Thursday 16 February 2023

তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে ত্রাণ সহায়তার কূটনীতি

১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩

তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিশ্বের বহু দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকেরা সকলেই একমত যে, সহযোগিতার এই উদাহরণগুলি কতদিন এই দেশগুলির মাঝে সম্পর্ককে উষ্ণ রাখবে, তা বলা মুস্কিল। পশ্চিমা চিন্তার উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সেকুলার বিশ্বব্যবস্থায় সকল রাষ্ট্রই জাতীয় স্বার্থকে সকলকিছুর উপরে স্থান দেয়; যেখানে মানবতার দিকগুলি সর্বদাই থাকে পিছনের সাড়িতে।

তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যেই ৪২ হাজার ছাড়িয়েছে। তুরস্ক সরকারের হিসেবে ৮০ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে, আর ১০ লক্ষের বেশি মানুষ অস্থায়ী তাঁবুতে বাস করছে। প্রচন্ড শীত ও বৃষ্টির মাঝে উদ্ধারকাজ যেমন কঠিন হয়েছে, তেমনি বেঁচে যাওয়া মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণও হয়েছে চ্যালেঞ্জিং। বিশ্বের বহু দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে তুর্কি সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি’ জানাচ্ছে যে, ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের মোট ১’শটা দেশ তুরস্ককে সহায়তা দিতে চেয়েছে। এই মুহুর্তে তুরস্কের মাটিতে ৮১টা দেশের ৯ হাজার ৪’শ ৫৬ জন উদ্ধার ও ত্রাণকর্মী কাজ করছে। এছাড়াও আরও ৭’শ ৪৭ জন ত্রাণকর্মী আসার পথে রয়েছে। এই সহায়তা কতটা মানবতার জন্যে, আর কতটা জাতীয় স্বার্থ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে, সেটা নিরূপণ করা না গেলেও এই সহায়তার সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথাগুলি আলোচনায় আসা শুরু হয়েছে। একইসাথে রাজনৈতিক কারণেই আবার সিরিয়ার অভ্যন্তরে ক্ষয়ক্ষতি ও উদ্ধারকাজ নিয়ে আলোচনা প্রায় নেই বললেই চলে।

তুরস্কের ভূমিকম্পে জরুরি সহায়তা দিয়েছে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। উভয় দেশই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ন্যাটোর সদস্যপদ পাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সদস্যপদ পাবার পথে বাধা হয়েছে তুরস্ক। তুরস্ক বলছে যে, এই দুই দেশ তুরস্কের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী বামপন্থী সংগঠন ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘পিকেকে’কে বিভিন্নভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে; যদিও ‘পিকেকে’কে শুধু তুরস্ক নয়, পশ্চিমা দেশগুলিও সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়েছে। কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক অনেককেই নরডিক এই দেশগুলি আশ্রয় দিয়েছে এবং সেখান থেকে তারা রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এদের মাঝে কেউ কেউ আবার সুইডেনের পার্লামেন্ট সদস্যও হয়েছে। তুরস্ক চাইছে যে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক ১’শ ৩০ জনকে এই দেশগুলি তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করুক। এখন পর্যন্ত তুরস্কের দাবি ফিনল্যান্ড তুরস্কের শর্ত মানার ক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়েছে; তবে সুইডেন পিছিয়ে রয়েছে।

‘ইউরোনিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুরস্কের দুর্যোগে সহায়তাদানের পর আঙ্কারার পররাষ্ট্রনীতিতে এর প্রভাব কতটুকু পড়বে, তা নিয়ে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে মতবিরোধ রয়েছে। ফিনল্যান্ডের তুর্কি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ ওজান ইয়ানার ‘ইউরোনিউজ’কে বলছেন যে, ভূমিকম্পে তুরস্কের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে সামনের বেশ অনেকদিন তুরস্কে অন্য কোন ইস্যু নিয়ে কথা বলা যাবে না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়া থেকে সুইডেনকে বঞ্চিত করার তুর্কি যেকোন পরিকল্পনাকে তুর্কি জনগণ ভূমিকম্প থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেবার প্রয়াস হিসেবেই দেখবে। অপরদিকে সুইডেনের ‘স্টকহোম ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর পল লেভিন মনে করছেন যে, ভূমিকম্প তুর্কি নেতা রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের চিন্তাকে পরিবর্তন করাতে পারবে না। কারণ ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকাজে ধীরগতিকে ঘিরে তুরস্কে যথেষ্ট পরিমাণে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এমতাবস্থায় জনগণের ক্রোধকে ক্ষমতাসীন দলের উপর থেকে সরাতে এরদোগান হয়তো আবারও সুইডেনের বিরুদ্ধাচরণে সোচ্চার হবেন। এমনকি খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত হলে তিনি নির্বাচনের দিনও পরিবর্তন করতে পারেন।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’ বা ‘সিএফআর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সিরিয়ার অভ্যন্তরের রাজনীতিকে এই ভূমিকম্প যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে। সিরিয়ায় ভূমিকম্পের সবচাইতে বড় আঘাতটা এসেছে ইদলিব অঞ্চলে; যার অনেকটাই যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং এখন তা বিদ্রোহী গ্রুপগুলির হাতে রয়েছে। এখানে আবার তুর্কি সেনারা সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকারি বাহিনী আর বিদ্রোহী গ্রুপগুলির মাঝে বাফার জোন তৈরি করেছে। এতকাল তুরস্কের সাথে শুধুমাত্র একটা সীমান্ত রাস্তার মাধ্যমে ইদলিবের লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে পারছিল। সিরিয় সরকার এই অঞ্চলে কার কাছে ত্রাণ পৌঁছাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। সিরিয়াতে তুরস্ক বাশার সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক সিরিয়ার সরকারের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ত্রাণকর্মীদের হিসেবে সিরিয়ায় নিহত সাড়ে ৩ হাজার মানুষের মাঝে শুধু ইদলিবেই ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ২২’শর বেশি মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে সিরিয়াতে ৫৩ লক্ষ মানুষ বর্তমানে গৃহহারা।

এদিকে কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ১৩ই ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সংস্থার ত্রাণ কর্মকান্ডের প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস জানিয়েছেন যে, সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলির নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার সুবিধার্থে সিরিয়ার বাশার সরকার তিন মাসের জন্যে তুরস্কের সাথে আরও দু’টা সীমান্ত সংযোগ চালু করার অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ রাশিয়া এবং চীন ত্রাণ কর্মকান্ডকে বাধা দেয়নি; যদিও ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, কিছুদিন আগ পর্যন্তও রাশিয়া বলেছে যে, ইদলিবে ত্রাণ পৌঁছাবার জন্যে একটা সীমান্ত রাস্তাই যথেষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মিডিয়া ‘দ্যা মিডিয়া লাইন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইইউএর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক বেশ খানিকটাই শীতল যাচ্ছিলো। কিন্তু ভূমিকম্পের সহায়তা হিসেবে ইইউএর ২০টা দেশ ২৯টা উদ্ধারকারী দল এবং ৫টা মেডিক্যাল দল পাঠিয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের মাঝেও টানাপোড়েন চলছিল। ওয়াশিংটন তুরস্কে দেড়’শ উদ্ধারকারী দল এবং ৭৭ টন যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছে। ইস্রাইলের সাথেও তুরস্কের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পার হয়েছে। তবে ইস্রাইল তুরস্কে ৪’শ সদস্যের বিশাল উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে। জেরুজালেমের ‘হিব্রু ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ইয়োনাটান ফ্রীম্যান বলছেন যে, জরুরি সহায়তা দেয়ার ব্যাপারগুলি একটা রাষ্ট্রের সক্ষমতাকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রভাবও বৃদ্ধি করে। এই সহায়তাগুলি নিঃশর্ত হলেও এর মাধ্যমে দু’টা রাষ্ট্রের জনগণের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়। তবে বিশ্লেষকেরা সকলেই একমত যে, সহযোগিতার এই উদাহরণগুলি কতদিন এই দেশগুলির মাঝে সম্পর্ককে উষ্ণ রাখবে, তা বলা মুস্কিল। ১৯৯৯ সালে তুরস্কের ভূমিকম্পের পর গ্রিস সহায়তা দিয়েছিল; যার ফলশ্রুতিতে বেশ কয়েক বছর দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা কমেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সমস্যাগুলি আবারও সামনে চলে আসে। পশ্চিমা চিন্তার উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সেকুলার বিশ্বব্যবস্থায় সকল রাষ্ট্রই জাতীয় স্বার্থকে সকলকিছুর উপরে স্থান দেয়; যেখানে মানবতার দিকগুলি সর্বদাই থাকে পিছনের সাড়িতে।

No comments:

Post a Comment