Monday 3 July 2023

‘ব্রিকস’এর সম্প্রসারণের সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক ফলাফল

০৩রা জুলাই ২০২৩

কেপ টাউন। ০২রা জুন ২০২৩। 'ব্রিকস' পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে অনেক দেশ ‘ব্রিকস’এর সদস্য হতে চাইলেও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হয়ে ওঠার মতো অবস্থান ‘ব্রিকস’ তৈরি করতে পারেনি। ভারত এবং চীনের মতো কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টা দেশ ‘ব্রিকস’এর সদস্য হওয়ায় সংস্থার লক্ষ্যের দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংস্থার রাজনৈতিক কর্মকান্ড এখনও কিছু বিবৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ।

গত ২রা জুন সাউথ আফ্রিকার কেপ টাউনে ‘ব্রিকস’ জোটের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়ে গেলো। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, পশ্চিমা বৈশ্বিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্য নিয়ে হয়ে যাওয়া এই বৈঠকে প্রতিষ্ঠাতা দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সাউথ আফ্রিকা সংস্থাটার সম্প্রসারণ নিয়ে কথা বলেছে। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকা পাঁচটা রাষ্ট্রের হাল্কা বন্ধনের উপরে গঠিত সংস্থা বলে মনে করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রচেষ্টায় এর কর্মকান্ড নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করতে থাকে। আর ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়াও সংস্থাটাকে শক্তিশালী করতে আগ্রহী হয়েছে। গত বছর ‘ব্রিকস’এর এক অনলাইন বৈঠকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়া ইয়ি বলেন যে, চীন চাইছে ‘ব্রিকস’এর সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া শুরু করতে এবং ধীরে ধীরে এব্যাপারে সদস্য দেশগুলির মাঝে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, চীনের এই প্রস্তাবের পর থেকে সদস্য দেশগুলি সম্প্রসারণের জন্যে নিজেদের মনোনীত দেশগুলির নামের তালিকা দিতে শুরু করেছে।

ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কিউবা, ডি আর কঙ্গো, কমোরুজ, গ্যাবন এবং কাজাখস্তান এবারের বৈঠকে ‘ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস’ আলোচনার জন্যে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। এছাড়াও মিশর, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, গিনি বিসাউ এবং ইন্দোনেশিয়া এবারের বৈঠকে ভার্চুয়ালি অংশ নেয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর সাংবাদিকদের বলেন যে, ‘ব্রিকস’এর বৈঠকে আলোচনা হয়েছে যে, সংস্থার সদস্যপদ পেতে কি রকমের নীতি, মানদন্ড বা শর্ত থাকবে, এবং কোন পদ্ধতিতে সম্প্রসারণ হবে। আগামী অগাস্টে জোহান্সবার্গে ‘ব্রিকস’এর শীর্ষ বৈঠকের আগে এই ব্যাপারগুলি নিয়ে আলোচনা চলবে।

‘ব্রিকস’এ যোগ দেয়ার জন্যে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে; যার মাঝে আর্থিক বিনিয়োগই প্রধানতম। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সৌদি আরব ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ বা ‘এনডিবি’র সদস্য হিসেবে যুক্ত হবে কিনা, সেব্যাপারে আলোচনা চলছে বলে ব্যাংকের এক বিবৃতিতে বলা হয়। ‘এনডিবি’ হলো ‘ব্রিকস’এর আর্থিক সংস্থা; যাকে কিনা বিশ্বব্যাংক এবং ‘আইএমএফ’এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠাতা দেশ রাশিয়ার অর্থনৈতিক সমস্যা ‘এনডিবি’র অর্থের উৎসকে চাপের মাঝে ফেলেছে; কারণ এই ব্যাংকে রাশিয়ার ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ইতোমধ্যেই ‘এনডিবি’ ‘ব্রিকস’এর বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, বাংলাদেশ এবং উরুগুয়েকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং ৩৩ বিলিয়ন ডলার এই দেশগুলিতে বিনিয়োগ করেছে। ব্যাংকের ডিরেক্টর জেনারেল আশওয়ানি মুথু এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, এই মুহুর্তে অর্থের যোগান সংস্থার জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ। একারণে চীনা মুদ্রা ইউয়ান এবং সাউথ আফ্রিকার মুদ্রা র‍্যান্ডে ব্যাংক অর্থ যোগাড় করছে।

‘ব্রিকস’এর সম্প্রসারণ একবার ইতোমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। ফ্রান্সের ‘লে মন্ড’ পত্রিকার এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং ‘গোল্ডমান সাকস’এর অর্থনীতিবিদ জিম ওনীল ২০০১ সালে যখন সর্বপ্রথম ভবিষ্যতের চারটা বড় অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেন, তখন তার মাঝে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীন থাকলেও সাউথ আফ্রিকা ছিল না। অর্থাৎ চারটা দেশকে একত্রে ওনীল ‘ব্রিক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সাউথ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার দীর্ঘ সময়ের কূটনীতির ফলাফলস্বরূপ দেশটা নতুন এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এর নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় ‘ব্রিকস’। ওনীল বলেছিলেন যে, সাউথ আফ্রিকার এই সংস্থায় যুক্ত হওয়াটা অর্থহীন। তবে যদি দেশটাকে পুরো আফ্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম। ওনীলএর এই চিন্তাটা সাউথ আফ্রিকার চিন্তাবিদেরা কিভাবে দেখছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘প্রিটোরিয়া ইউনিভার্সিটি’র লায়াল হোয়াইট বলছেন যে, সাউথ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ হলো আফ্রিকার বাজার ধরা; এখানে বাইরের কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়ে আসাটা বিপজ্জনক।

ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক ইন্দ্রানি বাগচি ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক লেখায় বলছেন যে, ‘ব্রিকস’এর সম্প্রসারণ উভয় সংকট তৈরি করতে পারে। যেহেতু ‘ব্রিকস’এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণকে পাশ কাটিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্বব্যবস্থা চাইছে, সেহেতু রাশিয়া এবং চীন উভয়কেই সাবধান হতে হবে যে, ‘ব্রিকস’এর নতুন সদস্য দেশগুলির মাঝে কোন একটাকে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে কিনা। যুক্তরাষ্ট্র তার পুরোনো বন্ধু দেশগুলির সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন হলে সেখান থেকে পরিস্থতি ঘুরিয়ে ফেলতে পরিপক্ক। তিনি বিশেষ করে সৌদি আরবের কথা উল্লেখ করেন।

অনেক প্রশ্ন থাকলেও ‘ব্রিকস’কে অনেকেই পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে দেখার চেষ্টা করছে। সাউথ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পান্ডর কেপ টাউনের বৈঠকে বলেন যে, করোনা মহামারির সময়ে ধনী দেশগুলি এবং বৈশ্বিক সংস্থাগুলি যখন উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উপেক্ষা করেছিল, তখন ‘ব্রিকস’ এই দেশগুলির পাশে দাঁড়িয়েছে। উন্নত দেশগুলি কথা দিয়ে কথা রাখেনি এবং তারা সকল দায় উন্নয়নশীল দেশগুলির উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। ডি আর কঙ্গোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফে লুতুনদুলা আপালা বলেন যে, তার দেশ নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি করে পরিবর্তন আনার জন্যে ‘ব্রিকস’কে উৎসাহ যোগাবে; কারণ সামষ্টিক শান্তি এবং উন্নয়নে উন্নত দেশগুলির কোন রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘দ্যা গ্লোবাল টাইমস’ বলছে যে, নতুন সদস্য যুক্ত হলে ‘ব্রিকস’ আরও শক্তিশালী হবে।

নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে অনেক দেশ ‘ব্রিকস’এর সদস্য হতে চাইলেও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হয়ে ওঠার মতো অবস্থান ‘ব্রিকস’ তৈরি করতে পারেনি। ভারত এবং চীনের মতো কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টা দেশ ‘ব্রিকস’এর সদস্য হওয়ায় সংস্থার লক্ষ্যের দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংস্থার রাজনৈতিক কর্মকান্ড এখনও কিছু বিবৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ। তথাপি অর্থায়নের জন্যে চীনের উপর নির্ভরশীলতা এবং মার্কিন ডলার-কেন্দ্রিক পশ্চিমা পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থাকে বাইপাস করতে না পারাটাও সংস্থার বড় দুর্বলতা। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, ‘ব্রিকস’এর ব্যাংক ‘এনডিবি’ এবং চীনা নেতৃত্বের ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ বা ‘এআইআইবি’ ইতোমধ্যেই পশ্চিমা ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির চাপে পড়ে অর্থায়নের খরচ কমাতে রাশিয়াতে তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রমকে স্থগিত করেছে। ডলার-ভিত্তিক ঋণ নেয়াকে সহজ করতেই ‘এনডিবি’র নীতিতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে আবির্ভাবের কথা বললেও মার্কিন ডলারের উপরে নির্ভরশীলতাকে এড়াতে পারেনি ‘ব্রিকস’।

No comments:

Post a Comment