Monday 4 September 2023

মিয়ানমার নৌবাহিনীর লক্ষ্য কি?

০৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২৩

মিয়ানমার নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ সাড়ে ১২ হাজার টনের ডক ল্যান্ডিং শিপ 'মোয়াত্তামা', যা চুপিসারে তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়া মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে সক্ষমতার দিক থেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। চীন মিয়ানমারকে অনেক অস্ত্রই দিয়েছে; কিন্তু সেগুলি বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। অপরদিকে ভারতের দেয়া সাবমেরিন, রাডার, সোনার, এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো, ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দেয়া ডক ল্যান্ডিং শিপ মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে ‘ব্লু-ওয়াটার নেভি’ হিসেবে গড়ে দিয়েছে। মিয়ানমারের নৌবাহিনীর লক্ষ্য হলো বঙ্গোপসাগরে বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের একপ্রকারের খিচুরি।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্ম এবং মিয়ানমারের প্রতি হুমকি

মিয়ামমারের নৌবাহিনীর কথা বলতে গেলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কথা বলতে হবে। কারণ মিয়ানমার নৌবাহিনীর ডেভেলপমেন্ট মূলতঃ বাংলাদেশের সাথে পাল্লা দিয়েই হয়েছে। কাজেই এই দুই দেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্কের সাথে এর ডেভেলপমেন্ট ওঁতোপ্রোতোভাবে জড়িত। বাংলাদেশের নিরাপত্তা চিন্তার সাথে মিয়ানমারের নৌশক্তির ডেভেলপমেন্ট জড়িত। একারণেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা চিন্তাটাকে একটু কাছে থেকে দেখতে হবে। ১৯৭০এর দশকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার মূল চিন্তা ছিল কিভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা যায়। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আকার দ্রুত বৃদ্ধি করার শুরু হয়; যাতে করে ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করাটা জটিল সমীকরণে পরিণত হয়। ১৯৮০এর দশকে গিয়ে ঠিক সেটাই হয়েছিল। ভারত তার নিরাপত্তা চিন্তার মাঝ থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামরিক হস্তক্ষেপকে বাদ দিতে বাধ্য হয়। তবে ঠিক এই সময়ের মাঝেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা চিন্তায় নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়। যদি ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামরিক হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে দিল্লী বাংলাদেশের উপরে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে কি কি পন্থা নেবে? প্রথমতঃ প্রক্সি যুদ্ধ; যার কেন্দ্রে থাকবে সাবভার্সন। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত সংঘাতে ইন্ধন যোগানো এবং বাংলাদেশের রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়ে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করা; যাতে করে ভারতের ‘চিকেন নেক’এর উপর হুমকি কমানো সম্ভব হয়। দ্বিতীয়তঃ অর্থনৈতিক বা নৌ অবরোধ; যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামকে পঙ্গু করে ফেলা যায়। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ নিজেদের নৌবাহিনীর আক্রমণভাগ গড়তে থাকে; যা কিনা একপ্রকার ডিটারেন্ট। অর্থাৎ আক্রান্ত হলে আক্রমণকারীর এমন ক্ষতিসাধন করা, যাতে করে সে অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৮০এর দশকে এই ডিটারেন্টের চেহারা ছিল মিসাইল বোট স্কোয়াড্রন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পিছনে যেসকল যুক্তি ছিল, তার মাঝে একটা ছিল পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না থাকা। কারণ এদেশের বেশিরভাগ চিন্তাবিদেরাই বাংলাদেশকে ‘ম্যারিটাইম নেশন’ হিসেবে চিন্তা করেছে; যা ইসলামাবাদের নেতৃত্বের চিন্তায় ছিল না। একারণে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ তার নৌবাহিনীকে ‘ব্লু-ওয়াটার নেভি’ হিসেবে দেখতে চেয়েছে। ১৯৭৬ সালেই বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় প্রাক্তন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ‘টাইপ ৬১ স্যালসবুরি-ক্লাস’এর ফ্রিগেট। ২১ বছরের পুরোনো এই ফ্রিগেট ছিল নবীন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে বিরাট একটা পদক্ষেপ। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করা বাণিজ্য জাহাজগুলির নিরাপত্তা দেয়াই ছিল এই ফ্রিগেটের মূল উদ্দেশ্য। অন্যকথায়, বাংলাদেশের সমুদ্রবাণিজ্যের সাথে ফ্রিগেট ক্রয় জড়িত।

অপরদিকে মিয়ানমার তার জন্মের পর থেকেই নিজেদের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে যুদ্ধরত। তাই তাদের নিরাপত্তা চিন্তার মাঝে অভ্যন্তরীণ শৃংখলাই ছিল সবার উপরে। এক্ষেত্রে নৌবাহিনীর গুরুত্ব ছিল খুবই কম। তবে তাদের ১৪’শ কিঃমিঃএর বিশাল সমুদ্র সৈকতের নিরাপত্তা এবং দূরবর্তী অঞ্চলের (মূলতঃ রাখাইন রাজ্য এবং দক্ষিণের আন্দামান সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের) সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে মিয়ানমার বড় সংখ্যক প্যাট্রোল বোট এবং পরিবহণ বা লজিস্টিকস জাহাজ যোগাড়ে মনোযোগী হয়। অর্থাৎ তাদের চিন্তায় দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সবচাইতে বড় হুমকি ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন; পার্শ্ববর্তী দেশের নৌবাহিনী নয়।

সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে হলেও নৌশক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চিত হয়েছিলেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ চীন থেকে 'টাইপ ০৫৩এইচ১' ফ্রিগেট 'ওসমান' কেনে। যদিও বাংলাদেশ নৌবাহিনী আরও আগ থেকেই এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তাদের মিসাইল বোটগুলিতে ব্যবহার করছিলো, তথাপি ফ্রিগেটে এই ক্ষেপণাস্ত্র বহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে বন্দর থেকে অনেক দূরের টার্গেটে হামলা করার সক্ষমতা চলে আসে। এর বিরুদ্ধে মিয়ানমার নৌবাহিনীর কোন জবাব ছিলো না।

নিজেদের দুর্বলতাকে বুঝতে পারা - ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০

তবে বাংলাদেশের জন্মের পরপরই মিয়ানমার সরকারকে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর শক্তির সামনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। প্রথমবারের মতো তারা রাখাইন উপকূলে বাংলাদেশের ফ্রিগেট দেখতে পেলো ১৯৭৬ সালে; যদিও তখন পর্যন্ত সেটার গুরুত্ব অতটা গভীর ছিল না। তবে পরিস্থিতি পাল্টে গেলো যখন রাখাইন প্রদেশে মুসলিম জনগণের উপরে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হলো। ১৯৭৮ সালের শুরুতেই রাখাইনে সামরিক অভিযানের প্রেক্ষিতে প্রায় ১ লক্ষ মুসলিম জনগণ শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এপ্রিল-মে নাগাদ বাংলাদেশ মিয়ানমারের উপরে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করলেও তাতে কাজ হয়নি। অবশেষে ৯ই জুলাই মিয়ানমার বাংলাদেশের শান্তি প্রস্তাব মেনে নিয়ে শরণার্থীদের ফেরত নিতে রাজি হয়। যদিও এই কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গুরুত্ব সরাসরি দেখানো যাবে না, তথাপি শান্তি প্রতিষ্ঠার মাত্র তিনদিন আগে ৬ই জুলাই যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের দ্বিতীয় ব্রিটিশ ফ্রিগেট ‘আলী হায়দার’ অন্তর্ভুক্ত করে, তা উল্লেখ করতেই হয়।

সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে হলেও নৌশক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চিত হয়েছিলেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় তৃতীয় ব্রিটিশ ফ্রিগেট ‘আবু বকর’। এই ফ্রিগেটগুলিতে খুব একটা শক্তিশালী অস্ত্র না থাকলেও বিভিন্ন কারণে এগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ; যেমন - দীর্ঘ সময় সমুদ্রে অবস্থান করে কমান্ড এন্ড কন্ট্রোলের কাজ করা, শক্তিশালী দূরপাল্লার রাডারের মাধ্যমে শত্রুর বিমান এবং জাহাজের উপরে নজরদারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের মাধ্যমে শত্রুর রাডার এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা দেয়া, এবং সর্বোপরি শক্তিশালী ১১৩মিঃমিঃ এবং ৪০মিঃমিঃ কামানের মাধ্যমে গোলাবর্ষণ করা। এই জাহাজগুলির ‘স্ট্রাইকিং পাওয়ার’ হিসেবে ১৯৮৩ সালে যুক্ত হয় চীনা ৪টা ‘টাইপ ০২৪’ মিসাইল বোট; যেগুলির একেকটা বহণ করছিলো ২টা করে ‘এসওয়াই-২’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; যা ‘সিল্কওয়ার্ম’ নামেও পরিচিত ছিল। সোভিয়েত ‘পি-১৫ টারমিট’এর চীনা সংস্করণ এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইরান পারস্য উপসাগরে ১৯৮৭ সালে ব্যাপক সফলতার সাথে ব্যবহার করেছিল। প্রায় নিয়মিতভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ১’শ কিঃমিঃএর বেশি দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল। ইরানের প্রয়োগ চীনা এই ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যে বাজার তৈরি করে; যার মাঝে বাংলাদেশও ছিল। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত ৪টা ‘টাইপ ০২১’ মিসাইল বোট সংগ্রহ করে; এগুলি একেকটা বহণ করছিলো ৪টা করে ‘সিল্কওয়ার্ম’। ১৯৮৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রধান ডিটারেন্ট ফোর্স ছিল নৌবাহিনীর এই মিসাইল বোটগুলি; যা কিনা যেকোন নৌ অবরোধ তুলে নেবার বিরুদ্ধে আক্রমণের দ্বায়িত্ব নেবে। ৩টা ফ্রিগেট এবং ৮টা মিসাইল বোটকে (মোট ২৪টা ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার) আরও সহায়তা দেয়ার জন্যে ১৯৮৫ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ২টা প্যাট্রোল ক্রাফট তৈরি করে নিয়ে আসা হয়। ‘মেঘনা’ এবং ‘যমুনা’ নামের এই জাহাজগুলিতে ছিল শক্তিশালী ৫৭মিঃমিঃ কামান। একই বছরে চীন থেকে নিয়ে আসা হয় ‘টাইপ ০৩৭’এর দু’টা সাবমেরিন চেজার ‘দুর্জয়’ এবং ‘নির্ভয়’।

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সরকার চীন থেকে তাদের প্রথম গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট কেনে। ১৯৮৭ সালে চীনা নৌবাহিনীতে কমিশন পাবার পর ১৯৮৮ সালে ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতার সাথে অংশ নেয় ‘শিয়াংতান’ জাহাজটা; যা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ‘ওসমান’ নামে কমিশনপ্রাপ্ত হয়। ‘টাইপ ০৫৩এইচ১’ ক্লাসের এই জাহাজগুলিতে ছিল ৬টা করে ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্র। যদিও বাংলাদেশ নৌবাহিনী আরও আগ থেকেই এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তাদের মিসাইল বোটগুলিতে ব্যবহার করছিলো, তথাপি ফ্রিগেটে এই ক্ষেপণাস্ত্র বহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে বন্দর থেকে অনেক দূরের টার্গেটে হামলা করার সক্ষমতা চলে আসে।

২০০৪ সালে মিয়ানমারের নিজস্ব শিপইয়ার্ডে তৈরি '৫-সিরিজ'এর মিসাইল বোট '৫৬২'। ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে আবারও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এসময়েই মিয়ানমার সরকার তাদের নৌবাহিনীকে নতুন করে তৈরি করার লক্ষ্য স্থির করে।


মিসাইল যুগে মিয়ানমারের ‘নতুন’ নৌবাহিনী - ১৯৯১-২০০৮

১৯৯১ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে আবারও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং যথারীতি মিয়ানমার সরকার বিচারবুদ্ধিহীনভাবে সাধারণ মুসলিম জনগণের উপরে হামলা করে। এতে রাখাইনের কমপক্ষে আড়াই লক্ষ মুসলিম শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় নেয়। এই শরণার্থী ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের উত্তেজনা তুমুল আকার ধারণ করে। তবে ১৯৭০এর দশকের মতো কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। কাজেই উত্তেজনার প্রশমন হয় না এবং পুরো ১৯৯০এর দশক জুড়েই রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পিছনে পশ্চিমা ইন্ধন থাকার সম্ভাবনাকে এড়ানো সম্ভব নয়। ১৯৮৯ সালে বেইজিংএর তিয়ানানমেন স্কয়ারের ঘটনার পর পশ্চিমাদের সাথে চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেই হিসেবেই চীনকে বিচলিত করতে মিয়ানমারের রাখাইনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকতে পারে। এসময়েই মিয়ানমার সরকার তাদের নৌবাহিনীকে নতুন করে তৈরি করার লক্ষ্য স্থির করে। আর তাদেরকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে চীন। মিয়ানমার ১৯৯১-৯২ সালের মাঝে চীন থেকে ৯টা ‘টাইপ ০৩৭’ সাবমেরিন চেজার ডেলিভারি পায়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীও ১৯৮৫ সালে এরকম দু’টা জাহাজ কিনেছিল। এই জাহাজগুলি ২টা করে শক্তিশালী টুইন ৫৭মিঃমিঃ কামান দ্বারা সজ্জিত ছিল এবং একইসাথে এদের ৩০ নটিক্যাল মাইল গতি প্রথমবারের মতো মিয়ানমার নৌবাহিনীকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও যুদ্ধ সক্ষমতা দেয়।

তবে মিয়ানমার এতেই স্বস্থির নিঃস্বাস ফেলতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে তখন ছিল ৮টা মিসাইল বোট; যার মাঝে ‘টাইপ ০২৪’ বোটগুলি (১৯৮৩) ২টা করে এবং ‘টাইপ ০২১’ বোটগুলি (১৯৮৮) ৪টা করে ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতো। শুধু উপকূলীয় অঞ্চলের জন্যে উপযুক্ত হলেও ৩৫ থেকে ৩৮ নটিক্যাল মাইল গতিবেগের দ্রুতগামী বোটগুলি ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান ডিটারেন্ট। এর সাথে ১৯৮৯ সালে যুক্ত হয়েছিল ফ্রিগেট ‘ওসমান’; যা আরও ৬টা ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করছিলো। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে ছিল ৩০টা ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার; যার বিপক্ষে মোতায়েন করার মতো কিছুই ছিল না মিয়ানমারের। এই কঠিন বাস্তবতা এড়াতে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সালের মাঝে চীন থেকে ৬টা ‘হাউশিন-ক্লাস’এর মিসাইল বোটের ডেলিভারি পায় মিয়ানমার। ৬৩ মিটার লম্বা ৪’শ ৭৮ টনের এই জাহাজগুলি প্রকৃতপক্ষে ‘টাইপ ০৩৭’ সাবমেরিন চেজারের এন্টি-শিপ ভার্সন; যা ৪টা করে ১’শ ২০কিঃমিঃ পাল্লার ‘সি-৮০২’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজকে বাধা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। মাত্র ৬ বছরের মাঝে ‘টাইপ ০৩৭’এর ৯টা জাহাজের সাথে এই ৬টা ‘হাউশিন-ক্লাস’এর জাহাজ মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে বেশ খানিকটা শক্তিশালী করে ফেলে। এসময় তাদের হাতে ছিল নতুন যুগের ২৪টা ‘সি-৮০২’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার। অপরদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে এসময়ে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ‘মধুমতি’ নামের একটা লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট তৈরি করে আনা হয় এবং ৫টা মাইনসুইপার কেনা হয় ব্রিটেন ও চীন থেকে। ‘মধুমতি’ জাহাজটার পাল্লা প্রায় ৬ হাজার নটিক্যাল মাইল; এতে রয়েছে ৫৭মিঃমিঃ শক্তিশালী কামান। আর ‘রিভার-ক্লাস’এর মাইনসুইপারগুলি ব্রিটিশরা ডিজাইন করেছিল এমনভাবে, যাতে করে এগুলি গভীর সমুদ্রে লম্বা সময় ধরে থাকতে পারে। এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গভীর সমুদ্রে অবস্থান করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং একইসাথে শত্রুপক্ষের মাইন অপসারণের সক্ষমতা তৈরি হয় প্রথমবারের মতো। তবে নিজেদের নৌবাহিনীর আক্রমণ সক্ষমতা আগের জায়গায়ই থেকে যায়। ১৯৯১ সালের ঘুর্নিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এবং কিছু নতুন প্রতিস্থাপনের পর তাদের ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চারের সংখ্যা তখন ৩২; যার সবগুলিই পুরোনো জেনারেশনের ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্র।

তবে মিয়ানমার কিন্তু থেকে থাকেনি। তারা নিশ্চিতভাবে বুঝেছিল যে বাংলাদেশের সাথে তাদের সংঘাত আবারও হতে পারে। ২০০০ সালের পর থেকে মিয়ানমার তার উপকূলে হাইড্রোকার্বন খোঁজার বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিল। ২০০৬ সাল নাগাদ ১৩টা বিদেশী কোম্পানি মিয়ানমারে ৩৩টা প্রকল্পে কাজ করছিলো। একইসাথে রাখাইনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে সংঘর্ষে বিদেশী ইন্ধনের কারণে মিয়ানমার নিরাপত্তা নিয়ে বিচলিত ছিলো। তাই তারা তাদের নৌবাহিনীর জন্যে চাইছিলো ‘ব্লু ওয়াটার’ সক্ষমতা। অর্থাৎ আরও বড় জাহাজ; যা কিনা গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ৪টা ফ্রিগেটকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে এবং সমুদ্রে আরও বেশি সময় ধরে অবস্থান করতে পারবে। বিদেশী কোম্পানিগুলিও সেটাই চাইছিলো। কারণ তারা চাইছিলো না যে মিয়ানমারের নৌ-দুর্বলতার কারণে তাদের বিপুল বিনিয়োগ ভেস্তে যাক। মিয়ানমারের টার্গেট ছিল কর্ভেট অথবা ফ্রিগেট। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের সবচাইতে বড় সুবিধা ছিল তাদের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের অভিজ্ঞতা। তারা বহু বছর আগে থেকেই নিজস্ব প্যাট্রোল বোট তৈরি করে আসছিলো; যদিওবা সেগুলি ছিল অভ্যন্তরীণ নদীপথ এবং উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে; অন্য কোন নৌবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্যে নয়।

ব্রিটিশ সামরিক ম্যাগাজিন ‘জেনস ইন্টেলিজেন্স রিভিউ’এর ২০০০ সালের এক প্রতিবেদনে একটা ধারণা দেয়া হয় যে, কিভাবে মিয়ানমার তার প্রথম কর্ভেটগুলি তৈরি করতে পেরেছিল। ১৯৯০এর দশকে মিয়ানমারের সরকার চীন থেকে রিটায়ার করা পুরোনো দু’টা বা তিনটা ‘টাইপ ০৬৫’ কামান সজ্জিত এন্টি-সাবমেরিন ফ্রিগেট অথবা অপেক্ষাকৃত নতুন ‘এসওয়াই-১’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত ‘টাইপ ০৫৩’ গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু এগুলির জন্য চীন তাদেরকে যে ‘স্পেশাল বন্ধুত্বের’ মূল্য দিতে বলেছিল, তা মিয়ানমার সরকার দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাই মিয়ানমার চীনের সহায়তায় ৩টা ৭৭ মিটারের জাহাজ ক্রয় করে; যেগুলির হাল ছাড়া কিছুই তারা কেনেনি। এই হালগুলিকে নিজেদের শিপইয়ার্ড পর্যন্ত নিয়ে এসে হালের উপরের সুপারস্ট্রাকচারের অংশ তারা নিজেরা তৈরি করে। জাহাজের প্রধান অস্ত্র থাকে ইতালিতে তৈরি দু’টা ‘অটো মেলারা’ ৭৬মিঃমিঃ অটোম্যাটিক কামান। অস্ত্র অবরোধকে বাইপাস করে তৃতীয় কোন পক্ষকে ব্যবহার করে তারা ইউরোপ থেকে এই কামানগুলি আমদানি করে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে মধ্যম ক্যালিবারের আটোম্যাটিক কামান চলে আসে। যদিও ‘জেনস’ তাদের রিপোর্টে ধারণা করে যে, জাহাজগুলি সম্ভবতঃ ইস্রাইলি ইলেকট্রনিক্সে সজ্জিত করা হবে, তথাপি পরবর্তীতে এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া কঠিন হয়। ২০০১ সালে কোনরূপ ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াই ১১’শ টনের প্রথম জাহাজটা ‘আনাওরাহতা’ নামে কমিশনিং করা হয়। তবে জাহাজের অস্ত্র এবং ইলেকট্রনিক্স নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলতে থাকে। কারণ অস্ত্র অবরোধের মাঝে তারা কোনটা কখন পাবে, সেটা নিশ্চিত ছিল না কখনোই। পরবর্তীতে কামানগুলির পেছনেরটা সরিয়ে ফেলা হয় এবং ৪টা চীনা ‘সি-৮০২’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করা হয়। একইসাথে এতে চীনে নির্মিত সার্চ এবং ট্র্যাকিং রাডার যুক্ত করা হয়। স্বল্প পাল্লার বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবস্থাও এতে রাখা হয় বলে অনেকে অনুমান করেন। দুই বছর পর ২০০৩ সালে দ্বিতীয় কর্ভেট ‘বায়িনং’ কমিশনিং করা হয়। তবে এই জাহাজের অস্ত্র ও ইলেকট্রনিক্স নিয়েও চলতে থাকে এক্সপেরিমেন্ট; এবং শিগগিরই এতে যুক্ত করা হয় ৪টা ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র।

১৯৯০এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একধাপ এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৮ সালের মার্চে তারা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সর্বশেষ প্রযুক্তির একটা ফ্রিগেট অর্ডার করে; যা কিনা বঙ্গোপসাগরে ভাসমান যেকোন যুদ্ধজাহাজকে মান্ধাতার আমলের বানিয়ে ফেলার জন্যে যথেষ্ট। ২০০১ সালে এই জাহাজটা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে যুক্ত হলেও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির উদাহরণ হিসেবে জাহাজটাকে ডিকমিশন করা হয়। এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আক্রমণ করার সক্ষমতা আগের অবস্থানেই থাকে; কিন্তু মিয়ানমারের এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত থাকে। ২০০০এর প্রথম দিকে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে দু’টা কর্ভেটে যোগ হয় মোট ৮টা ‘সি-৮০২’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ১৯৯০এর দশকে নিজেদের জাহাজ তৈরির সক্ষমতা তারা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। তারা ‘৫-সিরিজ’এর ৪৭ মিটার লম্বা ১১টা জাহাজ তৈরি করে ফেলে ২০০৪ সাল নাগাদ। এর মাঝে ৩টা জাহাজকে তারা সজ্জিত করে ৪টা করে ‘সি-৮০২’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা। ২০০৮ সাল নাগাদ আরও ৬টা বোট যুক্ত হয়; যার মাঝে ২টা বোটে ২টা করে ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র দেয়া হয়। অর্থাৎ ২০০৮ সাল নাগাদ মিয়ানমারের নৌবাহিনীতে আরও ১৬টা জাহাজ-ধ্বংসী ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার যুক্ত হয়; যা তাদের মোতায়েনকৃত মোট ‘সি-৮০২’ লঞ্চারের সংখ্যা ৪৮-এ নিয়ে যায়।

অপরদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ২০০০ সালের পর থেকে কিছু পদক্ষেপ নেয়; যা তাদের গভীর সমুদ্রে অবস্থান করার সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে। ব্রিটেন থেকে ৫টা পুরোনো ‘আইল্যান্ড-ক্লাস’ অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল যুক্ত হয় ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মাঝে। সাড়ে ১২’শ টনের এই জাহাজগুলি খুব বেশি অস্ত্র বহণ না করলেও এগুলি গভীর সমুদ্রে এক মাসেরও বেশি সময় অনায়াসে সার্ভেইল্যান্স চালাতে সক্ষম; যা কিনা ক্ষেপণাস্ত্রবাহী স্বল্প পাল্লার জাহাজগুলিকে সুযোগ বুঝে মোতায়েন করার সুবিধা করে দেয়। এবং একইসাথে ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যে টার্গেট খুঁজে দিতে সহায়তা দেয়। এছাড়াও ২০০৮ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ‘বঙ্গবন্ধু’ জাহাজটাকে পুনরায় কমিশনিং করে এবং ২১ বছরের পুরোনো ‘টাইপ ০৫৩এইচ১’ ফ্রিগেট ‘ওসমান’এর ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ৮টা ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপন করে। শুধু তা-ই নয়, নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্রের লাইভ ফায়ারিংএর মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতার জানান দেয়। কাজেই ২০০৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে থাকে ৯টা মিসাইল বোট; যেগুলি মোট ২৬টা ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করছিলো। ‘ওসমান’এর ৮টা ক্ষেপণাস্ত্রসহ মোট ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার ছিল ৩৪টা; যা মিয়ানমারের তুলনায় বেশ খানিকটাই কম। মিয়ানমারের ১১টা মিসাইল বোটে তখন ছিল ৪০টা ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র; কর্ভেট দু’টাতে ছিল আরও ৮টা। প্রায় ১৮ বছরের চেষ্টায় মিয়ানমার নৌবাহিনী কতটুকু এগুলো, তার প্রমাণ পেতে তাদের নৌবাহিনী বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ২০০৮ সালের অক্টোবরের শেষে।

মিয়ানমার নৌবাহিনীর আধুনিক ডিজাইনের ফ্রিগেট 'সিন ফায়ু শিন'; ডিজাইনের দিক থেকে যা সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কারণ জাহাজটাতে সর্বশেষ প্রযুক্তির বিভিন্ন রকমের স্টেলথ বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়িত ছিল; যাতে এই জাহাজ শত্রু রাডারে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা জাহাজ হিসেবে অবির্ভূত হয়। ভারতের সামরিক চিন্তাবিদদের মাঝে অনেকেই মিয়ানমারকে সামরিক সহায়তা দেয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যায়। বিশেষ করে মিয়ানমারের নতুন ফ্রিগেটের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ এয়ার ডিফেন্স রাডার এবং সাবমেরিন খোঁজার সোনার সরবরাহ করার জন্যে বলতে থাকে তারা।

ফ্রিগেট যুগে প্রবেশ - ২০০৮-২০১৫

২০০৭ সাল নাগাদ মিয়ানমার গ্যাস রপ্তানি করে আড়াই বিলিয়ন ডলার আয় করছিলো। ২০০৮ সালে মিয়ানমারের জিডিপি ছিল ২৩ বিলিয়ন ডলার। আর এর বিপরীতে বাংলাদেশের জিডিপি তখন ছিল প্রায় ৯২ বিলিয়ন ডলার। একদিকে গ্যাস বিক্রির অর্থ মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে যেমন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিচ্ছিলো, তেমনি নৌবাহিনীকে ঢেলে সাজানোর কাজটাও তাদের জন্যে বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিল। মিয়ানমারের রাখাইনের উপকূলে ২০০৮এর অক্টোবরের শেষে গ্যাস ড্রিলিং করার জন্যে ৪টা জাহাজ মোতায়েন করে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি ‘দাইয়ু’। মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদেরকে কাভার করছিলো। জায়গাটা বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ থেকে ৫০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। নভেম্বরের ২ তারিখ থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলে যে, জায়গাটা বাংলাদেশের। সমুদ্র সীমানা নির্দিষ্ট না থাকায় কেউই তাদের দাবি ছেড়ে দিতে চায়নি। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ তিনটা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে - ৩৩ বছরের পুরোনো ব্রিটিশ ফ্রিগেট ‘আবু বকর’; লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট ‘মধুমতি’ এবং ‘টাইপ ০৩৭’ সাবমেরিন চেজার ‘নির্ভয়’। আরও কিছু জাহাজ কাছাকাছি ছিলো নিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারকে বলে যে, সংঘাত হলে কোরিয়ার জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে; কাজেই তাদের উচিৎ হবে মিয়ানমার সরকারকে পিছু হঠতে রাজি করানো। অবশেষে এই হুমকিতেই কাজ হলো।

মিয়ানমার নৌবাহিনী বুঝতে পারে যে, ৪৮টা ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার থাকাটাই যথেষ্ট নয়। কারণ সকল সংঘাতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার সুযোগ না-ও হতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়লে নিজেদের ক্ষতিই বেশি হতে পারে। কারণ যুদ্ধ শুরু হলে মিয়ানমার সমুদ্রে তার বিদেশী বিনিয়োগ হারাতো। বাংলাদেশের মূল নৌঘাঁটি চট্টগ্রাম থেকে সংঘাতের স্থান ছিল প্রায় ১’শ ৩০ নটিক্যাল মাইল দূরে। সেই তুলনায় জায়গাটা মিয়ানমারের সিতওয়ে (আকিয়াব) এবং কিউকপিউ থেকে অপেক্ষাকৃত অনেক কাছে ছিল। তথাপি প্রায় এক সপ্তাহ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজগুলি অনায়াসে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিলো; যা কিনা মিয়ানমার নৌবাহিনীকে নতুন কিছু শেখায়। বাংলাদেশের ফ্রিগেট ‘আবু বকর’ কমান্ড শিপ হিসেবে কাজ করেছিলো। অপরদিকে মিয়ানমারের হাতে ‘আনাওরাহতা’ এবং ‘বায়িনং’ কর্ভেটগুলির বাইরে ছিল মিসাইল বোটগুলি, ‘টাইপ ০৩৭’ সাবমেরিন চেজার এবং ৪৭ মিটার প্যাট্রোল ক্রাফট। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, দক্ষিণ কোরিয় ড্রিলিং জাহাজের ক্রুদের ভয় দেখাবার জন্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজগুলির দিবারাত্র সার্ভেইল্যান্সই যথেষ্ট ছিল; তাদেরকে মিসাইল দেখাতে হয়নি। একবার গোলাগুলি শুরু হলে এই জাহাজগুলিই নিখুঁতভাবে মিসাইলের জন্যে টার্গেট খুঁজে দিতো। তখন কেউ চিন্তা করতো না যে মিসাইলগুলি কোথা থেকে ছোঁড়া হয়েছে। সার্ভেইল্যান্স এবং টার্গেট খোঁজার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে মিয়ানমারের চাইতে অনেক এগিয়ে রয়েছে, তা মিয়ানমার হারে হারে বুঝেছিল। ২০০৮ সালের এই ঘটনা একারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে ব্যাপারটা এমন নয় যে, ২০০৮এর আগে মিয়ানমার ফ্রিগেটের গুরুত্ব বোঝেনি। ২০০৮ সালেই মিয়ানমারের শিপইয়ার্ডে পানিতে নামানো নয় তাদের প্রথম নিজস্ব ডিজাইনের ফ্রিগেট। ‘অংজেয়া’ নামে জাহাজটার কমিশনিং হতে লেগে গেছে আরও দুই বছর। তবে এই ফ্রিগেটের ইলেকট্রনিক্স প্রায় কিছুই ছিল না। ২০১২ সালে মিয়ানমার সফরে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তখন ভারতের সামরিক চিন্তাবিদদের মাঝে অনেকেই মিয়ানমারকে সামরিক সহায়তা দেয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যায়। বিশেষ করে মিয়ানমারের নতুন ফ্রিগেটের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ এয়ার ডিফেন্স রাডার এবং সাবমেরিন খোঁজার সোনার সরবরাহ করার জন্যে বলতে থাকে তারা। কারণ ২০১২ সালের এপ্রিলে চীনারা মিয়ানমারকে দু’টা ‘টাইপ ০৫৩এইচ১’ ফ্রিগেট সরবরাহ করে মিয়ানমার নৌবাহিনীর সাথে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর করে। প্রায় সাথেসাথেই এই জাহাজগুলিকে আপগ্রেড করে এতে ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং দূর পাল্লার ‘টাইপ ৫১৭’ ‘এ-ব্যান্ড’এর ভিএইচএফ রাডার সংযুক্ত করা হয়। অপরদিকে ভারত চাইছিলো সেখানে চীনের প্রভাবকে প্রতিস্থাপিত করতে। আর ইতোমধ্যেই প্রচার হয়ে গেছে যে মিয়ানমার নৌবাহিনী আরও দুই খানা ফ্রিগেট পানিতে ভাসিয়েছে; যার মাঝে প্রথমটা, ‘কায়ান সিত্তার’ ২০১৪ সালের মার্চে এবং ‘সিন ফায়ু শিন’ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কমিশনিং করা হয়। উভয় জাহাজই ডিজাইনের দিক থেকে সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কারণ জাহাজগুলিতে সর্বশেষ প্রযুক্তির বিভিন্ন রকমের স্টেলথ বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়িত ছিল; যাতে জাহাজগুলি শত্রু রাডারে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা জাহাজ হিসেবে অবির্ভূত হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মিয়ানমারের তিনটা ফ্রিগেটই ভারতে তৈরি রাডারে সজ্জিত হিসেবে দেখা যায়। ডাচ কোম্পানি ‘সিগনাল’এর কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তৈরি করা ২’শ ৭০কিঃমিঃ পাল্লার ‘এল-ব্যান্ড’এর ‘আরএডব্লিউএল-০২ মার্ক৩’ রাডারগুলি তৈরি করেছে ভারতীয় কোম্পানি ‘ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড’ বা ‘বিইএল’। এই একই রাডার ১৯৯০এর দশকে তৈরি জার্মান নৌবাহিনীর ‘ব্র্যান্ডেনবার্গ-ক্লাস’ ফ্রিগেটে ব্যবহার করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত পুরোনো প্রযুক্তির হলেও এই রাডার এখনও যথেষ্টই কার্যকর; বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে তাদের প্রতিযোগী ধরলে।

একইসাথে ভারত মিয়ানমারের এই তিন জাহাজের জন্যে সাবমেরিন খোঁজার সোনার বিক্রি করে। জাহাজগুলিতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ইতালিতে তৈরি ‘আটো মেলারা সুপার র‍্যাপিড’ ৭৬মিঃমিঃ কামান; যা মিনিটে ১’শ ২০ রাউন্ড গোলা ছুঁড়তে সক্ষম। এর তুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ‘বঙ্গবন্ধু’ জাহাজের ৭৬মিঃমিঃ ‘অটো মেলারা কমপ্যাক্ট’ কামান মিনিটে ৮৫ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। প্রতিপক্ষের জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এতে যুক্ত হয়েছে ডেকয় সিস্টেম এবং তিনটা করে ৩০মিঃমিঃ গ্যাটলিং গান। তিনটা জাহাজেই চীনা নির্মিত ‘সি-৮০২’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বসানো হয়। বিমান প্রতিরক্ষার জন্যে এগুলিতে বসানো হয়েছে অতি স্বল্প (৬কিঃমিঃ) পাল্লার ‘ইগলা’ ক্ষেপণাস্ত্র। জাহাজগুলির ইঞ্জিন হলো ফ্রান্সে তৈরি ‘এসইএমটি পিয়েলস্টিক ১৬ পিএ৬ এসটিসি’, যা মোট ২২ হাজার ৮’শ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। বাংলাদেশের ‘বঙ্গবন্ধু’ জাহাজ থেকে যা ৩৬ শতাংশ বেশি শক্তি দেবে। একারণে ৩ হাজার টনের এই জাহাজগুলির সর্বোচ্চ গতিবেগ বলা হচ্ছে ঘন্টায় প্রায় ৩০ নটিক্যাল মাইল এবং এগুলির পাল্লা হবে প্রায় ৩ হাজার ৮’শ নটিক্যাল মাইল। এছাড়াও জাহাজগুলিতে যুক্ত করা হয়েছে ব্রিটেনে তৈরি ‘সেইলর’ স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সিস্টেম। প্রতিটা জাহাজে রয়েছে হেলিকপ্টার বহণ করার জন্যে হেলিপ্যাড এবং হ্যাঙ্গার।

মিয়ানমার নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র কম নেই। ফ্রিগেটগুলি তৈরির আগেই তাদের কাছে ছিল ৪৮টা ‘সি-৮০২’ লঞ্চার। পাঁচ বছরের মাঝে পাঁচটা ফ্রিগেট এবং ২০১৫ সালে ৪৯ মিটার লম্বা একটা স্টেলথ ডিজাইনের মিসাইল বোট যুক্ত হওয়ায় আরও ৪৪টা ‘সি-৮০২’ লঞ্চার যুক্ত হয় তাদের নৌবাহিনীতে; যা কিনা ২০১৫ সাল নাগাদ মোট ‘সি-৮০২’ লঞ্চারের সংখ্যা নিয়ে যায় ৯২টাতে। ২০০৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নৌবাহিনী অবশেষে মিয়ানমারের দৌড়ের ব্যাপারটা আমলে নিয়েছিল। চীন থেকে অর্ডার করা হয় ‘দুর্জয়-ক্লাস’এর ২টা লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট, যেগুলি মিয়ানমারের ছোট মিসাইল বোটগুলিকে টার্গেট করে অপেক্ষাকৃত ছোট (১’শ ৩০ কেজি ওয়ারহেড) ৩৫কিঃমিঃ পাল্লার ‘সি-৭০৪’ ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। ‘টাইপ ০২১’ মিসাইল বোটগুলিতে ৪টা করে ‘সি-৭০৪’ দ্বারা ‘সিল্কওয়ার্ম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিস্থাপিত করা হয়। ব্রিটেন থেকে ‘ক্যাসল-ক্লাস’এর দু’টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল কিনে এনে সেগুলিকে ৪টা করে ‘সি-৭০৪’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটা করে ৭৬মিঃমিঃ কামান দ্বারা সজ্জিত করে কর্ভেটে রূপান্তর করা হয়। ২টা ‘টাইপ ০৫৩এইচ২’ ফ্রিগেট কেনা হয় চীন থেকে; যেগুলি ১’শ ২০কিঃমিঃ পাল্লার ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দু’টা ‘হ্যামিল্টন-ক্লাস’ কাটার বা ফ্রিগেট কেনা হলেও সেগুলি মূলতঃ ট্রেনিং জাহাজ হিসেবেই সার্ভিসে যুক্ত করা হয়। তাই এগুলিতে নতুন করে কোন অস্ত্র সজ্জিত করা হয়নি; বরং দ্রুত নাবিকের সংখ্যা বৃদ্ধি করাটাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালের মাঝেই বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় চীন থেকে তৈরি করে আনা দু’টা ‘টাইপ ০৫৬’ কর্ভেট; যেগুলি ৪টা করে ১’শ ৮০কিঃমিঃ পাল্লার ‘সি-৮০২এ’ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত। ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে মোট ৮২টা জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার যুক্ত হয়েছে; যার মাঝে রয়েছে ৮টা ‘অটোম্যাট’, ২৪টা ‘সি-৮০২’, ১০টা ‘সিল্কওয়ার্ম’, ৩২টা ‘সি-৭০৪’ এবং ৮টা ‘সি-৮০২এ’। এছাড়াও চীন থেকে অর্ডার করা হয় আরও দু’টা ‘টাইপ ০৫৬’ কর্ভেট এবং প্রথমবারের মতো খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে অর্ডার করা হয় দু’টা ‘দুর্জয়-ক্লাস’ লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট; যেগুলি ক্ষেপণাস্ত্রের স্থলে বহণ করছে ৬টা করে সাবমেরিন ধ্বংসী টর্পেডো টিউব। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো এন্টি-সাবমেরিন জাহাজ তৈরি করলো বাংলাদেশ। এর মূল কারণ হলো, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তাদের প্রথম সাবমেরিন অর্ডার করেছিল এবং শোনা যাচ্ছিলো যে, মিয়ানমারও সাবমেরিন পেতে চাইছে। চীনের কাছ থেকে ২টা ‘টাইপ ০৫৩এইচ৩’ পাওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল; যেগুলি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতাকে, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সক্ষমতাকে আবারও একধাপ এগিয়ে নেয়। ২০১৯-২০ অবধি এই ফ্রিগেট, কর্ভেট এবং এলপিসিগুলির ডেলিভারি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদশ নৌবাহিনী মিয়ানমার নৌবাহিনী থেকে কিছুটা পিছিয়েই থাকে।

তবে মিয়ানমারের ফ্রিগেটগুলির রাডার এবং সোনার তাদেরকে এমন কিছু সক্ষমতা দিয়েছে, যা তাদেরকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। এটা ছিল ভারতের তৃতীয় নিরাপত্তা চিন্তা - প্রক্সি হিসেবে মিয়ানমারকে ব্যবহার। বাংলাদেশ সাবমেরিন পেতে চাইছে জানার পর থেকেই ভারত উঠেপড়ে লাগে মিয়ানমারের জাহাজগুলিকে এন্টি-সাবমেরিন সোনার দিয়ে সজ্জিত করতে। এর আগে বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের নীতি ফেলে দিতে বাধ্য হওয়ায় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভারতের দ্বিতীয় নিরাপত্তা চিন্তা অর্থনৈতিক অবরোধকে এড়াতে নিজেকে শক্তিশালী করতে থাকায় এই তৃতীয় চিন্তাতে যেতে বাধ্য হয় ভারত।

২০২০ সাল। মিয়ানমারের প্রথম সাবমেরিন; যা তারা পায় ভারত থেকে। মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্যে কাউকেই যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের সন্মুখীন হতে হয়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র জানে যে, মিয়ানমারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ এখন ভারত। এহেন দ্বিমুখী নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো মিয়ানমারে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা ও রাখাইনে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি; এবং একইসাথে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নৌ-উত্থান নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের নৌ-আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে।

ত্রিমাত্রিক মিয়ানমার নৌবাহিনী - ২০০৬-২০২০

২০১৬ সালে আবারও মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংঘাত শুরু হয়; যেখানে পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্সের ইন্ধন থাকার কথা বলেছেন অনেকেই। মিয়ানমারে অনেকেই বিশ্বাস করতে থাকে যে, বাংলাদেশ পশ্চিমা প্রক্সি হয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যের উপরে হামলার কাজ করেছে। তবে মিয়ানমারের সরকার এই সুযোগে ১০ লক্ষের বেশি মুসলিমকে রাখাইন প্রদেশ থেকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। একইসাথে হাজারো মানুষকে হত্যা করে গণহত্যার উদাহরণ তৈরি করে তারা। পরবর্তীতে মিয়ানমারের নোবেল প্রাইজ জয়ী গণতান্ত্রিক নেতা অং সান সু কি আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। রাখাইনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি জানতো যে, মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর উপর হামলা এই পরিস্থতির জন্ম দেবে। যাদেরকে হত্যা করা হবে এবং শরণার্থী বানানো হবে, তারা তো তাদেরই ভাই-বোন-সন্তান। কাজেই এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, মিয়ানমার বাহিনীর উপর হামলা পশ্চিমা ইন্ধনেই হয়েছে। এই ঘটনা মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মাঝে সম্পর্ককে স্বায়ীভাবে নষ্ট করে এবং বঙ্গোপসাগরে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে ইন্ধন যোগায়; যদিও মিয়ানমার ২০১৬ সালের আগে থেকেই নিজেকে অস্ত্রসজ্জিত করছিলো।

২০০৬ সালে মিয়ানমারকে ভারত ২টা ‘ব্রিটেন-নরমান বিএন-২ আইল্যান্ডার’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান দেয়। ব্রিটেনে তৈরি এই বিমানগুলি ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যবহার করছিলো অনেক বছর ধরে। পুরোনো এই বিমানগুলি মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে ভারত। পরের বছর তারা আরও দু’টা বিমান সরবরাহ করে। এই বিমানগুলির মাধ্যমে মিয়ানমারের নৌবাহিনী প্রথমবারের মতো আকাশ থেকে সার্ভেইল্যান্স করা এবং তাদের জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলির জন্যে টার্গেট খোঁজার সক্ষমতা পায়। অপরদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে প্রথমবারের মতো দু’টা ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান (ডর্নিয়ার ডিও-২২৮এনজি) যুক্ত হয় ২০১৩ সালে। এর আগে দু’টা ‘আগুস্টা এডব্লিউ ১০৯’ হেলিকপ্টার যুক্ত হয় ২০১১ সালে। ২০২০ সালে মিয়ানমার নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় অস্ট্রিয়ায় নির্মিত ‘শাইবেল এস-১০০ ক্যামকপ্টার’ ম্যারিটাইম সার্ভেইল্যান্স ড্রোন। এই ড্রোনগুলি মিয়ানমারের ফ্রিগেট এবং কর্ভেটগুলির টার্গেট খুঁজে পাবার সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও ২০১৭ সালে মিয়ানমার বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ‘এটিআর-৪২’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান। এগুলিও মিয়ানমার নৌবাহিনীকে সার্ভেইল্যান্সের মাধ্যমে সহায়তা দিতে পারবে। বিমান সংযোজন ছিল নৌবাহিনীর দ্বিতীয় মাত্র। তবে তৃতীয় মাত্রাটা ছিল কৌশলগত দিক থেকে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সাবমেরিন যুক্ত হয় ২০১৬ সালে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের মাঝে অনেকেই এটা মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলাদেশ চীন থেকে সাবমেরিন কেনায় দিল্লীর মাথাব্যাথা শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশের নৌবাহিনী থেকে ভারতের নৌবাহিনী কমপক্ষে ৫০ গুণ শক্তিশালী হবার পরেও বাংলাদেশের সাবমেরিনকে নিয়ন্ত্রণ করতে মিয়ানমারকে সাবমেরিন খোঁজার সোনার এবং এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো সরবরাহ করতে উঠেপড়ে লাগে ভারত। একইসাথে নিজেদের বাহিনী থেকে রিটায়ার করা রুশ নির্মিত ‘কিলো-ক্লাস’এর সাবমেরিন মিয়ানমারকে দেয়ার জন্যে অগ্রগামী হয় ভারত। ২০২০ সালে মিয়ানমার নৌবাহিনীতে ‘কিলো-ক্লাস’এর সাবমেরিন যুক্ত হবার মাধ্যমে মিয়ানমার নৌবাহিনী ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয়, মিয়ানমারে ভারতের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে চীনও মিয়ানমারকে ‘টাইপ ০৩৫জি’ সাবমেরিন সরবরাহ করে ২০২১ সালে।

 


এর আগে ২০১৯ সালে মিয়ানমার নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় সাড়ে ১২ হাজার টনের উভচর মিশনের জাহাজ ডক ল্যান্ডিং শিপ বা এলপিডি ‘মোয়াত্তামা’। জাহাজটা তৈরি করে দক্ষিণ কোরিয়া; যে কিনা যুক্তরাষ্ট্রের খুবই কাছের বন্ধু দেশ। মিয়ানমার নৌবাহিনীর সবচাইতে বড় এই জাহাজ ২৫টা ট্যাংক এবং ৫’শ ২০ জন সেনা বহণ করতে পারে এবং একাধিক হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং এবং বহণের সুবিধা রয়েছে এতে। ‘মোয়াত্তামা’ জাহাজটাকে প্রথমবারের মতো মিশনে পাঠানো হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। জাহাজটা রাখাইন প্রদেশের কিউকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দরে নোঙ্গর করে। পরে জাহাজটা সিতওয়ের উত্তরে মায়ু নদীর মোহনায় আহ নগু মাও জেটিতে সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়। সুউচ্চ এবং দুর্গম আরাকান পর্বতের কারণে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ বাকি মিয়ানমার থেকে প্রায় আলাদা। তাই মিয়ানমারের বাকি এলাকা থেকে রাখাইনে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর মূল পদ্ধতিই হলো সমুদ্রপথ। ‘মোয়াত্তামা’ জাহাজ এখন মিয়ানমার নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ। এতে রয়েছে অত্যাধুনিক কমিউনিকেশন সরঞ্জাম। পশ্চিমারা যা-ই বলুক না কেন, তাদের তৈরি করা সামরিক কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি মিয়ানমারের হাতে পোঁছানোটা তাদের গোপন ইচ্ছারই প্রতিফলন। এই জাহাজে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি ‘ব্যারেট ৪০৫০’ এইচএফ ট্রানসিভার, ইতালিতে তৈরি ‘এলমান আরএক্সএইচ-৮১৬১আর’ এমএফ-এইচএফ রিসিভার, চীনা কোম্পানি ‘হাইটেরা’র তৈরি ‘এমআর-৯৫৬০’ ভিএইচএফ ট্রানসিভার এবং জাপানে তৈরি ‘আইকম আইসিএম-৭১০’ এমএফ-এইচএফ ট্রানসিভার।

‘মোয়াত্তামা’ জাহাজটাকে সমর্থন দিচ্ছে পুরোনো ১২টা ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং মিয়ানমারের নিজস্ব তৈরি ৬টা এলসিএম (৫৬ মিটার লম্বা; ৪টা ট্যাংক বহণ করে) এবং ২০টা এলসিটি (২৯ মিটার লম্বা; ২টা ট্যাংক বহণ করে)। এলসিএম-গুলি তৈরি করা হয় ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মাঝে। আর এলসিটি-গুলি তৈরি করা হয় ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মাঝে। এই জাহাজগুলি মূলতঃ মার্কিন ল্যান্ডিং ক্রাফটের অনুসারে ডিজাইন করা হয়েছে। এই ডিজাইনের বিশেষত্ব হলো, এই বোটগুলি বড় উভচর জাহাজের পিছনের ডকের ভিতরে ঢুকে যায় এবং জাহাজের ভেতর থেকে সামরিক গাড়িগুলি সরাসরি এই বোটগুলিতে উঠে যায়। যেকারণে এগুলির সুপারস্ট্রাকচার থাকে ছোট এবং নিচু; গাড়ি ওঠাবার সুবিধা থাকে বেশি। মোটকথা উভচর সক্ষমতা তৈরিতে মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রকেই অনুসরণ করেছে। ‘মোয়াত্তামা’ জাহাজ থেকে সেনা, গাড়ি এবং রসদ দ্রুত উপকূলে নামাবার জন্যে এই ল্যান্ডিং ক্রাফটগুলি সহায়তা করবে। অপরদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ল্যান্ডিং ক্রাফটগুলি চওড়া এবং সুপারস্ট্রাকচার বেশ বড় এবং উঁচু। এগুলিকে ডিজাইন করা হয়েছে উপকূলের একস্থান থেকে অন্যস্থানে সৈন্য নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

ইস্রাইলের কাছ থেকে কিছু ‘সুপার ভোরা’ প্যাট্রোল ক্রাফটও কিনেছে মিয়ানমার। ২০১৬ সালে যুক্ত হয়েছে কর্ভেট ‘তাবিনশোয়েতি’; যেটাতে ৪টা ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় রাডার, সোনার এবং এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো। ২০২০ সালে তারা যুক্ত করেছে ২টা সাবমেরিন চেজার; যেগুলির একেকটা ৬টা করে ভারতীয় ‘শায়েনা’ এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো দ্বারা সজ্জিত; বাংলাদেশের সাবমেরিন যেগুলির টার্গেট। ২০২০ সালে যুক্ত হয়েছে স্টেলথ ডিজাইনের ২য় ৪৯ মিটার লম্বা মিসাইল বোট; যেগুলিতে বহণ করা হচ্ছে ৪টা করে ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১৭ এবং ২০২১ সালে যুক্ত হয়েছে দু’টা ওপিভি।


মিয়ানমার নৌবাহিনী - একটা বিশ্লেষণ

এখনও মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটা বড় অংশ হলো প্যাট্রোল বোট এবং লজিস্টিকস জাহাজ। ১৩টা মিসাইল বোটের সাথে রয়েছে মোটামুটিভাবে বড় আকারের ৪০টা প্যাট্রোল ক্রাফট। ছোট আকারের বোট রয়েছে বহু। এগুলি দেখিয়ে দেয় মিয়ানমারের ১৪’শ কিঃমিঃ উপকূল এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের বাস্তবতা। কিন্তু ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান, ম্যারিটাইম ড্রোন, সাবমেরিন, ডক ল্যান্ডিং শিপ, ফ্রিগেট, কর্ভেট, মিসাইল বোট, ইত্যাদি সকল কিছুই গত তিন দশকের মাঝে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমার নৌবাহিনীতে। ১৯৮০এর দশকের সেই মিয়ানমার নৌবাহিনী এখন আর নেই; যখন বাংলাদেশের নৌবাহিনীর ধারেকাছেও ছিল না তাদের সক্ষমতা। তখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং বিশাল উপকূলে আইন শৃংখলা বজায় রাখাই ছিল মিয়ানমার নৌবাহিনীর মূল কাজ। অপরদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রথম থেকেই ফ্রিগেট, কর্ভেট, ওপিভি এবং অন্যান্য দূর পাল্লার জাহাজের উপরে নির্ভর করেছে। কারণ বাংলাদেশের নৌ-চিন্তাতে সমুদ্র বাণিজ্যের নিরাপত্তা সবসময় প্রাধান্য পেয়েছে।

কিন্তু ১৯৯০এর দশক থেকেই মিয়ানমার নৌবাহিনী বাংলাদেশকে টার্গেট করে নিজেদের ডেভেলপ করতে থাকে। রাখাইন প্রদেশে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে বাংলাদেশ পশ্চিমাদের প্রক্সি হয়ে ইন্ধন যোগাচ্ছে - এটা মিয়ানমারের অনেকেই বিশ্বাস করে। এছাড়াও ২০০৮ সালের নৌ-উত্তেজনা দেখিয়ে দেয় যে, মিয়ানমার তার সমুদ্র সম্পদ আহরণের নিরাপত্তা দিতেও সমধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ এটা তাদের অর্থনীতিতে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা যোগাচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও চাইছে মিয়ানমারের নৌবাহিনী শক্তিশালী হোক। একারণে ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়া মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে সক্ষমতার দিক থেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। চীন মিয়ানমারকে অনেক অস্ত্রই দিয়েছে; কিন্তু সেগুলি বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। অপরদিকে ভারতের দেয়া সাবমেরিন, রাডার, সোনার, এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো, ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দেয়া ডক ল্যান্ডিং শিপ মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে ‘ব্লু-ওয়াটার নেভি’ হিসেবে গড়ে দিয়েছে। মিয়ানমারের নৌবাহিনীর লক্ষ্য হলো বঙ্গোপসাগরে বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের একপ্রকারের খিচুরি।

পশ্চিমা দেশগুলি মিয়ানমারকে নামে বেনামে বিভিন্নভাবে অস্ত্র, ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের তৈরি করা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সুবিধা নিয়েই মিয়ানমার এগুলি করেছে। মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্যে কাউকেই যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের সন্মুখীন হতে হয়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র জানে যে, মিয়ানমারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ এখন ভারত। এহেন দ্বিমুখী নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো মিয়ানমারে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা ও রাখাইনে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি; এবং একইসাথে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নৌ-উত্থান নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের নৌ-আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে কাছের বন্ধু দক্ষিণ কোরিয়া চুপিসারে মিয়ানমারের জন্যে সাড়ে ১২ হাজার টনের বিশাল ডক ল্যান্ডিং শিপ তৈরি করে দিয়েছে; যা এখন রাখাইনে গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ করছে। এবং একইসাথে এই জাহাজের মাধ্যমে মিয়ানমার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের উপর সত্যিকারের হুমকি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই জাহাজের কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি এসেছে অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, জাপান এবং চীন থেকে। মিয়ানমার নৌবাহিনীর বড় যুদ্ধজাহাজগুলির বেশিরভাগই এখন ইতালিতে তৈরি ৭৬মিঃমিঃ কামান, ভারতে তৈরি রাডার, সোনার ও টর্পেডো এবং ব্রিটেনে তৈরি স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি দ্বারা সজ্জিত। ভারত আবার এই রাডার তৈরি করেছে ডাচ কোম্পানি ‘সিগনাল’ (বর্তমানে থালেস)এর লাইসেন্স নিয়ে। অথচ বাংলাদেশ চীন থেকে সাবমেরিন কেনার পর সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় যেন ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিল! চীনের সহায়তায় কক্সবাজারের পেকুয়াতে বাংলাদেশের ‘সাবমেরিন ফ্লীট হেডকোয়ার্টার্স’ তৈরিও ভারত ও পশ্চিমারা পছন্দ করেনি। কারণ বাংলাদেশের হাতে ‘সাবমেরিন ফ্লীট’ বা শক্তিশালী নৌবাহিনী পশ্চিমাদের বঙ্গোপসাগর নিয়ন্ত্রণ-চেষ্টার বিরুদ্ধে। এখন তারা চাইছে মিয়ানমারকে প্রক্সি হিসেবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে; যাতে করে কোন একটা সময় মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধ লাগিয়ে বাংলাদেশের সামরিক শক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলা যায়। একারণেই তারা রাখাইনের মুসলিম শরণার্থীদের নিজেদের ভূমিতে ফেরত যাবার বিরোধী। তারা চাইছে এই মানুষগুলিকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে অমানুষিক পরিবেশে রেখে দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাবভার্সনে ব্যবহার করতে এবং মিয়ানমারের সাথে সংঘর্ষে জ্বালানি হিসেবে পোড়াতে। চিন্তাহীন মিয়ানমারও না বুঝেই সেই পথেই হাঁটছে। ১৯৯১ সাল থেকে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটাই কাজ - বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা; যা কিনা বঙ্গোপসাগরে পশ্চিমা আদর্শিক শক্তিদের লক্ষ্যের বাস্তবায়নে একটা অধ্যায়।



সূত্রঃ


‘BNS Abu Bakar - Ex RN Frigates (BNS UF,AB,AH)’ in Global Security (https://www.globalsecurity.org/military/world/bangladesh/bns-abu-bakr.htm)

‘Rohingya exodus in 1978: A history of systematic eviction’ by Probir Kumar Sarker, Dhaka Tribune, 31 August 2021

‘Myanmar and Israel develop military pact’ by William Ashton in Jane's Intelligence Review, 01 March 2000

‘Myanmar Navy Latest Corvette UMS Tabinshwehti Likely Operational’ in Navy Recognition, 15 November 2016

‘Daewoo to explore more gas in Myanmar’ in Mint, 06 April 2007

‘Bangladesh and Burma send warships into Bay of Bengal’ in The Guardian, 04 November 2008

‘Myanmar stops disputed gas exploration -Bangladesh officials’ in Reuters, 06 November 2008

‘Navy decommissions first two frigates’ in Dhaka Tribune, 22 January 2014

‘Upsurge in Indo-Myanmar Naval Cooperation’ by Rear Admiral (ret) Sushil Ramsay in SP’s Naval Forces, Issue 4, 2013

‘Tự đóng chiến hạm tàng hình cỡ lớn, CNQP Myanmar đã vượt mặt VN’ in SOHA, 11 December 2015 (in Vietnamese) (https://soha.vn/quan-su/tu-dong-chien-ham-tang-hinh-co-lon-cnqp-myanmar-da-vuot-mat-vn-20151211001902439.htm)

‘RAWL-02’ in Radar Tutorial (https://www.radartutorial.eu/19.kartei/07.naval2/karte038.en.html)

‘LW 08 “Jupiter”’ in Radar Tutorial (https://www.radartutorial.eu/19.kartei/07.naval/karte005.en.html)

‘Update: Myanmar Navy commissions its first LPD amphibious assault ship’ in Janes, 27 December 2019

‘Myanmar Navy has commissioned seven new warships and one submarine’ in Navy Recognition, 26 December 2020

‘Myanmar Navy commissions Type 35B Ming-class submarine’, in Naval Technology, 27 December 2021

‘Myanmar Navy commissions Type 035 Ming-class submarine’ in Naval Today, 27 December 2021

‘75th Anniversary Tatmadaw (Navy): Commissioning Ceremony of Navy Vessels’ in MITV, 24 December 2022

‘Myanmar gets India's maritime aircraft’ in Hindustan Times, 12 May 2007

‘Bangladesh Navy Do228NG emerges from its stable’ in Scramble, 20 October 2021

‘S-100 Camcopter Operating Onboard of Myanmar Navy's Ships’ in Defense Studies, 27 July 2020 (http://defense-studies.blogspot.com/2020/07/s-100-camcopter-operating-onboard-of.html)

‘Myanmar: Fact-finding mission identifies businesses linked to the military that is accused of serious rights violations; some companies respond’ in Business and Human Right Resource Centre, 13 February 2020 (https://www.business-humanrights.org/en/latest-news/myanmar-fact-finding-mission-identifies-businesses-linked-to-the-military-that-is-accused-of-serious-rights-violations-some-companies-respond/)

‘Chinese Supply Submarines to Bangladesh (Gravitas)’ in WION, 19 November 2016 (https://www.youtube.com/watch?v=hc-J96QmJ_o)

‘India’s World- Chinese submarines and Sino-Bangladesh defence ties’ in SansadTV, 22 November 2016 (https://www.youtube.com/watch?v=2BOqaLnIZ6s)

‘Bangladesh in Submarine Era : Amb. Muhammad Zamir and Maj. Gen. Abdur Rashid’ in EkattorTV, 29 March 2017 (https://www.youtube.com/watch?v=FpFPcYOUaOw&t=14s)

‘The Myanmar military are using Australian radios to commit atrocities’ in Justice for Myanmar, 18 October 2021 (https://www.justiceformyanmar.org/stories/the-myanmar-military-are-using-australian-radios-to-commit-atrocities)

‘What Myanmar’s New Amphibious Ship Says About Its Naval Ambitions’ by Mohammad Rubaiyat Rahman in The Diplomat, 09 November 2019

‘India gifts a submarine to Myanmar, gains edge over China’ in The Hindustan Times, 21 October 2020

‘With an eye on China, India gifts submarine to Myanmar’ in Nikkei Asia, 22 October 2020

‘Myanmar Navy boosts amphibious capability, adds UAV’ in Janes, 03 January 2019

‘Myanmar Navy flagship supports troop buildup in western Rakhine’ in Janes, 06 June 2022

‘Landing Craft, Mechanized and Utility - LCM/LCU’ in America’s Navy, updated 17 Jan 2019 (https://www.navy.mil/Resources/Fact-Files/Display-FactFiles/Article/2171588/landing-craft-mechanized-and-utility-lcmlcu/)

‘Myanmar Navy commissions seven new vessels’ in Mizzima, 29 December 2017

‘Myanmar Navy Commissions Some Asset’ in Defense Studies, 27 December 2016 (http://defense-studies.blogspot.com/2016/12/myanmar-navy-commissions-some-asset.html)

‘Myanmar Strengthens Navy’ in TurDef, 23 January 2023

‘Australian, Italian Chinese & Japanese biz provided comms systems for Myanmar Navy’s UMS Mottama warship’ by Justive for Myanmar, 24 May 2023 (https://twitter.com/JusticeMyanmar/status/1661314128991092737)

14 comments:

  1. তাহলে কি বাংলাদেশ নৌবাহিনী তার ফ্রিগেট আর সাবমেরিন এর জন্য শুধু শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে চেয়ে আছে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর করনিয় কি বা যা যা করছে তা কতটুকু যৈক্তিক?

    ReplyDelete
    Replies
    1. কিছু উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথম উদাহরণ - থাইল্যান্ড চীন থেকে সাবমেরিন অর্ডার করেছে। থাইল্যান্ডের কিছু ভদ্রলোক (জেনেশুনেই অথবা অন্য কারুর উপদেশে) চীনে তৈরি এই সাবমেরিনে জার্মান এমটিইউ ইঞ্জিন ব্যবহারের কথা বলেছে; যেই ইঞ্জিনগুলি জার্মান সাবমেরিনগুলিতে ব্যবহৃত হয়। ইইউ কিন্তু ১৯৮৯ সালের পর থেকে চীনের উপরে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে। কাজেই যখন সাবমেরিন তৈরি করার এক পর্যায়ে এমটিএই-এর কাছ থেকে ইঞ্জিন চাওয়া হলো, তখন তারা বললো যে, তারা তাদের সর্বশেষ প্রযুক্তির জিনিস চীনের হাত হয়ে থাইল্যান্ডের কাছে বিক্রি করবে না। কারণ চীনে অস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে ইইউএর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এখন থাইল্যান্ডের সাবমেরিন প্রকল্প মাঝামাঝি আটকে রয়েছে।

      দ্বিতীয় উদাহরণ - তুরস্ক পাকিস্তানের কাছে ৩০টা 'টি-১২৯' এটাক হেলিকপ্টার বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু এতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়। এই হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের জয়েন্ট ভেঞ্চার। যুক্তরাষ্ট্র সেই ক্ষমতাটাকে ব্যবহার করে তুরস্কের হেলিকপ্টার রপ্তানি বন্ধ করে দেয়; যদিও পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে এমন কোন কাজ নেই পাকিস্তান করেনি। অথচ তুরস্ক যখন ফিলিপাইনের কাছে একই হেলিকপ্টার বিক্রি করতে চাইলো, তখন সেটা যুক্তরাষ্ট্র কোন বাধাই দেয়নি। এর কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এমন অস্ত্র দিতে চায়না, যা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। তবে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে এমন সকল অস্ত্রই যুক্তরাষ্ট্র সমর্থ করবে। একই সূত্রে ভিয়েতনাম যখন রাশিয়া থেকে ফ্রিগেট কিনেছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্র পছন্দ করেছে; কারণ সেগুলি চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। জাপানও ফিলিপাইনকে অস্ত্র দিচ্ছে; কারণ সেগুলি চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে।

      এখন পশ্চিমা কোন দেশ ভারতের বিরুদ্ধে যেতে চায়? অথবা অন্য কথা বলতে গেলে, ভারত যদি বাধা দেয়, সেই বাধা পেরিয়ে খুব বেশি পশ্চিমা দেশ নেই যারা বাংলাদেশের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বিক্রি করবে। আগে ভারত নিশ্চিত হবে যে সেই অস্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না; তবেই ভারত সেটাতে গ্রীন সিগনাল দেবে। ভারত এই মুহুর্তে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র; যেকারণে ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রাইল থেকে সর্বশেষ প্রযুক্তির অস্ত্র পাচ্ছে; যেগুলি চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে।

      বাংলাদেশ তার কেনা অস্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না - এই মুচলেকা দিয়ে অস্ত্র কেনাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

      Delete
    2. থাইল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ কোথায় সেটা বুঝে উঠতে পারলাম না কিংবা চীনা সাবমেরিন এ জার্মান ইঞ্জিন নিলে বাকিদেরই বা কি সমস্যা। যাইহোক তুরস্ক তো বাংলাদেশকে টাইগার মিসাইল দিয়েছে এটা ভারতের বিরুদ্বে ব্যবহৃত হবেনা তারই বা গ্যারান্টি কি, কেহ ইহাতে উচ্যবাচ্য করলো না। তবে টাইগার মিসাইল গেমচেঞ্জার কিনা সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। শোনা যায় ফ্রান্স বাংলাদেশ কে রাফাল আর লা ফায়াত ফ্রিগেট অফার করছিল। আবার ব্রিটিশ রা টাইপ ৩১ আর টাইফুন দিতে চাইছিল। সে হিসাব কষলে যদি এদের কোনোটাও আসত তাহলে ডাউনগ্রেডেদ হয়ে আসত। এহিসাবে বাংলাদেশ এর হাতে ভারী সমরাস্ত্র বলতে চীন বিনা গতি নেই। আবার চীন থেকেও নিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এর ভয় আছে। রাশিয়ার ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে অভস্ত্য নয় বাহিনীগুলো (বিমানবাহিনী বাদে). আর রাশিয়ানদের আফটার সেলস সার্ভিস নিয়েও ঝামেলা করে। তুরস্ক আর ইতালি একটা পথ হতে পারে কিন্তু সেক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপার থাকতে পারে।

      Delete
    3. প্রথমতঃ থাইল্যান্ডের উদাহরণটা ভারত-কেন্দ্রিক নয়; যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক। যুক্তরাষ্ট্র এমন কোন সাবমেরিন মালাক্কা প্রণালির কাছাকাছি চায় না, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন, মালয়েশিয়ার সাবমেরিন ফ্রান্সের তৈরি; আর ইন্দোনেশিয়ার সাবমেরিন জার্মান এবং কোরিয়ান। কাজেই এগুিকে যুক্তরাষ্ট্র কোন হুমকি হিসেবে দেখে না। কারণ এগুলি স্পেয়ার পার্টস এবং মেইনটেন্যান্সের জন্যে পশ্চিমাদের উপরে নির্ভরশীল থাকবে।

      দ্বিতীয়তঃ তুরস্কের টাইগার ক্ষেপণাস্ত্র তুরস্কের নিজস্ব জিনিস। এখানে পশ্চিমা দেশের কোন হাত নেই। তুরস্ক এই ব্যাপারটাই করতে চাইছে তাদের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে। যেমন, তারা নিজেদের টারবোশ্যাফট ইঞ্জিন ডেভেলপ করেছে হেলিকপ্টারের জন্যে; একটা টারবোফ্যান ইঞ্জিন ডেভেলপ করছে ফাইটার বিমানের জন্যে; একটা ডিজেল ইঞ্জিন ডেভেলপ করছে নিজেদের ট্যাংকের জন্যে। আবার ট্যাঙ্কের আর্মার নিয়েও এখনও ঝামেলা রয়েছে। কারণ তুরস্ক এখনও আর্মার বাইরে থেকে আমদানি করে। ফিনল্যান্ডের আর্মার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি কিনতে গিয়ে অনেক কাহিনীও হয়েছে। মোটকথা পশ্চিমারা মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলে; কিন্তু তারা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় শতভাগ। তার দ্বিমুখী নীতি স্পষ্ট।

      বাকি যে উদাহরণগুলি আপনি দিয়েছেন রাশিয়া বা চীনকে কেন্দ্র করে, সেগুলির বাস্তবতা এরূপই। এগুলি প্রমাণ করে যে, নিজেদের ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোন উপায় নেই। ভারি শিল্পের আউটপুট হলো বিভিন্ন মেকানিক্যাল কম্পোনেন্ট - ইঞ্জিন, মোটর, ট্রান্সমিশন, ইত্যাদি। বিএমটিএফ-কে জুতার ফ্যাক্টরি বানাবার প্রয়োজন নেই। জুতা আরও অনেকেই বানাতে পারবে। কিন্তু হেভি মেশিনারি সকলে পারবে না।

      বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির কমতি নেই। কিন্তু কোন কোম্পানিকেই জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কোন পণ্য তৈরি করতে দেখা যায় না। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। দক্ষিণ কোরিয়ার ডিফেন্স কোম্পানি কিন্তু স্যামসাং, দাইয়ু, হুনদাই - এগুলিকে আমরা চিনি কনজিউমার গুডস মেকার হিসেবে।

      বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনী কিছু ইলেকট্রনিক্স জিনিসের দিকে গিয়েছে বাইরের নিয়ন্ত্রণকে বাইপাস করার জন্যে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে নিজস্ব জিনিস ডেভেলপ করার পিছনে যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি।

      Delete
    4. সেক্ষেত্রে একটা কিন্তু থেকে যায়। বাংলাদেশ এ সমরাস্ত্র শিল্প গড়ে ঊঠতে গেলে পশ্চিমারা বাধা দিবে না তার গ্যারান্টি বা কি? উত্তর কোরিয়া আর ইরান এক্ষেত্রে উদাহরন হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ যেহেতু সমরাস্ত্র শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ন নয় (জাহাজ বানাতে পারলেও রাডার, ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার, মিসাইল, গোলাবারুদ, ইঞ্জিন ইত্যাদি বিদেশ হতে আনতে হয়) সেক্ষত্রে প্রয়োজনিয় বিষয়াদির সোর্সিং করতে অসুবিধা হতে পারে। বেসরকারী খাতে সমরাস্ত্র উতপাদনের নজির নেই আর সরকার তা দিবেও কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অনেক কোম্পানি ছোটোখাটো ড্রোন নিয়ে কাজ করে কিন্তু সামরিক বাহিনিকে দেখিনা এতে কাজ করতে। নৌবাহিনির তাও সক্ষমতা আছে জাহাজ বানানোর। যেহেতু ফ্রিগেট প্রোগ্রাম বিলম্বিত, আর শর্তের বেড়াজাল আছে, তাই সবচেয়ে ভাল হয় যা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে তা দিয়ে কিছু একটা করে। বলা যেতে পারে এ মুহুর্তে বাংলাদেশের কাছে ১৫০০ টনের স্বাধীনতা ক্লাসের জাহাজ আছে। যদি চীন প্রযুক্তি দিয়ে থাকে (বা না দিলে সেটা নেয়া) তাহলে ইহাকে ভিত্তি ধরে মডিফিকেশন, এক্সটেনশন, করে ২৫০০ টনের কাছাকাছি নিয়ে মাল্টিরোল ফ্রিগেট বানাতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান ফ্রিগেট ফ্লীটের বয়স হয়েছে। তারঊপর নৌবাহিনির এয়ার ডিফেন্স আর এন্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের যাচ্ছেতাই অবস্থা। যা করার দ্রুত করতে হবে। এতদিন তো মিয়ান্মার আকাশসীমা পার করেছে, পরে মাঝ সমুদ্রে ঢুকে হুংকার দিবে। নৌ ও বিমান বাহিনি কে অতি দ্রুত কৌশল্গত সমরাস্ত্র দিতে হবে।

      Delete
    5. প্রথমতঃ সক্ষমতা না থাকার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশকে অন্যদের উপরে নির্ভরশীল করতে হবে। বরং এর অর্থ হলো, নিজেদের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। তুরস্ক একসময় যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল থাকতে থাকতে একসময় বুঝতে পেরেছে যে নিজেদের সামরিক শিল্প গড়ে তোলা ছাড়া গতি নেই। তাই তারা বিভিন্ন সামরিক ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করেছে।

      দ্বিতীয়তঃ আপনি নিজেকে শক্তিশালী করবেন আর বাকিরা এইটা মেনে নেবে, এটা চিন্তা করাটা বোকামি। কারণ তারা জানে যে, আপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি মানেই হলো তাদের প্রভাব কমতে থাকা। তারা বাধা দেবেই। আপনাকে আপনার নিজের কথা চিন্তা করতে হবে।

      তৃতীয়তঃ জাহাজ নির্মাণ বা বিমান নির্মাণ বা গাড়ি নির্মাণ কোন বেসিক ইন্ডাস্ট্রি নয়। এগুলি এসেম্বলি ইন্ডাস্ট্রি। আপনাকে কম্পোনেন্ট তৈরি করতে হবে - যেমন, স্টীল ও এলুমিনিয়াম ইন্ডাস্ট্রি, ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন, মোটর, কম্প্রেসর, ইলেকট্রনিক্স আইটেম, গ্লাসের আইটেম, রাবারের আইটেম, প্লাস্টিকের আইটেম, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, মেকানিক্যাল প্রসেস ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি। এগুলি হেভি ইন্ডাস্ট্রির অংশ। এগুলি না তৈরি করলে আপনি জাহাজ বা ট্যাংক বা বিমান নির্মাণের জন্যে অন্যের উপরে নির্ভরশীল থাকতে হবে।

      Delete
  2. মিয়ানমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এত সমরাস্ত্র কিভাবে জোগাড় করতে পারছে সেটা মোটামুটি ধারনা করা গেল এই ব্লগ থেকে। অসাধারন বিশ্লেষন! নিশ্চয়ই অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে এই আর্টিকেল তৈরী করতে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। এখানে যা দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ নয়। বিমান বাহিনীর কিছুই এই আলোচনায় নেই।

      মিয়ানমার বিমান বাহিনী পাকিস্তান থেকে 'জেএফ-১৭' বিমান কিনেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ধ্বংস করার জন্যে। কারণ 'সিপরি'র হিসেবে এগুলির জন্যে ৩০টা 'সি-৮০২একে' ক্ষেপণাস্ত্র কেনা হয়েছে ২০১৮-১৯ সালে। এই বিমানগুলি মিয়ানমারের পাথেইন বিমান ঘাঁটিতে দেখা গেছে; যা কিনা বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি। বাংলাদেশের পূর্বগামী বেশিরভাগ বাণিজ্যে জাহাজকে যেতে হয় আন্দামান দ্বীপ এবং মিয়ানমারের উপকূলের মাঝ দিয়ে। এই সমুদ্র করিডোর দু'শ কিঃমিঃএর কম চওড়া। এই করিডোরের খুব কাছেই এই পাথেইন বিমানঘাঁটি; যেখানে মোতায়েন করা হয়েছে 'জেএফ-১৭' বিমান + 'সি-৮০২একে' ক্ষেপণাস্ত্র। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের নৌবাণিজ্যের প্রতি সবচাইতে বড় হুমকি এই 'জেএফ-১৭'। কারণ ভারত হয়তো কাজটা নিজেরা না করে মিয়ানমারকে দিয়েই করাতে বেশি আগ্রহী থাকবে।

      আর এরকম একটা সংঘর্ষে প্রথমেই পশ্চিমারা বাংলাদেশকে অস্ত্র দিতে চাইবে; যা এতদিন তারা দিতে চায়নি। কারণ তাদের আসল কাজ হয়ে গেছে - বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে জড়ানো। তখন ভারতও বাংলাদেশের অস্ত্র কেনায় বাধা দেবে না; কারণ ভারতও তখন খুশি হবে যে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এমনকি ভারত বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয়কেই অস্ত্র দিতে চাইতে পারে!

      Delete
    2. শোনা যায় যে মিয়ানমার তাদের জে এফ ১৭ নিয়ে বেশ বিপদে আছে। বিমানের টেকনিকাল, স্ট্রাকচারাল আর ক্যাপাবিলিটিতে সমস্যা আছে????

      Delete
    3. শোনা কথার উপর বিশ্বাস করে আপনি কি আপনার সামরিক ডেভেলপমেন্ট বন্ধ রাখবেন? মিয়ানমার তার সামরিক সরঞ্জাম কতটা ঠিকমতো মেইনটেইন করতে পারছে, সেটা তো বাংলাদেশের নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা তৈরির মাপকাঠি হতে পারে না।

      Delete
  3. অনেক দিন পর লিখেছেন। অনেক কিছু তুলে এনেছেন। আচ্ছা ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পরে বৃহৎ রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে নৌ অবরোধ দেয়ার নজির আছে? আর সামান্য পেয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই বাংলাদেশের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। নৌ অবরোধ দেয়াত অনেক পরের ব্যাপার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই নৌ অবরোধের প্রথাটা অনেক বেশি করে শুরু হয়েছে। এর আগে বরং এটা কম ছিলো। কারণ বেশিরভাগ ছোট রাষ্ট্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বড় রাষ্ট্রের কলোনি ছিল। অর্থাৎ বেশিরভাগ ছোট রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৪৫ সালের পর।

      ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তানের উপর নৌ অবরোধ আরোপ করেছিল। বিশেষ করে করাচি এবং চট্টগ্রাম বন্ধ অচল করে ফেলার মাধ্যমে। ১৯৮০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপরে অবরোধ আরোপ করেছিল। ১৯৯০ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের উপরে অবরোধ আরোপ করেছিল। উত্তর কোরিয়ার উপর অবরোধ এখনও আছে; যা কিনা ১৯৫০এর দশক থেকেই চলছে।

      এমনকি কিছু ছোট দেশও একে অপরের উপর অবরোধ আরোপের চেষ্টা করেছে। এই উদাহরণটা অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের - ১৯৩৩ সালের। পেরু এবং কলম্বিয়ার মাঝে লেটিসিয়া যুদ্ধে পেরু এবং কলম্বিয়া চেষ্টা করেছিল একে অপরের যুদ্ধজাহাজকে আমাজন নদীর মুখে আটকে দিতে। যদিও আমাজন নদী ব্রাজিলের তথাপি এই সংঘাত হচ্ছিলো ব্রাজিলের নিয়ন্ত্রণে থাকা নৌসীমানার বাইরে।

      Delete
  4. মিয়ানমারের এই অগ্রগতিতে বাংলাদেশের এখন কি করা উচিত এবং যে কৌসলে এগুচ্ছে তা কতটুকু সন্তোষজনক??? বা আর কি কি করা বা কোন পদক্ষেপে যাওয়া উচিত?

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা; বিশেষ করে নিজেদের হেভি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা। অন্যান্য দেশ থেকে সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে এসে নিজেদের সামরিক উৎপাদন বৃদ্ধি করা। একইসাথে মিয়ানমারকে এক হাত দূরে রাখা এবং কোন প্রকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সামরিক সংঘাতে জড়িত হওয়া থেকে দূরে থাকা। পরের লেখাটাও এই লেখার সাথে সম্পর্কিত।

      Delete