১৩ই সেপ্টেম্বর ২০১৫
সিরিয়ায় রাশিয়ার নৌবাহিনী জাহাজ থেকে মিসাইল ছোঁড়ার সাথে সাথে সামরিক দিক থেকে বেশকিছু নতুন ব্যাপার সামনে এসে পড়েছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে কার কতটা সুবিধা হলো, সেটা আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়, বরং আলোচনা করতে চাই সামরিক দিক দিয়ে নতুন কি কি ব্যাপার ধরা পড়লো, যেগুলি শুধু সিরিয়া নয়, বরং বিশ্বের যেকোন স্থানে সামরিক ব্যালান্সেও ভূমিকা রাখতে পারে।
এতো ছোট জাহাজ থেকে কেন?
এখানে প্রথম চিন্তাটা আসে যে জাহাজ থেকে মিসাইল কেনো ছোঁড়া হলো; ভূমি থেকে হলে কি সমস্যা হতো? ১৯৮৭ সালের Intermediate-Range Nuclear Forces (INF) Treaty অনুযায়ী ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ায় বাধা রয়েছে, কিন্তু জাহাজ থেকে ভূমিতে ছোঁড়াতে বাধা নেই। বলাই বাহুল্য যে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা মাথায় রেখেই এই চুক্তি করা হয়েছিল অত বছর আগে। এর পর থেকে ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র সব যুদ্ধে জাহাজ থেকে ভূমিতে মিসাইল ছুঁড়েছে। ২০১১ সালে লিবিয়ায় Operation Odyssey Dawn-এ যুক্তরাষ্ট্র তাদের Ohio-class পারমাণবিক মিসাইল সাবমেরিনের কনভার্সন ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন ব্যবহার করেছিল। বিশাল ওই সাবমেরিন ১৫৪টা Tomahawk মিসাইল বহণ করতে পারে। মার্কিন অন্যান্য যুদ্ধজাহাজগুলি এই সাবমেরিনের মতো এত্তোবড় মিসাইলের ডিপো না রাখলেও অনেকগুলি মিসাইলই বহন করে থাকে। বলাই বাহুল্য যে আমরা ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইল নিয়ে কথা বলছি। বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ যুদ্ধজাহাজই জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল বহণ করে। একটা জাহাজকে মিসাইল-সজ্জিত করতে এটাই প্রধানতম পদ্ধতি। মিসাইল দিয়ে ভূমির অভ্যন্তরে বহুদূরে আক্রমণ করতে পারাটা সাধারণত সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য হিসেবেই থাকে। গত দু’দশকে ভূমি আক্রমণ করতে পারার ক্ষমতাটা যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। যে কারণে তাদের বড় বড় সব যুদ্ধজাহাজ Tomahawk মিসাইল-সজ্জিত হয়ে পানিতে ভাসছে। তাদের নতুন Zumwalt-class ডেস্ট্রয়ারগুলি ভূমিতে টার্গেট ধংসের জন্যেই যেন তৈরি করা হচ্ছে। মোট ৮০টা VLS (Vertical Launch System) মিসাইল লঞ্চারের মধ্যে বেশিরভাগটাই যে Tomahawk ক্রুজ মিসাইল হবে, সেটা মার্কিন নৌবাহিনীর অফিসাররা গোপন রাখেননি।
Buyan-class-এর জাহাজগুলি মাত্র ৭৫ মিটার লম্বা। এতো ছোট জাহাজগুলি কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাইক করতে পারে, সেটা খুব বেশি মানুষের চিন্তায় থাকার কথা ছিল না। এখন থেকে হিসেবটা পালটে গেল।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে রাশিয়া যেসব যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করলো ক্রুজ মিসাইল ছোঁড়ার কাজে, সেগুলি কেউ শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের ক্যাটাগরিতে কখনো ফেলেছেন বলে খুব একটা মনে হয় না। এখানে রাশিয়া ব্যবহার করেছে Gepard-class-এর একটা ফ্রিগেট আর Buyan-class-এর তিনটা কর্ভেট। রাশিয়ার কাসপিয়ান সাগরের ফ্লোটিলাতে Gepard-class-এর দু’টা জাহাজ আছে, যার একটা সেই ভুমিতে নিক্ষেপণযোগ্য Klub মিসাইল (২,৫০০ কিমি পাল্লার) বহন করে। আসলে সেটাও একটা মাঝারি পাল্লার জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল, যেটার একটা ভার্সন তৈরি করা হয়েছে দূরপাল্লার ভূমিতে নিক্ষেপের মিসাইল হিসেবে। যেকারণে ওই মিসাইল একই বক্স (Missile Canister) থেকে ছোঁড়া যায়। অর্থাৎ শুধু মিসাইলগুলি পরিবর্তন করে ফেললেই চলে। Gepard-class-এর একটা জাহাযে এই সুবিধা থাকলেও অন্যটা বহন করে Kh-35 মিসাইল (১৩০ কিমি পাল্লার), যার কিনা ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য কোন ভার্সন নেই। Buyan-class-এর তিনটা কর্ভেটের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। ৬টা জাহাজের মধ্যে মাত্র ৩টা জাহাজ Klub মিসাইল বহন করে। কাসপিয়ান ফ্লোটিলার ভূমিতে আক্রমণ করতে পারা মোট এই ৪টা জাহাজই ব্যবহার করা হয়েছে। ৩২টা মিসাইল এরা ছুঁড়তে পারতো সর্বোচ্চ; ছুঁড়েছে ২৬টা। Gepard-class-এর ফ্রিগেটগুলি মাত্র ১০২ মিটার লম্বা আর Buyan-class-এর কর্ভেটগুলি মাত্র ৭৫ মিটার লম্বা। এতো ছোট জাহাজের পক্ষে এতো দূরে ভূমিতে হামলা চালানোর ঘটনা এই প্রথম। এই ধরনের মিসাইলের একটা স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে, যেকারণে পাকিস্তান এরকমই একটা মিসাইল তাদের কিছু সাবমেরিনে সংযুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছে। সাবমেরিনের এই স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত গুরুত্ব জানা থাকলেও এত্তো ছোট্ট ফ্রিগেট বা কর্ভেটের ক্ষেত্রে এই গুরুত্ব এর আগে কেউ দেয়নি। স্ট্র্যাটেজিক্ স্ট্রাইকের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজের আকার হঠাত করেই মনে হয় অনেক ছোট হয়ে গেল। এরকম সাইজের জাহাজের সংখ্যা বিশ্বে অনেক; ছোট ছোট অনেক দেশের হাতেই রয়েছে। এসব জাহাজ যদি কেউ ভূমিতে আঘাত করার মতো মিসাইল দিয়ে সজ্জিত করার জন্যে তৈরি করে রাখে, সেটা শক্তিশালী দেশগুলির জন্যে মাথাব্যাথার কারণ হয়ে যেতে পারে। আর এটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার, তা-ও কিন্তু নয়। জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল কিন্তু ভূমির টার্গেটেও ব্যবহার করা সম্ভব। ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর ছোট্ট ছোট্ট মিসাইল বোটগুলি পাকিস্তানের করাচী বন্দর ধ্বংসপ্রাপ্ত করেছিল জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল ব্যবহার করেই। এখানে একটা ব্যাপারই রয়েছে এখন চিন্তা করার, সেটি হচ্ছে দূরপাল্লার ক্রুজ মিসাইল বিক্রির উপরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। তবে এই নিষেধাজ্ঞা যে কতটা কার্যকর, তা উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান এবং ইরানের মতো দেশগুলির মিসাইল প্রোগ্রাম দেখলে সন্দেহ জাগে। রাশিয়ার এই মিসাইল হামলা স্ট্র্যাটেজিক স্ট্রাইকের ক্ষমতা অনেকের মাঝে বিতরণ করে দেওয়ার জন্যে একটা উদাহরণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
রাশিয়ার মিসাইল হামলা হঠাত করেই কাসপিয়ান সাগরকে মধ্যপ্রাচ্যের স্ট্র্যাটেজিক হিসাবের ভেতরে ফেলে দিল। এখন থেকে এই সাগরকে ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক হিসেব পূর্ণ হবে না।
কাসপিয়ান সাগর কেন? কৃষ্ণ সাগর কেন নয়?
দ্বিতীয় চিন্তা, যেটি আসে রাশিয়ার মিসাইল হামলা থেকে, সেটি হচ্ছে - কাসপিয়ান সাগর বেছে নেওয়া হলো কেন এই স্ট্রাইকের জন্যে। কৃষ্ণ সাগরে যেখানে আরেকটা অপেক্ষাকৃত বড় ফ্লীট ছিল রাশিয়ার, সেখানে কাসপিয়ান সাগর কেন ব্যবহার করা হলো। কৃষ্ণ সাগরের জাহাজগুলি মোটামুটি নিয়মিতই বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করে ভূমধ্যসাগরে পাড়ি জমায়। সিরিয়ার সমস্যা শুরু হবার পর থেকে আসাদ সরকারের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন জানাতে এভাবে একাধিকবার তাদের জাহাজগুলি সিরিয়ার উপকূলে টহল দিয়েছে। কৃষ্ণ সাগরর ফ্লীটে বড় ক্রুজার এবং ডেস্ট্রয়ার থাকলেও Klub মিসাইল, যেটা সিরিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে, তেমন মিসাইল বহনকারী জাহাজের সংখ্যা কম। Buyan-class-এর কর্ভেট রয়েছে মাত্র দু’টি। কৃষ্ণ সাগরের এই জাহাজগুলির যুদ্ধ-ক্ষমতার উপরেও কিছুটা হলেও প্রশ্ন করা যায়। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সেবাস্তোপোলের নেভি ডে প্যারেডের সময় Ladnyy নামের ফ্রিগেট থেকে SS-N-14 মিসাইল ছোঁড়ার পরে সেটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অবশেষে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। তবে এই জাহাজগুলিকে ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার ফ্ল্যাগ উড়ানোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই লেখাটি লেখার সময়ে (অক্টোবর ২০১৫) পূর্ব ভূমধ্যসাগরে Slava-class ক্রুজার Moskva, Kashin-class ডেস্ট্রয়ার Smetlivyy, এবং Krivak-class ফ্রিগেট Ladnyy এবং Pytlivyy - যেগুলি ১১তম এন্টি-সাবমেরিন ব্রিগেডের অংশ – ভূমধ্যসাগরে মহড়া দিচ্ছে। এগুলি কৃষ্ণ সাগরের সবচাইতে শক্তিশালী জাহাজ। এগুলিকে শক্তি প্রদর্শন এবং সিরিয়ার লাটাকিয়া এবং টারটাস বন্দরের আশেপাশে রাশিয়ার নৌসম্পদের সুরক্ষা দেয়ার কাজেই ব্যবহার করা হবে বলে মনে হচ্ছে। ভূমিতে হামলা করার মতো মিসাইল দিয়েও এরা সজ্জিত নয়, আবার কৃষ্ণ সাগরে রেখে আসা অন্য মিসাইল-সজ্জিত জাহাজগুলিও এরকম আক্রমণের জন্যে যথেষ্ট নয়। কাজেই কাসপিয়ান ফ্লোটিলাতেই রাশিয়ার ভরসা। শুধু তা-ই নয়, কাসপিয়ান সাগরকে হঠাত করেই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে দেওয়া হলো। এই সাগর (যা কিনা আসলে একটা বড় হ্রদ) ককেশাস এলাকার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন এই সাগর পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। রাশিয়ার সামরিক হাতের ক্ষমতা নিয়ে চিন্তা করতে হলে এই সাগরের কথা এখন থেকে সবাই চিন্তা করবে। এই সাগর থেকে মোটামুটি ২,৫০০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যপ্রাচ্যের পুরো এলাকা এখন রাশিয়ার মিসাইলের পাল্লার মাঝে।
ইরান-ইরাকের ওভারফ্লাইট অনুমতি
তৃতীয় চিন্তাটি হলো ওভারফ্লাইট নিয়ে। মিসাইল ছোঁড়ার জন্যে ওভারফ্লাইটের অনুমতি লেগেছে ইরান এবং ইরাকের কাছ থেকে। ইরান রাশিয়ার বন্ধু রাষ্ট্র। আর ইরাকের মার্কিন-সমর্থিত সরকারও যে রাশিয়ার কার্যক্রমের পক্ষে, সেটা এবার বোঝা গেল। মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে, যেখানে রাশিয়া ইসলামিক কোন শক্তির আবির্ভাব দেখতে ইচ্ছুক নয়। আমেরিকাও মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামকে শক্তি হিসেবে দেখতে চায় না, যেকারণে তারা ইরাকের জেলখানাতে আইএসআইএস-এর মতো এক রক্তোন্মাদের জন্ম দিয়েছে এবং মুসলিমদেরকে আরও বেশি বিভক্ত করতে পেরেছে। একই হিসাবের অংশ হিসেবে মুসলিমদের মাঝে শিয়া-সুন্নী সংঘাত রাশিয়া এবং আমেরিকাকে স্বস্তি দেয়। এর মাঝে রাশিয়া শিয়া মুসলিমদেরকে নিজেদের অপেক্ষাকৃত ভালো বন্ধুরূপে দেখে। ইরান এবং হিযবুল্লাহ ছাড়াও সিরিয়ার আসাদ সরকারও শিয়া (আলাওয়াতি সম্প্রদায়)। সিরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ সুন্নী হলেও রাশিয়া শিয়া সরকারকেই তাদের বন্ধু ভাবছে, যদিও আসাদ সরকার নিজের দেশের মানুষের বিরূদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে ইরাকে শিয়াদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং সরকারও শিয়া হওয়ায় সেক্ষেত্রে রাশিয়ারও যে তাদের জন্য একটা বন্ধুসুলভ মনোভাব থাকবে, সেটা বোঝাই যায়। কাসপিয়ান সাগর থেকে মিসাইল ছোঁড়ার জন্যে দুই শিয়া দেশের কাছ থেকে অনুমতি লেগেছে, কিন্তু কৃষ্ণ সাগর থেকে ছোঁড়া হলে লাগতো তুরস্কের। রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ইতিহাস অতো পরিষ্কার নয়। খিলাফতের সময়ে বেশ কয়েকবার ইস্তাম্বুলের উসমানিয়া বংশের খলিফার যুদ্ধ হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তুরস্কের জন্মের সময়েও নতুন দেশের সাথে ততকালীন সোভিয়েতদের সম্পর্ক ভালো হয়নি। শীতল যুদ্ধের সময়ে তুরস্ক ছিল শীতল যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন। এরকম উত্তেজক সম্পর্কের কারণে রাশিয়ার জন্য তুরস্কের কাছে থেকে ওভারফ্লাইট না চেয়ে ইরান-ইরাকের কাছ থেকে চাওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্ক
চতুর্থ চিন্তাটি চলে আসে একই সূত্রে। রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরের ফ্লীট ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে পারে বসফরাস প্রণালীকে ঘিরে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার চুক্তির কারণে। কোন কারণে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার কোন বিরোধ দেখা দিলে এই প্রণালী রাশিয়ার জন্যে উন্মুক্ত না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার নৌবহরের সম্ভাব্য ব্যবহার সীমিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়ে যায়। কৃষ্ণ সাগর এবং কাসপিয়ান সাগরের নৌবহরের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যেতে পারে রাশিয়ার জন্যে।
মিসাইল টেস্টিং?
পঞ্চম চিন্তাটি আসে ক্রুজ মিসাইল নিয়ে, যা কিনা ফিক্সড টার্গেটের জন্যে প্রধানত উপযোগী। আইএসআইএস এমন একটা সংগঠন, যারা কিনা ছোট ছোট মোবাইল গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। আসাদ-বিরোধী গ্রুপগুলিও কাছাকাছি ধাঁচের। ক্রুজ মিসাইলগুলি সিরিয়ার একেবারে পশ্চিম উপকূলের কাছাকাছি শহরগুলিতে পড়েছে, যেগুলি আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলির হাতে, আইএসআইএস-এর হাতে নয়। বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলিও মিসাইলগুলির মতোই; শহরগুলির নামই বলে দেয় যে কাদের উপরে হামলা হচ্ছে। মার্কিনীরাও গত অনেকদিন ধরে সিরিয়াতে যেসব শহরে ড্রোন হামলা করছে, সেগুলিও বেশিরভাগই আসাদ-বিরোধীদের হাতে। ইরানের সৈন্যরাও সেসব শহরেই যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। আসাদ-বিরোধীরা রাশিয়া, আমেরিকা এবং ইরানের মূল টার্গেট হলেও বিমান হামলার সাথে সাথে ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার এক্ষেত্রে আমাদের জানান দিচ্ছে যে রাশিয়া মিসাইল হামলার ব্যাপারে প্রায় অত্যুতসাহী ছিল। অর্থাৎ ক্রুজ মিসাইল মিশনটা কঠিন টার্গেট ধ্বংস করার অতি-প্রয়োজনীয় সমাধান দেবার চাইতে রাশিয়ার নতুন ধরনের অস্ত্র টেস্ট করার কাজেই বেশি লেগেছে। এতকাল যুক্তরাষ্ট্র এই কাজটা করেছে মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যত্র সকল যুদ্ধে। রাশিয়া অবশেষে আমেরিকার কাছ থেকে এই শিক্ষাটি নিয়েছে। রাশিয়া তাদের আক্রমণভাগে ক্রুজ মিসাইল যোগ করে অপশন তৈরি করলো। এখন তারা তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনায় কয়েক ধরনের সমাধানের কথা চিন্তা করতে পারবে।
রাশিয়া ভিয়েতনামের কাছে ৬টা Gepard-class ফ্রিগেট রপ্তানি করছে। এই জাহাজগুলিতে কাসপিয়ান সাগরের আড়াই হাজার কিঃমিঃ পাল্লার মিসাইল না থাকলেও কাসপিয়ান সাগরের অপারেশন রাশিয়ার নৌ-অস্ত্র বাণিজ্যকে আরও চাঙ্গা করতে পারে।
অস্ত্রের বাজার ধরা
যষ্ঠ চিন্তাটি হচ্ছে রাশিয়ার মিলিটারি হার্ডওয়্যার নিয়ে। সিরিয়াতে রাশিয়ার বেশকিছু অস্ত্র টেস্ট করা হচ্ছে। রাশিয়ার অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অস্ত্র রপ্তানি। একইসাথে এই রপ্তানিকে রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে ব্যবহার করে। সিরিয়াতে নৌবাহিনীর অস্ত্র টেস্ট করার সম্ভাবনা ছিল বেশ খানিকটা কম। এই মিসাইল মিশনের মাধ্যমে রাশিয়া তাদের নৌজাহাজের জন্যে অস্ত্র-বাণিজ্যের একটা বাজার তৈরি করার সুযোগ খুঁজবে। রাশিয়া বর্তমানে ভিয়েতনামের কাছে Gepard-class-এর ছয়টা ফ্রিগেট বিক্রি করছে। কাসপিয়ান সাগরে ছোট জাহাজের শক্তি দেখানোর কারণে রাশিয়ার তৈরি ছোট জাহাজের বাজার তৈরি হতে পারে। তবে এটা এ-ই নয় যে রাশিয়া ২,৫০০ কিমি পাল্লার মিসাইল এর সাথে বিক্রি করতে পারবে। তারপরেও বিক্রি করা জাহাজগুলি যদি সেইরকম মিসাইল বহন করার ক্ষমতা-সহ বিক্রি করা হয়, তাহলে সেটা অন্যান্য শক্রিশালী রাষ্ট্রের জন্য গভীর চিন্তার বিষয় হবে।
কাসপিয়ান থেকে দূরের সাগরে
পরিশেষে এই সবগুলি চিন্তাকে একত্রিত করলে আমরা কয়েকটি বিষয়ে কিছু ধারণা লিপিবদ্ধ করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে তাদেরকে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক বাস্তবতাকে নিয়ে ভাবলেই হবে। কিন্তু রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সাথে তাদের নিজেদের ভৌগোলিক বাস্তবতাকে নিয়েও ভাবতে হবে। কাসপিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের সাথে সাথে ইরান-ইরাক-তুরস্কের অবস্থান রাশিয়ার ভৌগোলিক বাস্তবতা। একারণে রাশিয়া কাসপিয়ানের দিকে ঝুঁকছে। কাসপিয়ান এমন একটা সাগর যেখানে চলাচলের জন্যে রাশিয়ানরা জাহাজ বানাচ্ছে কাসপিয়ান থেকে প্রায় ৮০০ মাইল দূরে ভলগা নদীতে, যেকারণে জাহাজগুলি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ছোট। আবার কাসপিয়ান এমন কোন সাগর নয়, যেখানে সমুদ্রে টহল দিতে ডেস্ট্রয়ার বা ক্রুজারের মতো বিশাল জাহাজ বানাতে হবে। কাজেই কাসপিয়ানের জাহাজগুলি স্বভাবতই ছোট হবে। আর এই সাগরের জাহাজগুলিকে ভূমিতে আক্রমণযোগ্য মিসাইল সজ্জিত করতে হলে ছোট জাহাজই হবে ভরসা। অর্থাৎ ছোট জাহাজের উপরে রাশিয়ার স্থলভাগ আক্রমণের ভার দেওয়াকে আমরা রাশিয়ার ভৌগোলিক বাস্তবতার অংশ ধরতে পারি। এই বাস্তবতা রাশিয়ার সাথে থাকবে সকল সময়; শুধু আজকে সিরিয়ার যুদ্ধের সময় নয়। কিন্তু এই ছোট জাহাজের দূরপাল্লার অপারেশন অপেক্ষাকৃত ছোট নৌবহরের দেশের জন্যে অনুপ্রেরণার কারণ হতে পারে; জন্ম দিতে পারে একটা নতুন স্ট্র্যাটেজিক ডিটারেন্ট-এর। সিরিয়ায় মিসাইল অপারেশনের কারণে রাশিয়ার নৌশক্তির রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়তে পারে ঠিকই, কিন্তু ছোট জাহাজের স্ট্র্যাটেজিক ডিটারেন্ট হবার সম্ভাবনা এমন একটা ধারণাকে রপ্তানি করতে পারে, যা কিনা বিশ্বের কিছু এলাকার স্ট্র্যাটেজিক ব্যালান্সও পালটে দিতে পারে।
সিরিয়ায় রাশিয়ার নৌবাহিনী জাহাজ থেকে মিসাইল ছোঁড়ার সাথে সাথে সামরিক দিক থেকে বেশকিছু নতুন ব্যাপার সামনে এসে পড়েছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে কার কতটা সুবিধা হলো, সেটা আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়, বরং আলোচনা করতে চাই সামরিক দিক দিয়ে নতুন কি কি ব্যাপার ধরা পড়লো, যেগুলি শুধু সিরিয়া নয়, বরং বিশ্বের যেকোন স্থানে সামরিক ব্যালান্সেও ভূমিকা রাখতে পারে।
এতো ছোট জাহাজ থেকে কেন?
এখানে প্রথম চিন্তাটা আসে যে জাহাজ থেকে মিসাইল কেনো ছোঁড়া হলো; ভূমি থেকে হলে কি সমস্যা হতো? ১৯৮৭ সালের Intermediate-Range Nuclear Forces (INF) Treaty অনুযায়ী ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ায় বাধা রয়েছে, কিন্তু জাহাজ থেকে ভূমিতে ছোঁড়াতে বাধা নেই। বলাই বাহুল্য যে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা মাথায় রেখেই এই চুক্তি করা হয়েছিল অত বছর আগে। এর পর থেকে ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র সব যুদ্ধে জাহাজ থেকে ভূমিতে মিসাইল ছুঁড়েছে। ২০১১ সালে লিবিয়ায় Operation Odyssey Dawn-এ যুক্তরাষ্ট্র তাদের Ohio-class পারমাণবিক মিসাইল সাবমেরিনের কনভার্সন ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন ব্যবহার করেছিল। বিশাল ওই সাবমেরিন ১৫৪টা Tomahawk মিসাইল বহণ করতে পারে। মার্কিন অন্যান্য যুদ্ধজাহাজগুলি এই সাবমেরিনের মতো এত্তোবড় মিসাইলের ডিপো না রাখলেও অনেকগুলি মিসাইলই বহন করে থাকে। বলাই বাহুল্য যে আমরা ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইল নিয়ে কথা বলছি। বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ যুদ্ধজাহাজই জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল বহণ করে। একটা জাহাজকে মিসাইল-সজ্জিত করতে এটাই প্রধানতম পদ্ধতি। মিসাইল দিয়ে ভূমির অভ্যন্তরে বহুদূরে আক্রমণ করতে পারাটা সাধারণত সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য হিসেবেই থাকে। গত দু’দশকে ভূমি আক্রমণ করতে পারার ক্ষমতাটা যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। যে কারণে তাদের বড় বড় সব যুদ্ধজাহাজ Tomahawk মিসাইল-সজ্জিত হয়ে পানিতে ভাসছে। তাদের নতুন Zumwalt-class ডেস্ট্রয়ারগুলি ভূমিতে টার্গেট ধংসের জন্যেই যেন তৈরি করা হচ্ছে। মোট ৮০টা VLS (Vertical Launch System) মিসাইল লঞ্চারের মধ্যে বেশিরভাগটাই যে Tomahawk ক্রুজ মিসাইল হবে, সেটা মার্কিন নৌবাহিনীর অফিসাররা গোপন রাখেননি।
Buyan-class-এর জাহাজগুলি মাত্র ৭৫ মিটার লম্বা। এতো ছোট জাহাজগুলি কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাইক করতে পারে, সেটা খুব বেশি মানুষের চিন্তায় থাকার কথা ছিল না। এখন থেকে হিসেবটা পালটে গেল।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে রাশিয়া যেসব যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করলো ক্রুজ মিসাইল ছোঁড়ার কাজে, সেগুলি কেউ শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের ক্যাটাগরিতে কখনো ফেলেছেন বলে খুব একটা মনে হয় না। এখানে রাশিয়া ব্যবহার করেছে Gepard-class-এর একটা ফ্রিগেট আর Buyan-class-এর তিনটা কর্ভেট। রাশিয়ার কাসপিয়ান সাগরের ফ্লোটিলাতে Gepard-class-এর দু’টা জাহাজ আছে, যার একটা সেই ভুমিতে নিক্ষেপণযোগ্য Klub মিসাইল (২,৫০০ কিমি পাল্লার) বহন করে। আসলে সেটাও একটা মাঝারি পাল্লার জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল, যেটার একটা ভার্সন তৈরি করা হয়েছে দূরপাল্লার ভূমিতে নিক্ষেপের মিসাইল হিসেবে। যেকারণে ওই মিসাইল একই বক্স (Missile Canister) থেকে ছোঁড়া যায়। অর্থাৎ শুধু মিসাইলগুলি পরিবর্তন করে ফেললেই চলে। Gepard-class-এর একটা জাহাযে এই সুবিধা থাকলেও অন্যটা বহন করে Kh-35 মিসাইল (১৩০ কিমি পাল্লার), যার কিনা ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য কোন ভার্সন নেই। Buyan-class-এর তিনটা কর্ভেটের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। ৬টা জাহাজের মধ্যে মাত্র ৩টা জাহাজ Klub মিসাইল বহন করে। কাসপিয়ান ফ্লোটিলার ভূমিতে আক্রমণ করতে পারা মোট এই ৪টা জাহাজই ব্যবহার করা হয়েছে। ৩২টা মিসাইল এরা ছুঁড়তে পারতো সর্বোচ্চ; ছুঁড়েছে ২৬টা। Gepard-class-এর ফ্রিগেটগুলি মাত্র ১০২ মিটার লম্বা আর Buyan-class-এর কর্ভেটগুলি মাত্র ৭৫ মিটার লম্বা। এতো ছোট জাহাজের পক্ষে এতো দূরে ভূমিতে হামলা চালানোর ঘটনা এই প্রথম। এই ধরনের মিসাইলের একটা স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে, যেকারণে পাকিস্তান এরকমই একটা মিসাইল তাদের কিছু সাবমেরিনে সংযুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছে। সাবমেরিনের এই স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত গুরুত্ব জানা থাকলেও এত্তো ছোট্ট ফ্রিগেট বা কর্ভেটের ক্ষেত্রে এই গুরুত্ব এর আগে কেউ দেয়নি। স্ট্র্যাটেজিক্ স্ট্রাইকের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজের আকার হঠাত করেই মনে হয় অনেক ছোট হয়ে গেল। এরকম সাইজের জাহাজের সংখ্যা বিশ্বে অনেক; ছোট ছোট অনেক দেশের হাতেই রয়েছে। এসব জাহাজ যদি কেউ ভূমিতে আঘাত করার মতো মিসাইল দিয়ে সজ্জিত করার জন্যে তৈরি করে রাখে, সেটা শক্তিশালী দেশগুলির জন্যে মাথাব্যাথার কারণ হয়ে যেতে পারে। আর এটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার, তা-ও কিন্তু নয়। জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল কিন্তু ভূমির টার্গেটেও ব্যবহার করা সম্ভব। ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর ছোট্ট ছোট্ট মিসাইল বোটগুলি পাকিস্তানের করাচী বন্দর ধ্বংসপ্রাপ্ত করেছিল জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল ব্যবহার করেই। এখানে একটা ব্যাপারই রয়েছে এখন চিন্তা করার, সেটি হচ্ছে দূরপাল্লার ক্রুজ মিসাইল বিক্রির উপরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। তবে এই নিষেধাজ্ঞা যে কতটা কার্যকর, তা উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান এবং ইরানের মতো দেশগুলির মিসাইল প্রোগ্রাম দেখলে সন্দেহ জাগে। রাশিয়ার এই মিসাইল হামলা স্ট্র্যাটেজিক স্ট্রাইকের ক্ষমতা অনেকের মাঝে বিতরণ করে দেওয়ার জন্যে একটা উদাহরণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
রাশিয়ার মিসাইল হামলা হঠাত করেই কাসপিয়ান সাগরকে মধ্যপ্রাচ্যের স্ট্র্যাটেজিক হিসাবের ভেতরে ফেলে দিল। এখন থেকে এই সাগরকে ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক হিসেব পূর্ণ হবে না।
কাসপিয়ান সাগর কেন? কৃষ্ণ সাগর কেন নয়?
দ্বিতীয় চিন্তা, যেটি আসে রাশিয়ার মিসাইল হামলা থেকে, সেটি হচ্ছে - কাসপিয়ান সাগর বেছে নেওয়া হলো কেন এই স্ট্রাইকের জন্যে। কৃষ্ণ সাগরে যেখানে আরেকটা অপেক্ষাকৃত বড় ফ্লীট ছিল রাশিয়ার, সেখানে কাসপিয়ান সাগর কেন ব্যবহার করা হলো। কৃষ্ণ সাগরের জাহাজগুলি মোটামুটি নিয়মিতই বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করে ভূমধ্যসাগরে পাড়ি জমায়। সিরিয়ার সমস্যা শুরু হবার পর থেকে আসাদ সরকারের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন জানাতে এভাবে একাধিকবার তাদের জাহাজগুলি সিরিয়ার উপকূলে টহল দিয়েছে। কৃষ্ণ সাগরর ফ্লীটে বড় ক্রুজার এবং ডেস্ট্রয়ার থাকলেও Klub মিসাইল, যেটা সিরিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে, তেমন মিসাইল বহনকারী জাহাজের সংখ্যা কম। Buyan-class-এর কর্ভেট রয়েছে মাত্র দু’টি। কৃষ্ণ সাগরের এই জাহাজগুলির যুদ্ধ-ক্ষমতার উপরেও কিছুটা হলেও প্রশ্ন করা যায়। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সেবাস্তোপোলের নেভি ডে প্যারেডের সময় Ladnyy নামের ফ্রিগেট থেকে SS-N-14 মিসাইল ছোঁড়ার পরে সেটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অবশেষে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। তবে এই জাহাজগুলিকে ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার ফ্ল্যাগ উড়ানোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই লেখাটি লেখার সময়ে (অক্টোবর ২০১৫) পূর্ব ভূমধ্যসাগরে Slava-class ক্রুজার Moskva, Kashin-class ডেস্ট্রয়ার Smetlivyy, এবং Krivak-class ফ্রিগেট Ladnyy এবং Pytlivyy - যেগুলি ১১তম এন্টি-সাবমেরিন ব্রিগেডের অংশ – ভূমধ্যসাগরে মহড়া দিচ্ছে। এগুলি কৃষ্ণ সাগরের সবচাইতে শক্তিশালী জাহাজ। এগুলিকে শক্তি প্রদর্শন এবং সিরিয়ার লাটাকিয়া এবং টারটাস বন্দরের আশেপাশে রাশিয়ার নৌসম্পদের সুরক্ষা দেয়ার কাজেই ব্যবহার করা হবে বলে মনে হচ্ছে। ভূমিতে হামলা করার মতো মিসাইল দিয়েও এরা সজ্জিত নয়, আবার কৃষ্ণ সাগরে রেখে আসা অন্য মিসাইল-সজ্জিত জাহাজগুলিও এরকম আক্রমণের জন্যে যথেষ্ট নয়। কাজেই কাসপিয়ান ফ্লোটিলাতেই রাশিয়ার ভরসা। শুধু তা-ই নয়, কাসপিয়ান সাগরকে হঠাত করেই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে দেওয়া হলো। এই সাগর (যা কিনা আসলে একটা বড় হ্রদ) ককেশাস এলাকার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন এই সাগর পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। রাশিয়ার সামরিক হাতের ক্ষমতা নিয়ে চিন্তা করতে হলে এই সাগরের কথা এখন থেকে সবাই চিন্তা করবে। এই সাগর থেকে মোটামুটি ২,৫০০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যপ্রাচ্যের পুরো এলাকা এখন রাশিয়ার মিসাইলের পাল্লার মাঝে।
ইরান-ইরাকের ওভারফ্লাইট অনুমতি
তৃতীয় চিন্তাটি হলো ওভারফ্লাইট নিয়ে। মিসাইল ছোঁড়ার জন্যে ওভারফ্লাইটের অনুমতি লেগেছে ইরান এবং ইরাকের কাছ থেকে। ইরান রাশিয়ার বন্ধু রাষ্ট্র। আর ইরাকের মার্কিন-সমর্থিত সরকারও যে রাশিয়ার কার্যক্রমের পক্ষে, সেটা এবার বোঝা গেল। মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে, যেখানে রাশিয়া ইসলামিক কোন শক্তির আবির্ভাব দেখতে ইচ্ছুক নয়। আমেরিকাও মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামকে শক্তি হিসেবে দেখতে চায় না, যেকারণে তারা ইরাকের জেলখানাতে আইএসআইএস-এর মতো এক রক্তোন্মাদের জন্ম দিয়েছে এবং মুসলিমদেরকে আরও বেশি বিভক্ত করতে পেরেছে। একই হিসাবের অংশ হিসেবে মুসলিমদের মাঝে শিয়া-সুন্নী সংঘাত রাশিয়া এবং আমেরিকাকে স্বস্তি দেয়। এর মাঝে রাশিয়া শিয়া মুসলিমদেরকে নিজেদের অপেক্ষাকৃত ভালো বন্ধুরূপে দেখে। ইরান এবং হিযবুল্লাহ ছাড়াও সিরিয়ার আসাদ সরকারও শিয়া (আলাওয়াতি সম্প্রদায়)। সিরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ সুন্নী হলেও রাশিয়া শিয়া সরকারকেই তাদের বন্ধু ভাবছে, যদিও আসাদ সরকার নিজের দেশের মানুষের বিরূদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে ইরাকে শিয়াদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং সরকারও শিয়া হওয়ায় সেক্ষেত্রে রাশিয়ারও যে তাদের জন্য একটা বন্ধুসুলভ মনোভাব থাকবে, সেটা বোঝাই যায়। কাসপিয়ান সাগর থেকে মিসাইল ছোঁড়ার জন্যে দুই শিয়া দেশের কাছ থেকে অনুমতি লেগেছে, কিন্তু কৃষ্ণ সাগর থেকে ছোঁড়া হলে লাগতো তুরস্কের। রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ইতিহাস অতো পরিষ্কার নয়। খিলাফতের সময়ে বেশ কয়েকবার ইস্তাম্বুলের উসমানিয়া বংশের খলিফার যুদ্ধ হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তুরস্কের জন্মের সময়েও নতুন দেশের সাথে ততকালীন সোভিয়েতদের সম্পর্ক ভালো হয়নি। শীতল যুদ্ধের সময়ে তুরস্ক ছিল শীতল যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন। এরকম উত্তেজক সম্পর্কের কারণে রাশিয়ার জন্য তুরস্কের কাছে থেকে ওভারফ্লাইট না চেয়ে ইরান-ইরাকের কাছ থেকে চাওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্ক
চতুর্থ চিন্তাটি চলে আসে একই সূত্রে। রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরের ফ্লীট ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে পারে বসফরাস প্রণালীকে ঘিরে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার চুক্তির কারণে। কোন কারণে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার কোন বিরোধ দেখা দিলে এই প্রণালী রাশিয়ার জন্যে উন্মুক্ত না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার নৌবহরের সম্ভাব্য ব্যবহার সীমিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়ে যায়। কৃষ্ণ সাগর এবং কাসপিয়ান সাগরের নৌবহরের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যেতে পারে রাশিয়ার জন্যে।
মিসাইল টেস্টিং?
পঞ্চম চিন্তাটি আসে ক্রুজ মিসাইল নিয়ে, যা কিনা ফিক্সড টার্গেটের জন্যে প্রধানত উপযোগী। আইএসআইএস এমন একটা সংগঠন, যারা কিনা ছোট ছোট মোবাইল গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। আসাদ-বিরোধী গ্রুপগুলিও কাছাকাছি ধাঁচের। ক্রুজ মিসাইলগুলি সিরিয়ার একেবারে পশ্চিম উপকূলের কাছাকাছি শহরগুলিতে পড়েছে, যেগুলি আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলির হাতে, আইএসআইএস-এর হাতে নয়। বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলিও মিসাইলগুলির মতোই; শহরগুলির নামই বলে দেয় যে কাদের উপরে হামলা হচ্ছে। মার্কিনীরাও গত অনেকদিন ধরে সিরিয়াতে যেসব শহরে ড্রোন হামলা করছে, সেগুলিও বেশিরভাগই আসাদ-বিরোধীদের হাতে। ইরানের সৈন্যরাও সেসব শহরেই যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। আসাদ-বিরোধীরা রাশিয়া, আমেরিকা এবং ইরানের মূল টার্গেট হলেও বিমান হামলার সাথে সাথে ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার এক্ষেত্রে আমাদের জানান দিচ্ছে যে রাশিয়া মিসাইল হামলার ব্যাপারে প্রায় অত্যুতসাহী ছিল। অর্থাৎ ক্রুজ মিসাইল মিশনটা কঠিন টার্গেট ধ্বংস করার অতি-প্রয়োজনীয় সমাধান দেবার চাইতে রাশিয়ার নতুন ধরনের অস্ত্র টেস্ট করার কাজেই বেশি লেগেছে। এতকাল যুক্তরাষ্ট্র এই কাজটা করেছে মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যত্র সকল যুদ্ধে। রাশিয়া অবশেষে আমেরিকার কাছ থেকে এই শিক্ষাটি নিয়েছে। রাশিয়া তাদের আক্রমণভাগে ক্রুজ মিসাইল যোগ করে অপশন তৈরি করলো। এখন তারা তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনায় কয়েক ধরনের সমাধানের কথা চিন্তা করতে পারবে।
রাশিয়া ভিয়েতনামের কাছে ৬টা Gepard-class ফ্রিগেট রপ্তানি করছে। এই জাহাজগুলিতে কাসপিয়ান সাগরের আড়াই হাজার কিঃমিঃ পাল্লার মিসাইল না থাকলেও কাসপিয়ান সাগরের অপারেশন রাশিয়ার নৌ-অস্ত্র বাণিজ্যকে আরও চাঙ্গা করতে পারে।
অস্ত্রের বাজার ধরা
যষ্ঠ চিন্তাটি হচ্ছে রাশিয়ার মিলিটারি হার্ডওয়্যার নিয়ে। সিরিয়াতে রাশিয়ার বেশকিছু অস্ত্র টেস্ট করা হচ্ছে। রাশিয়ার অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অস্ত্র রপ্তানি। একইসাথে এই রপ্তানিকে রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে ব্যবহার করে। সিরিয়াতে নৌবাহিনীর অস্ত্র টেস্ট করার সম্ভাবনা ছিল বেশ খানিকটা কম। এই মিসাইল মিশনের মাধ্যমে রাশিয়া তাদের নৌজাহাজের জন্যে অস্ত্র-বাণিজ্যের একটা বাজার তৈরি করার সুযোগ খুঁজবে। রাশিয়া বর্তমানে ভিয়েতনামের কাছে Gepard-class-এর ছয়টা ফ্রিগেট বিক্রি করছে। কাসপিয়ান সাগরে ছোট জাহাজের শক্তি দেখানোর কারণে রাশিয়ার তৈরি ছোট জাহাজের বাজার তৈরি হতে পারে। তবে এটা এ-ই নয় যে রাশিয়া ২,৫০০ কিমি পাল্লার মিসাইল এর সাথে বিক্রি করতে পারবে। তারপরেও বিক্রি করা জাহাজগুলি যদি সেইরকম মিসাইল বহন করার ক্ষমতা-সহ বিক্রি করা হয়, তাহলে সেটা অন্যান্য শক্রিশালী রাষ্ট্রের জন্য গভীর চিন্তার বিষয় হবে।
কাসপিয়ান থেকে দূরের সাগরে
পরিশেষে এই সবগুলি চিন্তাকে একত্রিত করলে আমরা কয়েকটি বিষয়ে কিছু ধারণা লিপিবদ্ধ করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে তাদেরকে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক বাস্তবতাকে নিয়ে ভাবলেই হবে। কিন্তু রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সাথে তাদের নিজেদের ভৌগোলিক বাস্তবতাকে নিয়েও ভাবতে হবে। কাসপিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের সাথে সাথে ইরান-ইরাক-তুরস্কের অবস্থান রাশিয়ার ভৌগোলিক বাস্তবতা। একারণে রাশিয়া কাসপিয়ানের দিকে ঝুঁকছে। কাসপিয়ান এমন একটা সাগর যেখানে চলাচলের জন্যে রাশিয়ানরা জাহাজ বানাচ্ছে কাসপিয়ান থেকে প্রায় ৮০০ মাইল দূরে ভলগা নদীতে, যেকারণে জাহাজগুলি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ছোট। আবার কাসপিয়ান এমন কোন সাগর নয়, যেখানে সমুদ্রে টহল দিতে ডেস্ট্রয়ার বা ক্রুজারের মতো বিশাল জাহাজ বানাতে হবে। কাজেই কাসপিয়ানের জাহাজগুলি স্বভাবতই ছোট হবে। আর এই সাগরের জাহাজগুলিকে ভূমিতে আক্রমণযোগ্য মিসাইল সজ্জিত করতে হলে ছোট জাহাজই হবে ভরসা। অর্থাৎ ছোট জাহাজের উপরে রাশিয়ার স্থলভাগ আক্রমণের ভার দেওয়াকে আমরা রাশিয়ার ভৌগোলিক বাস্তবতার অংশ ধরতে পারি। এই বাস্তবতা রাশিয়ার সাথে থাকবে সকল সময়; শুধু আজকে সিরিয়ার যুদ্ধের সময় নয়। কিন্তু এই ছোট জাহাজের দূরপাল্লার অপারেশন অপেক্ষাকৃত ছোট নৌবহরের দেশের জন্যে অনুপ্রেরণার কারণ হতে পারে; জন্ম দিতে পারে একটা নতুন স্ট্র্যাটেজিক ডিটারেন্ট-এর। সিরিয়ায় মিসাইল অপারেশনের কারণে রাশিয়ার নৌশক্তির রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়তে পারে ঠিকই, কিন্তু ছোট জাহাজের স্ট্র্যাটেজিক ডিটারেন্ট হবার সম্ভাবনা এমন একটা ধারণাকে রপ্তানি করতে পারে, যা কিনা বিশ্বের কিছু এলাকার স্ট্র্যাটেজিক ব্যালান্সও পালটে দিতে পারে।
No comments:
Post a Comment