই |
দৈত্যাকৃতির জাহাজ 'কস্টা কনকরডিয়া' ভাসিয়ে তোলা হয়েছিল স্টীলের তৈরি ফাঁপা সিলিন্ডার ব্যবহার করে। তাহলে আমরা শুধু ক্রেন নিয়ে লাফালাফি করছি কেন? |
রেসকিউ & স্যালভেজ = উদ্ধার
'রেসকিউ’ আর ‘স্যালভেজ’-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে; আমরা বাংলায় যদিও ‘উদ্ধার’ বলেই খালাস। আমরা পিনাক-৬-এর খোঁজে যা যা ব্যবহার করেছি, তার সবই
স্যালভেজের কাজ করেছে। মানে ডুবে যাওয়া জাহাজ খোঁজা ও পানির উপরে ওঠানোর চেষ্টা
করেছি। কাউকে বাঁচাবার
চেষ্টা করিনি; যেটা হতো ‘রেসকিউ’। স্যালভেজ অনেক ক্ষেত্রেই একটা কমার্শিয়াল কাজ। জাহাজ উপরে তুলে সেই
জাহাজকে মেরামত করে আবার চালু করা, অথবা সেটা স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া।
তুলতে কত খরচ হবে, বনাম বিক্রি করলে কত পাওয়া যাবে – পুরোটাই টাকা-পয়সার খেলা। তাই বেশিরভাগ স্যালভেজ অপারেশনে সময় নির্ধারণ
করা হয় টাকার দিকটা বিবেচনা করে; কারুর জীবন বাঁচাবার কথা চিন্তা করে নয়। আমাদের
বিআইডব্লিউটিএ-এর ফ্লোটিং ক্রেন ‘হামজা’, ‘রুস্তম’, ‘প্রত্যয়’ ও ‘নির্ভীক’ এই স্যালভেজ কাজের অংশ। এদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কোন গুরুত্বপূর্ণ
নৌরুটে একটা জাহাজ ডুবে গিয়ে সেই নৌরুট যেন বন্ধ করে না দেয়। ডুবে যাওয়া লঞ্চের
থেকে গলিত লাশ উদ্ধার এদের প্রধান দায়িত্ব নয়। তবুও একেকটা ক্রেন একেক জায়গায় রাখা
হয়, যাতে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে অকুস্থলে গিয়ে পৌঁছাতে পারে; যে কাছে থাকবে সে
যাবে সেখানে। কিন্তু কথা তো সেখানে গিয়েই ঠেকলো – আগে গেলেই কি? কাউকে তো বাঁচাতে পারবেন না। তাহলে নারায়নগঞ্জ, চাঁদপুর,
বরিশাল- এসব যায়গায় ক্রেনগুলিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে লাভটা কি হচ্ছে? লাভটা হচ্ছে এই
যে – আমরা যত দ্রুত সম্ভব আপনাদের প্রিয়জনের লাশ
আপনাদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে নিয়োজিত! ভয়ঙ্কর শোনালেও ব্যাপারটা তা-ই। যারা একই
ক্যাপাসিটির দু’টি করে ক্রেন কেনার পরামর্শ দিয়েছেন, তারাও তো
আমাদের মতোই ‘বাঙ্গালী রোগে’ আক্রান্ত! ৬০টন ক্যাপাসিটির ২টা (‘হামজা’ ও ‘রুস্তম’) এবং ২৫০টন ক্যাপাসিটির ২টা (‘প্রত্যয়’ ও ‘নির্ভীক’) ক্রেনের বদলে ৬০টনের
একটি, ১২০ টনের একটি, ২৫০ টনের ১টি আর ৫০০ টনের একটি ক্রেন হলে অন্তত স্যালভেজ
অপারেশনটা বিআইডব্লিউটিএ আরও একটু ভালোভাবে চালাতে পারতো। অন্তত আন্তর্জাতিক মানের
স্যালভেজ কোম্পানিগুলি সেটাই করে থাকে। আর সবসময় কি জাহাজের ওজন ক্রেনের
ক্যাপাসিটি থেকে কম হবে? আন্তর্জাতিকভাবে সুক্ষ্যাতি পাওয়া কোম্পানি বসক্যালিসের
৯টা বিশাল ক্রেন রয়েছে, যার সবচেয়ে ছোটটি ৪০০টন ক্ষমতার হলেও সবচেয়ে বড়টি কিন্তু
মাত্র ৩,২০০ টনের। তার মানে এর বেশি ওজনের জাহাজ হলে কি এরা উঠাতে পারবে না? এখানেই
আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা। পানিতে জাহাজ ডুবলে শুধু ক্রেন দিয়েই সেটাকে টেনে
তুলতে হবে – এটা কে বলেছে? ২০০১ সালে দেশী কোম্পানি প্রান্তিক
বেঙ্গল স্যালভেজ এন্ড ডাইভিং কোন প্রত্যয়ের মতো শক্তিশালী কোন ক্রেন ছাড়াই
চট্টগ্রাম বন্দরের জেটির পাশেই ডুবে যাওয়া ‘এমভি সাউদার্ন কুইন’ জাহাজ উদ্ধার করে। মালামাল
ছাড়া এই জাহাজের ওজন ছিল ৩,৯৩২ টন। সিম্পল সাইন্স ব্যবহার করেছিল তারা – ২,৩০০ টন ক্যাপাসিটির ৪টা পন্টুন বেধে দিয়েছিল তারা জাহাজের সাথে; ব্যাস,
বুদবুদ যেমন সবসময় পানির নিচ থেকে উপরের দিকে যায়, ঠিক তেমনি জাহাজ পানিতে ভেসে
উঠলো। ২০১২ সালে ডুবে যাওয়া ১,১৪,০০০ টনের ইটালিয়ান ক্রুজ লাইনার ‘কস্টা কনকরডিয়া’ একইভাবে অল্প কিছুদিন
আগেই তোলা হয়েছে। ২০১২ সালে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের কাছে তেলবাহী জাহাজ ‘এমটি মেহেরজান’ ৬০০ টন তেল নিয়ে ডুবে
যায়। আমাদের বিআইডব্লিউটিএ জাহাজটিকে উঠাতে ব্যর্থ হলেও জাহাজের মালিকপক্ষ কিন্তু
ঠিকই নয় মাস পরে জাহাজটি উঠিয়ে ফেলে। ২০০৯ সালে ডুবে যাওয়া লঞ্চ ‘এমভি কোকো-৪’-এর মালিকপক্ষও কিন্তু
একই কাজ করে আড়াই বছর পরে। কেউই বিশাল কোন ক্রেন ব্যবহার করেনি। পন্টুন, বার্জ,
এয়ার ব্যাগ, খালি কার্গো জাহাজ, ইত্যাদি বেঁধে একটা ডুবে যাওয়া জাহজকে উদ্ধার করা
যায়। এটা সিম্পল ফিজিক্স। কাজেই বিআইডব্লিউটিএ-এর ক্রেনের উপরে সকল রাগ ঝাড়ার
অভ্যাস আমাদের পরিহার করা উচিত। বরং সেই একই সংস্থার সেই লোকগুলিকে জিজ্ঞেস করা
দরকার – আপনারা কি ইচ্ছে করেই লঞ্চটা উদ্ধার করলেন না? স্যালভেজ
করতে দেরী হয়ে গেলে বিকৃত লাশ চিনতে কষ্ট হবে এই জন্য, নাকি ক্ষতিপূরণের দায়ভার
লাঘবের জন্য? তাহলে সেই প্রশ্নেই আবার আসি - নারায়নগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল- এসব
যায়গায় কাছাকাছি ক্যাপাসিটির এই ক্রেনগুলিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন কেন – ‘দ্রুত উদ্ধারের’ জন্য?
'এমভি মিরাজ-৪'-কে টেনে তুলছে ফ্লোটিং ক্রেন 'প্রত্যয়'। এতে প্রমাণ হয়েছিল যে আবহাওয়া ভালো থাকলে আর ক্রেনের ক্যাপাসিটির মধ্যে থাকলে সেটা ঠিকই কাজ করবে। |
জাহাজ খুঁজে না পেলে কি টেনে তুলবেন?
আমরা যেহেতু প্রথমেই আমাদের জীবন বিকিয়ে দিয়েছি, কাজেই লাশ ছাড়া আমাদের আর কিছু থাকছে না। শোকার্ত পরিবারগুলির কাছে তখন দাফন করার জন্য লাশটাই অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে দাঁড়ায়। লঞ্চ খুঁজতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানে বেশ খানিকটা কমেডি অব এরর ধরা পড়ে যায়। এই ধরনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য কোন ধরনের আলাদা এজেন্সি না থাকায় কে কোথায় থেকে কতটুকু করবে, সেটা বোঝা দুষ্কর হয়ে গেল। বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী – বাকি রয়নি কেউ। চট্টগ্রাম বন্দরও যোগ দিল সেখানে। কিন্তু কে কোথায় কিভাবে কাজ করছে সেটা এক জায়গা থেকে জানাটা যেন অসম্ভব হয়ে গেল। প্রথমে বিআইডব্লিউটিএ-এর সার্ভে জাহাজগুলি হিমসিম খেল। ‘সন্ধানী’, ‘তিস্তা’, 'তুরাগ', ‘ব-দ্বীপ’ –এই জাহাজগুলি এরকম পরিস্থিতিতে এর আগেও পড়েছে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেও ব্যর্থ হয়েছে। মাওয়া ঘাটের বিআইডব্লিউটিসি-এর টাগবোটগুলিতে (আইটি-৩৯৪, ৮-৩৯৭) লাগানো যন্ত্রপাতিও লঞ্চ খুঁজে পেত বলে মনে হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের জাহাজগুলিতেও ডুবে যাওয়া জাহাজ খোঁজার যন্ত্র নেই। তাই তারা নদীতে জাল ফেলে, দড়ি টেনে, রশিতে ইট বেঁধে, এংকর টেনে ও ডুবুরি নামিয়ে লঞ্চ খোঁজার চেষ্টা করেন, যাতে সাকসেস পাবার সম্ভাবনা তেমন একটা ছিল না। কোস্ট গার্ড, র্যাব, পুলিশ – এরা দিলো সিকিউরিটি এবং জনবল। র্যাব এবং বিমান বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে (লাশ খোঁজার?) ‘সাপোর্ট’ দিল। ২০১৩ সালে কোরিয়া থেকে কেনা ফ্লোটিং ক্রেন ‘প্রত্যয়’ ও ‘নির্ভীক’-এর সাথে এসেছিল ৪০টন টানা ক্যাপাসিটির শক্তিশালী টাগবোট ‘দুরন্ত’ ও ‘দুর্বার’। দু’টি স্পীডবোট আর চারটি রেসকিউ বোটও থাকার কথা এই জাহজগুলির সাথে। ২০১৪-এর ঝড়ের সিজনেই ‘প্রত্যয়’ প্রথম মিশন পেয়ে যায়- লঞ্চ ডুবির জন্যে এই দেশে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। পানির ৮০ ফুট নিচ থেকে ‘এমভি মিরাজ-৪’-কে টেনে তোলে এই ক্রেন। প্রমাণ হলো যে আবহাওয়া ঠিক থাকলে আর জাহাজের ওজন সাধ্যের মাঝে থাকলে এই ক্রেন কাজ করবে। সেবারে লঞ্চ খুঁজে পেতে কষ্ট পেতে হয়নি তেমন, তাই কোন কথাও উঠেনি। সবাই ব্যস্ত ছিল ঝড়ের পূর্বাভাস সত্তেও লঞ্চটি কিভাবে ছাড়া হলো সেটা নিয়ে। ক্রেনগুলি উদ্ভোদনের সময় কিন্তু বলা হয়েছিল যে এগুলির সাথে পানির নিচে লঞ্চ খোঁজার যন্ত্র আছে। যেহেতু ক্রেনগুলি চলতে পারে না, তাই ধরেই নেয়া যায় যে সেই যন্ত্র হয়তো টাগবোটগুলিতেই রাখা হয়েছে। কিন্তু যখন মাওয়ায় পিনাক-৬ উদ্ধারের সময় ক্রেনের সাথে টাগবোটও বসে থাকতে দেখা গেল, তখন প্রশ্ন জাগে স্বাভাবিকভাবেই– আদৌ কি সেই ক্রেনের সাথে পানির নিচে জাহাজ খোঁজার যন্ত্র এসেছিল? জাহাজ খুঁজে না পেলে কি টেনে তুলবেন?
'জরিপ-১০' - নৌবাহিনীর অফিসারদের কথায় এই ছোট্ট জাহাজটাই 'পিনাক-৬' খোঁজায় বাংলাদেশ সরকারের সবচাইতে বড় অস্ত্র ছিল। |
ইমার্জেন্সি ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি
কাজেই আবারো সেই নৌবাহিনী। তাদের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের একটা দল মংলা থেকে সড়কপথে যন্ত্রসহ হাজির হয়ে গেলেন। পোর্টেবল এই ‘সোনার’-গুলি যেকোন জাহাজে লাগিয়ে সেটাকে সার্ভে জাহাজ বানিয়ে দেওয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন – চট্টগ্রাম থেকে ‘জরিপ-১০’ নামের ছোট্ট জাহাজটি কেন আনা হলো? কারণ এই জাহাজের ভেতরে ‘মাল্টিবিম ইকোসাউন্ডার’ (বেশ বড় একটা যন্ত্র যেটি পোর্টেবল না) রয়েছে। আবার জাহাজের পেছন থেকে ছোট্ট পোর্টেবল ‘সাইড-স্ক্যান সোনার’ দিয়েও সার্ভে করা হলো, যেটি পানির নিচে খুব অল্প জায়গার আল্ট্রা হাই রেজোলিউশন ইমেজ তৈরি করতে পারে। মাল্টিবিম ইকোসাউন্ডার-এ অনেক বড় জায়গায় সার্ভে করা যায়। যেহেতু সবার ধারণা ছিল যে স্রোতে জাহাজ অনেক দূর চলে গিয়ে থাকতে পারে, কাজেই বড় জায়গা সার্ভে করতে পারে এমন যন্ত্রই দরকার। ছোট্ট ‘জরিপ-১০’ জাহাজটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিকূল আবহাওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে উপকূলীয় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছে। এটার ডিজাইন দেখলে বোঝাই যায় যে সমুদ্রে যাবার জন্য এটি তৈরি করা হয়নি। নৌবাহিনীর ‘মাল্টিবিম ইকোসাউন্ডার’-সহ জাহাজ ‘বিএনএস অনুসন্ধান’ এবং ‘বিএনএস শৈবাল’ (যেগুলি সমুদ্রগামী জাহাজ) যোগার করা যেত কিনা (বা হয়েছিল কিনা) সেটা জানা যায়নি যদিও। যাইহোক, সোনারের সার্ভে লোকেশনের সমস্যার সাথে যোগ হয় নদীর পানিতে ভেসে আসা পলি-কাদা-বালুর চ্যালেঞ্জ। এবারেও পোর্টেবল একটা যন্ত্র দরকার হলো – ‘সাব-বটম প্রোফাইলার’। চট্টগ্রাম বন্দরের টাগ ‘কান্ডারী-২’, যেটি ‘জরিপ-১০’-এর আগেই চলে এসেছিল, সেটি থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল ‘সাব-বটম প্রোফাইলার’। এই যন্ত্র পানির নিচে পলি-কাদা-বালুর নিচেও একটা জাহাজ খুঁজে পাওয়ার সামর্থ রাখে। শেষ পর্যন্ত পানির নিচে কিছু একটা কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেলেও নদীর স্রোতের কারণে ডুবুরীরা বেশিদূর যেতেই পারলেন না। পানির ৬৫ ফুট নিচে ১৭ থেকে ২০ মিটার সাইজের এই বস্তুটি পিনাক-৬-এর প্রোফাইলের সাথে মিলে গিয়েছিল মোটামুটি। একবাক্যে বলতে গেলে – বিআইডব্লিউটিএ এবং ফায়ার সার্ভিস লঞ্চ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হবার পরে এলো নৌবাহিনী, এরপর এলো চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ। এখানে পুরো অপারেশনের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে সেটা নিয়ে স্বভাবতই একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সমন্বয়হীনতার অভাব ছিল সবক্ষেত্রে। একটা ইমার্জেন্সি ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দিল। এমন একটা এজেন্সি থাকলে হয়তো সময় নষ্ট কম হতো; তারা জানতো কোন সময় কাকে ডাকতে হবে। রানা প্লাজা ধ্বসের পরেও এইরকম এজেন্সির দরকার অনুভূত হয়েছিল। এনটিভি বিল্ডিং এবং বসুন্ধরা সিটি বিল্ডিং-এ আগুন লাগার পরেও বোঝা গিয়েছিল ব্যাপারটা। ভবিষ্যতে যে আমাদের আরও জটিল কোন দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে না, সেটা কে বললো? পিনাক-৬-এর ক্ষেত্রে লাশ উদ্ধার মূল লক্ষ্য থাকলেও রানা প্লাজা, এনটিভি ও বসুন্ধরার ক্ষেত্রে কিন্তু মানুষের জীবন বাঁচানোই মূল লক্ষ্য ছিল। ভবিষ্যতেও এরকম ঘড়ির কাটার দিকে লক্ষ্য রেখে উদ্ধারকাজ চালাতে হতে পারে।
উদ্ধারকাজ শেষ করা পর্যন্ত 'পিনাক-৬' ল্যাপটপ স্ক্রীনে একটা রঙ্গিন দাগ হয়েই থেকে গেল। কারো মনে সত্যিকারের দাগ কাটতে পারলে কেউ না কেউ দায়িত্ব স্বীকার করতেন। |
দায়িত্ব? সেটা আবার কি?
সমুদ্রে তেল-গ্যাস আহরণ করতে গিয়ে পানির অনেক নিচে (৯০০ ফুটেরও বেশি গভীর পর্যন্ত) ডুবুরী পাঠাতে হয়। তারা বেশ খানিকটা প্রতিকূল আবহাওয়াতেও কাজ করতে পারে। কারণ তাদের ডাইভিং সাপোর্ট জাহাজগুলি সেইরকমভাবে তৈরি। আমাদের দেশে সেই প্রযুক্তি নেই; তাই ডুবুরীরা কেন সোনারে খুঁজে পাওয়া জাহাজ পর্যন্ত যেতে পারলেন না, সেটা নিয়ে তর্ক করা অবান্তর। আর ডুবুরীরা নিচে যেতে না পারলে কিন্তু জাহাজের সাথে ক্রেনও আটকানো সম্ভব নয়। যেহেতু জাহাজটা নদীপথে কোন সমস্যা করবে না, তাই পরবর্তীতে জাহাজ উঠাতে গেলে মালিকপক্ষকেই উঠাতে হবে। আর অন্যান্য সববারের মতো এবারও মালিকপক্ষের যে কিছু হবে না, সেটা তো জানা-ই। ২০১৪-এর এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ার ফেরী ‘সিওল’ ডুবিতে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। জাহাজ ইন্সপেক্ট করেছেন যে যে অফিসার, তাদের বিরূদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে জাহাজের চালক এবং অন্যান্য ক্রুর বিরূদ্ধে। মালিকপক্ষের বিরূদ্ধে মামলা হয়েছে; লাইসেন্স বাতিল হয়েছে কোম্পানীর। আর আমাদের এখানে কেউ কখনো দায়িত্বই স্বীকার করেনা। যেখানে কোন জবাবদিহিতা নেই, সেখানে দায়িত্ব নেবার তো প্রশ্নই আসে না।
বারে বারে ক্রেনের ক্যাপাসিটির বাইরে বলে উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু একটা বড় জাহাজ যদি বুড়িগঙ্গা বা কর্ণফুলী নদীর ঠিক মাঝাখানে ডুবে যায়, তাহলে কি উদ্ধারকাজ এত্ত সহজে গুটিয়ে নেওয়া যাবে? হাজার কোটি টাকার ক্ষতির প্রশ্ন সেখানে। নাকি সেই ক্ষেত্রে আবার আমাদের বিআইডব্লিউটিএ-এর অনেক বুদ্ধি হয়ে যাবে? তারা কি ঝট করে বুঝে ফেলবেন যে শুধু ক্রেন না, অন্যভাবেও জাহাজ তোলা সম্ভব? লাশের চেয়ে টাকার গন্ধ ভালো বলেই কি? প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর – আমরা ভুলে যাই বারবার। আর যেখানে কিউরও দিতে পারবে না কারুর জীবন, সেখানে প্রিভেনশন ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা আছে কি? ‘বাঙ্গালী সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত এই জাতিকে কে উদ্ধার করবে? আর উদ্ধার করলেও সেটা কি জীবিত (মানে রেসকিউ) নাকি মৃত (স্যালভেজ) উদ্ধার হবে?
No comments:
Post a Comment