Sunday 5 February 2023

বেলুন কান্ড ও এর সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক ফলাফল

০৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের বিশাল বেলুনকে অতিক্রম করছে মার্কিন বিমান বাহিনীর 'এফ-২২' যুদ্ধবিমান। মার্কিন গোয়েন্দা বিমানগুলি যখন নিয়মিতভাবেই চীনের কাছাকাছি ঘুরে চীনাদের অস্বস্তির মাঝে ফেলছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের বেলুনের অবাঞ্ছিত প্রবেশকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়; যা চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমান্বয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যের দিকেই নির্দেশ করে।

মার্কিন আকাশসীমায় চীনের তৈরি বিশাল একটা বেলুনের প্রবেশকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন যে, বেলুনটা সর্বপ্রথম ২৮শে জানুয়ারি প্রায় ৬০ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে আলাস্কার আকাশে ঢোকে। এর তিনদিন পর কানাডার আকাশসীমায় চলে গেলেও ৩১শে জানুয়ারি তা আবারও যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে প্রবেশ করে। এরপর পুরো যুক্তরাষ্ট্রের উপর দিয়ে ওড়ার পরে ৫ই ফেব্রুয়ারি আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে বেলুনটাকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত করা হয়। মার্কিন কর্মকর্তারা এটাকে গোয়েন্দা বেলুন বলে আখ্যা দিচ্ছেন। আর চীনারা বলছে যে, বেলুনটা ছিল আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহের জন্যে তৈরি; যা কিনা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চলে গিয়েছে। ‘সিএনএন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বেলুনটা ভূপাতিত হবার আগে পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনার উপর দিয়ে উড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো’র এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংএর প্রফেসর ইয়াইন বয়েড ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, বেলুনটা খুব সম্ভবতঃ আবহাওয়ার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছিল না। কারণ আবহাওয়া বেলুনের আকৃতি অনেক ছোট হয়। এটা বিশ্বাস করাটা কঠিন যে, চীনারা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি বাতাসের তাপমাত্রা বা চাপ মাপার চেষ্টা করবে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’র প্রাক্তন কর্মকর্তা ট্রেসি ওয়াল্ডার মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘এমএসএনবিসি’কে বলছেন যে, এই বেলুন খুব সম্ভবতঃ ছবি তোলার জন্যে পাঠানো হয়নি। কারণ চীনের বেশকিছু গোয়েন্দা স্যাটেলাইট রয়েছে, যেগুলি হাই রেজোলিউশনের ছবি তুলতে পারে। এই বেলুন হয়তো ইলেকট্রনিক সিগনালস ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করছিল। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে তেজষ্ক্রিয়তা কতটুকু বা আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারের কর্মকান্ড কেমন, এগুলি জানতে হলে স্যাটেলাইটের চাইতে আরও কম উচ্চতায় উড়তে হবে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল ব্যারি ম্যাকাফরে ‘এমএসএনবিসি’কে বলছেন যে, এটা নিঃসন্দেহে গত ৫০ বছরের মাঝে চীনা ইন্টেলিজেন্সের সবচাইতে ‘গোঁয়াড়’ কর্মকান্ড ছিল। তার ধারণা, চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এটা সম্পর্কে জানতেন না। এটাও হতে পারে যে, চীনের সামরিক বাহিনীর উপর রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ নেই। জেনারেল ম্যাকাফরে মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে সামরিক দিক থেকে চীনের চেয়ে বহু এগিয়ে রয়েছে। এখানে তাইওয়ানের সামরিক সক্ষমতা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সামরিক শক্তি। এবং অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে নতুন করে ৯টা সামরিক ঘাঁটি পাবার অবস্থানে পৌঁছেছে; যার মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কৃত্রিম দ্বীপভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা ডিটারেন্ট তৈরি হবে। কাজেই চীনারা মারাত্মক ভুল না করলে যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা নেই। ট্রেসি ওয়াল্ডার বলছেন যে, গোয়েন্দা সংস্থাতে তিনি চীনা ইন্টেলিজেন্স ঠেকাতে কাজ করেছেন; কিন্তু কখনোই চীনাদের এহেন খোলামেলা কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করেননি। সাধারণতঃ চীনারা খুব সন্তর্পণে কাজ করে; সহজে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’র প্রাক্তন প্রধান লিয়ন প্যানেট্টা ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, বেলুনের ধ্বংসাবশেষ থেকে যদি বুঝতে পারা যায় যে, এটা কি প্রকারের তথ্য সংগ্রহ করছিল এবং আকাশে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল কিনা, তাহলে বোঝা যাবে যে এটা যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে গোয়েন্দাবৃত্তির জন্যেই এসেছিল কিনা। প্যানেট্টা মনে করছেন যে, যদি মার্কিন সামরিক নেতৃত্ব বুঝেই থাকে যে, বেলুনটা একটা গোয়েন্দা বেলুন, তাহলে এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনার উপর দিয়ে উড়তে দেয়াটা উচিৎ হয়নি; বরং এটাকে আরও আগেই ভূপাতিত করা উচিৎ ছিল। প্যানেট্টা বলছেন যে, চীন কিভাবে কাজটা করেছে, তা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হলেও চীনে কেন এই কাজটা করেছে, সেটা নিয়ে খুব কমই কথা হচ্ছে। চীনারা নিঃসন্দেহে জানতো যে, মার্কিনীরা এটা খুঁজে পাবে এবং এর প্রত্যুত্তর দেবে। তারা হয়তো বার্তা দিতে চাইছিলো যে, মার্কিনীরা যদি চীনের উপরে গোয়েন্দাবৃত্তি করে, তাহলে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের উপরে গোয়েন্দাবৃত্তি করতে সক্ষম। কারণ মার্কিনীরা নিয়মিতভাবেই চীনের সীমানার খুব কাছ দিয়ে গোয়েন্দা বিমান ওড়ায় এবং সেগুলি বেশ নিয়মিতভাবেই চীনারা বাধা দিতে আসে। কারণ চীনারা এই কর্মকান্ডকে মোটেই ভালো চোখে দেখে না।

‘সিআইএ’র আরেক প্রাক্তন প্রধান জন ব্রেনান ‘এমএসএনবিসি’কে বলছেন যে, এটা এখনও পরিষ্কার নয় যে, চীনারা প্রকৃতপক্ষে কি চিন্তা করছিল। একটা বেলুন ৬০ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে কিছু কাজ করতে পারে, যা কিনা একটা গোয়েন্দা স্যাটেলাইট আরও বেশি উচ্চতা থেকে করতে পারে না। তবে এই বেলুন কে উৎক্ষেপণ করেছিল এবং এর প্রযুক্তিগত সক্ষমতাই বা কতটুকু ছিল, তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে চীনারা জানতো যে, যুক্তরাষ্ট্র এটাকে খুঁজে পাবে এবং ব্যবস্থা নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের আলোচনার অনেকগুলি বিষয় রয়েছে, যেগুলি এখন ব্যাহত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু সেটাই চীনারা চেয়েছিল কিনা, সেব্যাপারে এখনও কেউই নিশ্চিত নয়।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল মাইকেল ক্লার্ক ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’কে বলছেন যে, এই বেলুনের মাধ্যমে চীনারা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ইন্টেলিজেন্স পাবে না, যা কিনা তারা ইতোমধ্যেই পাচ্ছে না। বরং দেখতে হবে যে, এর মাধ্যমে চীনাদের বার্তাটা কি ছিল। ক্লার্ক বলছেন যে, তারা ধারণা কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে যে ঘাঁটি তৈরির চুক্তি করেছে, এটা সেই চুক্তিরই প্রত্যুত্তর।

মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন বেলুনের ঘটনাকে একটা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কর্মকান্ড বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং ইতোমধ্যেই ৫ই ফেব্রুয়ারি তার বেইজিং সফর বাতিল করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, তারা চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে ইচ্ছুক নয়, তথাপি ব্লিনকেনের বেইজিং সফর বাতিল করা দেখিয়ে দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র বেলুনের ইস্যুটাকে ব্যবহার করতে চাইছে। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি তৈরির যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটাকে তারা চীনের অসন্তুষ্ট হবার কোন কারণই দেখছে না। আর মার্কিন গোয়েন্দা বিমানগুলি যখন নিয়মিতভাবেই চীনের কাছাকাছি ঘুরে চীনাদের অস্বস্তির মাঝে ফেলছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের বেলুনের অবাঞ্ছিত প্রবেশকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়; যা চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমান্বয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যের দিকেই নির্দেশ করে।

No comments:

Post a Comment