Friday 13 November 2020

আজেরবাইজানের যুদ্ধজয় এবং অতঃপর...

১৪ই নভেম্বর ২০২০
আজেরবাইজান এবং তুরস্কের পতাকা নিয়ে আজেরবাইজানের রাজধানী বাকুতে উল্লাস করছে মানুষ। ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র আর্মেনিয়াকে সহায়তা না দেয়ায় মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে কি বার্তা গেলো, তা এখন আলোচ্য বিষয়। শুশার মসজিদ নিয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বই বলে দিচ্ছে যে, আজেরবাইজানের জয় এখনও শুধুমাত্র সামরিক। অপরদিকে বৃহত্তর মধ্য এশিয়াতে কৌশলগত জয়ের ফসল গিয়েছে তুরস্কের ঘরে, যা তুরস্ককে আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির দিকে ঠেলবে।

১২ই নভেম্বর তুরস্কের পত্রিকা ‘ডেইলি সাবাহ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, নাগোর্নো কারাবাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শুশাতে ২৮ বছর পর মসজিদ থেকে আজান দেয়া হয়। সোশাল মিডিয়াতে এক ভিডিওতে দেখা যায় যে, শুশার ঐতিহাসিক ইউখারি গোভহার আগা মসজিদের মিনার থেকে একজন আজেরি সেনাসদস্য আজান দিচ্ছে। ২৭শে সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া আজেরবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার যুদ্ধ ১০ই নভেম্বর রুশ মধ্যস্ততায় থামার পর এখানকার ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলি আলোচনায় আসছে।

শুশা শহর কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ট থেকে মাত্র ১০ কিঃমিঃ দূরে এবং শুশা স্তেপানাকার্টএর প্রায় ২ হাজার ফুট বেশি উচ্চতায়। স্তেপানাকার্টএর সাথে আর্মেনিয়ার যোগাযোগের রাস্তার উপর অবস্থিত শুশা; আর তাই শুশার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার অর্থ হলো স্তেপানাকার্টএর নিয়ন্ত্রণ নেয়া। ৮ই নভেম্বর আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ শুশা পুণর্দখলের ঘোষণা দেন। শহরটা আজেরিদের নিয়ন্ত্রণে যাবার কারণেই আর্মেনিয়া যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন যে, উভয় পক্ষ ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি’তে সম্মত হয়েছে, যা অত্র অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতার দিকে যাবার সম্ভাবনা তৈরি করবে। তিনি আরও বলেন যে, উভয় পক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলি ধরে রাখবে এবং রুশ শান্তিরক্ষী সেনারা দুই পক্ষের মাঝে অবস্থান নেবে। রুশ সেনারা নাগোর্নো কারাবাখের সাথে আর্মেনিয়ার যোগাযোগের জন্যে একটা করিডোর নিয়ন্ত্রণে রাখবে। রুশ বার্তা সংস্থাগুলি বলছে যে, মোট ১ হাজার ৯শ ৬০ জন রুশ সেনা এবং ৯০টা সাঁজোয়া যান শান্তিরক্ষায় মোতায়েন হবে।

ফরাসি বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, যুদ্ধবিরতির পর আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে বিক্ষুব্ধ জনতা পার্লামেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন অফিস ভাংচুর করে। আর্মেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকল পাশিনিয়ান এক ঘোষণায় বলেন যে, সার্বিক সামরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে একটা ‘অকল্পনীয় যন্ত্রণাদায়ক’ চুক্তি স্বাক্ষরে তিনি বাধ্য হয়েছেন। অপরদিকে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিইয়েভ বলছেন যে, একটা ‘লৌহ হস্ত’ পাশিনিয়ানকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করেছে। তিনি এই চুক্তিকে আর্মেনিয়ার ‘আত্মসমর্পণ’ বলে আখ্যা দেন। আলিইয়েভ বলেন যে, একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মাঝে কারাবাখের একটা বড় এলাকা থেকে আর্মেনিয়া সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়েছে। আর আজেরবাইজানের বন্ধুরাষ্ট্র তুরস্ক যুদ্ধবিরতি ধরে রাখতে সহায়তা দেবে।

শুশার মসজিদের ইতিহাসের সাথে অত্র অঞ্চলের সংঘাতের গভীরতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ‘ইউরেশিয়ানেট’ বলছে যে, এই মসজিদের কাজ শেষ হয় ১৮৮৫ সালে। সোভিয়েত আমলে মসজিদটাকে জাদুঘর হিসেবে আখ্যা দিয়ে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেয়া হলেও ১৯৮৮ সালে আবার নামাজ আদায় শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ৮ই মে শুশা শহর আর্মেনিয়দের হাতে চলে যাবার পর থেকে এই মসজিদ থেকে আজান প্রচার হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে আর্মেনিয়রা ইরানিদের সহায়তায় এই মসজিদ মেরামত করে জাদুঘর হিসেবে জনসাধারণের জন্যে খুলে দেয়। তবে এই মসজিদের মেরামত আজেরিরা ভালো চোখে দেখেনি। আর্মেনিয়রা কারাবাখ দখল করে নেবার পর কারাবাখের ৬ লাখের বেশি আজেরি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। শুশার এক শিক্ষক নুনে হাকোবিয়ান মসজিদখানা মেরামতের পর মন্তব্য করেন যে, তিনি এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটাকে পছন্দ করেন; তবে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন যে, এই মসজিদখানা তৈরি হয়েছে খ্রিস্টান ভূমিতে। আরটার পোগোসিয়ান নামের আরেক ব্যক্তি মন্তব্য করেন যে, কারাবাখের কর্তাব্যক্তিরা এই মসজিদের মেরামত চাইলেও জনগণ চায় না। তারা মনে করে যে, এখানে একটা মসজিদ থাকলে মুসলিমরা কোন এক সময় মনে করবে যে, এই ভূমি মুসলিমদের। শুশার আর্মেনিয়দের কথায় অত্র অঞ্চলে আর্মেনিয় এবং আজেরিদের মাঝে দ্বন্দ্ব কতটা গভীর, তার প্রমাণ মেলে। উভয় পক্ষের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি। মসজিদটা মেরামত করে কারাবাখের আর্মেনিয়রা ঘোষণা দেয় যে, আজেরিরা আর্মেনিয়দের ইতিহাস ধ্বংস করলেও আর্মেনিয়রা তার উল্টোটা করেছে। অপরদিকে আজেরিরা বলছে যে, আর্মেনিয়রা মসজিদখানা মেরামত করে এটাকে ‘পারস্যের মসজিদ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে, যা কিনা এখান থেকে আজেরিদের ঐতিহ্য মুছে ফেলার একটা চক্রান্ত। কারাবাখের মন্ত্রী আরতাক গ্রিগোরিয়ান বলছেন যে, ইরানি প্রকৌশলীরা সহায়তা করতে এসে এই মসজিদকে ‘পারস্যের মসজিদ’ বলেই আখ্যা দিয়েছে; তাই তারাও সেটাই বলছেন। দুই পক্ষের কথাগুলি জাতিগত চরম মেরুকরণেরই উদাহরণ, যা অত সহজে পরিবর্তনীয় নয়। আজেরিরা নিজেদেরকে তুর্কি জাতির অংশ বলে মনে করলেও পারসিক আখ্যা দেয়াটা তাদের পছন্দনীয় নয়।

কমপক্ষে ১৩’শ মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে বলছে বার্তাসংস্থাগুলি; যদিও অনেকেই এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলে বলছেন। এই হত্যাযজ্ঞ প্রায় তিন দশক ধরে চলা যুদ্ধাবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। তুর্কি ও ইস্রাইলি মনুষ্যবিহীন ড্রোন এবং বাকুর তেল বিক্রির অর্থে কেনা বিপুল অস্ত্রের সমাহার আজেরবাইজানকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে একচ্ছত্র প্রাধান্য দিলেও তুরস্কের সমর্থন ব্যাতীত আজেরিদের পক্ষে এতদিন যুদ্ধ চালিয়ে নেয়া সম্ভব ছিল না। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে আর্মেনিয়রা সহায়তা চাইলেও পুতিন সরাসরিই বলে দেন যে, শুধুমাত্র আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলেই রুশরা আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়াবে; কারাবাখ যেহেতু আজেরবাইজানের এলাকা বলে স্বীকৃত, তাই সেখানকার যুদ্ধে রুশরা জড়াবে না। আজেরবাইজানকে তুরস্কের সরাসরি সমর্থনই শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করে যে, রাশিয়া যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ব্যতীত অন্য কোন ভূমিকা নেয়নি। এই যুদ্ধ শেষ হলো রাশিয়া এবং তুরস্কের ভূমিকায়; যা কিনা ‘ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপ’কে অর্থহীন করে ফেলেছে। সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র নীরব থেকে তুরস্ককে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় একদিকে মিনস্ক গ্রুপের সদস্য ফ্রান্সের প্রভাব যেমন আরও কমলো, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র যে এই অঞ্চল নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবে না, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলো। প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ানের পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের খুঁটিও দুর্বল হলো; যা রাশিয়াকে খুশিই করবে। তবে ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র আর্মেনিয়াকে সহায়তা না দেয়ায় মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে কি বার্তা গেলো, তা এখন আলোচ্য বিষয়। শুশার মসজিদ নিয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বই বলে দিচ্ছে যে, আজেরবাইজানের জয় এখনও শুধুমাত্র সামরিক। অপরদিকে বৃহত্তর মধ্য এশিয়াতে কৌশলগত জয়ের ফসল গিয়েছে তুরস্কের ঘরে, যা তুরস্ককে আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির দিকে ঠেলবে।

No comments:

Post a Comment