Tuesday 16 March 2021

মধ্য এশিয়াতে কি চাইছে তুরস্ক?

১৬ই মার্চ ২০২১
মধ্য এশিয়ার ‘লাপিস লাজুলি’ করিডোর। উসমানি খিলাফতের সময়ের ইতিহাসের উপর ভর করে গড়ে ওঠা ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা থেকে তুর্কি জনগণকে যখন আলাদা করা কঠিন, তখন মধ্য এশিয়াতে রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রভাব বিস্তার করা হবে আরও বেশি কঠিন। কারণ মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তার মানেই রাশিয়া এবং চীনের দুশ্চিন্তা। আর একইসাথে তা যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাজেই মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হবে। 


তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু গত ৬ই মার্চ থেকে ৯ই মার্চ মধ্য এশিয়ার তিনটা দেশ তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং কিরগিজস্তান ঘুরে এসেছেন। তিনি মধ্য এশিয়ার সবচাইতে জনবহুল দেশ উজবেকিস্তানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেবার আশা করেন। মধ্য এশিয়া সফরের ব্যাপারে তুর্কি মিডিয়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে কাভুসোগলু বলেন যে, তার সফর শুধু ব্যাপক সফলই ছিল না, তা ছিল আন্তরিক ও ফলপ্রসু। তিনি বলেন যে, উজবেকিস্তানের সাথে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি করার কথাবার্তা চলছে। এটা সফল হবার সাথে সাথেই তারা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে কথা শুরু করতে চান। দুই দেশের বাণিজ্য বর্তমানের ২ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চান তারা। এছাড়াও গত বছরের অক্টোবরে তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকারের উজবেকিস্তান সফরের সময় দুই দেশের মাঝে সামরিক সহযোগিতার ব্যাপারে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তুর্কমেনিস্তান তুরস্ককে রাজধানী তুর্কমেনাবাদ থেকে টারকিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অপারেট করতে দিচ্ছে, যদিও সেখান থেকে অন্য দেশের ফ্লাইট অপারেট করে না। এছাড়াও কাস্পিয়ান সাগরে আজেরবাইজান এবং তুর্কমেনিস্তানের সাথে তুরস্ক যৌথভাবে ‘দোস্তলুগ’ তেলখনি নিয়ে কাজ করছে।

সফরকালে কিরগিজস্তানের তুর্কি কিরগিজ মানাস ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত ‘আনতালিয়া ডিপ্লোম্যাসি ফোরাম’এ কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, ২১ শতক হবে এশিয়ার শতক। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্ধেক এখন এশিয়ার। একারণেই তুরস্ক চাইছে এশিয়ার সাথে যুক্ত হতে। তিনি বলেন যে, বহু বছর ধরে ‘তুর্কি দুনিয়া’ আলাদা হয়ে ছিল ‘কৃত্রিম দেয়াল’এর কারণে। এই দেয়াল ভেঙ্গে যাবার পর তুরস্ক এবং ‘তুর্কি দুনিয়া’ একে অপরকে আলিঙ্গন করেছে। তিনি এপ্রসঙ্গে ২০০৯ সালে গঠিত ‘তুরকিক কাউন্সিল’এর সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। একইসাথে তিনি নাগোর্নো কারাবাখে আজেরবাইজানের যুদ্ধজয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় সাবেক মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা পল গোবল বলেন যে, আজেরবাইজানের যুদ্ধজয়ের পর বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনায় থাকা ‘লাপিস লাজুলি’ করিডোর নতুন জীবন পেয়েছে। এই করিডোর আজেরবাইজান এবং তুর্কমেনিস্তান হয়ে আফগানিস্তানকে তুরস্কের সাথে যুক্ত করবে। একই সূত্রে বাঁধা আফগানিস্তান। ১২ই মার্চ কাভুসোগলু নিশ্চিত করেন যে, এপ্রিল মাসে ইস্তাম্বুলে আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনা হতে চলেছে। এর আগে ৭ই মার্চ আফগানিস্তানের টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘টিওএলও নিউজ’ বলে যে, মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্থনি ব্লিংকেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির কাছে এক চিঠি দিয়ে জানান যে, যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে আফগান শান্তি আলোচনার ভেন্যু হতে অনুরোধ করেছে। ব্লিংকেনের এই চিঠিই বলে দিচ্ছে যে, আফগানিস্তানে তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের সমন্বয় রয়েছে।

গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তুরস্কের ‘সেন্টার ফর ডিপ্লোম্যাটিক এফেয়ার্স এন্ড পলিটিক্যাল স্টাডিজ’এর উপদেষ্টা মেসুত হাক্কি কাসিন বলেন যে, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলি অর্থনীতির ভিন্ন ভিন্ন স্তরে রয়েছে। এদের মাঝে কৌশলের সমন্বয় জরুরি। তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন যে, তুরস্কের চিন্তার কেন্দ্র এখনও ইইউ। এক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলি তুরস্কের মাধ্যমে ইইউ পৌঁছাতে পারে। অপরদিকে পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ এবং প্রাক্তন তত্বাবধায়ক অর্থমন্ত্রী সালমান শাহ বলেন যে, তুরস্ক যেমনি ইউরোপে ঢোকার পথ, পাকিস্তানও তেমনি চীন এবং মধ্য এশিয়াতে ঢোকার পথ। তিন আরও বলেন যে, এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র, যখন ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিপেক’ আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া হয়ে তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের সাথে যুক্ত হবে। একইসাথে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বও আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলির হাতেই থাকা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন। এপ্রসঙ্গে তিনি তুরস্ক ও পাকিস্তানের মাঝে অনুষ্ঠিত ‘আতাতুর্ক ২০২১’ যৌথ সামরিক মহড়ার কথা মনে করিয়ে দেন।

তুর্কি পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক ইউসুফ এরিম মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা সুযোগ হিসেবে দেখছেন। ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় তিনি বলছেন যে, তুরস্ককে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে বেশ হিসেব করেই রুশ প্রভাবকে ব্যালান্স করতে হচ্ছে। রাশিয়া এবং চীনের সাথে বেশ কিছু বিষয়ে তুরস্কের সহযোগিতা থাকার কারণেই মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সুযোগ। তিনি মনে করছেন যে, দুই দেশের উচিৎ ‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং সিরিয়ার কুর্দি ‘ওয়াইপিজি’ মিলিশিয়ার ইস্যুকে প্রাধান্য না দিয়ে মধ্য এশিয়া বিষয়ে একটা সমন্বিত কৌশলের ব্যাপারে একমত হওয়া। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’এর ডিরেক্টর লিউক কোফি তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর লেখায় ন্যাটো, মধ্য এশিয়া এবং ইউক্রেনে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার রাস্তা খোলা রয়েছে বলে বলেন। ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারাস কুজিও তুরস্কের সরকারি মিডিয়া ‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক লেখায় তুরস্কের সাথে আজেরবাইজানের কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকা উচিৎ বলে মত দেন।

মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের জন্যে সবচাইতে বড় সুযোগ তৈরি হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে; যখন ২৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর উজবেকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইসলাম কারিমভের মৃত্যু হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিইয়োয়েভ ২০১৭ সালের অক্টোবরে তুরস্ক সফরে যান। সাথেসাথে মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের দুয়ার খুলে যায়। তবে আদর্শিক দিকনির্দেশনা না থাকার কারণে তুরস্ক, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলি কৌশলগত দিক থেকে এখনও জাতীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে পারছে না। একারণেই দেশগুলি একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে সাথে চাইছে, অন্যদিকে উইঘুর ইস্যুতে কথা বলে চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইছে না। উসমানি খিলাফতের সময়ের ইতিহাসের উপর ভর করে গড়ে ওঠা ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা থেকে তুর্কি জনগণকে যখন আলাদা করা কঠিন, তখন মধ্য এশিয়াতে রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রভাব বিস্তার করা হবে আরও বেশি কঠিন। কারণ মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তার মানেই রাশিয়া এবং চীনের দুশ্চিন্তা। আর একইসাথে তা যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাজেই মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হবে।

5 comments:

  1. এই আর্টিকেল থেকে বুঝতে পেলাম যে, এরদোয়ান এর তুর্কী এখনো তার সেকুলার মাস্টার ইউএস এর প্রভাবমুক্ত নয়। তাহলে তুর্কী কিভাবে উস্মানি খিলাফাতের উত্তরসুরি হিসাবে নিজেদের দাবি করতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এর আগের অনেক লেখাতেই বহুবার বলা হয়েছে যে তুরস্ক একটা আদর্শিক রাষ্ট্র নয়; যেকারণে তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের প্রভাবমুক্ত নয়। এছাড়াও আপনি 'যুক্তরাষ্ট্রের পর...' বইখানা পড়তে পারেন। সেখানে তুরস্ক নিয়ে আলাদা একটা সেকশন রয়েছে।

      Delete
  2. আমেরিকার পর সম্ভাব্য কোন শক্তি বিশ্বে প্রভাব তৈরী করবে? যেখানে চায়না আদর্শিক শক্তি নয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা একটা বিস্তারিত আলোচনা। আপনি 'যুক্তরাষ্ট্রের পর...' বইটা পড়তে পারেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পর কোন দেশগুলি মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাদের সম্ভাবনা কতটুকু, তা আলোচিত হয়েছে। এখানে এক কথায় উত্তর দেবার চেষ্টা করাটা সমুচিত হবে না; ভুল মেসেজ যাবে।

      Delete