Friday 20 January 2023

যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইল থেকে ইউক্রেনে আর্টিলারি শেল পাঠাচ্ছে কেন?

২১শে জানুয়ারি ২০২৩
 
আর্টিলারি শেলের সরবরাহের ঘাটতি পূরণে যুক্তরাষ্ট্র তার স্টক থেকে যোগান দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর অর্থ হলো, ওয়াশিংটন অন্য কোথাও ঝুঁকি নিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা যে শুধু আর্টিলারি শেল নিয়ে, তা কিন্তু নয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পে সরবরাহকারীর সংখ্যা অত্যধিকভাবে কমে যাওয়ায় এবং দক্ষ শ্রমিকের স্বল্পতা দেখা দেয়ায় মার্কিন সামরিক উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে।

গত ১৭ই জানুয়ারি ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে মার্কিন এবং ইস্রাইলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলে মজুত করা তাদের গোলাবারুদের একাংশকে ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। খুবই কম আলোচিত এই মজুত যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলের মাটিতে রেখেছিল মধ্যপ্রাচ্যে ভবিষ্যৎ কোন সম্ভাব্য যুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে। জরুরি প্রয়োজনে ইস্রাইলেরও এই মজুত থেকে গোলাবারুদ ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষই ব্যাপকভাবে আর্টিলারি গোলা ব্যবহার করছে। যার ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষই গোলাবারুদের স্বল্পতায় পড়েছে। এমতাবস্থায় কার গোলাবারুদের স্টক আগে শেষ হয়, সেটার উপরেই নির্ভর করছে যুদ্ধে কে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকবে।

গোলাবারুদের স্বল্পতার কারণে ইউক্রেন বাধ্য হয়েছে পশ্চিমা ডিজাইনের আর্টিলারির উপরে নির্ভরশীল হতে। এখন পশ্চিমা দেশগুলি ইউক্রেনকে আর্টিলারি গোলা দিতে গিয়ে নিজেদের স্টকই কমিয়ে ফেলেছে। একইসাথে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলি এখনও তত দ্রুতগতিতে আর্টিলারি গোলা উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে না। ইউক্রেন প্রতিমাসে ৯০ হাজার আর্টিলারি শেল ব্যবহার করছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের যৌথ উৎপাদন ক্ষমতার দ্বিগুণ! ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইস্রাইলে মজুত করা গোলাবারুদ থেকে ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে। ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত ১০ লক্ষ আর্টিলারি শেলের অর্ধেকের কিছু কম আসছে এই দুই দেশের মজুত থেকে। ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন মার্কিন অস্ত্র নির্মাণ সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরছে, তেমনি দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইস্রাইলের মতো দেশগুলি, যারা কিনা এতদিন ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে রাশিয়ার সাথে সরাসরি শত্রুতা করতে চাইছিলো না, তাদেরকেও এখন ইউক্রেন যুদ্ধের অংশ হতে বাধ্য করলো।

ইস্রাইলি গবেষণা সংস্থা ‘মিতভিম’এর প্রধান নিমরড গোরেন ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে বলছেন যে, ইস্রাইল থেকে আর্টিলারি শেল সরিয়ে ফেলার মার্কিন সিদ্ধান্তে ইস্রাইলের খুব বেশি কিছু বলার নেই। কারণ এই অস্ত্রগুলির মালিক যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ইউক্রেনকে শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা দেয়ার ইস্রাইলি সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন আসেনি। ইস্রাইলের মধ্যপন্থীরা ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানাচ্ছে; অপরদিকে ডানপন্থীরা সাবধানে কথা বলছে। ইস্রাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে কম কথা বলার নীতিতে রয়েছে। ‘ইস্রাইলি ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইস্রাইলের ‘ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ’এর জ্যেষ্ঠ গবেষক আরকাদি মিলমান বলেন যে, রাশিয়া এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নাও নিতে পারে। ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইস্রাইল ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। তবে এর কারণে রাশিয়ার সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক নষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘সিএনএ’এর ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, আর্টিলারি শেলের সরবরাহের ঘাটতি পূরণে যুক্তরাষ্ট্র তার স্টক থেকে যোগান দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর অর্থ হলো, ওয়াশিংটন অন্য কোথাও ঝুঁকি নিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা গোলাবারুদের মজুত পুনরায় পরিপূর্ণ করবে এবং জরুরি প্রয়োজনে অতি দ্রুত গোলাবারুদ সরবরাহ করবে। মার্কিন কংগ্রেসের রিসার্চ সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইস্রাইল ২০০৬ সালে হিযবুল্লাহ এবং ২০১৪ সালে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন মজুত থেকে আর্টিলারি শেল ব্যবহার করেছিল। ইস্রাইলিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছে যে, তারা ইউক্রেনকে সহায়তা দিলে রাশিয়া সিরিয়াতে রুশ সামরিক শক্তিকে ইস্রাইলের বিপক্ষে ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরানি টার্গেটে ইস্রাইলি হামলার বিরুদ্ধে রাশিয়া কিছু করা থেকে বিরত থাকছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ইউক্রেনে গোলাবারুদ সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোরিয়রা ইস্রাইলের মতো ততটা বাধা দেয়নি। তারা একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদের স্বল্পতা পুষিয়ে নিতে ১ লক্ষ আর্টিলারি শেল বিক্রি করার জন্যে চুক্তি করেছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা যে শুধু আর্টিলারি শেল নিয়ে, তা কিন্তু নয়। ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনকে ৭ হাজার ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্টকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শেষ করে ফেলেছে। একইসাথে কাঁধের উপর থেকে ছোঁড়া ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মজুতের প্রায় এক-চতুর্থাংশও ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হয়েছে। ‘স্টিংগার’এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘রেথিয়ন’ বলছে যে, কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে এই ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপাদন পুনরায় শুরু করতে। ২০২০ সালে পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পে সরবরাহকারীর সংখ্যা অত্যধিকভাবে কমে যাওয়ায় এবং দক্ষ শ্রমিকের স্বল্পতা দেখা দেয়ায় মার্কিন সামরিক উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রাংশ এখন হাতে গোণা কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে; যা কিনা পুরো ব্যবস্থাকেই হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের এই সমস্যা শুধু ইউক্রেনকে সরবরাহ নয়, ভবিষ্যতে তাইওয়ানকে জরুরি সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে কম্পিউটার চিপ সরবরাহের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে অনেক বেশি সমস্যায় পড়তে হবে।

গত ১১ই জানুয়ারি মার্কিন নৌবাহিনীর সচিব কার্লোস ডেল টরো সাংবাদিকদের বলেন যে, আগামী ছয় মাস বা এক বছরের মাঝে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্প যদি তাদের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে সক্ষম না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এর কিছুদিন আগেই মার্কিন নৌবাহিনীর এডমিরাল ড্যারিল কাউডল এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন যে, অতি শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করবে, নাকি নিজেকে শক্তিশালী করবে? তিনি আরও বলেন যে, তিন বছর ধরেই প্রতিরক্ষা শিল্পের সরবরাহকারীরা করোনা মহামারির দোহাই দিয়ে সরবরাহ পিছাচ্ছে; যা মেনে নেয়া কষ্টকর। সরবরাহের সমস্যাগুলি এমন সময়ে আসছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে একটা শত্রুকে মোকাবিলা করছে; আর অপরদিকে আরেকটা সম্ভাব্য শত্রু প্রস্তুত হচ্ছে, যেরকম শত্রু মার্কিনীরা আগে কখনও দেখেনি। এরকম পরিস্থিতিতে অস্ত্র সরবরাহ পিছিয়ে যাওয়া জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। এডমিরাল কাউডল মূলতঃ রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সহায়তা দিতে গিয়ে চীনকে মোকাবিলায় দুর্বলতা নিয়ে কথা বলেছেন। বিশ্বের সবচাইতে বড় সমরশক্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেন যথেষ্ট অস্ত্র নেই।

2 comments:

  1. বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়া সত্ত্বেও যেন লেজে গোবরে অবস্থা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেকটাই। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র।

      যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা শক্তি নয়; বরং শক্তি ব্যবহার করে দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে, সেখানে প্রকৃত সমস্যা। গায়ের জোরে দুনিয়া শাসন করা যায় না। মানুষ যতদিন একটা শক্তিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নেতা হিসেবে মেনে নেবে, ততদিন সে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। শুধুমাত্র পেশীশক্তির প্রভাব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কারণ এতে অনেকেই নিজেদের পেশী তৈরিতে মনোযোগী হবে। অনেকেই পেশী তৈরি করে ফেলতে পারলে সুপারপাওয়ারের আগের অবস্থান থাকবে না। কারণ সেতো শুধু পেশীশক্তিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে। যদি পেশী সেখানে প্রধান স্থান দখল করে ফেলে, তবে যেকেউ পেশী তৈরি করতে পারলেই তাকে মানুষ নেতৃত্ব দিতে চাইবে।

      Delete