Saturday 28 November 2020

‘আরসেপ’ বাণিজ্য চুক্তি... ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন?

২৯শে নভেম্বর ২০২০

‘আরসেপ’ অত্র অঞ্চলের ভূরাজনৈতিকে পরিবর্তিত করেনি। এখনও এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পণ্য তৈরি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বকে টার্গেট করেই। এশিয়ার দেশগুলি নিজেদের মাঝে পণ্যের ‘কম্পোনেন্ট’ বা অংশবিশেষ নিয়ে বাণিজ্য করে, যাতে পশ্চিমা বাজারে ‘ফিনিশড প্রডাক্ট’ বা সর্বশেষ পণ্য আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়। সেই লক্ষ্যে ‘আরসেপ’ সেই সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে মাত্র।

গত ১৫ই নভেম্বর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট ‘এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস’ বা ‘আসিয়ান’এর ১০টা দেশ সহ এশিয়া প্যাসিফিকের মোট ১৫টা দেশ পৃথিবীর সবচাইতে বড় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।‘রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ’ বা ‘আরসিইপি’ বা ‘আরসেপ’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই জোটের সদস্যদেশগুলির মাঝে পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মাঝে পড়েছে ২’শ ২০ কোটি মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় একতৃতীয়াংশ; এর ২৬ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি গোটা বিশ্বের ২৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর বাণিজ্য চুক্তি এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চাইতেও এই চুক্তি বড়। স্বাক্ষর করা দেশগুলির মাঝে চীন ছাড়াও মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কমনওয়েলথ এবং ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। তবে জোটের বাইরে থাকা দেশগুলির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। এরকম বিরল ঘটনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে কতটুকু?

২০১২ সালে আলোচনা শুরুর পর থেকে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত ‘ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ বা ‘টিপিপি’ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বের হয়ে আসার ঘোষণা দেবার পর থেকেই ‘আরসেপ’এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। ওবামা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘টিপিপি’ নিয়ে যখন কথা চলছিল, তখনই প্রতিদ্বন্দ্বী চুক্তি হিসেবে ‘আরসেপ’এর আবির্ভাব হয়। ‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ‘আরসেপ’ প্রকৃতপক্ষে ‘টিপিপি’র মতো শুল্ক কর্তনের দিকে যায়নি। তবে এর আকার এটাকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে; বিশেষ করে এর মাঝে চীন থাকার কারণে পুরো জোটের একত্রিত জিডিপি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। যদিও চীন এতকাল অনেক দেশের সাথেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে, এবারই প্রথম চীন বহুপাক্ষিক কোন বাণিজ্য চুক্তির মাঝে ঢুকেছে। চীনা প্রধানমন্ত্রী লী কিচিয়াং বলেন যে, আট বছর ধরে দরকষাকষির পর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি এই চুক্তিকে ‘বহুপাক্ষিকতা এবং মুক্ত বাণিজ্যে’র বিজয় বলে উল্লেখ করেন।

‘সিএনবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, এই চুক্তি চীনের জন্যে একটা ভূরাজনৈতিক বিজয়; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যখন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে সরে আসছিল। এটা এখনও পরিষ্কার নয় যে, হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বী নতুন কোন বড় বাণিজ্য চুক্তির দিকে এগুবে কিনা। সিটি ব্যাঙ্কের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সিটি রিসার্চ’ তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে যে, অর্থনৈতিকভাবে এই চুক্তি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্ব বহন করছে এর কূটনৈতিক বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে এই চুক্তি বার্তা দিচ্ছে যে, পূর্ব এশিয়া মুক্ত বাণিজ্যের জন্যে প্রস্তুত রয়েছে। আর চীন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে বলে যা অনেকে মনে করছিল, তা আসলে ঠিক নয়। এছাড়াও এটা এখন বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র অথবা শুধুমাত্র চীনের সাথে থাকার পক্ষপাতি নয়। এই ব্যাপারটা দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে। 

ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার ফলে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশের কাছেই নতুন শুল্কমুক্ত এলাকার গুরুত্ব বেশকিছুটা কমে গেছে। সদস্য দেশগুলির জন্যে চুক্তিকে এড়িয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট পদ্ধতি রাখার ফলে এটা অত শক্তিশালী চুক্তি নয়। তথাপি চুক্তিটা অনেককেই মনে করাবে যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে পারস্পরিক সহযোগিতায় অধিকতর বিশ্বাসী। ‘আরসেপ’এর কারণে চীন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হবে না; কারণ চীন ইতোমধ্যেই অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু।

ভারতও এই চুক্তির আলোচনায় অংশ নেয়; তবে গত বছর কমদামি চীনা পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাবার ভয়ে ভারত এই চুক্তির আলোচনা থেকে নিজেকে উঠিয়ে নেয়। ‘ক্যাপিটাল ইকনমিক্স’এর জ্যেষ্ঠ এশিয়া অর্থনীতিবিদ গ্যারেথ লেদার বলছেন যে, চুক্তিতে ভবিষ্যতে ভারতের ফিরে আসার জন্যে দুয়ার খোলা রাখা হয়েছে। জাপানিরাই মূলতঃ ভারতকে চেয়েছিল চীনের অর্থনৈতিক আকৃতিকে ব্যালান্স করতে। তবে হিমালয়ের পাদদেশে চীনের সাথে ভারতের দ্বন্দ্বের ফলে এই চুক্তিতে থাকাটা ভারতের জন্যে কঠিন হয়ে যায়। ‘সিটি রিসার্চ’ বলছে যে, ‘আরসেপ’এ না থাকার কারণে ভারত বিরাট একটা সুযোগ হারিয়েছে; ভারত এখন এই জোটের প্রতিদ্বন্দ্বী উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে নিজেকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবে না।

তবে অনেকেই বলছেন যে, এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির জন্যে বড় কোন সুবিধা নিয়ে আসবে না; আর এর বাস্তবায়ন অনেক বছর লেগে যাবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ‘আরসেপ’ ‘টিপিপি’র মতো শক্তিশালী চুক্তি নয়; এর বাধ্যবাধকতা বেশ অনেকটাই কম। সদস্য রাষ্ট্রগুলির নিজেদের নীতি এবং ভর্তুকি দেয়ার চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ‘আরসেপ’এর সদস্য দেশগুলির মাঝে ইতোমধ্যেই দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি ছিল। ‘আসিয়ান’এর দেশগুলির মাঝে মোট বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যেই শুল্কবিহীনভাবে হয়ে থাকে। তবে ‘দ্য ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’এর বৈশ্বিক প্রধান অর্থনীতিবিদ সায়মন ব্যাপটিস্ট বলছেন যে, ‘আরসেপ’এর যে দেশগুলির মাঝে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই, সেই দেশগুলির মাঝে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। ‘এইচএসবিসি’র হিসেবে ২০৩০ সালের মাঝে ‘আরসেপ’এর দেশগুলির একত্রিত জিডিপি দাঁড়াবে বিশ্বের ৫০ শতাংশ। চুক্তির আগ থেকেই গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে, তা চুক্তির পরেও অব্যহত থাকবে।

‘আরসেপ’ অত্র অঞ্চলের ভূরাজনৈতিকে পরিবর্তিত করেনি। এখনও এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পণ্য তৈরি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বকে টার্গেট করেই। এশিয়ার দেশগুলি নিজেদের মাঝে পণ্যের ‘কম্পোনেন্ট’ বা অংশবিশেষ নিয়ে বাণিজ্য করে, যাতে পশ্চিমা বাজারে ‘ফিনিশড প্রডাক্ট’ বা সর্বশেষ পণ্য আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়। সেই লক্ষ্যে ‘আরসেপ’ সেই সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে মাত্র। ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্ট্রাটফর’এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রজার বেকার বলছেন যে, ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার ফলে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশের কাছেই নতুন শুল্কমুক্ত এলাকার গুরুত্ব বেশকিছুটা কমে গেছে। সদস্য দেশগুলির জন্যে চুক্তিকে এড়িয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট পদ্ধতি রাখার ফলে এটা অত শক্তিশালী চুক্তি নয়। তথাপি চুক্তিটা অনেককেই মনে করাবে যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে পারস্পরিক সহযোগিতায় অধিকতর বিশ্বাসী। ‘আরসেপ’এর কারণে চীন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হবে না; কারণ চীন ইতোমধ্যেই অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। অপরদিকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজস্ব একটা প্রভাব বলয় তৈরি করতে চাইছে জাপান; যার অংশ হিসেবে জাপান এই চুক্তির অংশ হয়েছে।

No comments:

Post a Comment