Saturday 18 July 2020

হায়া সোফিয়ায় নামাজ আদায়ের সিদ্ধান্তের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

১৮ই জুলাই ২০২০

ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, হায়া সোফিয়ার এই সিদ্ধান্তে তুরস্ক মুসলিম আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশে এবং বিশ্বব্যাপী বেশকিছু সমর্থন যুগিয়েছে; তবে আরব বিশ্বের নেতৃত্বের সমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ক্যাথোলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ভিতের পশ্চিমা সেকুলার দুনিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের আলাদা করে কঠোর বার্তা দেয়া থেকে দূরে থেকেছে; যা চার্চের কয়েক শতকের দ্বন্দ্বের কথাকে ভুলিয়ে দেয়না। পশ্চিমাদের সাথে রুশদের চলমান টানপোড়েনের মাঝে এই ঘটনা জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে; এরদোগানও তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু ফসল ঘরে তুলে নেবেন। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নতুন কোন বিভেদের জন্ম না দিলেও মুসলিম আবেগ জড়িত থাকার কারণে তা তুর্কি জনগণকে একত্রিত করা ছাড়াও বিশ্বব্যাপী তুরস্ককে আরও গুরুত্বপূর্ণ করেছে; ব্যাপারটা কারুর পছন্দ হোক বা না-ই হোক।


১৭ই জুলাই তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান সাংবাদিকদের বলেন যে, হায়া সোফিয়াকে আবারও মসজিদে রূপান্তরিত করার ব্যাপারটা তুরস্কের সার্বভৌমত্মের ব্যাপার। তুরস্ক মনে করে না যে, এব্যাপারে আন্তর্জাতিক মতামত তুরস্কের জন্যে কোন বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। একই দিনে ‘সিএনএন’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন বলেন যে, হায়া সোফিয়াতে যেকেউ ঢুকতে পারবে এবং এর অভ্যন্তরের ঐতিহাসিক মোজাইকগুলিকে গত ৫’শ বছরের মতোই রক্ষা করা হবে। তিনি বলেন যে, তুরস্ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে করে এই মোজাইকগুলিকে নামাজের সময় ঢেকে রাখা যায়। হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার ব্যাপারটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া পুরোনো ধারণা থেকে এসেছে; বর্তমানে তুরস্কে ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, তুরস্কে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সমঅধিকার পাচ্ছে; যা কিনা ভিন্ন ধর্মালম্বী যেকোন মানুষকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারা সম্ভব। তুরস্ক ইতোমধ্যেই ক্যাথোলিক চার্চের পোপসহ অনেককেই হায়া সোফিয়াতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বলে বলেন তিনি। গত ১০ই জুলাই হায়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের পক্ষে তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালতের রায় পাবার পর থেকে প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো এই স্থাপনাকে নিয়ে চলছে ব্যাপক বাকযুদ্ধ। হায়া সোফিয়ার ইতিহাস এবং এর সাথে বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে এর গুরুত্ব আসলে কতখানি?

৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপল শহরে হায়া সোফিয়া নির্মিত হয় ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের উপাসনালয় হিসেবে। একাদশ শতকে ইস্টার্ন অর্থোডক্স থেকে ক্যাথোলিক চার্চ আলাদা হয়ে যাবার পর ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা বাইজ্যান্টাইন রাজ্যের প্রায় পুরোটাই দখল করে নেয় এবং কন্সটানটিনোপল শহর লুট করে। ক্যাথোলিক ক্রুসেডারদের তৈরি করা ল্যাটিন সাম্রাজ্যের অধীনে ১২৬১ সাল পর্যন্ত এটা ক্যাথোলিক চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ল্যাটিন সাম্রাজ্যকে বাইজ্যান্টাইনরা ফ্রাঙ্কদের (বর্তমানে ফ্রান্স) সাম্রাজ্য বলতো। ক্যাথোলিকরা ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চকে পুরোপুরি নির্মূল করে দেবার চেষ্টা করলেও ১২৬১ সালে কন্সটানটিনোপল শহর আবারও বাইজ্যান্টাইনদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সেসময় থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত হায়া সোফিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৪৫৩ সালে উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের অধীন মুসলিম সেনাবাহিনী কন্সটানটিনোপল বিজয় করে নেয়। মেহমেদ ‘আল ফাতিহ’ হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন এবং সেখানে নামাজ আদায়ের প্রচলন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফত ধ্বংসের পর মুস্তফা কেমাল আতাতুর্কের অধীনে সেকুলার তুরস্ক তৈরি হলে ১৯৩১ সালের পর থেকে হায়া সোফিয়াতে প্রথমবারের মতো সব ধরনের উপাসনা বাতিল করা হয়। ১৯৩৪ সালে এটাকে একটা জাদুঘরে রূপান্তরিত করে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। তুর্কি সংস্কৃতি এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ২০১৯ সালে ৩৭ লক্ষ পর্যটক হায়া সোফিয়া দেখতে এসেছিল।

অনেকেই বলছেন যে, হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের মাধ্যমে এরদোগান নিজ দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাকে ঢাকতে চাইছে। ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৯এর মার্চের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’ আঙ্কারা এবং ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণ হারাবার পর এরদোগান এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে জোর দিয়েছেন। ‘এরাব নিউজ’এর এক লেখায় ধর্মবিষয়ক কনসালট্যান্ট পিটার ওয়েলবি বলেন যে, বর্তমান তুরস্কের বহু ধরনের সমস্যা থাকলেও মসজিদের অভাব সেই সমস্যাগুলির মাঝে একটা নয়। তিনি বলছেন যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে তুরস্ক মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করতে চাইছে। জুনের প্রথম সপ্তাহে করা এক জনমত জরিপের বরাত দিয়ে তুর্কি পত্রিকা ‘ইয়েনি সাফাক’ বলছে যে, তুরস্কের ৭৩ শতাংশ জনগণ হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের পক্ষে; ২২ শতাংশ বিপক্ষে; ৪ শতাংশ কোন মতামত দেয়নি।

হায়া সোফিয়ার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব খুব শক্ত কোন শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হায়া সোফিয়ার ঘোষণার ব্যাপারে ‘হতাশা’ ব্যক্ত করে। ক্যাথোলিক চার্চের পোপ ফ্রান্সিস এতে ‘খুবই ব্যাথিত’ হয়েছেন বলে বলেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেফ বোরেল সাংবাদিকদের বলেন যে, ইইউএর মাঝে হায়া সোফিয়াকে আগের অবস্থানে নিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে; এবং তারা তুরস্ককে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানাবেন। তবে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারীরা তাদের আবেগ প্রকাশ করেছেন। রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল বলেন যে, তিনি ‘গভীরভাবে চিন্তিত’ হয়েছেন এবং তিনি মনে করছেন যে, এটা ‘পুরো খ্রিস্টান সভ্যতার জন্যে হুমকিস্বরূপ’। গ্রীক সংস্কৃতি মন্ত্রী লিনা মেনডোনি বলেন যে, এই সিদ্ধান্ত তুরস্ককে ছয় শতক পিছনে নিয়ে গেছে; এবং এটা ‘সভ্য দুনিয়ার প্রতি সরাসরি হুমকি’। রুশ পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির উপ-প্রধান ভ্লাদিমির জাভারভ বলেন যে, এতে মুসলিম দুনিয়ার কোন উপকার হবে না; বরং বিভিন্ন জাতিকে একে অপরের বিপক্ষে দাঁড় করাবে। হায়া সোফিয়ার ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব থেকে আসা বিভিন্ন সমর্থনের এক তালিকা তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে প্রকাশ করে ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’, যেখানে ওমান, ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার নাম রয়েছে; তবে আরব দেশগুলির নাম নেই। আরব আমিরাতের সংস্কৃতি মন্ত্রী নৌরা আল-কাবি এক টুইটার বার্তায় তুরস্কের এই সিদ্দ্বান্তের সমালোচনা করেন। ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, হায়া সোফিয়ার এই সিদ্ধান্তে তুরস্ক মুসলিম আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশে এবং বিশ্বব্যাপী বেশকিছু সমর্থন যুগিয়েছে; তবে আরব বিশ্বের নেতৃত্বের সমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ক্যাথোলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ভিতের পশ্চিমা সেকুলার দুনিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের আলাদা করে কঠোর বার্তা দেয়া থেকে দূরে থেকেছে; যা চার্চের কয়েক শতকের দ্বন্দ্বের কথাকে ভুলিয়ে দেয়না। পশ্চিমাদের সাথে রুশদের চলমান টানপোড়েনের মাঝে এই ঘটনা জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে; এরদোগানও তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু ফসল ঘরে তুলে নেবেন। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নতুন কোন বিভেদের জন্ম না দিলেও মুসলিম আবেগ জড়িত থাকার কারণে তা তুর্কি জনগণকে একত্রিত করা ছাড়াও বিশ্বব্যাপী তুরস্ককে আরও গুরুত্বপূর্ণ করেছে; ব্যাপারটা কারুর পছন্দ হোক বা না-ই হোক।

No comments:

Post a Comment