Saturday 14 November 2020

ককেশাসের পর কি সিরিয়ার যুদ্ধ পুনরায় শুরু হচ্ছে?

১৫ই নভেম্বর ২০২০
অক্টোবর ২০২০। ইদলিবের কাছে সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে যাচ্ছে তুর্কি সেনাবাহিনী। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই ঘাঁটিগুলি ছেড়ে আসার অর্থ এই নয় যে, তুরস্ক অস্ত্র অঞ্চলে নিজেদের অবস্থানকে কমাচ্ছে; বরং এর মাধ্যমে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর আভাস পাওয়া যায়।

গত ২৬শে অক্টোবর সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে রুশ বিমান হামলায় সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ৫০ জনের বেশি সদস্য নিহত হয়। সিরিয়ার যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে, এই হামলা হয়েছে জেবেল আল দোয়াইলা এলাকায়, যেখানে ‘ফাইলাক আল শাম’ নামের বিদ্রোহী গ্রুপের সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে। এই গ্রুপটা তুর্কি সমর্থিত গ্রুপগুলির মাঝে সবচাইতে বড়। সাম্প্রতিক সময়ে রুশদের বেশিরভাগ বিমান হামলার উদ্দেশই ছিল কৌশলগত ‘এম৪’ হাইওয়ের আশপাশ থেকে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে সরানো; কিন্তু দোয়াইলার হামলার উদ্দেশ্য ছিল পুরোপুরি আলাদা। হামলার ভয়াবহতা দেখে অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই হামলার পিছনে শুধুমাত্র সিরিয়া নয়, আরও বড় ভূরাজনীতি জড়িত। তুরস্ক এবং রাশিয়া বর্তমানে লিবিয়া, ককেশাস এবং সিরিয়াতে ভিন্ন পক্ষ সমর্থন করে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ‘আল জাজিরা’ তাদের এক বিশ্লেষণে বলছে যে, এই হামলা খুব সম্ভবতঃ ককেশাসে আজেরবাইজানের পক্ষে তুরস্কের জড়ানোর সাথে সম্পর্কিত। রাশিয়া ককেশাস এবং মধ্য এশিয়ার অঞ্চলকে তার নিজের প্রভাবের মাঝে মনে করে থাকে। সেখানে তুরস্কের জড়ানোটা রাশিয়া ভালো চোখে দেখেনি। ২০২০এর মার্চে তুরস্ক এবং রাশিয়া সিরিয়ার ইদলিবে একটা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল, যা এতকাল মোটামুটিভাবে বহাল থাকলেও বিভিন্ন আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে তুরস্কের জড়াবার পর এই যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ১০ই অক্টোবর ককেশাসে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হবার পর সিরিয়ার যুদ্ধের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে গেছে।

ইউরেশিয়া বিশ্লেষক এসরেফ ইয়ালিনকিলিচলি তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, এই বিমান হামলার মাধ্যমে রাশিয়া খুব সম্ভবতঃ তুরস্ককে বার্তা দিতে চাইছে যে ককেশাসে তুরস্কের জড়ানোটা রাশিয়া পছন্দ করছে না। দুই দেশ অর্থনৈতিকভাবে নিবিঢ় সম্পর্ক রাখলেও লিবিয়া, সিরিয়া এবং ককেশাসের ব্যাপারে দুই দেশের ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। তিনি বলেন যে, সিরিয়ার ঘটনাগুলি তুরস্ক এবং রাশিয়ার সম্পর্কের মূল ভিত্তি হতে যাচ্ছে; সেখানে দুই দেশের মাঝে সংঘাত শুরু হলে পুরো সম্পর্কই টানাপোড়েনে পড়বে। তুর্কি বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, লিবিয়া এবং ককেশাসে রাশিয়া এবং ফ্রান্স এক পক্ষে থেকেছে, যদিও দুই দেশের মাঝে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। লিবিয়াতে জেনারেল হাফতারকে এবং ককেশাসে আর্মেনিয়াকে তারা সমর্থন দিয়েছে। অপরদিকে সিরিয়াতে রাশিয়া বাশার সরকারকে সরাসরি সমর্থন দিলেও ফ্রান্স সেক্ষেত্রে অতটা আগায়নি। তবে ২০১৭ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ বলেন যে, বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার উপযুক্ত উত্তরসুরী কে হবে, সেব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না; তাই বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরাবার কোন প্রাধান্য তাদের নীতির মাঝে নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে রুশদের বেশিরভাগ বিমান হামলার উদ্দেশই ছিল কৌশলগত ‘এম৪’ হাইওয়ের আশপাশ থেকে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে সরানো; কিন্তু দোয়াইলার হামলার উদ্দেশ্য ছিল পুরোপুরি আলাদা। হামলার ভয়াবহতা দেখে অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই হামলার পিছনে শুধুমাত্র সিরিয়া নয়, আরও বড় ভূরাজনীতি জড়িত। 


বিমান হামলার সপ্তাখানেক আগে ১৯শে অক্টোবর ইদলিবে একটা সামরিক ঘাঁটি খালি করা শুরু করে তুরস্ক। মোরেক এলাকায় ঘাঁটিসহ বেশ কয়েকটা ঘাঁটি বাশার বাহিনীর অধিকৃত অঞ্চলের একেবারে মাঝখানে। যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে তুরস্কই এই ঘাঁটিগুলিকে বাশার বাহিনীর অধিকৃত অঞ্চলের মাঝে রেখেছিল। ৩রা নভেম্বর নাগাদ এই ঘাঁটি পুরো খালি করা হয়। ৯ই নভেম্বর নাগাদ তুর্কি বাহিনী শের মুঘার, মার হাত্তাত, ক্বাবতান আল জাবাল এবং শেইখ আকিল ঘাঁটিগুলি খালি করা শুরু করেছে। সিরিয়ান মিডিয়া ‘এনাব বালাদি’ বলছে যে, ১৫ই অক্টোবর তুরস্ক ঘাঁটি সরাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরও বলছে যে, তুরস্ক হয়তো বাশার বাহিনীর অধিকৃত অঞ্চলের মাঝে সকল ঘাঁটিই খালি করতে যাচ্ছে। তুর্কি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওমরান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর গবেষক মাআন তালআ বলছেন যে, ঘাঁটি খালি করার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় যে, তুরস্ক সামনের দিনগুলিতে সংঘাত বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে। বাশার বাহিনী খুব সম্ভবতঃ রুশ সহায়তায় নতুন অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে; যার প্রস্তুতি হিসেবে তুরস্ক তার বাহিনীগুলিকে নতুন করে বিন্যাস করছে। তিনি বলছেন যে, সরিয়ে নেয়া বাহিনীগুলিকে তুরস্ক বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নতুন করে মোতায়েন করে কিনা, সেটা দেখার বিষয় হবে। ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় তুর্কি কলামিস্ট ফেহিম তেস্তেকিন বলছেন যে, এই ঘাঁটিগুলি ছেড়ে আসার অর্থ এই নয় যে, তুরস্ক অত্র অঞ্চলে নিজেদের অবস্থানকে কমাচ্ছে; বরং এর মাধ্যমে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর আভাস পাওয়া যায়।

যেসময় তুরস্ক ইদলিবের আশেপাশে ঘাঁটি খালি করছে, সেই সময় সিরিয়াতে ঢুকছে আরও তুর্কি সেনা। তুরস্কের পত্রিকা ‘মিলিয়েত’ বলে যে, গত ১৫ই অক্টোবর তুরস্কের সামরিক বাহিনীর ৭০টা গাড়ির একটা বহর ইদলিবে ঢোকে, যে বহরের মাঝে ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারিও ছিল। একইসাথে পত্রিকাটা বলে যে, ইদলিবের দক্ষিণ দিকে তুরস্ক নতুন একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরির কাজ শুরু করেছে। এর একদিন আগেই বাশার বাহিনীর হামলায় দু’জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনাগুলি কয়েক মাসের অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশকে বিঘ্নিত করছিল।

২০২০ সালের শুরুতে ইদলিবে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের বাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে তুরস্ক সরাসরি বিদ্রোহীদের পক্ষ নেয়। যুদ্ধের ফলে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হয়ে তুরস্কের সীমান্তে আরও লাখো উদ্বাস্তুর সাথে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ‘ডেইলি সাবাহ’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, বাশার বাহিনীর আক্রমণ তুরস্ক অভিমুখে আরও উদ্বাস্তু তৈরি করছে, এই পরিস্থিতিটাই তুরস্কের ইদলিবে সেনা পাঠাবার ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ‘আল মনিটর’এর ‘তুর্কি পালস’এর কলামিস্ট সেলিম ইদিজএর মতে, রাশিয়া এবং তুরস্কের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে কিছু বিদ্রোহী গ্রুপের সংজ্ঞার ব্যাপারে। ২০১৭ সালে রাশিয়া এবং তুরস্ক একটা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার শর্ত ছিল কিছু বিদ্রোহী গ্রুপকে তুরস্ক ভেঙ্গে ফেলবে, যাদেরকে রাশিয়া ‘উগ্রপন্থী’ বলে মনে করে। এই গ্রুপগুলির মাঝে সবচাইতে বড় গ্রুপ হলো ‘হায়াত তাহরির আল শাম’ বা ‘এইচটিএস’। তুরস্ক যে ১১টা গ্রুপকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে, তার মাঝে ‘এইচটিএস’ নেই। সেলিম ইদিজ বলছেন যে, তুরস্ক হয় ‘এইটিএস’কে ভাংতে পারছে না বা ভাংতে চায় না। তিনি আরও বলেন যে, ইদলিবে সর্বশেষ রুশ হামলা খুব সম্ভবতঃ পুতিনের সতর্কবাণী ছিল।



‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর বিশ্লেষক দারীন খলিফা ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, মস্কো বিদ্রোহী গ্রুপের ব্যাপারে তাদের দাবি বাস্তবায়ন হবার আগ পর্যন্ত আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবে, যা মোটামুটি জানাই ছিল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের মাঝে যুদ্ধবিরতির যে সমঝোতা ছিল, তার মাঝে প্রধান শর্ত ছিল সিরিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী কয়েকটা বিদ্রোহী গ্রুপকে তুরস্ক ভেঙ্গে ফেলবে। এরকম অবান্তর শর্তের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। সেলিম ইদিজ বলছেন যে, যুদ্ধবিরতির পর রাশিয়া এবং তুরস্ক ফ্রন্টলাইন বরাবর যৌথ প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করে। এই প্যাট্রোল প্রকৃতপক্ষে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিতে পারেনি; শুধুমাত্র সকলকে একটা ধারণা দিয়েছে যে, সিরিয়াতে রাশিয়া এবং তুরস্ক একত্রে কাজ করছে। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে যৌথ প্যাট্রোল বন্ধ হয়ে গেছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যুদ্ধবিরতির শেষ অতি সন্নিকটে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউট’এর ডিরেক্টর চার্লস লিস্টার মনে করছেন যে, এই মুহুর্তে বড় কোন যুদ্ধ হয়তো আসন্ন নয়, তবে আঙ্কারা এই হামলাকে একেবারেই এড়িয়ে যাবে, এটা ভাবা ভুল হবে। রুশ হামলার পরদিনই সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলি বাশার বাহিনীর উপর শত শত রকেট নিক্ষেপ করে। এই রকেটগুলির মাঝে কোন একটা যদি অতি গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থাপনার উপর গিয়ে পড়ে, অথবা এই আক্রমণগুলি যদি নিজে থেকেই চলতে থাকে, তাহলে এই সহিংসতা একটা অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। দারীন খলিফা বলছেন যে, রুশদের সাথে তুর্কিদের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল দরকষাকষির জন্যে ব্যবহৃত হতে থাকবে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিয়ে বলছে যে, গত মার্চের যুদ্ধবিরতির সময় দুই পক্ষের সমঝোতায় বলা ছিল যে, বাশার বাহিনী হামলা করলে তুরস্কের অধিকার থাকবে সর্বশক্তি দিয়ে প্রত্যুত্তর দেবার।

লিবিয়া এবং ককেশাসে প্রক্সি যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর তুরস্ক এখন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রটা তাই নতুন করে জেগে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইদলিবে তুরস্কের ঘাঁটিগুলির পুনর্বিন্যাস এবং নতুন করে সৈন্য সমাবেশ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সিরিয়ার স্থিতাবস্থা নিয়ে তুরস্ক খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। অপরদিকে লিবিয়া এবং ককেশাসে তুরস্ককে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মোকাবিলার পর সিরিয়াতে তুরস্কের প্রভাব কমাতে নতুন করে সচেষ্ট হতে পারে রাশিয়া। ইদলিবে রাশিয়ার সাম্প্রতিক বিমান হামলা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সিরিয়ার যুদ্ধবিরতি কতটা দুর্বল ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো ককেশাসের ফয়সালাই সিরিয়ার ফ্রন্টলাইনকে কয়েক মাসের জন্যে থামিয়ে রেখেছিল। তুরস্ক এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বলি হচ্ছে সিরিয়ার লাখো মানুষ। শীতকাল এবং করোনাভাইরাসের কারণে এই ঘরছাড়া মানুষগুলির অবস্থা হয়তো আরও শোচনীয় হতে চলেছে। 

No comments:

Post a Comment