Saturday 6 March 2021

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের ভবিষ্যৎ কি?

০৭ই মার্চ ২০২১

প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলি ছাড়াও বড় সমস্যা হলো তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের মূল ক্রেতা এখনও তুর্কি সরকার। নিজস্ব চাহিদা সমস্যায় পতিত হলে পুরো শিল্পই সমস্যায় পড়বে। তবে এক্ষত্রে সবচাইতে ভালো দিক হলো, এই শিল্পের পিছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিরক্ষা শিল্প থাকবে অগ্রাধিকার। কারণ এই প্রতিরক্ষা শিল্পের মাঝেই তুর্কিরা উসমানি খিলাফতের ছায়া দেখতে পায়।

 
তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘আসেলসান’ গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক ঘোষণায় বলে যে, গত এক বছরে কোম্পানির আয় ২৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারে। এর মাঝে রপ্তানি আয় ছিল সাড়ে ৩’শ ৩১ মিলিয়ন ডলার। প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্কের সবচাইতে বড় এই কোম্পানি এক বছরে লাভ করেছে ৬’শ ৩০ মিলিয়ন ডলার; যা আগের বছরের চাইতে ৩৩ শতাংশ বেশি। কোম্পানি বলছে যে, করোনাভাইরাসের মহামারি সত্ত্বেও তারা এই আয় করেছে। বিশ্বের মোট ১২টা দেশে ‘আসেলসান’এর ব্যবসা রয়েছে। এর একদিন আগে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হালুক গোরগুন তুর্কি ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে বলেন যে, ২০১৭ সালে ‘আসেলসান’এর আয় ছিল ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এখন পর্যন্ত ৬০টা দেশে রপ্তানি করেছে কোম্পানিটা। আর গত বছর তারা ৪’শ ৫০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি অর্ডার পেয়েছে। গোরগুন বলেন যে, তারা কোম্পানিটাকে গবেষণা ও প্রকৌশল কোম্পানি বলে সংজ্ঞায়িত করেন। বিশ্বের সবচাইতে বড় ১’শ প্রতিরক্ষা কোম্পানির মাঝে থাকা এই কোম্পানিতে প্রায় ৯ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। মহামারির মাঝেই তারা ১৪’শ ৭৯ জনকে নতুন করে রিক্রুট করেছেন। তবে ২০২০ সালে ‘আসেলসান’ পারলেও তুরস্কের পুরো প্রতিরক্ষা শিল্প আয় বাড়াতে পারেনি, যদিও বিগত কয়েক বছরে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প নিয়মিতই আলোচনায় এসেছে। ‘টারকিশ এক্সপোর্টার্স এসেম্বলি’র হিসেবে ২০২০ সালে তুরস্কের প্রতিরক্ষা রপ্তানি ছিল ২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের চাইতে ১৭ শতাংশ কম। ৭’শ ৪৮ মিলিয়ন ডলারে যুক্তরাষ্ট্র ছিল সবচাইতে বড় বাজার।

তুর্কি সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের হুমকির কারণেই তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘আসেলসান’এর পণ্য তালিকার মাঝে রয়েছে যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি, রাডার ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, ইলেক্ট্রো অপটিক্স, এভিওনিক্স, মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান, স্থল বা সমুদ্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ওয়েপন সিস্টেম, বিমান প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেম, ইত্যাদি। ‘আসেলসান’ ছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্পে তুরস্কে আরও বেশকিছু কোম্পানি ভালো করছে। এর মাঝে রয়েছে বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘টারকিশ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘টিএআই’, কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেম তৈরি করা সফটওয়্যার কোম্পানি ‘হাভেলসান’, ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি ‘রকেটসান’, প্রতিরক্ষা গবেষণা কোম্পানি ‘তুবিতাক’, ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘বায়কার’, বিমানের ইঞ্জিন তৈরির কোম্পানি ‘তুসাস ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘টিইআই’, আর্মার্ড ভেহিকল তৈরি করা প্রতিষ্ঠান ‘এফএনএসএস’, ‘অতোকার’ ও ‘বিএমসি’, যুদ্ধজাহাজ নির্মাতা ‘টারকিশ এসোসিয়েটেড ইন্টারন্যাশনাল শিপইয়ার্ডস’, ‘এসটিএম’, রাডার নির্মাতা ‘আয়েসাস’, ‘মেতেকসান’, ইত্যাদি।

তুরস্কের সামরিক শিল্প গত ১০ বছরে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ বা ‘সিপরি’র হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মাঝে তুরস্ক তার অস্ত্র রপ্তানি ২’শ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। গত পাঁচ বছরের মাঝে তুরস্ক ড্রোন বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, আর্মার্ড ভেহিকল, আর্টিলারি এবং যুদ্ধজাহাজ রপ্তানি করেছে। এর মাঝে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার এবং আজেরবাইজান ছিল বড় ক্রেতা। তুরস্কের সরবরাহ করা ড্রোন নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধে আজেরবাইজানের জিততে ব্যাপক সহায়তা করেছে। লিবিয়ার ত্রিপোলির জিএনএ সরকারও সেখানকার গৃহযুদ্ধে তুর্কি ড্রোন ব্যাবহার করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে ফেলে। এই সফলতাগুলি ইউক্রেনকে অনুপ্রাণিত করেছে তুর্কি ড্রোন কিনতে এবং যৌথভাবে তৈরিতে। এছাড়াও আঞ্চলিকভাবে তুরস্কের সামরিক অভিযানগুলিও দেশটার প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে সহায়তা করেছে। সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালনার সময় তুরস্কের সীমানায় ‘হিসার এ’ স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘হিসার ও’ মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে তুরস্ক। এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা যৌথভাবে ডেভেলপ করেছে ‘আসেলসান’ ও ‘রকেটসান’।

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে তুর্কি কর্মকর্তারা বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে তুরস্কের সম্পর্কোন্নয়নের কারণে তারা সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে বড় বাজার দেখতে পাচ্ছেন। ২০২০ সালে আমিরাতে রপ্তানি ছিল ২’শ মিলিয়ন ডলার। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করা একজন কর্মকর্তা বলছেন যে, আরব দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন হলে সেখানে ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানি খুব কঠিন ব্যাপার নয়। ফেব্রুয়ারি মাসে আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত ‘আইডিইএক্স ২১’ প্রতিরক্ষা মেলায় ১১টা তুর্কি কোম্পানি অংশ নেয়; যদিও বড় সরকারি কোম্পানিগুলি এখনও অংশ নিতে যায়নি।

তবে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প এখনও সমস্যাসংকুল। যুক্তরাষ্ট্রের উপর তুরস্কের নির্ভরশীলতা দেশটার প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রধান দুর্বলতা। রাশিয়া থেকে ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা কেনার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ‘এফ ৩৫’ স্টেলথ বিমান প্রকল্প থেকে বের করে দেয়। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক ওয়াশিংটনে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে ‘এফ ৩৫’ প্রকল্পে পুনরায় ঢোকার জন্যে। পাকিস্তানের কাছে ‘টি ১২৯ আতাক’ হেলিকপ্টার রপ্তানিও থেমে রয়েছে ওয়াশিংটনের বাধার কারণে। কারণ হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন তৈরিকারক কোম্পানিতে যুক্তরাষ্ট্রের পার্টনারশিপ রয়েছে। তুরস্ক তাই চেষ্টা করছে নিজস্ব হেলিকপ্টার ইঞ্জিন তৈরি করতে। নিজস্ব ‘আলতায়’ ট্যাঙ্ক তৈরিও আটকে রয়েছে নিজস্ব ইঞ্জিন তৈরি করতে না পারার কারণে। ২০১৮ সালে সিরিয়ার যুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে জার্মানি তুরস্কের কাছে ইঞ্জিন বিক্রি আটকে দিলে তুরস্ক নিজস্ব ইঞ্জিন তৈরিতে মনোযোগী হয়। নিজস্ব ফাইটার বিমান ‘টিএফএক্স’এর ডেভেলপমেন্ট নিয়েও বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তুরস্ককে। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, তুরস্ক তার প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলি থেকে বের হতে পাকিস্তানকে পাশে পেতে চাইছে। পাকিস্তানের মাধ্যমে তুরস্ক হয়তো চীনা প্রযুক্তির সহায়তা পেতে পারে; বিশেষ করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ফাইটার বিমানের ক্ষেত্রে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর এক লেখায় সাংবাদিক ফেরহাত গুরিনি বলছেন যে, প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলি ছাড়াও বড় সমস্যা হলো তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের মূল ক্রেতা এখনও তুর্কি সরকার। নিজস্ব চাহিদা সমস্যায় পতিত হলে পুরো শিল্পই সমস্যায় পড়বে। তবে এক্ষত্রে সবচাইতে ভালো দিক হলো, এই শিল্পের পিছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিরক্ষা শিল্প থাকবে অগ্রাধিকার। কারণ এই প্রতিরক্ষা শিল্পের মাঝেই তুর্কিরা উসমানি খিলাফতের ছায়া দেখতে পায়।

8 comments:

  1. Bangladesh is also one of the customers of Turkish defense products. Previously Bangladesh had purchased several drones (mini). F7's are now being jeweled with Turkish bombs. T300 and other mutations are on the way. Turkey has offered assistance to pull up the shipbuilding industry of Bangladesh. What will be the political, geopolitical impact of such move???

    ReplyDelete
    Replies
    1. This has already been discussed last September in another writing.... Please find the link below....

      https://koushol.blogspot.com/2020/09/turkey-arrives-in-bay-of-bengal.html

      Delete
  2. Currently Bangladesh is getting towards Turkey for cutting edge technology and weapons though indigenous military industry of Turkey is far behind the satisfactory standard as Turkey still have to depend on foreign assistance. Will that be a problem for Bangladesh in future if Turkish defense industry fall apart due to any reason???

    ReplyDelete
    Replies
    1. When the US's world hegemony is falling apart, such questions would always come with a timeline attached... Most countries in the world have to think about US when they formulate their policies, including their defence and industrial policies.... US is the global regulator of technology.... Even China and Russia cannot export surface-to-surface missiles with a range beyond 300km.... or the technology to make centrifuge for Uranium enrichment... yet, these all depend on how long the US can sustain its position at the top.... Recent developments show that such a position is visibly finite....

      The US capability to impose its will upon others is no longer what it used to be.... This isn't the US of Kissinger; its the US of Bush-Obama-Trump-Biden....

      Delete
  3. What is the difference between us of kissinger and us of bush-obama-trump-biden?

    ReplyDelete
    Replies
    1. Geopolitical strength....

      Kissinger's US was able to force other countries to conform to the US's will.... This can no longer be guaranteed by the US....

      Delete
  4. স্যার আপনার একটা পুরাতন লেখা পড়লাম তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুথান ও আমাদের জন্য শিক্ষা। আপনি ওই খানে বলছেন যে তুরস্কের ভূরাজনৈতি তাদের জনগনের হাতে কোনো দলের হাতে নয়। তাহলে বাংলাদেশে ভূরাজনৈতি জনগনকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমানের বাস্থবতায় আর্দশিক দিক দিয়ে। বাস্তবেই কি কোন আর্দশিক রাষ্ট্র সম্ভব

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভূরাজনীতিতে জনগণের আকাংক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই আকাংক্ষা কোন একটা লক্ষ্যের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হতে পারে; আবার একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের উপর একটা ভিত্তি গড়ার আকাংক্ষার দিকেও নিয়ে যেতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলির ক্ষেত্রেও এরকমই হয়েছে; যেকারণে তারা আদর্শিক রাষ্ট্র তৈরির দিকে এগুতে পেরেছে, এবং শেষ পর্যন্ত আদর্শিক রাষ্ট্র তৈরি করেছে। সেই রাষ্ট্র তাদের আদর্শকে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়েছে এবং বাস্তবায়িত করেছে। বর্তমানে তারা তাদের আদর্শকে দুনিয়াতে টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এটাই আদর্শিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। ব্রিটেন এবং আমেরিকা এমনই রাষ্ট্র। ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন - এরাও একই আদর্শের অনুসারী। তাই তারা নেতৃত্বশীল দেশগুলির সাথেই থাকে; যদিও তাদের নিজেদের মাঝেও প্রতিযোগিতা রয়েছে।

      বাংলাদেশ নিয়ে অনেক লেখাই এই ব্লগে রয়েছে। আপনি "বঙ্গোপসাগর আসলে কার?" বইখানা পড়লে একটা দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন। কারণ সেখানে লেখাগুলিকে একটা দৃষ্টিভঙ্গির আদলে সমন্বয় করা হয়েছে। রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা প্রকৃতপক্ষে ভূরাজনীতিকে ছাপিয়ে যায় না। আর ভূরাজনীতিতে গত চার'শ বছর ধরে আদর্শিক দন্দ্বই মূল দ্বন্দ্ব। তাই বাংলাদেশ এবং ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি বুঝতে হলে ভূরাজনীতিতে আদর্শিক দ্বন্দ্বকে বুঝতে হবে।

      Delete