Sunday 1 November 2020

ককেশাসের যুদ্ধের এক মাস ...

০১লা নভেম্বর ২০২০
'লাচিন করিডোর' বা গিরিপথ। কৌশলগত ‘লাচিন করিডোর’ হাতছানি দিচ্ছে আজেরিদের কাছে; এর পর রয়েছে ‘কারাবাখের হৃদয়’ শুশা। এই দুই টার্গেটের কোন একটা আজেরিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তুরস্ক আর রাশিয়ার মাঝে বর্তমান স্থিতাবস্থা যে আরও চাপের মাঝে পড়বে, তা নিশ্চিত।


২৭শে সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে এক মাসের উপর হয়ে গেলো ককেশাসের যুদ্ধে থামেনি। অক্টোবরের ১০, ১৮ এবং ৩০ তারিখে তিনটা যুদ্ধবিরতির চেষ্টা বিফলে গিয়েছে। আজেরিরা বলছে যে, নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চল মুক্ত করার আগ পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চল আজেরবাইজানের ভূখন্ড বলেই স্বীকৃত। ১৯৯০এর দশকে আর্মেনিয়রা সামরিকভাবে কারাবাখ দখল করে সেখানে ‘রিপাবলিক অব আর্তসাখ’ নামের একটা রাষ্ট্র ঘোষণা করে, যাকে বিশ্বের আর কোন দেশই স্বীকৃতি দেয়নি। অন্যদিকে আর্মেনিয়ার সাথে সামরিক চুক্তি থাকলেও রাশিয়া বলছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আর্মেনিয়ার মূল ভূখন্ড হামলার শিকার না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করবে না। অপরদিক তুরস্ক আজেরবাইজানকে সরাসরি রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে, যা যুদ্ধে আজেরিদের এগিয়ে থাকতে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক বিশেষজ্ঞরাও খুব সম্ভবতঃ আজেরিদেরকে উপদেশ দিয়ে সহায়তা করছেন। তবে অনেক হুমকি সত্ত্বেও তুরস্ক আজেরবাইজানে সরাসরি সেনা পাঠানো থেকে বিরত থেকেছে, যা কিনা ককেশাসে রাশিয়া বা অন্য কোন তৃতীয় দেশের সরাসরি জড়িত হওয়ার পেছনে ‘ডিটারেন্ট’ হিসেবে কাজ করেছে। এই সুযোগটা নিয়েই আজেরিরা বিগত বছরগুলিতে তেল বিক্রির অর্থে কেনা বিপুল সামরিক শক্তিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করে কারাবাখের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু অঞ্চল মুক্ত করে নিয়েছে। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে দেখানো হচ্ছে যে, ২৭শে অক্টোবর নাগাদ কারাবাখের দক্ষিণে ইরানের সাথে সীমানার পুরোটাই এখন আজেরিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এক মাস রক্তক্ষরণের পর এই যুদ্ধ কোথায় এসে পৌঁছেছে? এই যুদ্ধের শেষই বা কোথায়?

যুদ্ধে সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী আজেরবাইজানকে সকল বিশ্লেষকেরাই এগিয়ে রেখেছেন। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় সাংবাদিক সেবাস্টিয়ান রোবলিন বলছেন যে, কারাবাখের দক্ষিণের পুরোটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবার পর আজেরিরা খুব সম্ভবতঃ উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে; টার্গেট কৌশলগত ‘লাচিন করিডোর’ গিরিপথ। এই করিডোর হলো কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ট (যাকে আজেরিরা বলে খানকেন্দি) এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর শুশার সাথে আর্মেনিয়ার মূল ভূখন্ডের যোগাযোগের মূল রাস্তা। ১৯৯২ সালে কারাবাখের সাথে আর্মেনিয়ার একটা কৌশলগত লাইফলাইন নিশ্চিত করতেই এই করিডোর দখল করে নেয় আর্মেনিয়রা। এবারের যুদ্ধে ২২শে অক্টোবর নাগাদ ইরানের সীমানায় আরাস নদী বরাবর পশ্চিমে এগুনোর পর আজেরিরা হাকারি নদীর সংযোগস্থলে পৌঁছে যায়। এই নদীর অববাহিকাই উত্তরে গিয়ে মিলেছে ‘লাচিন করিডোর’এর সাথে। অত্র অঞ্চলের পাহাড়ি বাস্তবতার কারণেই যোগাযোগের পথগুলি বেশ স্বল্প পরিসরের মাঝে সীমাবদ্ধ। এই করিডোরের উপর চাপ কমাতে আজেরবাইজানের সর্বদক্ষিণে আর্মেনিয়ার সীমানার কাছাকাছি আর্মেনিয়রা প্রতিআক্রমণ শুরু করে। আর এই অঞ্চলটা এমন একটা স্থানে, যেখানে আক্রমণ চালাতে গেলে আর্মেনিয়ার মূল ভূখন্ডের উপর নির্ভর করেই করতে হবে। আজেরিরা যদি এই করিডোরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, অথবা করিডোরের উপর সামরিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে সামনের শীতকালে কারাবাখের আর্মেনিয়রা মারাত্মক সমস্যায় পড়বে। তবে রোবলিন এও বলছেন যে, এই করিডোরের উপর চাপ পড়লে নাগোর্নো কারাবাখে যদি মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়, তাহলে তা রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশের জন্যে এই যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণ তৈরি করতে পারে। রাশিয়া লাচিন করিডোরের পশ্চিমে তেগ শহরের কাছে একটা সামরিক ক্যাম্প বসিয়েছে এই করিডোরের উপর নজরদারির জন্যে। 


তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর সাথে সাক্ষাতে ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক রাউফ মামাদভ বলেন যে, দুই দেশের যুদ্ধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শহর এখন লাচিন এবং শুশা। গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলগুলি দখলে নিয়ে আজেরিরা চাইবে দক্ষিণে কৌশলগত লাচিন এবং উত্তরে কারবাহাল এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আজেরিদের কাছে শুশা হলো কারাবাখের হৃদয়। এই শহরটা যদি আজেরিরা সময়মত নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে, তাহলে তারা তা আলোচনার টেবিলে ব্যবহার করতে পারে; অবশ্য যদি আর্মেনিয়রা আলোচনায় রাজি থাকে। আজেরিরা ইতোমধ্যেই লাচিন থেকে আর্টিলারি দূরত্বে রয়েছে। বাকুর থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘তোপচুবাশভ সেন্টার’এর ডিরেক্টর রুসিফ হুসেইনভ বলছেন যে, লাচিন হলো কারাবাখ এবং আর্মেনিয়ার মাঝে সেতু; আর শুশা হলো এমন এক উঁচু জায়গা, যা নিয়ন্ত্রণে থাকলে পুরো কারাবাখই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি বলেন যে, লাচিন বা শুশার একটাও যদি আজেরিরা দখলে নিতে পারে, তা হবে এই যুদ্ধের মোড় ঘোড়ানো ঘটনা। আর দু’টাই যদি আজেরিদের কাছে চলে যায়, তবে যুদ্ধও শেষ হয়ে যেতে পারে। হুসেইনভ বলছেন যে, আর্মেনিয়রা এতকাল আলোচনা মেনে না নেয়ায় আজেরিরা এখন পুরো কারাবাখ পুনরুদ্ধারের পথেই হাঁটছে। আর সেটা সম্ভব না হলে তারা হয়তো লাচিন করিডোর এবং শুশার নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করবে। লাচিন করিডোর হারালে কারাবাখের বেঁচে থাকা কঠিন হবে।

তবে যুদ্ধ শেষের কথা বলতে গেলে শক্তিশালী দেশগুলির কথাও আলোচনায় আনতে হবে। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুলের প্রকাশনা ‘রাশিয়া ম্যাটার্স’এ এক লেখায় জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল কফম্যান বলছেন যে, আজেরবাইজানকে তুরস্ক সরাসরি সমর্থন দেয়ায় যে প্রশ্নটা সামনে এসেছে তা হলো, রাশিয়া তার আশেপাশের দেশগুলির সাথে যে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে, সেই অনুযায়ী রাশিয়া নিরাপত্তা দিতে সক্ষম কিনা। তিনি আরও বলছেন যে, এই যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ‘গ্রেট পাওয়ার’ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলি অনেক সময়ই অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশগুলির উপর নিজেদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে চাইলেও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় তা সর্বদা সাফল্য পায় না।

তিনটা ব্যর্থ যুদ্ধবিরতির চেষ্টার পরেও জেনেভায় আলোচনায় বসেছেন আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহরাব মেনাতসাকানিয়ান এবং আজেরবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেইহুন বায়রামভ। তবে এই আলোচনার সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। যখন আজেরিরা যুদ্ধে এগিয়ে রয়েছে এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, তারা যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে, তখন আলোচনার গুরুত্ব কমে যায় বৈকি। কৌশলগত ‘লাচিন করিডোর’ হাতছানি দিচ্ছে আজেরিদের কাছে; এর পর রয়েছে ‘কারাবাখের হৃদয়’ শুশা। তবে এই দুই টার্গেটের কোন একটা আজেরিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তুরস্ক আর রাশিয়ার মাঝে বর্তমান স্থিতাবস্থা যে আরও চাপের মাঝে পড়বে, তা নিশ্চিত।

No comments:

Post a Comment