Sunday 5 July 2020

হিমালয়ে ভারত-চীন সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র কি পেল?

০৫ই জুলাই ২০২০
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলেই বেইজিংএ অনেকের মাঝে ধারণা জন্ম নিয়েছে; যা থেকে বের হওয়া কঠিন। কিন্তু দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন সাগরে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেই বেইজিং ভারতের সাথে স্থলসীমানা নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে, যা কিনা বেইজিংএর কৌশলগত সক্ষমতাকে বিভাজিত করেছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিতে একটা বড় সাফল্য উপহার দিয়েছে।


প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪টা জুলাই মার্কিন জাতীয় দিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে টুইটারে শুভেচ্ছাবার্তা পাবার পর মোদিকে ধন্যবাদ দিয়ে বার্তা দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ভালোবাসে। ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কথাগুলি বললেও ভারতীয় মিডিয়াতে তা ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করার হয়। চীনের সাথে চলমান সীমান্ত দ্বন্দ্বে ভারত তার প্রতিবেশীদেরকে কাছে না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই যেন কাছে টেনে নিতে চাইছে। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলছে যে, ট্রাম্পের বার্তা দেয়ার মুহুর্তটা বলে দিচ্ছে যে, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। যদিও মুহুর্তটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দিবস। চীনের সাথে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে দিল্লী এবং বেইজিংএ চলছে ব্যাপক জল্পনাকল্পনা। দুই পক্ষ যখন সীমান্তে নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই সকলে তাকিয়ে রয়েছে। হিমালয়ের পাদদেশের এই বিবাদে ওয়াশিংটনের প্রভাব আসলে কতটুকু?

চীনারা সবসময়ই বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ৫ই জুলাই চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ‘গ্লোবাল টাইমস’এর এক লেখায় বলা হয় যে, ওয়াশিংটন চাইছে ভারত এবং চীনের সংঘাত থেকে নিজেরা লাভবান হতে। যতবারই ভারতের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব হয়েছে, প্রতিবারই মার্কিনীরা ভারতের পক্ষ নিয়েছে এবং দ্বন্দ্বকে আরও উস্কে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলি ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি গড়ে তুলেছে, যার মাধ্যমে তারা ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে যে, তারা ভারতকে যথেষ্ট সমর্থন দেবে। চীনারা প্রকৃতপক্ষে ভারতের সাথে সংঘাতের বিরোধী। তবে চীনারা যে ভারতের সামরিক পদক্ষেপগুলিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘গ্লোবাল টাইমস’এর এক বিশ্লেষণে। ‘ইন্সটিটিউট অব চাইনিজ বর্ডারল্যান্ড স্টাডিজ’এর রিসার্চ ফেলো ঝাং ইয়ংপ্যান বলছেন যে, গালওয়ান নদীর কাছে শায়ক নদীর স্থানে ভারত একটা বিমানবন্দর তৈরি করেছে; সাথে রাস্তা, সেতু এবং মানুষের বসবাসের জন্যে গ্রাম তৈরি করেছে। অনেক বছর ধরেই ভারত চীনা স্থলভাগের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার চিন্তা করছিল। ১৯৬২ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় থেকে এই স্থানটা উভয় দেশের জন্যেই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বলেন তিনি। ভারত খুব সম্ভবতঃ লাদাখ এবং কাশ্মিরে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে ভৌগোলিক সুবিধা আদায় করতে চাইছে।

কেউ কেউ অবশ্য চীনকে ভারতের সাথে সমঝোতা করার উপদেশ দিচ্ছেন। ‘বাকনেল ইউনিভার্সিটি’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ঝিকুন ঝু ‘আল-জাজিরা’তে এক লেখায় বলছেন যে, চীনারা তাদের চিন্তাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে কেন্দ্রিভূত করার ফলে এশিয়ার দেশগুলিতে চীন বিরোধী চিন্তা দানা বেঁধেছে। চীনের উচিৎ অনেকগুলি শত্রু তৈরি না করে বন্ধু তৈরিতে অগ্রসর হওয়া। ভারতের সাথে সংঘাত বাড়তে থাকলে ভারত আরও শক্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে যাবে। সীমানার দেশগুলির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেইজিংএর চিন্তাবিদদের মাঝে হয়তো পূর্ণ সমঝোতা নেই। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, একটা চীনা প্রবাদ রয়েছে যে, কাছের প্রতিবেশী দূরের আত্মীয় অপেক্ষা বেশি কাছের। তিনি আরও বলছেন যে, এশিয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো ভারত।

ভারতেও কেউ কেউ পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। দিল্লীর সাংবাদিক ভারত ভূষণ ‘দ্যা কুইন্ট’এ এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়ন হলে তা নিঃসন্দেহে চীনকে চিন্তিত করবে। কিন্তু তা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কৌশলগত চুক্তির অংশ হলেও তার বন্ধুদের জন্যে যুদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র এখন কতটা প্রস্তুত তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্রে রেখে কৌশলগত গ্রুপিং স্বপ্নের মতোই। আর যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ভারতের সীমানায় দখলীকৃত ভূমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করতে পারবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত চুক্তি হিমালয়ের পাদদেশে ভারতের কোন কাজেই আসবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে গত এক দশকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে। যেমন সীমানাতে দ্রুত সেনা মোতায়েনের সুবিধার্থে ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’ এবং ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ পরিবহণ বিমান; অতি উঁচু ভূমিতে যুদ্ধ করার সক্ষমতা সম্বলিত ‘এএইচ-৬৪ এপাচি’ ও ‘সিএইচ-৪৭ শিনুক’ হেলিকপ্টার; এবং পাহাড়ের উপর সহজে পরিবহণযোগ্য ‘এম-৭৭৭’ হাল্কা কামান। এই অস্ত্রগুলি বিক্রি করে একাধারে যুক্তরাষ্ট্র যেমন স্বল্প সময়ের মাঝে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারীর তালিকায় নাম লিখিয়েছে, তেমনি হিমালয়ের পাদদেশে ভারতকে স্থলযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার একটা সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে, যা কিনা গত পাঁচ দশকে ভারতের ছিল না।

হিমালয়ের পাদদেশে ভারতের যুদ্ধ করার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ভারত এবং চীন উভয় দেশেই ভিন্ন মতের জন্ম দিয়েছে। চীনের হুমকি মোকাবিলায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের সুর ধরেই অনেকে ওয়াশিংটনকে কাছে টেনে নিতে চাইছেন। তবে একইসাথে কেউ কেউ আবার ভারতের চিরাচরিত জোট নিরপেক্ষ চিন্তাকে তুলে আনতে চাইছেন এবং নিরাপত্তার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। অপরপক্ষে বেইজিংএ অনেকেই ভারতের সাথে যুদ্ধ এড়াতে চাইলেও সীমানাতে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে পারছেন না। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলেই বেইজিংএ অনেকের মাঝে ধারণা জন্ম নিয়েছে; যা থেকে বের হওয়া কঠিন। আর আঞ্চলিকভাবে এশিয়ার দেশগুলির উপর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই বেইজিংএর পক্ষে এশিয়ার দেশগুলিকে কাছে টেনে নেয়া কঠিন হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকার নীতিটাই বেইজিংএ হালে পানি পাচ্ছে বেশি, যা কিনা বেইজিংএর জন্যে এশিয়ার দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা কঠিন করে দিচ্ছে। এই বাস্তবতায় দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন সাগরে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেই বেইজিং ভারতের সাথে স্থলসীমানা নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে, যা কিনা বেইজিংএর কৌশলগত সক্ষমতাকে বিভাজিত করেছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিতে একটা বড় সাফল্য উপহার দিয়েছে।

5 comments:

  1. শেষে কার কি লাভ হল

    ReplyDelete
    Replies
    1. শেষ হয়েছে মনে করাটা ভুল। এটা আরও অনেকদূর এগুবে। কারণ উভয় পক্ষই এখানে স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করে ফেলেছে। এর আগের লেখা পড়লে এটা বুঝতে পারবেন।

      https://koushol.blogspot.com/2020/06/Future-india-china-border-tension.html

      Delete
  2. করনো ভাইরাস কি বিধাতার দেওয়া অভিশাপ নাকি মানুষের তৈরি কিছু।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এক লোক রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কলা খেয়ে খোসাটা রাস্তায় ফেলে দিলো। পথচারীরা প্রায় সকলেই খোসাটাকে এড়িয়ে চলে গেলো। শুধু একজন লোক মোবাইলে কথা বলতে বলতে খোসার উপর পাড়া দিয়ে পিছলে পড়ে গেলো এবং কোমড়ে বেশ ব্যাথা পেলো। সে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে গেলো চিকিতসা করাতে। ডাক্তার তাকে ভুল ঔষধ দিলো; এবং ভুল ঔষধ খেয়ে লোকটা মারা গেলো।

      এখন বলুন মানুষটার উপর কি বিধাতার অভিশাপ ছিল, নাকি তাকে খুন করা হয়েছে?

      Delete
    2. ইহা রোগী ও ডাক্তার উভয়রই খামখেয়ালিপনা বটে

      Delete