Saturday 8 July 2023

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী সরিয়ে নেবার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

০৮ই জুলাই ২০২৩

মালি, সেপ্টেম্বর ২০১৭। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা মিশনে নিহত তিনজন বাংলাদেশী সেনার মৃতদেহ বহণ করছে। শক্তিশালী দেশগুলির ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এবং তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের ৩ শতাধিক সেনা; যারা অর্থের বিনিময়ে মালির মরুভূমিতে শক্তিশালী দেশগুলির স্বার্থরক্ষা করেছে।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর মিশন ২০২৩এর ৩০ জুন পর্যন্ত থাকার কথা ছিল, যদি সেই মিশনের সময় বৃদ্ধি করা না হতো। কিন্তু জাতিসংঘের অনুরোধ সত্ত্বেও জাতিসংঘে মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুলায়ে দিওপ মিশনের ইতি টানার কথা বলেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, মালিতে নিরাপত্তার যেই চ্যালঞ্জগুলি রয়েছে, সেগুলির সমাধান দিতে ব্যার্থ হয়েছে এই মিশন। এছাড়াও মালি সরকার অভিযোগ করে যে, জাতিসংঘ মিশন সেদেশে জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি করছে, যেকারণে মালির শান্তি নষ্ট হচ্ছে, এবং দেশের মানুষকে সহিংসতা ভুলে গিয়ে শান্তির পথে এগুতে বাধা সৃষ্টি করছে। অপরদিকে জাতিসংঘ অভিযোগ করছে যে, ২০২২ সালের মার্চে মালির সেনাবাহিনী এবং রুশ ভাড়াটে সেনারা দেশের মধ্যাঞ্চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ৫’শরও বেশি বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। এছাড়াও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী অভিযোগ করেছে যে, মালির সরকার শান্তিরক্ষী মিশনের কর্মকান্ডে নিয়মিতভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। এহেন অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০শে জুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ফ্রান্সের প্রস্তাবিত এক রেজোলিউশনে ভোটাভুটির পর সর্বসম্মতিক্রমে ২০২৩এর ৩১শে ডিসেম্বরের মাঝে মালি থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত হয়। একইদিনে জাতিসংঘের প্রশাসনিক এবং আর্থিক ৫ম কমিটির সভায় আগামী ছয় মাসের জন্যে মালির মিশনের জন্যে ৫’শ ৯০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়; যা স্বাভাবিক বার্ষিক বাজেটের অর্ধেক।

২০১৩ সালে মালির উত্তরাঞ্চলে ‘আল-কায়েদা’ সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীদের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেখানে ইতোমধ্যেই মোতায়েন করা ফরাসি বাহিনীর সমর্থনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী গত ফেব্রুয়ারি মাসে মালিতে মোট ১৭ হাজার ৪’শ ৩০ জন বিদেশী শান্তিরক্ষী মোতায়েন ছিল। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, দশ বছর পরেও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন থাকা অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসেনি। বছরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার খরচে এই মিশনের সাফল্য নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। তবে এই মিশনের সাফল্য পাবার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা ছিল ২০২০ সালের অগাস্টের সামরিক অভ্যুত্থান; যার প্রধান কারণ ছিল বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করায় ব্যার্থতা। এরপর ২০২১এর মে মাসে দ্বিতীয়বার সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সেসময় থেকেই মালির সরকার অভিযোগ করতে থাকে মালির পরিস্থতিকে অশান্ত করছে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স।

মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন পরিচালনা সত্ত্বেও সহিংতার কমতি হয়নি। মালিতে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েনের তিন বছর পর ২০১৬ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের নিজস্ব মিডিয়া ‘ইউএন ডিসপ্যাচ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের পর শান্তিরক্ষীরাই সেখানে জঙ্গি গোষ্ঠিগুলির প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন এন্ড ইভেন্ট ডাটা’ বা ‘এসিএলইডি’ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে সহিংসহতার নিয়মিত হিসেব রাখছে। তাদের হিসেবে মালিতে সহিংস ঘটনার সংখ্যা কমেনি; বরং বেড়েছে। ২০২০ সালে প্রায় ৩ হাজার সহিংস ঘটনা থেকে ২০২১ সালে কমে গিয়ে ২ হাজারের নিচে নেমে গেলেও ২০২২ সালে তা সাড়ে ৪ হাজার পেরিয়েছে। একইসাথে জঙ্গি সংগঠনগুলিতে মালির জনগণ রিক্রুটিংও বেড়েছে। গত এক দশকে সেখানে ৩’শরও বেশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী সদস্য নিহত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মালি থেকে এই সংঘাত আশেপাশের দেশ বুরকিনা ফাসো এবং নিজেরএ ছড়িয়ে পড়েছে।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, রাশিয়া এবং চীন মালির এই মিশনের সমালোচনা করেছে ও ব্রিটেন এবং সুইডেন সেখানে সেনা মোতায়েনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ২০২২ সালে মালি সরকারের বিরুদ্ধাচরণের ফলস্বরূপ ফ্রান্স মালি থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর হতাশা ছিল, মালির সামরিক সরকার দেশটাতে নির্বাচন দিতে দেরি করছে এবং তারা নিরাপত্তার জন্যে রুশ ভাড়াটে সেনাবাহিনী ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর হাজারখানেক সদস্যকে সেখানে মোতায়েন করেছে।

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন সীমিত করতে চেয়েছিলেন। জো বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তন করলেও অর্থায়নের ক্ষেত্রে তা অনেক ক্ষেত্রেই মার্কিন কংগ্রেসের উপর নির্ভরশীল। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’ বা ‘সিএফআর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের বাজেটের ২৭ শতাংশ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সমস্যা হলো, ২০০১ সাল থেকে মার্কিন কংগ্রেস জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাজেটের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছে; এর বেশি অংশ যুক্তরাষ্ট্র দেবে না। একারণেই প্রতিবছরের শান্তিরক্ষী বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র বড় একটা অংক বাকি রেখে দিচ্ছে। তবে ৮ বছরের মাঝে তিনগুণ বাড়িয়ে ২০২১ সাল নাগাদ চীন শান্তিরক্ষী বাজেটের ১৫ শতাংশ অর্থায়ন করে। তথাপি শান্তিরক্ষী মিশনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলি তেমন কোন সেনা মোতায়েন করে না। এই শূণ্যস্থান পূরণ করছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ; যারা অর্থের বিনিময়ে মিশনে সেনা পাঠায়।

ব্রিটিশ থিংকট্যাংক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর গবেষক পল মেলি ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, শান্তিরক্ষীরা চলে যাবার ফলে মালির কিছু অঞ্চলে সরকার বিভিন্ন সার্ভিস দিতে ব্যর্থ হবে এবং বিদ্রোহীদের সাথে সরকারের নতুন করে সংঘাত হতে পারে। কিন্তু পল মেলি এড়িয়ে গেছেন যে, এক দশকেও জাতিসংঘ মালিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। মালি থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী সরিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থাৎ ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া এবং চীন সেই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, শক্তিশালী দেশগুলির স্বার্থ ছিল মালি থেকে সেনা প্রত্যাহারের পিছনে; যার ঠিক উল্টোটা ছিল মালিতে সেনা মোতায়েনের সময়। শান্তিরক্ষী মিশন যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না, সেই বাস্তবতাটা এক দশক ধরেই ছিল; কিন্তু ২০২৩ সালে শক্তিশালী দেশগুলির স্বার্থ একত্রিত হওয়ায় মিশনের সমাপ্তি ঘটছে। শান্তিরক্ষী মিশনের অর্থায়ন অনেক ক্ষেত্রেই মার্কিন কংগ্রেসের মর্জির উপরে নির্ভরশীল; যা আবার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সাথে জড়িত। অর্থাৎ শক্তিশালী দেশগুলির ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এবং তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের ৩ শতাধিক সেনা; যারা অর্থের বিনিময়ে মালির মরুভূমিতে শক্তিশালী দেশগুলির স্বার্থরক্ষা করেছে।

No comments:

Post a Comment