Saturday 28 January 2023

আফ্রিকাকে ঘিরে চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ঘনীভূত হচ্ছে

২৮শে জানুয়ারি ২০২৩

জানুয়ারি ২০২৩। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসার সাথে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফ্রিকার দেশগুলির সমর্থন না পেয়ে ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসন যে আফ্রিকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তা নিশ্চিত। তবে রাশিয়া এবং চীনের যৌথ প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করাটা যে খুব সহজ হবে না, সেব্যাপারেও সকলেই একমত। আফ্রিকার দেশগুলিকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে তার আদর্শিক অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা সরে আসতে বাধ্য হবেন।

মাত্র কিছুদিন হলো চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং আফ্রিকার পাঁচটা দেশ ভ্রমণ করেছেন। আর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাত্র একদিন পরই সেখানে হাজির হয়েছে মার্কিন বাণিজ্য সচিব জ্যানেট ইয়েলেন। এছাড়াও জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি লিন্ডা থমাস গ্রীনফিল্ড পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানা সফরে গিয়েছেন। ‘এনপিআর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই বলছেন যে, আফ্রিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন আফ্রিকার দিকে খুব একটা তাকায়নি। এখন জো বাইডেনের প্রশাসন আফ্রিকায় তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করায় ব্রতী হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন ডিসিতে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই বৈঠকে নীতি বিষয়ক কোন দিকনির্দেশনা ছিল না; বরং আফ্রিকার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সেতু তৈরিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে যে, ২০২৩ সালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজে এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসও আফ্রিকা সফর করতে পারেন। তবে বর্তমানে আফ্রিকার সাথে মার্কিন বাণিজ্য যতটুকু, চীনের সাথে আফ্রিকার বাণিজ্য তার চারগুণ! মার্কিনীরা চীনা ঋণের ফাঁদের কথা বললেও চীনের বিপরীতে তারা আফ্রিকাকে কি দিতে পারে সেটা পরিষ্কার করতে পারেনি। অপরদিকে আফ্রিকার দেশগুলি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা চাপের মুখে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক কর্তনের ক্ষেত্রেও আগ্রহী হয়নি।

‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অস্বীকার করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকাতে রুশ এবং চীনা প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে; যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকার দেশগুলি যখন রুশদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন ওয়াশিংটন আফ্রিকার দেশগুলির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। মার্কিনীরা বলছে যে, তারা বাণিজ্য, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা বিষয়েই আফ্রিকার দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে বেশি আগ্রহী। মার্কিন বাণিজ্য সচিব জ্যানেট ইয়েলেন আফ্রিকা সফরের সময় বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত নয়; শুধুমাত্র আফ্রিকার সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করতে আগ্রহী। কিন্তু আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের চেয়ারপার্সন মুসা ফাকি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি একসময় আফ্রিকাকে উপনিবেশ হিসেবে শাসন করেছে। আফ্রিকানরা এখন সকলের সাথেই সহযোগিতা করতে চায়; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আফ্রিকানদের স্বার্থকে সন্মান করবে। চীনের সাথে আফ্রিকার সহযোগিতা এই চিন্তাগুলির উপরেই স্থাপিত।

তবে শক্তিশালী দেশগুলি আফ্রিকাকে নিয়ে প্রতিযোগিতা বরং বাড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, আগামী ১৭ থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে ভারত মহাসাগরে রাশিয়া এবং চীনের সাথে এক যৌথ নৌমহড়ার আয়োজন করা হয়েছে। ‘মোসি-২’ নামের এই মহড়াটা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বার্ষিকীকে স্পর্শ করবে। ‘সিবিএস নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই এই মহড়ার ব্যাপারে তার উদ্বেগ জানিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পান্ডর সমালোচকদের বক্তব্যের প্রত্যুত্তরে বলেন যে, এটা শুধু কিছু বন্ধু দেশের সাথে মহড়া মাত্র। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দেশ ব্রিটেন, চীন, নাইজেরিয়া, এমনকি এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় বলেন যে, এই মহড়াটা পুরোপুরি স্বচ্ছতা বজায় রেখে করা হচ্ছে এবং মহড়া সম্পর্কে সকল তথ্যই আগে থেকেই দেয়া হয়েছে। রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’ বলছে যে, এই মহড়ায় একটা রুশ যুদ্ধজাহাজ প্রথমবারের মতো সর্বাধুনিক ‘হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র’ বহণ করবে।

‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর ডেপুটি ডিরেক্টর পলিন ব্যাক্স ‘সিবিএস’কে বলছেন যে, এই মহড়ার পরিকল্পনা বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই করা হয়েছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে এই মহড়া কিছুটা ভিন্নরকম। কূটনৈতিক জটিলতা এড়াতে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়তো অন্য কোন দিন দেখতে পারতো।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর গবেষক ক্যামেরন হাডসন ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, যদিও মার্কিনীরা বলছে যে, তারা শুধুমাত্র আফ্রিকার উন্নয়নের সহযোগী হতে চায়, প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা এর চাইতে আরও জটিল। উন্নয়ন সহযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আলাদা করা যাবে না। মার্কিনীরা একদিকে যেমন চাইছে যে, আফ্রিকার দেশগুলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন এবং রাশিয়ার প্রভাবকে এড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হোক, তেমনি তারা আফ্রিকায় রুশ এবং চীনা কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। হাডসন প্রশ্ন করছেন যে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন আফ্রিকা সফর করতে গেলে গণতন্ত্রকে তুলে ধরার যে আদর্শিক ব্রত তিনি দেখিয়েছিলেন সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখবেন কিনা। আফ্রিকার দেশগুলি যখন গণতন্ত্র থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি কি আফ্রিকার সরকারগুলির সরাসরি সমালোচনা করবেন, নাকি জাতিসংঘে আফ্রিকার দেশগুলির সমর্থন পেতে আপাততঃ সমালোচনাকে পিছনের সারিতে রাখবেন?

‘মরগ্যান স্ট্যানলি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনারা তাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর আওতায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে চীনারা বেশ শক্তভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলাবার নীতিতে অটল রয়েছে। চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং আফ্রিকা সফরের সময় বলেন যে, কোন দেশের অধিকার নেই আফ্রিকার দেশগুলিকে কোন বিশেষ পক্ষালম্বন করার জন্যে চাপ দেয়ার। আফ্রিকার হওয়া উচিৎ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র; শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নয়।

‘এনপিআর’ বলছে যে, আফ্রিকার সাধারণ জনগণ আফ্রিকাকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে ভালো চোখে দেখছে না। কিন্তু যখন আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশই বাইরের সহায়তার উপর নির্ভরশীল, তখন এই মহাদেশকে নিয়ে যে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে প্রতিযোগিতা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফ্রিকার দেশগুলির সমর্থন না পেয়ে ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসন যে আফ্রিকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তা নিশ্চিত। তবে রাশিয়া এবং চীনের যৌথ প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করাটা যে খুব সহজ হবে না, সেব্যাপারেও সকলেই একমত। আফ্রিকার দেশগুলিকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে তার আদর্শিক অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা সরে আসতে বাধ্য হবেন।

4 comments:

  1. চিনা dept trap policy কি রিয়াল নাকি অপপ্রচার?

    ReplyDelete
    Replies
    1. চীন যখন বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে, তার মাঝে কিছু প্রকল্পের, বিশেষ করে সমুদ্রবন্দরের মতো প্রকল্পগুলির, ঋণ ফেরত দেয়ার মতো কোন পরিকল্পনা ছিল না। প্রকল্প থেকে যদি যথেষ্ট পরিমাণে আয় না হয়, তাহলে সেই ঋণ একটা বোঝা হয়ে যেতে পারে। এই প্রকারের প্রকল্পগুলিই ছিল সমস্যা। শ্রীলংকা এবং কেনিয়াতে চীনা ঋণের উপরে নির্ভর করে গড়া সমুদ্রবন্দরগুলি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে এই প্রকল্পগুলিকে পরবর্তীতে ঋণদাতা চীনের হাতে ছেড়ে দেয়ার একটা প্রশ্ন চলে এসেছে।

      এটাই হলো ভূরাজনৈতিক সমস্যা। কারণ কৌশলগত স্থানে চীনারা যদি কোন বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুরা সেটাকে ভালো চোখে দেখবে না; কারণ এই বন্দরগুলিকে বিভিন্ন সময়ে চীনা যুদ্ধজাহাজগুলি রিফুয়েলিংএর কাজে ব্যবহার করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলি চীনকে এই সুবিধা দিতে একেবারেই নারাজ। তারা সমুদ্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চায়; চীন বা অন্য কোন শক্তির সাথে সমুদ্র ভাগাভাগি করতে নারাজ। একারণে মূলতঃ সমুদ্রবন্দরে চীনের বিনিয়োগ নিয়েই সবচাইতে বেশি কথা হয়েছে। চীনারা নিঃসন্দেহে এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে; যার কারণে চীনা ঋণের বিরুদ্ধে একপ্রকারের জনমত অনেকখানেই তৈরি হয়েছে।

      সমুদ্রবন্দর ছাড়াও অন্যান্য প্রকল্পে চীনারা বিনিয়োগ করেছে; যেখানে পশ্চিমারা খুশি নয়; কারণ সেখানে চীনাদের একটা প্রভাব তৈরি হয়েছে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে। এতকাল যাবত ঋণ দিয়ে প্রভাব তৈরি করার কাজটা শুধুমাত্র পশ্চিমারাই করতো। তারা চীনের এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাতে খুশি হয়নি। মোটকথা এখানে দুই পক্ষের প্রভাব বিস্তারের একটা প্রতিযোগিতা চলছে। এখানে সকলেই নিজের স্বার্থ দেখছে।

      Delete
  2. Non profit organisations গুলো ইম্পেরিয়ালিজম এ কি সাহায্য করে?
    কিভাবে করে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক পুরোনো একটা লেখার লিঙ্ক দিচ্ছি; সাবভার্সন নিয়ে। এটা থেকে একটা ধারণা করতে পারবেন যে, এনজিও এবং অন্যান্য সংস্থাগুলি কিভাবে শক্তিশালী দেশগুলি ব্যবহার করে থাকে।
      https://koushol.blogspot.com/2016/08/how-state-weakens-through-subversion.html

      Delete